চলচ্চিত্র সমালোচক ডেভিড স্টেরিট (জন্ম : ১৯৪৪) পেশাজীবনের প্রায় পুরোটা সময় ‘ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটর’ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সিনেমা স্টাডিজের ওপর পিএইচডি করা এই ভদ্রলোক চলচ্চিত্র সমালোচনার পাশাপাশি শিক্ষকতাও করেছেন। আলফ্রেড হিচকক ও জাঁ-লুক গদারের সিনেমা নিয়ে প্রকাশিত তার বইগুলি চলচ্চিত্রপ্রেমীদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। এছাড়া বিতর্কিত এবং নীরিক্ষামূলক সিনেমা নিয়ে সাবলীল ভাষায় লেখা তার প্রবন্ধগুলির জন্যেও বিখ্যাত তিনি। ‘ফিল্মকমেন্ট’ ম্যাগাজিনের ২০০০ সালের জুলাই সংখ্যায় পরিচালক আব্বাস কিয়ারোস্তামি’র সাথে তার এই সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়।

ইরানিয়ান সিনেমার গত দুই দশকের নাটকীয় পরিবর্তনে পরিচালক আব্বাস কিয়ারোস্তামির অবদান সম্ভবত সবচাইতে বেশি। তার জনপ্রিয়তার শুরু ১৯৯০ সালের ‘ক্লোজ-আপ’ সিনেমার আন্তর্জাতিক জনপ্রিয়তা দিয়ে; যা চরমে পৌঁছায় যখন ১৯৯৭ সালের কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে তার সিনেমা ‘টেস্ট অফ চেরি’ পাম দি’অর পুরষ্কার লাভ করে।

২০০০ সালের সান ফ্রানসিস্কো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ক্রিটিক ‘ডেভিড স্টেরিট’ এর সাথে আলোচনা হয় আব্বাস কিয়ারোস্তামির। আব্বাস ইংরেজিতে তেমন দক্ষ না হওয়ায় তাদের সেই সাক্ষাৎকার চলে দোভাষী ‘নাজলি মোনাহান’ এর সহায়তায়।

আব্বাস কিয়ারোস্তামির সাক্ষাৎকার (২০০০)

ডেভিড স্টেরিট

অনুবাদ: আয়মান আসিব স্বাধীন


ডেভিড স্টেরিট

আপনি তো সান ফ্রানসিস্কোতে এসেছেন ‘আকিরা কুরোসাওয়া আজীবন সম্মাননা পুরষ্কার’ নিতে। তা আপনার ও আকিরার চলচ্চিত্রে বিশেষ কোনো সাদৃশ্য আছে বলে মনে হয়েছে কখনো?

আব্বাস কিয়ারোস্তামি

না। আমি মনে করি কোনো নির্দিষ্ট ধাঁচের চলচ্চিত্র নির্মাতা খুব সহজেই সম্পূর্ণ ভিন্ন ধাঁচের আরেকজন নির্মাতার কাজ উপভোগ করতে পারেন। যেমন ধরেন, ‘দ্যা গডফাদার’ আমার খুবই প্রিয় একটা ছবি। অথচ লোকে শুনলে বিশ্বাসই করতে পারে না!

ডেভিড

কিন্তু আপনি যে রকম ছবি বানান, সেগুলি দেখলে তো মনে হয় না আপনার পক্ষে এই ধরনের ছবিও পছন্দ করা সম্ভব!

আব্বাস

এইটাই তো সিনেমার সৌন্দর্য ! (হাসি)

ডেভিড

বর্তমান সময়ে সিনেমাকে কি দেশের ভিত্তিতে আলাদা আলাদাভাবে দেখাটা ঠিক বলে মনে করেন? নাকি চলচ্চিত্র এত বেশিই আন্তর্জাতিক হয়ে গেছে যে এই রকম ‘রাষ্ট্রীয় লেবেল’ লাগানোর আর সুযোগ নাই?

