এক জায়গায় পড়েছিলাম, হরর জঁনরা পরিচালকদের অধিকারে থাকে, আর কমেডি থাকে চিত্রনাট্যকারদের হাতে। কোথায় পড়েছিলাম সেই সাফাই দেওয়ার দরকার বোধ করতেছি না; কারণ কথাটার সত্যতা আমার সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতাতেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। বিশ্বের সেরা সব হরর সিনেমা দুর্দান্ত পরিচালকদের কাছ থেকেই পাওয়া গেছে—সেজন্যে তাদেরকে যে শুধু এই জঁনরাতে আধিপত্য তৈরি করে নিতে হয়েছিল তা না। স্ট্যানলি কুব্রিক ‘শাইনিং’ (১৯৮০) দিয়ে, উইলিয়াম ফ্রীডকিন ‘একজরসিস্ট’ (১৯৭৪) কিংবা মাসাকি কোবায়াশি ‘কোয়াইদান’ (১৯৬৪) দিয়ে এ ধারণার ভিত্তিপ্রস্তর দিয়ে গেছেন। সম্প্রতি হলিউডে এর সমর্থনে আরো একটা নমুনা দেখা গেল।

পরিচালক মাইক ফ্ল্যানাগান ২০১৩ সালের হরর সিনেমা ‘অক্যুলাস’ দিয়ে নিজের প্রচারণা চালিয়েছিলেন উপযুক্ত মহলেই। ফলে মাইকেল বে প্রযোজিত ‘উইজি : অরিজিন অফ ইভিল’ (২০১৬)- এ কাজ করার সুযোগ পেয়ে যান। আর এর মধ্য দিয়েই তার দক্ষতার বিস্তার বোঝা যায়। ভালো সিনেমা বানাতে একরকম অক্ষম মাইকেল বে’র প্রোডাকশন হাউজ থেকে এর আগে এমন কোনো সিনেমা বের হয় নাই যা সমালোচকদের কাছে প্রশংসা পেয়েছিল। ‘উইজি : অরিজিন অফ ইভিল’ দিয়ে সেই ধারা বন্ধ হয়। আর তার মূল প্রভাবক ছিলেন পরিচালক ফ্ল্যানাগানই।

তো মাইক ফ্ল্যানাগান নাকি কিশোর বয়স থেকে স্টিফেন কিংয়ের উপন্যাস ‘জেরাল্ড’স গেম’ সাথে নিয়ে বেড়াতেন। এর গল্প অবলম্বনে সিনেমা বানানো তার স্বপ্ন ছিল তখন থেকেই। উপন্যাসটা আমি পড়ি নাই, কিন্তু কেন এটা নিয়ে এর আগে সিনেমা বানানোর উদ্যোগ নেওয়া হয় নাই তা ছবিটা দেখে বুঝে নেওয়া যায়। কারণ সিনেমার—আর অবশ্যই বইয়েরও—অধিকাংশ কার্যকলাপ ঘটে মূল চরিত্রের মাথার ভেতর।

মূল চরিত্র জেসি ও তার কিছুটা বয়স্ক স্বামী জেরাল্ড শহর থেকে দূরে একটা কটেজে বেড়াতে এসেছে। তাদের এগারো বছরের দাম্পত্য জীবনে হালকা ঝাঁঝ আনার জন্যে আইনজীবী জেরাল্ড তার স্ত্রীর সাথে একটু নতুন তরিকায় সেক্স করতে চায়। এ কারণে শুরুতেই ব্যাগ গোছানোর সময় একজোড়া হাতকড়া ঢুকিয়ে নেয় সে।

কটেজে পৌঁছে যথারীতি তাদের সেক্সের আয়োজন শুরু—জেসি সাদা রঙের গাউন পরে রমণীয় সাজে। জেরাল্ড ভায়াগ্রা জাতীয় কিছু একটা খেয়ে নেয়; তারপর জেসিকে বিছানার তক্তার সাথে হাতকড়ায় আটকে দিয়ে নিজের ধর্ষকাম চরিতার্থ করতে চায় সে। শুরুতে ইচ্ছা থাকলেও ধীরে ধীরে জেরাল্ডের তীব্রতায় অস্বস্তি বোধ শুরু করে জেসি। বাকবিতণ্ডা শুরু হয়।

জেরাল্ডের আকস্মিক এই যৌনবিকারের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারে না জেসি। স্বামীর যৌন সক্ষমতার পাশাপাশি আন্তরিকতার অভাব নিয়েও প্রশ্ন তোলে।

কিছু সময় পর স্ত্রীর এসব আপত্তি আর তিরস্কারে ক্ষুব্ধ জেরাল্ড প্রতিক্রিয়া দেখাতে গিয়ে হঠাৎ করেই বুকে চাপ দিয়ে ঠাস করে পড়ে যায়। হার্ট অ্যাটাক।

জেরাল্ড মারা গেছে। জেসি এখনো আটকে আছে বিছানার সাথে। একান্তে ছুটি কাটানোর জন্য সব কর্মচারীকে ছুটি দেওয়া হয়েছিল। কটেজে তাই আর কেউ নাই।

এ উদ্ভট বন্দি অবস্থা থেকে উদ্ধার পাওয়ার চিন্তা আর স্বামীর মৃত্যুতে প্রচণ্ড ভাবে বিচলিত জেসি বাস্তবতার খেই হারিয়ে ফেলে। হ্যালুসিনেশনে দেখতে পায়—তার স্বামী আর তার নিজেরই অন্য একটা সত্তা তাকে সঙ্গ দিচ্ছে।

