ছাত্র হিসেবে আমি খুবই নিম্নমানের। পরীক্ষায় বরাবরই কোনোরকমে পাস করে আসছি। ফার্স্ট সেকেন্ড হওয়ার জন্য যে আগ্রহ থাকা লাগে সেটা আমার কখনোই ছিল না। তবে হ্যা ফার্স্ট গার্লদের দেখে লাস্টদের যেরকম হিংসা হিংসা লাগার কথা আমারও সেরকম একটু একটু হিংসা লাগে।

ক্লাস সিক্স পর্যন্ত আমি চট্টগ্রামের বাওয়া স্কুলে পড়াশোনা করি। ভাল স্কুল হিসেবে এই স্কুলটা খুবই নাম করা। সব পাবলিক পরীক্ষায় এই স্কুল ফার্স্ট না হয় সেকেন্ড হয়। মেয়েরা সব পড়াশোনার ব্যাপারে মারাত্মক সিরিয়াস, তাই প্রতিটা ক্লাসে কম্পিটিশান ও অনেক।

আমি অবশ্য কখনোই এসবের মাঝে ছিলাম না। প্রতিটা পরীক্ষায় টেনেটুনে যাতে ৫০ (পাস নাম্বার) তোলা যায় সেই জন্যই টুকটাক পড়াশোনা করতাম। ফাঁকিবাজ হিসেবে আমি স্কুলে মোটামুটি ফেমাস ছিলাম।

২০১১ সালের জেএসসি পরীক্ষা আমি ‘চকরিয়া প্রত্যাশার আলো শিক্ষালয়’ থেকে দেই। চকরিয়া প্রত্যাশার আলো শিক্ষালয় হচ্ছে আমার দিদির শ্বশুরের স্কুল। উনি যখন স্কুলটা চালু করেন তখন স্কুলে কোনো স্টুডেন্ট ছিল না। পরে পরে দেখা গেল অন্যান্য স্কুল থেকে চার পাঁচবার ফেল করার কারণে যাদেরকে বের করে দেয়া হত তারাই এই স্কুলে এসে ভর্তি হত। চার পাঁচবারের ফেল্টুসরা অবশ্য এই স্কুলে এসে মেসোর টাইট খেয়ে ঠিকই ভাল রেজাল্ট করত।

আমি চকরিয়া যাওয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই অন্য স্কুলে না গিয়ে মেসোর স্কুলেই যাই। আমার আগমনে স্কুলের ছেলেমেয়েরা খুবই অবাক আর স্কুলের স্যাররা খুবই বিরক্ত। প্রিন্সিপালের আত্মীয় তাই স্যাররা আমাদের ক্লাসগুলি খুব কেয়ারফুলি নিতেন, কারণ ভুলভাল হলে আমি যদি মেসোকে বলে দেই! স্কুলের মাসিও আমাদের ক্লাসরুম যত্ন করে ঝাড়ু দিতেন।

যেহেতু আমি বরাবরই পড়াশোনা করতাম ৫০ মার্কের এবং পাইতামও মোটামুটি ৫০-এর উপরই, তাই আমিই এই ক্লাসের ফার্স্ট ছিলাম (যেহেতু এখানে পাস ৩৩-এ)। কিন্তু অন্যদের ফার্স্ট গার্লকে দেখে যেরকম হিংসা হিংসা চোখে তাকানোর কথা, আমার দিকে সেভাবে কেউ তাকানো তো দূরে থাক, কেউ পাত্তাও দিত না—কে ফার্স্ট না কে লাস্ট! পড়াশোনা ওদের কাছে একরকম অবসরের কাজ। কম্পিটিশন জিনিসটা এখানে একেবারেই নাই।

মেসো আমাদের অংক ক্লাস নিতেন। ক্লাস শুরু হত সকাল সাড়ে ছয়টায়। টানা দুই ঘণ্টা অংক ক্লাসের পর ইংরেজি ক্লাস আর এরপর ৩০ মিনিটের ব্রেক। ব্রেকে সবাই যে যার বাসায় গিয়ে খাওয়া দাওয়া করে আসত। এত সকালে ঘুম থেকে ওঠাটা আমার জন্য পুরাই অসম্ভব। তার উপর প্রিন্সিপালের আত্মীয় বলে স্কুলে খুব ভাল মানুষ হয়ে থাকতে হয়, ক্লাস ফাঁকি দেয়া যায় না। আর ক্লাসের কেউ আমার সাথে কথাবার্তাও খুব একটা বলত না। সব মিলায়ে স্কুলে যেতে আমার খুবই বিরক্ত লাগত। তবুও আমি দশ বিশ মিনিট দেরি করে হলেও ক্লাসে যেতাম।