আব্বাস

প্রত্যেকটা সিনেমার নিজ নিজ পরিচয় আছে, নিজস্ব বার্থ সার্টিফিকেট আছে। সব সিনেমাই মানুষদের নিয়ে; মানবতা নিয়ে। বিশ্বের সব দেশেরই কমন একটা ব্যাপার আছে—তা তাদের ভাষা, চেহারা, ধর্ম, আচার-আচরণ যতটা আলাদাই হোক না কেন—আর তা হলো আমাদের ভেতরটা। আপনি যদি দুইজন মানুষের এক্স-রে করে সেই এক্স-রে কপি কাউকে দেখান, কেউ কিন্তু বলতে পারবে না তাদের ব্যাকগ্রাউন্ড বা জাতি বা ভাষা একই নাকি আলাদা আলাদা। আমাদের সবারই রক্তপ্রবাহ একই রকম, ধমনীতন্ত্র একই রকম, আমাদের চোখ দুইটাও একই ভাবে কাজ করে; আমরা সবাই একই রকম ভাবে হাসি, কাঁদি। আমাদের সবারই একই ভাবে ব্যথা লাগে। আমাদের জাতীয়তা যাই হোক না কেন, দাঁত ব্যথা হলে সবার কিন্তু এক রকমই লাগে। সিনেমা বা সিনেমার বিষয় যদি ভাগ করতেই চান, তাহলে তা করতে হবে আনন্দ আর কষ্টের ভিত্তিতে। এই ব্যাপারগুলি সব দেশেই এক রকম।

ডেভিড

আপনার ছবিগুলিতে প্রায়ই চরিত্রদের সম্পর্কে বা মূল কাহিনী নিয়ে তেমন কোনো ব্যাখ্যা কিংবা তথ্য থাকে না। এই ব্যাপারে আপনি বলেছেন, আপনি দর্শকদেরকেও সিনেমার সৃজনশীল প্রক্রিয়ার গুরুত্বপূর্ণ অংশ মনে করেন। আপনার সিনেমা দেখা শেষ হলে আমাদের সবার নিজেদের মত করে বুঝে নিতে হয়। এখন একেকজন এই কাজ একেক ভাবে করবে। এই যে  প্রত্যেক ব্যক্তির নিজের মত করে উপলব্ধিতে আসা—এর সাথে আমাদের একক মানবতা বা আমরা সবাই একই রকম—এই ধারণার সম্পর্কটা ঠিক কী ধরনের?

আব্বাস

কঠিন প্রশ্ন। এইটা কিন্তু সত্যি যে প্রত্যেক মানুষের ভাবনার ধরন আলাদা। তবে ক্রসওয়ার্ড পাজল যেমন যে যেভাবেই সমাধান করুক না কেন, শেষ পর্যন্ত উত্তর একই হয়; আমার মুভি সে রকম না। অন্তত আমি তেমনটাই আশা রাখি। আমার ছবিতে শূন্যস্থান থাকে ঠিকই, কিন্তু তাই বলে কোনো নির্ধারিত পদ্ধতিতে সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে হবে—ব্যাপারটা এমন না। কেউ যদি ভুল সিদ্ধান্তেও আসে, আমার সিনেমা শেষ পর্যন্ত ঠিকই থাকবে। আমি চাই সবাই তাদের ব্যক্তিগত চিন্তার ধরন ও চাওয়া অনুসারে সবকিছু সমাধান করে নিক। অন্যান্য শিল্পের ব্যাপারে আমরা যত সহজে বিমূর্ত ভাব মেনে নিই—যেমন কবিতা, সঙ্গীত, পেইন্টিং, ভাস্কর্য—চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রেও তাই হওয়া উচিত। আমার কাছে চলচ্চিত্র হলো সপ্তম শিল্প। আর চলচ্চিত্রেরই তো সবচাইতে পূর্ণাঙ্গ শিল্পমাধ্যম হওয়ার কথা, কারণ এখানে সব রকম শিল্পের সম্মেলন ঘটে। কিন্তু সিনেমা বলতে আমরা সবাই শুধু কাহিনিই বুঝি, অনন্য কোনো শিল্প বুঝি না।

ডেভিড

আপনি এইমাত্র যা যা বললেন, অনেক নির্মাতাই ঠিক এ রকম কথাই বলেন। আর শেষ পর্যন্ত দেখা যায় তারা আসলেই বিমূর্ত চলচ্চিত্র বানাচ্ছেন। চিত্র, রঙ আর শব্দ ব্যবহার করে তারা এমন সব গল্প বলেন— যেগুলির কাহিনিধারায় নির্দিষ্ট কোনো কাঠামো নাই। এ রকম সিনেমা বানানোর ইচ্ছা হয়েছে কখনো?