এ কারণেই উপন্যাসটার কাহিনি চলে মূল চরিত্রের ‘মাথার ভেতর’। মানসিক অস্থিরতা থেকে ডিফেন্স মেকানিজম হিসাবে জেসির অবচেতন মন তাকে এসব চরিত্র দেখায়, যাতে সে তার সঙ্কটের একটা সুরাহা করতে পারে।

সিনেমার গঠনে এই চরিত্রগুলি অনেকটা গার্ডিয়ান অ্যান্জেলে রূপ নেয়। জেসি তার স্বামীকে এমনভাবে কল্পনা করে, যে উদ্ধার পাওয়ার জন্য জেসির প্রতিটা সিদ্ধান্তের সমালোচনা আর টিটকারি করতে থাকে বার বার। ক্রিশ্চিয়ান মিথোলজির হিসাবে কল্পনার এই স্বামী হল ডেভিল বা বাম কাঁধের অ্যান্জেল। আর ডান কাঁধের অ্যান্জেল হিসাবে থাকে জেসিরই পরিশীলিত এক রূপ, যে তাকে বাস্তবসম্মত বুদ্ধি দেয় বেঁচে থাকার জন্য। তার মানসিক দ্বন্দ্বের প্রতিফলন এ দুই চরিত্রের সাথে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে জেসি।

এখানে একটু স্টিফেন কিংয়ের প্রসঙ্গে ফিরে যাই। আমেরিকান এই লেখক সাধারণত সুপারন্যাচারাল হরর আর থ্রিলার জঁনরায় কাজ করেন। ১৯৭০ এর দশক থেকে তার লেখা নিয়ে সিনেমা বানানো হচ্ছে। কিংয়ের লেখা সিনেমায় অনুদিত হওয়ার জন্য কার্যকরী, কারণ অতিপ্রাকৃত ব্যাপারগুলি দৃশ্যতে ফোটে ভালো (যদিও আয়রনি হল, তার লেখা অবলম্বনে সবচাইতে বিখ্যাত সিনেমাগুলির একটি ‘শশাঙ্ক রিডেম্পশন’—যা নিখাদ ড্রামা ছবি, অতিপ্রাকৃতের কিছু নাই)। কিন্তু তার চিত্রনাট্যের উপযুক্ত দৃশ্যায়নের জন্য পরিচালকের দক্ষতা অপরিহার্য। এ কারণে তার গল্প নিয়ে ভালোর পাশাপাশি খারাপ, এমনকি হাস্যকর সব সিনেমাও বের হয়েছে।

২০১৭ সালে কিংয়ের বই নিয়ে সিনেমা বের হলো মোট ৪ টা। তার মধ্যে ‘১৯২২’ এখনো দেখা হয় নাই। তবে বাকিগুলির মধ্য থেকে (ডার্ক টাওয়ার,ইট) “জেরাল্ড’স গেম’ সেরা দুইয়ের মাঝেই থাকবে।

গল্পের দিক থেকে “জেরাল্ড’স গেম” সাসপেন্স থ্রিলার। কিংয়ের গল্পে ১৯৯০ সালের ছবি ‘মিজারি’ এই গোত্রের ছিল। আর এর কাঠামোর সাথে স্টিফেন কিংয়ের আরেক সিনেমা ‘১৪০৮’ (২০০৭) এর মিল আছে। ওইটাতেও মূল চরিত্র একটা হোটেল রুমে আটকা পড়ে থাকে। পরিচালক মাইক ফ্ল্যানাগান আগেও তার ছবিতে এরকম বদ্ধ জায়গায় টান টান উত্তেজনার গল্প বলেছেন (অক্যুলাস, হাশ)। সীমিত পরিসরকে গল্পের সাথে দরকারমত সম্মিলিত করে নিতে পারেন তিনি। অযাচিত ও অপ্রাসঙ্গিকভাবে দর্শকদেরকে ভয় দেখানোর জন্য উচ্চমাত্রার তীক্ষ্ম শব্দে দৃশ্যের কোনো আচমকা পরিবর্তন তার সিনেমায় থাকে না। হরর সিনেমার এই বিশেষত্ব (যাকে ‘জাম্প স্কেয়ার’ বলে) বর্তমানে ক্লিশে। আর ক্লিশে-বিমুখ নির্মাতা হলিউডের এখন খুব দরকার; আমূল না হোক, অন্তত ইঙ্গিতে পরিবর্তন আনতে হলেও।

তবে জেসি’র চরিত্রে কারলা গুগিনো হলিউডের একেবারে প্রথাগত অভিনেত্রী, যা ছবির জন্য ঠিক আছে বলা যায়। পুরুষ সঙ্গীদের হাতে অপদস্থ জেদী নারী চরিত্রে পারদর্শী হওয়া হলিউডের (ভালো) অভিনেত্রীদের একরকম পূর্বশর্ত। আর জেসির মানসিক অবস্থা ও অবধারণের তারতম্য গুগিনো স্পষ্টভাবেই ধরেছেন। কিন্তু গোলমাল বাঁধে যখন জেসির প্রতিক্রিয়াশীলতা গল্পের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে। হাতকড়া হয়ে যায় শেকলের প্রতীক, আর জেসি প্রতিনিধিত্ব করে বিশেষ এক গোষ্ঠীর। তাছাড়া কাহিনির এক অংশে সূর্যগ্রহণের মতো বিরল একটা ঘটনাকে জবরদস্তি ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করা হয়। স্টিফেন কিংয়ের নাম থাকার পরেও এত এত অ্যাবসার্ডিটি গল্পটাকে স্থূল করে ফেলে। সবকিছু ভারি আর আলগা লাগে তাই।