একদিন ক্লাসে গিয়ে দেখি নতুন ছেলে আসছে নাম মুনিরুল ইসলাম মুনির। চকরিয়ার সবচেয়ে ভাল স্কুল ‘চকরিয়া কোরক বিদ্যাপিঠ’ এর ছাত্র ছিল সে। আমরা ধরেই নিলাম এই ছেলে কয়েক ক্লাস ফেল করে স্কুল থেকে লগ আউট খেয়ে এখানে আসছে। কিন্তু সে দেখি পড়াশোনায় খুবই ভাল। হাতের লেখা দেখে সবাই একদম হা।

আমাদের স্যার ওকে জিজ্ঞেস করলেন, আগের স্কুল থেকে চলে আসছো কেন? ও বলল স্কুলের বেতন দিতে পারে নাই তাই বের করে দিছে।

চকরিয়া প্রত্যাশার আলো শিক্ষালয়

মুনিরের বাবা ভ্যান চালায়। ছেলে হিসেবে মুনির খুবই শান্তশিষ্ট টাইপ। ক্লাসে কোনোদিন ওকে আমরা হইহল্লা করতে দেখি নাই। মেয়েদের দেখে লজ্জা পেত আর ছেলেদের সাথেও খুব একটা কথা বলত না। যেহেতু ওর হাতের লেখা খুবই ভাল তাই স্যাররা ওকে দিয়েই আমাদের পড়াশুনাগুলি বোর্ডে লেখাইতেন। একদিন সুমি নামে আমাদের এক ক্লাসমেট ওকে জিজ্ঞেস করল, ওর হাতের লেখা এত সুন্দর হয় কীভাবে?

ও লাজুক লাজুক হেসে উত্তর দিল, ছোটবেলা থেকে আমি কখনো মুরগীর ঠ্যাং চাবাই না। মুরগীর ঠ্যাং চাবালে হাতের লেখা বিশ্রী হয়!

মুনিরের রোল বিদ্যাপিঠ স্কুলে সবসময় পাঁচ থেকে দশের মধ্যে ছিল। ইংরেজিতে খারাপ বলেই ওর এই পিছায়ে থাকা। তার উপর ও গরীব তাই স্যার-মাষ্টারের কাছে পড়ার সুযোগও খুব একটা নাই। ওর খুব স্বপ্ন হচ্ছে ক্লাসে ফার্স্ট হওয়া। তাই এই স্কুলে এসে ও খুব খুশি ছিল, ধরেই নিছিল এখানে ও ফার্স্ট হবে। তাই ক্লাসে আমাকে দেখে ওর খুব মেজাজ খারাপ হয়।

মেয়েদের সারির প্রথম বেঞ্চে আমি আর ছেলেদের সারির প্রথম বেঞ্চে সবসময় মুনির বসত। মুনিরকে দেখতাম ক্লাসে সবসময় পড়াশোনা করত। যখন ক্লাসে টিচাররা কেউ আসে নাই, ক্লাসের সবাই মিলে হইহল্লা, নাচ-গান করতেছে, তখনও মুনির এক কোনায় বসে পড়ে।

দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা আসল। ক্লাসের সব ছেলেমেয়ে আর স্যাররা সবাই খুব কৌতূহলী, কে পরীক্ষা ভাল দিচ্ছে—মুনির না আমি! রেজাল্ট দেয়ার পর দেখা গেল বাংলায় আর ধর্মে মুনির, ইংরেজি আর বিজ্ঞানে আমি আগায়ে আছি। অঙ্কে দুইজনই একই নাম্বার। তো সব কিছু মিলায়ে কয়েক নাম্বারের ব্যবধানে আমি ফার্স্ট হয়ে গেলাম।

পুরা ঘটনাটায় আমি খুবই মজা পাইছি আর মুনির আরো বেশি সিরিয়াস হয়ে গেছে। ক্লাসের ছেলেপেলের কাছে শুনছি ওরা যখন বিকালবেলা ফুটবল নিয়ে মাঠে দাপাদাপি করে তখনও নাকি মুনির মাঠের এক কোণায় বসে পড়ে। এটা শুনে আমি বলছিলাম, “মাঠে বসে পড়ে কাজী নজরুল হইতে চায় ক্যান? ঘরে বসে পড়লেই পারে।”

ও বাসায় থাকলে নাকি ওর আম্মা ওরে দিয়ে কাজ করায় তাই ও খেলার নাম দিয়ে মাঠে চলে যায়! এরপরেও আমাদের যত পরীক্ষা হইত সব কয়টাতেই ইংরেজির জন্য মুনির আমার চেয়ে পিছায়ে যাইতো। এটা নিয়ে মুনিরকে খুব মন খারাপ আর হতাশ হতাশ লাগতো