আব্বাস

সব ছবিরই কোনো না কোনো ধরনের গল্প থাকা উচিত। তবে গল্প যাই হোক না কেন, তা কীভাবে বলা হচ্ছে সেটাই আসল। গল্প বলার ধরন হওয়া উচিত কাব্যিক, যেন একটি গল্পই ভিন্ন ভিন্ন ভাবে দেখার সুযোগ তৈরি হয়। অনেক মুভি দেখার সময় আমি তেমন কিছু বুঝতে পারি না, বা ধরেন মুভিটা আমাকে তেমন আকর্ষণ করতে পারে না; কিন্তু তারপরও দেখা গেছে কিছু দৃশ্য দেখে আমার মনে হয় যেন কোনো জানালা খুলে গেল। আর আমি সেই জানালা দিয়ে আমার কল্পনা ব্যবহার করার সুযোগ পেয়ে গেলাম। অনেক ছবিই আমি মাঝপথে এসে দেখা বাদ দিয়ে দিয়েছি। কারণ আমি মনে মনে চরিত্রগুলির এন্ডিং কী রকম হবে তা ঠিক করে নিই। আমার কল্পনাতেই সেই ছবির গল্প পূর্ণতা পেয়ে যায়। কিন্তু ছবিগুলি একেবারে শেষ পর্যন্ত দেখলে এই অনুভূতিটা নষ্ট হয়ে যেত। তখন আমাকে জবরদস্তি বলে দেওয়া হত, কার ভাগ্যে কী হয়েছে, কে নায়ক, কে ভিলেন। আমি আসলে গল্পের শেষটা নিজের মত করে ভেবে নিতেই পছন্দ করি বেশি।

ডেভিড

আপনার বর্ণনা শুনে কোনো ঔপন্যাসিকের চাইতে একজন কবির কথাই মনে হয়ে বেশি। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো, আপনার সর্বশেষ ছবি ‘দ্যা উইন্ড উইল ক্যারি আস’ এর শিরোনাম ও কিছু সংলাপ কবিতা থেকে নেওয়া। আপনি কি সেদিকে যাওয়ার চেষ্টাই করছেন—যেখানে সিনেমা বলতে উপন্যাসের বদলে কবিতার কথাই মনে হবে বেশি?

আব্বাস

হ্যাঁ। আমার কাছে মনে হয় সাধারণ কাহিনিধারার সিনেমাগুলির চাইতে বরং কাব্যিক সিনেমাই টিকে থাকবে বহুদিন। আমার বাসায় যত উপন্যাসের বই আছে, সবগুলিই একদম নতুনের মত চকচকে। কিন্তু কবিতার বইগুলির অবস্থা করুণ, জায়গায় জায়গায় ছিঁড়ে গেছে। কারণ উপন্যাস সাধারণত আমি একবার পড়া শেষ হলেই রেখে দিই। কিন্তু কবিতা পড়া হয় বার বার। আসলে কবিতা এমন এক জিনিস যা আপনার কাছ থেকে শুধু দূরে সরে যেতে থাকে। কাব্য ধরতে পারা অনেক কঠিন। আপনি যতবারই একটা কবিতা পড়েন না কেন, একেক রকম পরিস্থিতিতে তার একেক রকম অর্থ দাঁড়াবে। অন্যদিকে উপন্যাস একবার পড়লেই ধরে ফেলা যায়। অবশ্যই সব উপন্যাসের ব্যাপারে এই কথা খাটে না। অনেক উপন্যাসেই কাব্যিক মূর্ছনা থাকে, ঠিক যেমন অনেক কবিতার গড়ন একেবারে উপন্যাসের মতই। আমরা স্কুলে থাকতে যে কবিতাগুলি পড়তাম—যেমন শুয়াপোকা আর মাকড়সার কথোপকথন বা এই ধরনের কবিতাগুলি—সেগুলি ওই রকম কবিতা। এই কবিতাগুলি কাব্যের প্রকৃত রূপ সম্বন্ধে কোনো ধারণা দেয় নাই, তবে কবিতার মাধ্যমে আমাদের বেড়ে উঠতে সাহায্য করেছে।

