নাসিরকোট স্কুলে শিক্ষকতা করার সময়ে পরিচয় হয় মোরশেদ সাহেবের সাথে। মোরশেদ সাহেব ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ থেকে ইন্টারমেডিয়েট পাশ করে তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইকনমিকসে অনার্স পড়ছিলেন।

তাঁর কাছ থেকে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে কী কী বিষয়ে পড়াশোনা হয় সে সম্পর্কে একটা মোটামুটি ধারণা পাই। ইকনমিকস সম্পর্কেও আমি প্রাথমিক ধারণা পাই মোরশেদ সাহেবের কাছেই। নাসিরকোট স্কুল মাঠে তিনি প্রায়ই আসতেন খেলার জন্য কিংবা বন্ধু বান্ধবদের সাথে আড্ডা দেবার জন্যে।

 

মোরশেদ সাহেবের ছোট ভাই মানিক স্কুলে আমার ছাত্র ছিল। সেই সুবাদে মোরশেদ সাহেব আমার ঘনিষ্ঠজনদের একজন হয়ে ওঠেন। একদিন অনেকটা বেকুবের মতই জিজ্ঞেস করে বসেছিলাম, “এই যে আপনি অর্থনীতি সম্পর্কে পড়াশোনা করছেন, ইউনিভার্সিটি থেকে বের হয়ে নিশ্চয়ই আপনি অনেক বেশি টাকা পয়সা রোজগার করবেন?”

তিনি বললেন, এমনটা কেন ভাবছেন?

আমি বললাম, এই যে অর্থ নিয়ে এতসব পড়াশোনা, নিশ্চয়ই আপনার জীবনে অর্থ উপার্জনের ক্ষেত্রেও এটা কাজে লাগবে।

তিনি হেসে উত্তর দিয়েছিলেন ব্যাপারটা ঠিক তেমন না।

তিনি বলেছিলেন, যদিও বাংলা অভিধানে অর্থের অর্থ হচ্ছে টাকা তবু অর্থনীতির অর্থ শুধু টাকার নীতি কিংবা মুদ্রানীতি নয়। অর্থনীতি বিষয়টি ইংরেজি ‘ইকনমিকস’ এর বাংলা তরজমা মাত্র। কিন্তু ইংরেজীতে ‘ইকনমিকস’ এর অর্থ মানিটারি পলিসি বা মুদ্রানীতির তুলনায় অনেক ব্যাপক।

ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবার পর আমার থাকার জায়গা হয় এস এম হলে। হলের রেস্তোরাঁয় খাবারের মান দিন দিন কমে যাচ্ছিল। সহপাঠীরা এর কারণ হিসাবে বলাবলি করছিল invisible hand বা অদৃশ্য হাতের কথা। কী এই অদৃশ্য হাত? আমার বন্ধুদের অনেকে মনে করত এই অদৃশ্য হাত হচ্ছে রেস্তোরাঁর ম্যানেজার এবং ছাত্রদের খাবার দাবার দেখাশোনার দায়িত্বে নিয়োজিত হাউজ টিউটর। কিন্তু পরবর্তী কালে জানতে পেরেছিলাম এই অদৃশ্য হাত হচ্ছে বাজার ব্যবস্থা।

সকাল বেলা চায়ের টেবিলে চা, রুটি, বিস্কু্‌ট, দুধ কিংবা খবরের কাগজ এক একটা একেক জায়গায় তৈরি। কোন শক্তি বলে এই সবকিছু আমার টেবিলের ওপর এসে জড় হল? রেস্তোরাঁর বয়-বেয়ারাদেরকে কে বাধ্য করল আমার জন্যে এত সব সামগ্রী যোগাড় করে আনতে? আমার টেবিলের ওপর যে খবরের কাগজ তার উপাদান এসেছে হয়ত বা পৃথিবীর অপর প্রান্ত কানাডা থেকে। সেই মণ্ড কাগজের কলে এসে কাগজ হল। সেই কাগজ প্রেসে এসে খবরের কাগজ হল।

অর্থ হিসাবে স্বর্ণমুদ্রা, গরু, কড়ি ও ডলার

হাজার হাজার প্রেসকর্মী সাংবাদিক ফটোগ্রাফার স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বার্তা প্রতিষ্ঠান মিলে যে খবরের কাগজ তৈরি করল তা আমার স্থানীয় হকার সকাল বেলা আমার টেবিলে উপস্থিত করল। কোন শক্তির মাধ্যমে এত সব কাজ কোন রকম জোর জবরদস্তি ছাড়াই সম্পন্ন হয়ে গেল? আধুনিক অর্থনীতির জনক অ্যাডাম স্মিথ এই শক্তির নাম দিয়েছেন অদৃশ্য হাত, যার অপর নাম বাজার ব্যবস্থা।

