সম্রাট আকবর একটি পুত্র সন্তান চাইতেন। এই কারণে তিনি একবার দরবেশ সেলিম চিশতির কাছে গেলেন।

সেলিম চিশতি সম্রাট আকবরকে বললেন, খুব শীঘ্রই তার একটি পুত্র সন্তান হবে। এক বছর পরে রাণীর একটি পুত্র সন্তান হলে আকবর তার নাম রাখলেন ‘সেলিম’।

পুত্র সন্তানের কারণে আকবর এত খুশি হলেন যে তিনি দরবেশ চিশতিকে সম্মান জানিয়ে একটি শহর গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিলেন। ১৫৬৯ সালে আকবর সিক্রি নামের একটি গ্রামের কাছে সুন্দর সুরক্ষিত একটি শহর বানালেন এবং এর নাম দিলেন ফতেহপুর সিক্রি।

ফতেহপুর সিক্রিতে সেলিম চিশতির মাজার

শহরটি আগ্রা থেকে খুব বেশি দূরে ছিল না। ফতেহপুর সিক্রি এখনো আছে।

তাদের গ্রামের কাছে সম্রাটের শহর হওয়ার কারণে সিক্রির লোকেরাও খুব খুশি হলো। আকবরের প্রতি রাণীর জন্যে শহরের ভিতরে আলাদা প্রাসাদ ছিল। সেই সব প্রাসাদে কাজ করার জন্য সিক্রি গ্রাম থেকে অনেক মানুষ ফতেহপুর শহরে যেত।

সিক্রিতে জরিনা নামের এক নর্তকী ছিলেন। তিনিও চাইতেন তার বান্ধবীদের মত ওইসব প্রাসাদে কাজ করতে, কিন্তু তার বাবা রাজি ছিলেন না।

একদিন সম্রাট আকবর তার কাছে আসা অতিথিদের জন্যে এক অনুষ্ঠান আয়োজন করলেন। তিনি গায়ক তানসেনকে ডাকলেন সেই অনুষ্ঠানে গান গাইতে।

সম্রাট তানসেনকে বললেন, আপনার গানের সাথে সেখানে কাউকে নাচতেও হবে।

তানসেন বললেন, আচ্ছা। আমি চেষ্টা করব নর্তকী রাখতে, কিন্তু আমি এখানে কোনো নর্তকীকে চিনি না।

দাসীদের মধ্য থেকে কেউ একজন সম্রাট আর তানসেনের এই আলাপ শুনেছিলেন। সম্রাট চলে গেলে সেই দাসী তানসেনকে গিয়ে জরিনার কথা বললেন, এবং পরামর্শ দিলেন তানসেন যাতে জরিনাকে নাচার জন্য প্রস্তাব দেয়।

যখন তানসেনের মত বিখ্যাত গায়ক জরিনাকে সম্রাট আকবরের নাচার জন্য প্রস্তাব দিলেন তখন জরিনার বাবা আর না করতে পারলেন না। জরিনা ফতেহপুর শহরে যাওয়ার আগে বিদায় নেওয়ার জন্য তার বাবার কাছে আসলে তিনি জরিনাকে পরামর্শ দিলেন, একটা ব্যাপার মাথায় রাখবে, যেখানে ক্ষমতা আছে, সেখানে বিপদও আছে। সাবধানে থাকবে, আর মনে রাখবে তোমার জন্য আমি সবসময়ই আছি।

জরিনা প্রাসাদে গিয়ে আকবর এবং তার সভাসদদের সামনে সারারাত নাচলেন। জরিনার কাছে এটা ছিল স্বপ্ন সত্যি হওয়ার ব্যাপার। সম্রাট জরিনাকে এত পছন্দ করলেন যে তিনি জরিনাকে প্রাসাদে রেখে দিলেন যাতে প্রয়োজন হলে তাকে ডাকতে পারেন।

প্রাসাদের সবাই জরিনাকে পছন্দ করলেও রানি যোধা বাঈয়ের একজন দাসী জরিনাকে পছন্দ করল না। সম্রাটের কাছ থেকে জরিনা বেশি মনোযোগ পাওয়ার কারণে মাধবী জরিনার প্রতি ঈর্ষাকাতর ছিল। জরিনা যেন সম্রাটের চোখে অপরাধী হয় সেজন্য একটা বুদ্ধি বের করল মাধবী। রানি যোধা বাই যখন স্নান করছিলেন তখন মাধবী তার গয়নার বাক্স থেকে একটি সোনার বালা চুরি করে জরিনার জিনিসপত্রের মধ্যে লুকিয়ে রাখল।

যোধা বাঈ যখন দেখল যে তার একটি বালা নেই তখন তিনি মারাত্মক ক্রোধান্বিত হয়ে সারা প্রাসাদ তল্লাশি করার নির্দেশ দিলেন।

মাধবী তখন রানি যোধা বাঈকে বলল, আমি নিশ্চিত যে আমি জরিনার ঘরে সেই বালাটি দেখেছি। বালাটি যখন জরিনার ঘরে পাওয়া গেল যোধা বাঈ তখন রাগে ফেটে পড়লেন। তিনি সম্রাট আকবরের কাছে গেলেন।

বিখ্যাত চিত্রশিল্পী মনোহরের (মনোহর দাস, ১৫৮২ থেকে ১৬২৪ পর্যন্ত সক্রিয় ছিলেন) আঁকা আকবর।

সম্রাট আকবরের কাছে গিয়ে যোধা বাঈ কাঁদতে কাঁদতে বললেন, আপনার আদরের নর্তকী একটা চোর। এই ব্যাপারে আপনি কী করবেন এখন?