হয়্যার ইজ দ্যা ফ্রেন্ড’স হোম (১৯৮৭)

ডেভিড

চলচ্চিত্র ও কবিতার প্রধান পার্থক্য হলো, মানুষ ভাবে কোনো সিনেমা তারা এক-দুইবার দেখলেই ধরে ফেলতে পারবে। যারা একই সিনেমা বার বার দেখতে আগ্রহী, এরকম দর্শক খুঁজে পাওয়া কি সবসময়ই কঠিন ব্যাপার হবে বলে মনে করেন? আপনি কি এমনটা চান বা অন্তত আশা করেন যে, আপনার কোনো সিনেমা দর্শকেরা বার বার দেখবে?

আব্বাস

এখন আমি যদি দর্শকদের আমার কোনো সিনেমা একাধিকবার দেখতে বলি, তাহলে ব্যাপারটা স্বার্থপরের মত হয়ে যাবে। মানুষ মনে করবে আমি আমার সিনেমার মার্কেটিং করার চেষ্টা করছি! আমি আসলে জানি না আমি এরকম সিনেমা ঠিক কেন বানাই। কোনো সিনেমা বানানোর সময় শেষমেশ ছবিটা কেমন হবে, লোকে বার বার দেখবে কিনা কিংবা তাদের প্রতিক্রিয়া কেমন হবে—এসব কথা কখনো চিন্তা করি না আমি। আমি শুধু বানাই আর ফলাফল যাই হোক মেনে নিই। তবে আমি একটা জিনিস জানি। আর তা হলো, আমার ছবি দেখে অনেক দর্শকই ঠিক সন্তুষ্ট না হলেও এর কথা সহজে ভুলতে পারবেন না। তারা বাসায় এসে ডিনার করার সময় আমার মুভি নিয়ে আলাপ করবেন। আমি চাই আমার সিনেমা দেখে দর্শকদের মাঝে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হোক, তারা যেন বার বার সেখানে কিছু খোঁজার চেষ্টা করেন।

ডেভিড

আপনি চলচ্চিত্র নির্মাতাদের ছোট একটা গ্রুপের সদস্য—যারা নিয়মিতভাবে তাদের নিজস্ব বিশ্বাস আর নৈতিক অবস্থান থেকে সিনেমা বানিয়ে চলেছেন। আর এর মাধ্যমে তারা দর্শকদের শিখিয়ে যাচ্ছেন কীভাবে চ্যালেন্জিং সিনেমা উপভোগ করতে হয়। আপনার প্রতিটা নতুন সিনেমা দিয়ে আপনার পূর্ণাঙ্গ কাজ সম্বন্ধে আগের চেয়ে বেশি ধারণা পাওয়া যায়।

আব্বাস

আমার কাছে মনে হয় আজ থেকে বিশ বছর আগেও এই ধরনের সিনেমা বানানোর সুযোগ তেমন ছিল না। বর্তমান সময়ের দর্শকেরা শুধু এক রকম ছবি দেখতে দেখতে ক্লান্ত; তারা অন্য রকম কিছু দেখতে চান। হ্যাঁ, আমি যে ধরনের কাব্যিক সিনেমা বানাই, সেগুলি হয়তো ইরানের একটা আর আমেরিকার দুইটা থিয়েটারে চলে। তবে আমি সন্তুষ্ট। বেশির ভাগ মানুষই সরলতা খোঁজেন। তারা উত্তেজিত হয়ে হাসতে চান, কাঁদতে চান। তাই বলে কাব্যিক চলচ্চিত্রের ব্যাপারেও তারা একই রকম আগ্রহ দেখাবেন, এমনটা ভাবা ঠিক না। আমি নিজের সাথে তাদের শিল্পকর্মের তুলনা করছি না, কিন্তু কোনো প্রদর্শনীতে যদি পিকাসো বা কান্দিনস্কি বা ব্রাক এর পেইন্টিং বিক্রি করা হয়, তাহলে কয়জন লোকে সেগুলি কিনবে বলেন? সত্যিকার শিল্প আর বিনোদনের ব্যাপারে আমাদের চাহিদার ধরনে পার্থক্য থাকা উচিত। সাধারণ জনগণ এমন কোনো ছবির পেছনে পয়সা খরচ করবেন না যেটা দেখে তাদের বুঝতে কষ্ট হয়, আসলে ছবিটা দিয়ে কী বলতে চাওয়া হয়েছে।