বাজার ব্যবস্থার মূল চালিকা শক্তি হচ্ছে অর্থ। অর্থ আছে বলেই বাজারে বিনিময় হচ্ছে। এক স্থানের দ্রব্যসামগ্রী অন্য স্থানে যাচ্ছে। মানুষ কাজকর্ম করতে পারছে। অর্থ আছে বলেই দেশে উৎপন্ন নানাজাত দ্রব্যসামগ্রীর একটা সামগ্রিক মান পেতে আমাদের অসুবিধা হয় না। অর্থ না থাকলে এই যে হাজার রকম দ্রব্যসামগ্রী দেশে তৈরি হচ্ছে, কোন জিনিস কম তৈরি হচ্ছে কোনটা বেশি, দেশ উন্নতির দিকে যাচ্ছে নাকি অবনতির দিকে তা নির্ণয় করা ছিল সুকঠিন।

এডেলেইড বিশ্ববিদ্যালয়ে থিসিস করার সময়ে আমার সুপারভাইজার ক্লিফ ওয়ালশের সৌজন্যে বহু খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ এডেলেইড বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিনার কিংবা স্বল্পকালীন এসাইনমেন্টে আসতেন এবং এই সুযোগে আমিও তাঁদের সাথে পরিচিত হতাম এবং আমার থিসিসের খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে আলাপ করার সুযোগ পেতাম। যেসব খ্যাতনামা ইকনমিস্টদের সাথে এইভাবে পরিচিত হবার সুযোগ পেয়েছিলাম তাদের মধ্যে আমেরিকান ইকনমিক এসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি প্রফেসর কিনেথ বৌল্ডিং ছিলেন অন্যতম।

খাবার টেবিলে বসে তিনি আলোচনা করেছিলেন কী ভাবে অর্থনীতিতে বৈষম্য সৃষ্টি হয় এবং কী ভাবে বাজার ব্যবস্থা সর্বোৎকৃষ্ট উৎপাদন, ভোগ ও বণ্টন ব্যবস্থার জন্ম দিতে ব্যর্থ হয়। তিনি বলেছিলেন কোন দেশে বিদ্যমান অর্থের পরিমাণ আর সেই দেশে অবস্থিত সম্পদের পরিমাণ এক কথা নয়। কোন দেশে উৎপন্ন দ্রব্যসামগ্রী ও সেবার পরিমাণ বৃদ্ধি না করে কেবল মাত্র টাকার পরিমাণ বৃদ্ধি করলে জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি পাবে। ফলে মানুষের হাতে আগের তুলনায় বেশি পরিমাণ টাকা থাকা সত্ত্বেও আগের তুলনায় বেশি সমৃদ্ধ বলা যাবে না। এ তো গেলো দেশের সার্বিক ও গড়পড়তা আবস্থার কথা।

আয়ারল্যান্ডের আদি বার্টার সিস্টেম, দুধ দেওয়া ১ গাভির বিনিময় হিসাবে ৮ ভেড়া

বোল্ডিং বিশেষভাবে উল্লেখ করছিলেন মূল্যবৃদ্ধির সাথে সাথে কিছু লোক আগের তুলনায় বেশি ধনী আর কিছু লোক আগের তুলনায় বেশি গরীব হতে থাকে। এর ফলে দেশীয় উৎপন্ন দ্রব্যের সার্বিক চাহিদার ঘাটতি দেখা দিতে পারে। পরিণামে একদিকে দেশের ভিতরে বিদেশী পণ্যের চাহিদা বাড়তে থাকবে এবং অন্যদিকে বেকার সমস্যা বৃদ্ধি পাবে। এই কারণে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সাথে সাথে সুষম বণ্টন ব্যবস্থার নিশ্চয়তা না থাকলে উন্নয়ন টেকসই হতে পারে না।

অর্থনীতির এসব গল্প বরং আরেকদিনের জন্যে রেখে দেওয়া যাক। অর্থনীতিতে টাকার প্রচলন কীভাবে হলো আজ বরং সেই গল্পটাই বলি।

মোরশেদ সাহেব বলছিলেন, ধরুন, আপনি একটি বই কিনতে চান আর আপনার আছে ধান। আপনি ধান নিয়ে বইয়ের দোকানে গেলেন কিন্তু বই বিক্রেতার ধানের দরকার নেই। তার দরকার একটি জামা। তখন আপনাকে এমন এক জন লোক খুঁজে বের করতে হবে যার কাছে বিক্রয়ের জন্যে জামা আছে এবং তার ধানের প্রয়োজন। এই সিস্টেমের নাম বার্টার সিস্টেম।