জরিনা তখন আকবরের সামনে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, হুজুর, আমি বালা চুরি করি নি। আমি নাচার সময়ে এর চেয়ে সুন্দর বালা পরি, আমি কেন বালা চুরি করব!

এর জবাবে রানি যোধা বাঈ বললেন, তুমি বলতে চাও যে আমার গয়না সুন্দর না?

সম্রাট আকবর তখন বললেন, তোমার ঘরে বালা কীভাবে পাওয়া গেল সেই ব্যাখ্যা কি তুমি দিতে পারবে?

স্বাভাবিকভাবেই জরিনার তখন বলার কিছু ছিল না। সে জানত না বালা কীভাবে তার ঘরে গেল।

সম্রাট খুব দুঃখের সাথে মাথা নেড়ে বললেন, প্রমাণ যেহেতু দেখাই যাচ্ছে, জরিনা তুমি চোর এবং মিথ্যুক। চুরি করার শাস্তি তুমি জানো।

জরিনা ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেল। কারণ চুরির শাস্তি হিসেবে চোরের হাত কেটে দেওয়া হত যাতে সে আর চুরি করতে না পারে।

জরিনা তখন বলল, কিন্তু হুজুর, আমি একজন নর্তকী। আমার হাত কেটে ফেললে আমি নাচব কীভাবে? আর তাছাড়া আমি চুরি করি নি।

সম্রাট আকবর চিৎকার করে উঠলেন, চুপ সবাই! আগামীকাল সকালে তোমাকে শাস্তি দেওয়াই হবে প্রথম কাজ।

সম্রাট আকবর এরপর দরবার ত্যাগ করলেন। তিনি রাগে এবং দুঃখে হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। তার কাছে জরিনাকে খুবই ভালো একটি মেয়ে মনে হয়েছিল। আর মাধবী চুপ করে সব দেখছিল এবং খুশি হয়েছিল।

জরিনা সারাদিন কাঁদলেন। রাতে জরিনা অন্যান্য দিনের মতই সম্রাটের সামনে নাচলেন। কিন্তু এটা আনন্দের নাচ ছিল না, এটা ছিল খুবই ধীরগতির দুঃখের একটি নাচ। আকবরের সভাসদদের কেউই এত সুন্দর নাচ জীবনে দেখে নি। তার নাচ আর দেখতে পারবেন না ভেবে আকবরও খুব দুঃখ পেলেন।

পরের দিন সকালে আকবর তার সকল সভাসদদের ডাকলেন। তিনি একজন রক্ষীকে পাঠালেন জরিনাকে নিয়ে আসার জন্য। সারা প্রাসাদ তন্ন তন্ন করে খুজেও সেই রক্ষীটি কোথাও জরিনাকে পেল না। সে এসে সম্রাটকে এ কথা জানালো।

সম্রাট আকবর জিজ্ঞাসা করলেন, কেউ কি জরিনাকে দেখেছে?

সভায় উপস্থিত সবাই একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো।

তখন সভায় এক বৃদ্ধ লোক প্রবেশ করলেন।

সিংহাসনে বসা সম্রাট আকবরের সামনে গিয়ে তিনি বললেন, হুজুর, কোনো প্রমাণ ছাড়াই জরিনাকে অভিযুক্ত করে আপনি ভুল করেছেন।

আকবর জরিনার বাবাকে চিনতে পারলেন। তিনি বললেন, জরিনা কোথায় আমাকে বলুন, আমি দেখব তার সাথে যাতে ন্যায়বিচার ঘটে।

জরিনার বাবা মাথা নেড়ে বললেন, অনেক দেরি করে ফেলেছেন আপনি। আর কিছুই করা যাবে না। আপনি আমার মেয়ের জীবনে অনেক দুঃখ এনে দিয়েছেন, আর ফতেহপুর সিক্রি অবশ্যই এই বেঈমানির শাস্তি পাবে।

বৃদ্ধ লোকটির এই কথার অর্থ কী আকবর তা জিজ্ঞাসা করার আগেই সেই লোকটি ভিড়ের মধ্যে মিশে অদৃশ্য হয়ে গেল।

দুই সপ্তাহ পরে ফতেহপুর সিক্রির কুয়াগুলি শুকিয়ে গেল। সম্রাটের উট ও ঘোড়ার জন্য এবং মানুষের জন্য কোনো পানি আর কুয়াগুলিতে অবশিষ্ট ছিল না। সম্রাট আকবর তার স্ত্রীদের ও সন্তানদের নিয়ে আগ্রার দুর্গে গিয়ে উঠলেন। তারা আর কখনোই ফতেহপুরে ফিরে আসেন নি।

সিক্রি গ্রামে এই গল্প এখনো প্রচলিত আছে। গ্রামের কেউ কেউ বলে যে পূর্নিমা রাতে ফতেহপুর সিক্রির প্রধান ফটক, বুলন্দ দরজাতে কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। তারা বলে যে এটা আসলে মাধবী, সে জরিনার জন্য অপেক্ষা করে যাতে তার কাছে ক্ষমা চাইতে পারে।