ডেভিড

চিন্তার ধারা আটকে দেওয়ার এই যে রীতি—এইটাকে আমি সবসময় আমাদের স্কুলজীবনের কবিতা শিক্ষার আদলে দেখে এসেছি। যেখানে মুক্তচিন্তার বদলে তাদের নির্দিষ্ট ভাবনা এবং উত্তরগুলি জোর করে আমাদের বুঝিয়ে দেওয়া হত। নিজের মত করে চিন্তা শুরু করার কোনো সুযোগ সেখানে থাকত না।

আব্বাস

ঠিক বলেছেন। কাব্যিক চলচ্চিত্র আসলে ধাঁধার মত। আপনাকে নিজের বুদ্ধিতে সবকিছু মেলাতে হয়, আবার সব সময় যে উত্তর খুঁজে পাওয়া যায় তাও না। অন্যদিকে সাধারণ দর্শক একেবারে বিপরীত পদ্ধতিতে অভ্যস্ত। কাব্যিক সিনেমায় আপনাকে হাতে ধরে সবকিছু বুঝিয়ে দেওয়া হয় না, কোনও উপদেশ দেওয়ার চেষ্টাও করা হয় না।

ডেভিড

এবার ‘দ্যা উইন্ড উইল ক্যারি আস’ এর ব্যাপারে একটু বলি। ছবিটাতে বাহ্যিক, বস্তুগত এবং আধ্যাত্মিক ব্যাপারগুলির মাঝে যে দ্বন্দ্ব কাজ করে—আমার কাছে তা বেশ ইন্টারেস্টিং বলে মনে হয়। ছবিতে অনেক ভাবেই ঘটনাটা দেখা যায়, কিন্তু যদি একটা ঘটনা বলি—যেমন ধরেন গ্রামের লোকদের মাঝে যোগাযোগ; তারা নিজেদের মাঝে আলাপ-আলোচনা করেন, জিনিসপাতি দেওয়া-নেওয়া করেন। অন্য দিকে আছে সেল ফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ, যা আসলে বাতাসের মাধ্যমে কাজ করে। এই যে মহাজাগতিক আর আধ্যাত্মিক বিষয়গুলির সাথে আমাদের বাহ্যিক জগতের সীমাবদ্ধতার সম্পর্ক—এই ব্যাপারে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি জানতে  চাই। কারণ শেষ পর্যন্ত আমরা সবাই তো বস্তুগত, মরণশীল সত্তাই।

আব্বাস

আমি ছবিটা এখনো ওই রকম ভাবে দেখি নাই। গত এক বছর টেকনিশিয়ান হিসাবে বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে, কিন্তু দর্শক হিসাবে দেখার সুযোগ পাই নাই এখনো। তাই ঠিক বলতে পারছি না। তবে একজন দর্শক বললেন, তার কাছে মনে হয়েছে সিনেমাটার মূল গল্প আত্মাদের নিয়ে; যাদের শারীরিক উপস্থিতি নাই, যারা চলে গেছেন। যেমন মৃত্যুশয্যায় থাকা বৃদ্ধা কিংবা গর্ত খুঁড়তে থাকা লোকটার কথাই ধরেন। তাদের কিন্তু গোটা মুভিতে এক বারের জন্যও দেখা যায় না। তবে আপনি যেমন বললেন, মুভিটাতে বস্তুগত নির্যাসও আছে। কিন্তু সেই সাথে আধ্যাত্মিক আর মহাজাগতিক ব্যাপারও চোখে পড়ে। কিছু চরিত্র আছে যাদেরকে আমরা দেখতে পাই না, কিন্তু তাদের অনুভব করা যায়। এই যে না থেকেও থাকা—এটাই বোধহয় ছবিটার সারমর্ম।

ডেভিড

না থেকেও থাকা? এইটা নিয়ে একটু ব্যাখ্যা করবেন কি?