মেসো প্রতিদিনই ভোর সাড়ে ছয়টায় স্কুলে আসতেন আর বিকাল ৪টায় সব ক্লাস শেষ হওয়ার পর বাসায় যাইতেন। মেসো যেদিন স্কুলে থাকতেন না ঐদিন ক্লাস-ট্লাস সব কিছুতেই ফাঁকিঝুকি দেখা যাইত। তো একদিন মেসোর জ্বর জ্বর লাগতেছিল বলে উনি সকাল বেলা এসে দুপুরের দিকে বাসায় চলে গেছেন। আর প্রিন্সিপ্যাল নাই, সেই উপলক্ষে ক্লাস মিস হলেও যে আমি স্যারকে কখনো বলি না এটা ততদিনে আমাদের স্যাররা বুঝে গেছেন। তাই আজিজ স্যার কোনো দুশ্চিন্তা ছাড়াই আমাদের ক্লাস নিতে আসেন নাই।

ক্লাসে স্যার নাই, তাই স্বাভাবিক ভাবেই চিল্লাফাল্লা শুরু হয়ে গেছে। কয়েকটা মেয়ে বসে বসে বাংলা সিনেমার গান গাইতেছিল, আমি বসে বসে ওদের সাথে হেসে হেসে সেটা শুনতেছিলাম আর মুনির চুপচাপ পড়তেছিল। চিল্লাফাল্লা বোধহয় একটু বেশিই হয়ে গেছিল, কারণ হঠাৎ করে স্যার ক্লাসে এসে সবাইকে স্কেল দিয়ে মারতে শুরু করে দিছিলেন।

স্যার এক নাগাড়ে সবাইকে মারলেন, আমাকে ছাড়া। গ্রামের স্কুলের একটা কমন বৈশিষ্ট্য হইল মাইর। মাইর দেয়াও যে একটা আর্ট সেইটা গ্রামের স্যারদের না দেখলে বোঝাই যায় না। প্রত্যেকটা স্যারই মাইর দেয়ার ব্যাপারে এখানে পিএইচডি করা! আর ছাত্ররাও এখানে মহা আনন্দে মাইর খায়। স্যারদের হাতে মাইর খাওয়া তাদের কাছে ভাতের সাথে পানি খাওয়ার মত।

কিন্তু আমি কখনোই কোন স্যার/ম্যাডামের হাতে মাইর খাই নাই। কারণ আমি প্রিন্সিপ্যালের আত্মীয় আর শহর থেকে আসছি। তো আজিজ স্যার ক্লাসে এসে আমি ছাড়া বাকি সবাইকে এক নাগাড়ে মারা শুরু করলেন। মুনিরও মাইর খেল। মাইর খাওয়ার পরে হঠাৎ দেখি মুনির খেপে উঠছে। মাইরের ভয়ে স্যারদের মুখের উপর সাধারণত কেউ কথা বলে না।
মুনির ঝাড়ি মেরে বলছে, আমি কী করছি? আপনি আমাকে মারলেন কেন?

স্যার মহা খেপে গিয়ে ওকে আরো মারতেছেন। আর সেও সমানে চেঁচাচ্ছে, “আমি কী করছি? আমি কী করছি?”

স্যার—তুমি কী করছো মানে? সবাই মাইর খাচ্ছে, তুমিও খাবা।

মুনির—সবাই মাইর খাইলে ঐ যে ও (আমাকে দেখাচ্ছে), বাদ যাবে কেন?

স্যার—”এত বড় সাহস, মুখে মুখে কথা বল? আমার যাকে ইচ্ছা তাকে মারব। চুপ বেয়াদব কোথাকার!” বলে আরো অনেক অনেক মারছেন। ওর গায়ে লাল লাল দাগ হয়ে গেছিল মাইর খেয়ে। সেইটা ব্যাপার না। গ্রামের স্কুলে এমন মাইর সবাই খায়। ঘটনাটা ঘটল পরদিন সকালে স্যার মুনিরের মাকে ডেকে এনে বিচার দিলেন, আপনার ছেলে বেয়াদব, হেন তেন আরো বহু কিছু।

ঐদিনের মাইরের কারণ পরে জানতে পারছিলাম। কারণটা হচ্ছে দুপুরে বাসায় যাওয়ার পরে মেসো আবার স্কুলে ফিরে আসছিলেন। আর এসেই দেখছেন স্যার ক্লাস না নিয়ে টিচার্স রুমে চা বিস্কুট খাচ্ছেন!

