আমি তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। গণিত অলিম্পিয়াড হচ্ছে আমাদের স্কুলে। আমি দেয়ালে পা ঝুলায়ে উদাস মনে আমার বখাটে বান্ধবীদের সাথে বসে আছি। এক মেয়ে এসে আমাকে বলল সে মুহম্মদ জাফর ইকবাল এর অটোগ্রাফ নিতে চায়। লজ্জায় বলতে পারতেছে না। আমি যেন একটু ম্যানেজ করে দেই।

আমি তখন ক্ষুদে বুদ্ধিজীবী। সুতরাং যারপরনাই বিরক্ত।

আমি বললাম, ‍‌‌‌‍”এইসব ছোট লেখকদের বই পড়ো কেন? বড় লেখকদের বই পড়বা। টলস্টয় পড়বা, প্লেটো পড়বা। আর জাফর ইকবালরে আমি বলব অটোগ্রাফ দিতে! হুহ্! একদিন উনি আসবে আমার অটোগ্রাফ নিতে, মিয়া, যাও যাও।”

একটু পর ইয়া বিশাল এক গোঁফওয়ালা লোক আমার দিকে একটা কাগজ আর কলম এগিয়ে দিলেন। বললেন, “একদিন না আজকেই তোমার অটোগ্রাফ নিতে চাই। তুমি খুব মজার বাচ্চা বলে মনে হচ্ছে।”

আমি বুঝলাম এই লোকই মুহম্মদ জাফর ইকবাল। দেয়ালে থাকা অন্যরা ভোঁ-দৌড় দিল উনাকে দেখে। একমাত্র আমি ভুরু কুঁচকে বসে থাকলাম। আমার মনে হচ্ছিল আমিও দৌড় দেই। ভাবের কারণে তা করা গেল না। গম্ভীরভাবে উনার কাগজে লিখে দিলাম—‘পা..র..মি..তা’।

এরপরে উনার সাথে আমার নিয়মিত যোগাযোগ হইত আমার এক বান্ধবীর কারণে। তখন একমাত্র আমারই ই-মেইল অ্যাড্রেস আছে। সাইবার ক্যাফেতে গিয়ে ইন্টারনেট ব্যবহার করি। আমার বান্ধবী উনার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখত। আর তাদের ই-মেইল বাহক ছিলাম আমি। কিন্তু যেহেতু আমি উনার ভক্ত না, সেহেতু আমি নিজে কোনো খাতির করতাম না উনার সাথে।

এক বছর পর আবার অলিম্পিয়াড হল। উনি আমাদেরকে আসতে বললেন। আমি গেলাম ঠিকই। কিন্তু উনার আশেপাশে ঘুরতে লাগলাম। ইগোর চোটে বলতে পারতেছিলাম না যে স্যার আমি আসছি। উনি তখন অটোগ্রাফ দিতে মহাব্যস্ত।

চশমা নাকের ডগায় রেখে অটোগ্রাফ দেয়ার ফাঁকে আমাকে দেখে ফেললেন। দেখে ডাক দিলেন। উনার সামনের অটোগ্রাফপ্রার্থী কিচির মিচির কিচির মিচির পোলাপানরে দেখায়ে বললেন, এদেরকে সুন্দরভাবে লাইন করে দাঁড় করাও তো দেখি। পরীক্ষা হয়ে যাক তুমি লিডার হিসেবে কেমন?

কথাটা শুনে তো আমার বিষম বিরক্তি হইল।

আমি চিৎকার দিয়ে বললাম, যেসব পোলাপান লাইনে দাঁড়াবে না, তাদের অটোগ্রাফ দেওয়া বন্ধ। তাদেরকে বহিস্কার করা হবে।

এমন কঠিন কথা কোমলমতি শিশুদের স্যার কোনোদিন বলতে পারতেন না। উনি আমার এ কঠোর ভাব দেখে খুবই হতাশ হলেন। আরো হতাশ হলেন যখন দেখলেন ঘোষণার চোটে বাচ্চাগুলা ভদ্রভাবে লাইনে দাঁড়ায়ে গেছে। অথচ দুই ঘণ্টা ধরে এগুলারে লাইনে আনার জন্য ভলান্টিয়াররা রীতিমত হিমশিম খাচ্ছিল। আমার মনে কৌতূহল হইল অটোগ্রাফ কেমনে দেয় দেখি।