বলাই বাহুল্য, এই সিস্টেমের ঝকমারি এখানেই শেষ নয়। বই ও জামার মধ্যে বিনিময় হার অর্থাৎ একটি বইয়ের পরিবর্তে কয়টি জামা এবং আপনার প্রয়োজনের অতিরিক্ত ধানের বিনিময়ে আপনি কী কী জিনিস পেতে চান এবং ধানের সাথে ওইসব জিনিসের বিনিময় হার নিরূপণ করা ছিল অতীব দুরূহ কাজ। এর ফলশ্রুতিতে বার্টার সিস্টেমের আওতায় জিনিসপত্রের কেনাবেচা তথা মানুষের সুখ স্বাচ্ছন্দ ছিল খুবই সীমিত ।

যুগে যুগে মানুষ খুঁজে ফিরছিল এমন একটি বস্তুর যা সব মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে এবং যা যখন খুশি তখনই অন্য জিনিসের বিনিময়ে ব্যবহার করা যাবে। মানুষ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকম জিনিস টাকা হিসাবে ব্যবহার করেছে। এক সময়ে বিনিময়ের মাধ্যম ছিল গরু, অর্থাৎ গরুই টাকা হিসাবে ব্যবহৃত হতো। সমাজের বেশির ভাগ লোকই চাষাবাদের সাথে জড়িত ছিল। চাষাবাদের জন্যে প্রয়োজন ছিল গরুর। কাজেই গরুর চাহিদা ছিল প্রায় সার্বজনীন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই মানুষ বুঝতে পারল গরুর মূল্যমান খুব দ্রুত বদলিয়ে যায়। গরুকে ঘাস পানি খাওয়াতে হয়, যত্ন করতে হয় আবার অসুখে-বিসুখে মারা গেলে মালিককে সর্বহারা হতে হয়।

টাকা
আমেরিকার রাজনৈতিক পত্রিকা হারপার্স উইকলিতে ১৮৭৪ সালের একটি ইলাস্ট্রেশনে দেখা যাচ্ছে বার্ষিক পত্রিকা সাবস্ক্রিপশনের বিনিময় হিসাবে বার্টার সিস্টেমে মুরগি প্রস্তাব করেছেন গ্রাহক।

কাজেই মানুষ এমন কিছু খুঁজতে লাগল যা বিনিময়ের মাধ্যম হিসাবেও গ্রহণযোগ্য আবার তার মূল্যমান সংরক্ষণও করা যাবে ভবিষ্যতের জন্যে। এর প্রতীক হিসাবেই ঐতিহাসিকভাবে স্বর্ণ বা রৌপ্যমুদ্রার আকৃতি বৃত্তাকার ও চ্যাপ্টা। বৃত্তাকার সারকুলেশান অথবা হাত বদল হওয়ার প্রতীক—একের কাছ থেকে অপরের কাছে ঘুরতে থাকবে। আর চ্যাপ্টা হচ্ছে মূল্যমান সংরক্ষণের প্রতীক।

মোরশেদ সাহেব যখন এসব জটিল ব্যাপার অতি সহজ ভাষায় আমাদের শোনাতেন তখন কখনও তা স্বপ্ন কিংবা গল্পের মতো মনে হয় নি। বরং আমার চোখের সামনে ভেসে উঠত ছোটবেলায় কী ভাবে আমার মা-চাচিদের পাতিলওয়ালা কিংবা চুড়িবিক্রেতা বেঁদে মেয়েরা বার্টার সিস্টেমের মাধ্যমে ঠকিয়ে যেত। একটি এ্যালমুনিয়ামের পাতিল কিংবা একটি চীনামাটির বাটির জন্যে একটি নির্দিষ্ট আকারের বাটিতে করে তিন বাটি ধান কিংবা এক বাটি চাল দিতে হত। টাকার অঙ্কে সে পাতিলের দাম কত কিংবা তিন বাটি ধানের দাম কত আমার মা-চাচিদের মাথায় সে অঙ্ক ছিল অবান্তর। শিল্পায়নের ফলে যখন এ্যালমুনিয়ামের তৈরি পাতিলের দাম কমে আসছিল এবং ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে ধানচালের দাম বেড়ে যাচ্ছিল তখনও বার্টার বিনিময় হারে বড় রকমের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় নি।