এরপর কয়েকদিন মুনিরকে আমরা আর ক্লাসে দেখি নাই। প্রায় সাত আট দিন পর, স্কুলের সবাই মারাত্মক উত্তেজিত —মুনির পাগল হয়ে গেছে! পাগল হয়ে গেছে মানে কী? কাল রাত ১টা বাজে ও মিজান স্যারের বাসায় গেছে।

মিজান স্যারের বাড়ি বগুড়া। উনি ঘরবাড়ি সব ছেড়ে গ্রামে এসে মাষ্টারি করেন। একা একা থাকেন একটা বাসায়। চকরিয়ার লোকদের সাথে খুব একটা খাতির নাই। উনার বাসায় কারোই কোনো আসা-যাওয়া নাই বললেই চলে। আর মুনিরের মাকে আজিজ স্যার যখন বিচার দিচ্ছিলেন তখন এই মিজান স্যারও সাক্ষী হিসাবে ছিলেন। উনিও আজিজ স্যারের কথায় কথায় তাল দিছিলেন।

রাত ১টা গ্রামের মানুষের কাছে গভীর রাত। তাই মিজান স্যার ঘটনাটায় খুবই শঙ্কিত হইছেন। রাতের বেলা উনি যখন ঘুমাচ্ছিলেন তখন হঠাৎ দরজায় নক নক।

উনি জিজ্ঞেস করলেন, কে?

গম্ভীর গলা—আমি মুনির।

স্যার ভয়ে পুরাই কাঁচুমাচু। ভয়ে ভয়েই জিজ্ঞেস করলেন, মুনির তুমি এত রাতে এখানে কেন?

মুনির—স্যার আপনি আমার মা’কে এ রকম বললেন কেন? আপনি আমার মা’কে বলছেন আমি নাকি বেয়াদব। সেটা শুনে আমার মা অসুস্থ হয়ে গেছে। আমার মা’র যদি কিছু হয় আমি আপনাকে ছাড়ব না স্যার।

এটুকু বলেই ও স্যারের বাসা থেকে চলে আসছে।

এত বড় সাহস স্যারকে থ্রেট দেয়। আজকেই ওর বাড়িতে বিচার যাবে। প্রয়োজনে বাসায় গিয়ে ওকে পিটায়ে আসা হবে। কিন্তু মিজান স্যার রাজি না। উনি সত্যি সত্যি ভয় পাইছেন। তাই আর মুনিরের বাসায় যাওয়া হয় নাই।

এর আরো দুইদিন পর। আরেক স্যার। নাম শওকত স্যার। উনি রাতের বেলা বাথরুমে যাওয়ার জন্য উঠছিলেন। গ্রামেগঞ্জের বাথরুম বাড়ির বাইরে থাকে। উনি বাসা থেকে যেই বের হইতে যাবেন সেই দেখেন মুনির চুপচাপ বাসার সামনে দাঁড়ায়ে আছে। কোনো কথা নাই, বার্তা নাই, দরজায় নকও করে নাই। স্যারও একইভাবে জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার? এত রাতে এখানে কী?

মুনির অসহায়ের মত বলছে, স্যার আপনি জানেন কী হইছে?

স্যার বলছে, হ্যাঁ জানি। এটা খুবই খারাপ হইছে। কালকে আমরা তোমার মায়ের কাছে গিয়ে মাফ চেয়ে আসব। এখন তুমি যাও। এত রাতে এভাবে দাঁড়ায়ে আছো, কেউ দেখলে তো চোর ভেবে মাইর দিবে তোমাকে।

মুনির ভাল ছেলের মত চলে গেছে।

এরপর স্যারদের ছেড়ে মুনির ম্যাডামদের বাসায় যাওয়া শুরু করছে। ও বুঝতে পারছে, স্যারদের ডিস্টার্ব করে লাভ নাই। স্যাররা ডিস্টার্বড হয় না। মণি ম্যাডাম আর শামীমা ম্যাডামের বাসায় গেছে সে। দুইজনের বাসায় গিয়ে নাকি দুইটা কবিতা শোনায়ে দিয়ে আসছে!

এরপর থেকে আমি মনে মনে খুবই এক্সাইটেড ছিলাম। কারণ আমি প্রিন্সিপালের বাসায় থাকি। মুনির তো অবশ্যই প্রিন্সিপালের বাসায় আসবে। তা না হলে আর কী পাগল হইল!