দেখলাম লেখা—

‘অনেক অনেক শুভেচ্ছাসহ
মুহম্মদ জাফর ইকবাল’

সবাইরে একই কথা লিখতেছে। আর নামটাও স্রেফ বানান করে লিখা। কোনো ঘুরানো প্যাঁচানো স্টাইল নাই। ওরকম আমিও লিখতে পারি চাইলে। আমার কাছে নিজের স্বাক্ষর মানে শুধু প্রথম অক্ষর টানা হাতে বড় করে লেখা। ওইটা ছাড়া বাকিগুলা হবে প্যাঁচানো ও দুর্বোধ্য। যে লোক এমন নব্যসাক্ষরদের মত নাম লেখে, তাকে মেধাহীন না ভাবার কোনো কারণই আমি পাইলাম না।

আমি উনাকে বললাম, শুনেন, আপনার কারণে অনুষ্ঠানে অনেক ডিস্টার্ব হয়। এই একই কথা সবাইরে লিখতেছেন! আসার সময় এইটা এক হাজারটা ফটোকপি করে আনলেই পারতেন!‍ হুদাই এত সময় নষ্ট হত না। আপনারও হাত ব্যথা হইত না।

উনি আমার কথা শুনে হাসতে থাকলেন।

আমি বললাম, শোনেন, নেক্সট টাইম কিন্তু এইটা করবেন। মানুষরে এইসব ডিস্টার্ব দিবেন না। না হইলে আমি নিজে ফটোকপি করে নিয়ে আসব। আমি আনলে কিন্তু পার পিস পাঁচ টাকা করে বেচব। তখন কিছু বলতে পারবেন না।

পরের বার উনি আমাকে মেইল করলেন, লিখলেন আমরা যেন নীল পোশাক পরে অলিম্পিয়াডে আসি। আমি মহা বিরক্ত। আমি নীল শার্ট আর মৌরিন নীল জামা গায়ে দিয়ে গেলাম। কিন্তু উনার কোনো পাত্তাই পাওয়া গেল না। উনি যথারীতি ব্যস্ত। বিকাল চারটার দিকে হবে বোধহয় উনি আমাদেরকে নিয়ে গেলেন রাস্তায়। তখন কিবরিয়া হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তার বউ আসমা কিবরিয়া ‘শান্তির সপক্ষে নীলিমা’ (নামটা কি এইটা? ঠিক মনে নাই) আন্দোলন করতেছেন। আন্দোলনটাতে মনে হয় বিকাল বেলা একটা টাইমে সবাই নীল পোশাক পরে রাস্তায় দাঁড়ায়ে থাকো-টাইপ কোনো ব্যাপার ছিল।

আমি তখন উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষ পড়ে ফেলছি। পড়ে ফেলছি দূরবীন, প্রথম আলো, সেই সময়। সুতরাং আমি মনেপ্রাণে নকশাল, মার্ক্সিস্ট তো বটেই। এইসব শান্তিবাদী, গান্ধীবাদী আন্দোলন নিয়ে আমি গভীর সন্দেহ পোষণ করলাম এবং উনাকে তিরষ্কার করলাম একজন মার্ক্সিস্টকে অমন একটা ফালতু আন্দোলনে নেয়ার জন্য।

বেচারা! উনি আমার পড়াশোনার খোঁজ নিচ্ছিলেন। আমি আরো বিরক্ত হইলাম। আমি বললাম, আজকে আলপিনে (তখন রসালো-র নাম ছিল আলপিন) আপনার যে ছড়া ছাপানো হইছে সেইটা কি আপনার না আপনার ছেলের লেখা আসলে? এরকম একটা ফালতু ছড়া আপনে লিখলেন? আপনার লজ্জা হইল না এমন ছড়া লিখেন! লিখেন তো লিখেন আবার ছাপেন!

জাফর ইকবাল ভক্তরা আমাকে দোররা মারার আগে সেই ছড়াটা পড়ে দেখেন।

“দেশের ডাকে সাড়া দিলাম সবাই বলে বেশ,
প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিলাম সবাই হেসে শেষ”

উনি মিনমিন করে বললেন, খুব খারাপ হইছে নাকি?