আব্বাস

এই ধরনের সিনেমার এ রকম অদৃশ্য ব্যাপারগুলি দর্শক হিসেবে আমরা নিজেদের অভিজ্ঞতার আলোকে তৈরি করে নিই। এই ছবিতে মোট এগারো জন ব্যক্তি রয়েছেন যাদেরকে আমরা দেখি না। শেষ পর্যন্ত তাদেরকে দেখতে না পেলেও তারা ঠিক কী রকম, তা কিন্তু আপনি বুঝে ফেলেন। আমি এমন সিনেমা বানাতে চাই, যা কিছু না দেখিয়েও সব দেখিয়ে দেয়। বর্তমানের বেশিরভাগ ছবিই আক্ষরিক অর্থে পর্নোগ্রাফিক না হলেও সারবত্তার দিক থেকে পর্নোগ্রাফিক। কারণ এই ছবিগুলিতে সব কিছু এত বেশি করে দেখিয়ে দেওয়া হয় যে, আমাদের সৃজনশীলতা বা কল্পনা রস ব্যবহার করার কোনো সুযোগই আর থাকে না। আমি দর্শকদেরকে এই সুযোগটা করে দিতে চাই। আমি আপনার ভেতরের সুপ্ত সব তথ্য বের করে আনতে চাই, যেগুলি সম্বন্ধে আপনি নিজেও হয়তো সচেতন ছিলেন না। ফারসিতে একটা প্রবাদ আছে, কেউ যখন কোনো কিছু খুব গুরুত্ব নিয়ে খোঁজা শুরু করে, বলা হয়, “সে যেন আরো দুইটা চোখ ধার করে নিয়েছে।” এই ধার করা বাড়তি চোখ দু’টিই আমি ধরতে চাই, যা দিয়ে দর্শক কোনো দৃশ্যের বাইরের জিনিসগুলিও দেখে নিতে পারবেন। সেখানে কী আছে আর কী নাই, তা যেন তিনি বুঝে ফেলেন অনায়াসেই।

ডেভিড

অন্য কোনো পরিচালকেরা এই ঘরানার ছবি করছেন বলে মনে হয়?

আব্বাস

হু সিয়াও সিয়েন করছেন। তারকোভস্কি’র সিনেমা আমাকে বাহ্যিক জগত থেকে একদম বিচ্ছিন্ন করে দেয়। আমার দেখা সবচাইতে আধ্যাত্মিক সিনেমাগুলি তারই বানানো। এছাড়া ফেলিনি’র কিছু কাজে আমি এই ধারা পেয়েছি। থিও অ্যান্জেলোপোউলোস-এর সিনেমার কিছু মুহূর্তেও এক রকম আধ্যাত্মিকতা দেখা যায়। মোট কথা, সিনেমা ও আর্টের দায়িত্ব হলো রোজকার জীবন থেকে আমাদের সরিয়ে নিয়ে যাওয়া। যদিও উড্ডয়নের শুরুটা রোজকার জীবন থেকেই হওয়া উচিত। এর মাধ্যমেই আরাম ও শান্তি খুঁজে পাওয়া যাবে। শুধু কাহিনি শুনিয়ে ভুলিয়ে রাখার সময় ফুরিয়ে এসেছে।

ডেভিড

‘টেস্ট অফ চেরি’র মূল চরিত্রকে দেখে মনে হয়, তিনি বস্তুগত ও বাহ্যিক জগত থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে চান। প্রথাগতভাবে চিন্তা করলে, একজন পরিচালকের এই ধারণা নিয়ে একেবারেই মনস্তাত্ত্বিক একটা গল্প বলার চেষ্টা করার কথা। তবে আপনি তেমনটা করেছেন বলে মনে হয় না। কারণ এই চরিত্রকে দেখে কখনোই বোঝা যায় না, তিনি ঠিক কী চিন্তা করছেন। তার চিন্তার ধরন সম্পর্কে ছবির শুরুতে আমাদের যতটুকু ধারণা ছিল, ছবির শেষেও ঠিক ততটুকুই থাকে। সেইদিক থেকে দেখলে, ছবিটিতে বাহ্যিক জগত থেকে বেরিয়ে আসতে চাওয়ার অভিযানের কথাই বলা হয়েছে। ফলে এখানেও সেই জাগতিক ও মহাজাগতিকের মাঝে দ্বন্দ্বের প্রসঙ্গ এসে পড়ছে।