একদিন সেই মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত হল। রাত ১২টায় মুনির আমাদের বাসায় এসে হাজির হইল। রাত ১২টায় বাসার সবাই মোটামুটি শু’তে চলে গেছে। শুধু আমিই একা বিছানায় শুয়ে শুয়ে গান শুনতেছি, এত তাড়াতাড়ি ঘুমানোর অভ্যাস আমার নাই যেহেতু।

হঠাৎ দরজায় নক হইল। আমার দুলাভাই ডাক্তার তাই এত রাতে সাধারণত রোগীরাই আসে। আমি নক শুনে বড়দাকে ডাকতে গেলাম। বড়দা এসে দরজা খুলে দেখে মুনির।

মুনির ভদ্রগলায় জিজ্ঞেস করছে, স্যার আছে? আমার একটু জরুরি দরকার ছিল।

মেসো আমাদেরকে আগেই বলে দিছিল যদি কখনো রাতের বেলা মুনির আসে তো উনাকে ডাকতে। উনি ওর সাথে কথা বলবেন।

তখন বাসায় কারেন্ট ছিল না আর জেনারেটারের চার্জও শেষ। চার্জলাইট ছিল, কিন্তু সেটাতে বেশি আলো ছিল না। তাই মেসো একটা মোম নিয়ে মুনিরের সাথে দেখা করতে গেলেন। মেসোকে দেখেই মুনির বলে উঠল:

“যেজন দিবসে মনের হরষে
জ্বালায় মোমের বাতি,
আশু গৃহে তার দেখিবে আবার
জ্বলবে কারেন্ট বাতি!”

আমি পাশের রুম থেকে কান পেতে সব শুনতেছি আর হাসতেছি। মেসো জিজ্ঞেস করছে, কী ব্যাপার মুনির?

মুনির—স্যার আপনি নাকি বলছেন আমি পাগল হয়ে গেছি!

মেসো—তুমি পাগল না, বেয়াদব হয়ে গেছো।

মুনির—কেন আমি বেয়াদব?

মেসো—তোমার রাতে-বিরাতে স্যারদের বাসায় কী? আর ম্যাডামদের বাসায় গিয়ে ডিস্টার্ব করো কোন সাহসে? তুমি তো বেয়াদবই!

মুনির চুপ করে আছে দেখে মেসো বলছে, যাও বাসায় যাও। রাত বিরাতে ঘুরে বেড়াবা না এভাবে।

মুনির খুবই অবাক হয়ে বলছে, স্যার ঘুরে বেড়াব না?

মেসো, না।

মুনির, স্যার ঘুরে বেড়াব না কেন? রবীন্দ্রনাথ বলছে না:

“বহুদিন ধরে বহু পথ ঘুরে
বহু ব্যয় করে বহুদেশ ঘুরে,
দেখিতে গিয়াছি পর্বতমালা
দেখিতে গিয়াছি সিন্ধু,
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হৈতে শুধু দুপা ফেলিয়া
একটি ধানের শীষের উপর
একটি শিশির বিন্দু।”

বলেই ও চলে গেছে। এরপর ওর আর কোনো খবর নাই। প্রায় একমাস পর আমাদের টেস্ট পরীক্ষা শুরু হইল।

পরীক্ষার প্রথম দিন। আমি ফার্স্ট বেঞ্চে বসে পরীক্ষা দিচ্ছি। হঠাৎ মুনির হাজির। এসেই মারামারি শুরু করে দিছে, “আমি পরীক্ষা দিব, আমি পরীক্ষা দিব। আমি ফার্স্ট হব, আমি ফার্স্ট হব।”

কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তি হওয়ার পর, ও চুপ হয়ে গেছে। ক্লাসরুমের বাইরে গিয়ে মাটিতে বসে বসে কাঁদতেছে আর বলতেছে, “আপনাদের জন্য আমার জীবনটা ধ্বংস হয়ে গেছে, নষ্ট হয়ে গেছে, আমি পিঁপড়া হয়ে গেছি!”

এসব বলে বলে সে আবার ক্লাসরুমের দিকে আগাচ্ছিল। ক্লাসের ছেলেরা তখন রেডি ছিল। মুনিরকে ধরে গেইটের বাইরে নিয়ে গেছে। যাওয়ার সময় মুনির মহা খুশি খুশি হয়ে বলতেছিল, “তিথি ভাল করে পরীক্ষা দিও। “ক” কে “ব” ন লিক্ষিয়ু, তোয়ার লিখা তো অ্যাঁর নান সুন্দর ন!”

এরপর আমি ক্লাস নাইনে ঢাকায় চলে আসি। মুনিরের আর কোনো খবর জানি না।

পরিবাগ, ঢাকা, জুলাই ৫, ২০১৪