আমি বললাম, সত্যি করে বলেন তো এইটা কে লিখছে? আপনার ছেলে লিখছে, তাই না? আপনি নিজের নামে ছাপায়ে দিছেন, তাই না? এইরকম ক্লিশে জিনিস তো আপনি লিখেন নাই! এর চেয়ে কত ভাল কবিতা তো আমিই লিখি। সত্যি কথা বলেন দেখি!

উনি বললেন, না, না, আমিই লিখছি এই খারাপ ছড়া। তুমি নিশ্চয়ই অনেক ভাল লিখ। কী করব বল! আমি তো তোমার মত লিখতে পারি না। আচ্ছা তুমি এত অদ্ভুত বাচ্চা হইলা কেমনে? শার্ট প্যান্ট পরো কেন ছেলেদের মত? চুল বয়কাট?

আমি বললাম, আমি অদ্ভুত না, অস্বাভাবিক না, আমি অগতানুগতিক। আপনি বড় লেখক হইবেন কেমনে? আপনি তো শব্দই জানেন না!

উনি হেসে ফেললেন। বললেন, একদিন তুমি যখন বড় হবা, প্রেম করবা, বিয়ে করবা, তোমার বাচ্চাদের আর তোমার বরকে আমি বলব তুমি ছোটবেলায় কেমন পাকা ছিলা!

আমি বললাম, আমি জীবনেও বিয়ে করব না। আর প্রেম আবার কী? জানেন না, ফ্রয়েড কী বলছে? সবই শারীরিক আকর্ষণ! প্রেম-ট্রেম বলে কিছু নাই!

স্যার হো হো হো করে হাসছিল।

ষোলোই ডিসেম্বরে আমার অফিসের কাজ ছিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। আমি একটু সাজগোজ করে, মাঞ্জা মেরে গেছি ওখানে। সেখানে জাফর ইকবাল স্যার ছিল। আমি পালায়ে পালায়ে থাকলাম যেন উনার সাথে আমার দেখা না হয়। কিন্তু অন্যেরা সবাই যখন উনার অনুভূতি জানতে চাইল তখন আমারও মাইক্রোফোন আগায়ে দিতে যেতে হইল। আমার সামনে বিটিভি আর দেশ টিভির রিপোর্টার। দুজনের পিছনে, মাঝখানে আমি। যতটা সম্ভব চেহারা লুকায়ে উনার দিকে মাইক্রোফোন ধরে আছি। কথা বলতে বলতে হঠাৎ উনি থেমে গেলেন। তারপর আমার সামনের দুজনকে দুহাতে সরায়ে আগায়ে এসে আমারে জড়ায়ে ধরলেন।

বললেন, “আরেরররর তুমি! তুমি রিপোর্টার হইছ!”

আমি ততক্ষণে লজ্জায় শেষ।

আমি উনার কানে কানে বললাম, “স্যার, আমার তো ভার্সিটি জীবন প্রায় শেষ, আমি তো আর স্কুলে পড়ি না এখন।”

উনার চোখ বড় বড় হয়ে গেল। পাশে থাকা ইয়াসমিন ম্যাডামকে বললেন, “ওরে চিনছো? ওই যে চট্টগ্রামের মেয়েটা। পাকনা পাকনা কথা বলত!”

ম্যাডামও ততক্ষণে চিনে ফেলছে আমারে। এবারে উনিও আমারে জড়ায়ে ধরলেন।

বললেন, সিলেট আসবা বলে তো আর আসো নাই।

স্যার এরপর অনেক কথা বলল। ছোটবেলায় উনার সাথে কী কী পাকনামি করতাম, মৌরিনকে কীভাবে হেল্প করতাম, অলিম্পিয়াডে কী দুষ্টামি করতাম, স্কুলে আমি কেমন বখাটে ছিলাম, উনাকে গোঁফ উঠায়ে চা খেতে বলছিলাম, ফালতু কবিতা কেন লিখে তা নিয়ে ক্যাঁচর-ম্যাঁচর করছিলাম—সব।

এদিকে আমার সহকর্মীরা ধৈর্য সহকারে, মাইক্রোফোন হাতে দাঁড়ায়ে আছে। আমার মোটামুটি লজ্জায় মরি মরি অবস্থা।

শেষে উনি বললেন, কিন্তু তুমি এরকম মেয়ে মেয়ে হয়ে গেলা কেমন করে? ওমা টিপও পরো এখন! এখন তো দেখি আবার লজ্জাও পাও! প্রেম করো নাকি?

১৭ ডিসেম্বর, ২০১৩