টাকার আবিষ্কারের ফলে বিনিময় ও লেনদেনের ক্ষেত্রে এই বিরাট অসুবিধাটি দূর হয়েছিল। এখন বইবিক্রেতা আমার কাছ থেকে তার বইয়ের দাম নেবে টাকার অঙ্কে আবার আমিও আমার ধানের দাম পাব টাকার মাধ্যমে।

 

ব্যাংক ও কাগজের টাকা

মোরশেদ সাহেব যখন টাকার জন্মকাহিনী শোনাচ্ছিলেন সেই সময়ে সিক্স-সেভেনের একটি বইয়ে পড়েছিলাম আধুনিক ব্যঙ্কিং সিস্টেমের শুরুর কথা। এই কাহিনীটি কে লিখেছিলেন তা আর এখন মনে নাই। পরবর্তীকালে Sir Crowther এর লেখা An Outline Of Money নামক বইয়ে একই রকম কাহিনী পড়েছিলাম। প্রধানতঃ নিরাপত্তার কারণে মানুষ তাদের স্বর্ণ ও স্বর্ণমুদ্রা স্বর্ণকারদের কাছে গচ্ছিত রাখতেন। এজন্যে স্বর্ণকাররা মজুদ স্বর্ণমুদ্রা নিরাপদে রাখার জন্যে নির্দিষ্ট হারে ফি আদায় করতে পারতেন। স্বর্ণমুদ্রা মজুদ রাখার সময় স্বর্ণকাররা জমাদানকারীকে একটি রিসিট দিত। জমাদানকারী এই রিসিট দেখিয়ে যখন খুশি স্বর্ণকারের কাছ থেকে টাকা উঠিয়ে নিতে পারত।

জমাদানকারীরা দেখল যে যখনই তারা রিসিট দেখিয়ে টাকা ওঠাতে যান, স্বর্ণকাররা বেশ বিশ্বস্ততার সাথে টাকা দিয়ে দেয় এবং টাকা পেতে কোনই অসুবিধা হয় না। এর ফলে মানুষ ওই রিসিটকেই টাকার পরিপূর্ণ বিকল্প ভাবতে শুরু করল। কালক্রমে বেচাকেনার জন্যে প্রতিবার স্বর্ণকারের কাছে গিয়ে টাকা ওঠানোর ঝামেলায় না গিয়ে ব্যবসায়ীরা নিজেদের মধ্যে টাকা জমার রিসিট বিনিময় করতে লাগল। যেহেতু এই রিসিটগুলি বিনিময়ের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছিল, কাজেই রিসিটগুলিই হচ্ছে কাগজের টাকার পূর্বসূরী। আর স্বর্ণকাররা হচ্ছে আধুনিক বাণিজ্যিক ব্যাংকের পূর্বসূরী।

মোরশেদ সাহেব বলেছিলেন, প্রথম দিকে কাগজের মুদ্রার জন্যে সম পরিমাণ স্বর্ণ কিংবা রৌপ্য মুদ্রা ব্যাংকে জমা রাখতে হত। এই যুগে টাকার পরিমাণ নির্ভর করত দেশে বিদ্যমান সোনারুপার পরিমাণের ওপর। সোনারুপার যোগার না থাকলে সরকারের পক্ষে টাকা বানানোও সম্ভব ছিল না।

কালক্রমে রিসিট প্রদানকারী স্বর্ণকাররা বুঝতে পারল যে স্বর্ণমুদ্রা জমাদানকারী লোকজন একইসঙ্গে তাদের সমুদয় টাকা ওঠায়ে নিতে আসে না। গচ্ছিত অঙ্কের একটা সামান্য অংশ মাত্র প্রতিদিন কিংবা প্রতি সপ্তাহে ওঠানো হয়। কাজেই স্বর্ণকারদের কাছে কেউ টাকা ধার নিতে আসলে তাদের নিজস্ব টাকা না থাকলেও যদি এই মর্মে একটা রিসিট লিখে দেয়া যায় ‘বাহককে [ঋণ গ্রহিতা] চাহিবা মাত্র… পরিমাণ স্বর্ণ/রৌপ্য মুদ্রা প্রদান করতে বাধ্য থাকিব।’ তাহলে এই রিসিট অন্যান্য রিসিটের মতই বিনিময়ের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহৃত হতে থাকবে। যেই চিন্তা সেই কাজ। স্বর্ণকাররা তাদের কাছে গচ্ছিত অর্থের চেয়ে বেশি পরিমাণ সার্টিফিকেট দিতে লাগল। বেসরকারী পর্যায়ে এটাই ছিল ফ্রেকশানাল রিজার্ভ বা আংশিক স্বর্ণমানের প্রবর্তন।