আব্বাস

একেক দর্শক ছবিটার ব্যাপারে একেক রকম মত দেন। ইসলাম ধর্মে আত্মহত্যা নিষিদ্ধ। কিন্তু তারপরও কিছু ধার্মিক মানুষ ছবিটা পছন্দ করেছেন। কারণ আপনি যেমনটা বললেন, তাদের কাছে মনে হয়েছিল এর মাধ্যমে জাগতিক সব সম্পর্ক ত্যাগ করে স্বর্গীয় সম্বন্ধ তৈরির দিকে যাত্রা শুরু হয়েছে। ছবির শেষে চেরিগাছ ও অন্যান্য যেসব সুন্দর দৃশ্য—তা দিয়ে এই বক্তব্যেরই প্রতিফলন ঘটে। তার কাজটি নারকীয় কিছু ছিল না, বরং তিনি স্বর্গের দরজাই খুলে ফেলেছেন।

ডেভিড

এরকম একটা সাবজেক্ট নিয়ে সিনেমা বানাতে সেন্সর বোর্ডে ঝামেলা হয় নি?

আব্বাস

কিছুটা বিতর্ক হয়েছিল। কিন্তু কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলার পর তারা বুঝতে পেরেছিলেন যে, এই মুভির বিষয় আত্মহত্যা নয়। বরং জীবনে আমাদের প্রত্যেকের পছন্দমত সিদ্ধান্ত নেওয়ার যে সুযোগ—তা নিয়েই এই ছবি। আমাদের সবার সামনে একটা দরজা আছে, যা আমরা চাইলেই খুলতে পারি। তারপরও আমরা থেকে যাই। এই যে সুযোগ করে দেওয়া—আমার কাছে এটাকে সৃষ্টিকর্তার দয়া বলেই মনে হয়। সৃষ্টিকর্তা দয়ালু বলেই তিনি আমাদের হাতে এত বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ছেড়ে দিয়েছেন।

এই ব্যাপারে একজন রোমানিয়ান দার্শনিকের কথা আমাকে সাহায্য করেছিল অনেক: “আত্মহননের সুযোগ না থাকলে আমি অনেক আগেই নিজেকে মেরে ফেলতাম।”

ছবিতে বেঁচে থাকার সম্ভাবনার কথাই বলা হয়েছে। জীবন যে আমাদের উপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয় নাই, এটাই আমার ছবির বক্তব্য।

ডেভিড

আরেকটা প্রশ্ন, আপনি সাধারণত পূর্ণাঙ্গ চিত্রনাট্য নিয়ে কাজ করেন না, প্রথমে কয়েক পাতায় গল্পের মূল ভাব লিখে নিয়ে কাজ শুরু করে দেন। আর বেশিরভাগ সংলাপ ও অভিনয়ের ধরন নিয়ে শুটিং-এর সময় একেবারে শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ ভাবে কাজ করার সুবিধাটা কী?

আব্বাস

অন-দ্যা-স্পট সংলাপ তৈরি করাটা জরুরি। কারণ একমাত্র এই উপায়েই অপেশাদার অভিনেতাদের সাথে কাজ করা সম্ভব হয়। এমনকি অন্যান্য দর্শকের মত আমার সিনেমার কিছু দৃশ্য দেখে আমি নিজেই অবাক হয়ে যাই। আমি কখনো সংলাপ বলে দেই না, দৃশ্যটা বুঝিয়ে দেয়ার পর তারা নিজেরাই কথা বলা শুরু করেন। এটা এক ধরনের চক্র, এর শুরু আর শেষ ঠিক কোথায় আমার জানা নেই। কী কী বলতে হবে তা আমি তাদের শিখিয়ে দিচ্ছি, নাকি কতটুকু নিতে হবে তারা আমাকে তা শিখিয়ে দিচ্ছেন—আমি জানি না!