বর্তমানকালেও দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রচলিত একশ টাকা, পাঁচশ টকা ও এক হাজার টাকার নোটের ওপর ব্যাংকের গভর্নর এই মর্মে একটি অঙ্গীকারপত্র লিখে দেন যে “বাংলাদেশ ব্যাংক চাহিবা মাত্র ইহার বাহককে এক হাজার টাকা (এক শত কিংবা পাঁচ শত টাকা) দিতে বাধ্য থাকিবে।”

মোরশেদ সাহেবকে জিজ্ঞেস করেছিলাম কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে আমি কাগজের টাকার বিনিময়ে স্বর্ণমুদ্রা পেতে পারি কিনা।

ব্রিটেনে পাওয়া প্রথম শতকের স্বর্ণমুদ্রা

উত্তরে তিনি বলেছিলেন, আধুনিক কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগের মত এখন আর “চাহিবা মাত্র ইহার বাহককে একশত স্বর্ণমুদ্রা কিংবা একশত টাকা পরিমাণ স্বর্ণ দিতে বাধ্য থাকিব” লেখে না। কারণ বর্তমানে পৃথিবীর কোথাও পরিপূর্ণ স্বর্ণমান ( gold standard) চালু নাই। স্বর্ণের দামও আগের মত একই স্থানে দাঁড়িয়ে নাই।

এক আউন্স স্বর্ণের সরকারী দাম ১৯৭২ সালের আগ পর্যন্ত ছিল মাত্র ৩৫ ইউ এস ডলার। ওই বছর আমেরিকান সরকার গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড রহিত করার কারণে স্বর্ণের বাজার লাগামহীন ভাবে ওঠানামা করতে শুরু করে। এক আউন্স স্বর্ণের বর্তমান বাজার দর প্রায় ১২০০ ডলার। এইসব কারণে এবং বিশেষ করে স্বর্ণের অপর্যাপ্ততার জন্যে বাংলাদেশ সহ পৃথিবীর বহু দেশ এখন স্বর্ণের পরিবর্তে কিংবা স্বর্ণের সাথে ডলার, পাউন্ড, মার্ক, ফ্রাঙ্ক এইসব কারেন্সি বাংলাদেশের টাকার বিপরীতে রিজার্ভ হিসাবে সংরক্ষণ করে।

এছাড়া সরকার ইচ্ছা করলে প্রমিসরি নোটের বিপরীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ধার করতে পারে। অর্থাৎ দেশে টাকার পরিমাণ এখন আর কেবল মাত্র স্বর্ণ কিংবা ফরেন কারেন্সির পরিমাণের ওপর নির্ভর করে না। সরকার ইচ্ছা করলেই টাকার পরিমাণ বাড়াতে বা কমাতে পারে।

টাকার পরিমাণ বাড়ানো-কমানোর জন্যে সরকারের হাতে আরেকটি উপায় হচ্ছে ট্যাক্সের পরিমাণ বাড়ানো-কমানো। ট্যাক্সের পরিমাণ কমালে কিংবা সরকারি অনুদান, ভাতা, সাবসিডি অথবা বেতন বাড়লে অর্থনীতিতে টাকার পরিমাণ বাড়বে। এই বাড়ানো-কমানোর সিদ্ধান্তগুলি সংক্ষেপে রাজস্বনীতি হিসাবে পরিচিত।

অর্থনীতির নিয়মানুসারে কোন দেশে দ্রব্যসামগ্রী এবং টাকার পরিমাণ সমান হারে হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটলে জিনিসপত্রের গড় দামের সূচক অপরিবর্তিত থাকবে। কিন্তু জিনিসপত্রের তুলনায় টাকার পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে মূল্যস্ফীতি ঘটবে।

বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রানীতির মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু সরকার যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ধার করা না কমায় তাহলে মুদ্রানীতি একক ভাবে মূল্যস্ফীতি কমাতে সমর্থ হবে না। অর্থাৎ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণের জন্যে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাক একই লক্ষ্যে একযোগে কাজ করতে হবে। যদি সরকার রাজনৈতিক কারণে রাজস্বনীতি শিথিল করে তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রানীতির মাধ্যমে তা ব্যালেন্স করতে পারে। এজন্য অবশ্যই প্রয়োজন সরকারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

#

কভার. ২০০০ বছর আগে তৈরি গ্রিক মুদ্রার এক পিঠে দেবি অ্যাথেনা, অন্য পিঠে অ্যাথেনার প্রতীক পেঁচা।