[জর্জ অরওয়েলের আসল নাম এরিক আর্থার ব্লেয়ার। ইংল্যান্ডের অরওয়েল নদী থেকে তিনি জর্জ অরওয়েল নাম নেন। উনার জন্ম হইছিলো ২৫ জুন ১৯০৩ সালে। মারা গেছেন আমার জন্মদিন ২১ জানুয়ারি ১৯৫০-এ। ১৯৫০ সালে যদিও আমার জন্ম হয় নাই। উনি ছিলেন একজন ব্রিটিশ প্রবন্ধকার, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, সাংবাদিক এবং সমালোচক। অরওয়েলের লেখায় সমাজের অন্যায় অবিচারের কথা আসছে, গণতান্ত্রিক সাম্যাবস্থার কথা আসছে, রাষ্ট্রের ‘টোটালিটারিয়ানিজম’ অর্থাৎ রাষ্ট্র কর্তৃক জনগণ এবং সমাজের সকল স্থরের সর্বময় ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধাচরণ আসছে।

উনার বিখ্যাত এবং উল্লেখযোগ্য লেখাগুলির মধ্যে আছে ১৯৩৭ এ লিখা ‘দ্যা রোড টু উইগান পিয়ার’, স্প্যানিশ সিভিল ওয়ার নিয়ে ১৯৩৮ এ লিখা ‘হোমায টু কাতালোনিয়া’, ১৯৪৫ এ লিখা রূপক উপন্যাস ‘এ্যানিমেল ফার্ম’ এবং ১৯৪৯ এ লিখা ডিসটোপিয়ান নভেল, ‘নাইটিন এইটি ফোর’।

ইকোনোমিস্টের ভাষ্য অনুযায়ী তিনি ছিলেন ‘সম্ভবত ২০ শতকের সবচাইতে সেরা কাহিনীকার’, যার কড়া চায়ের প্রতি ভালোবাসাও ছিলো অনবদ্য! তিনি নাকি এমনকি কাতালোনিয়ায় বসে ফোর্টনাম এবং মেসনের চা নিয়ে আসতেন! উনার ১৯৪৬-এ লিখা ‘আ নাইস কাপ অফ টি’ প্রকাশ হয় লন্ডন ইভনিং স্ট্যান্ডার্ডে, যাতে তিনি বলেন, ‘চা’, এদেশের সাথে—এই সভ্যতার সাথে হাজার বছর টিকে গেছে, কিন্তু, সামান্য এক বানানোর পদ্ধতি নিয়েই সারাক্ষণ মতবিরোধ চলে ভয়ঙ্কর।

চা নিয়ে অরওয়েলের যা কড়াকড়ি, তার সিকিভাগও খাওয়া নিয়ে ছিল না জানা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার রেশনিং-এর খাবার ‘ভিক্টরি পাই’ নিয়েও উনাকে বেশ গুণগান করতে দেখা যায়। ভিক্টরি পাই-এর অন্য নাম ‘ওয়ল্টন পাই’, যা যুদ্ধের আগে ফ্রান্সিস লেড্রি বলে এক বাবুর্চি আবিষ্কার করেন, পরে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের প্রধান, লর্ড ওয়ল্টনের নামে এর নাম ‘ওয়ল্টন পাই’ রাখা হয়। আলু, ফুলকপি, গাজর, ওটমিল এবং সবজি সিদ্ধ করা পানি দিয়ে বানানো এই পাই নিয়ে যুদ্ধাবস্থায়ও হাসাহাসি চলত, এবং অরওয়েল ছাড়া কেউই তার বিশেষ ভক্ত ছিল না। তিনি নাকি একবার ভুল করে বিড়ালের খাবারও খেয়ে ফেলছিলেন।

অরওয়েলের সামাজিক ভব্যতা নিয়ে গোলমেলে আচরণের জন্য তিনি ইংলিশ সমাজে মাথাখারাপ খামখেয়ালি খাপছাড়া হিসাবে বেশ পরিচিত ছিলেন। যেমন ধরা যাক, একদিকে তিনি যেমন আশা করতেছেন শ্রমিক বা তৃতীয় শ্রেণীর মানুষ ডিনারে আসার আগে ঠিকঠাক জামা কাপড় পরে আসবেন, আবার, তাকেই দেখা যাচ্ছে বি-বি-সি ক্যান্টিনে বসে পিরিচে ঢেলে সশব্দে চা খেতে।

চা খাওয়া (নাকি পান করা) বিষয়ে আমি উনার মত পিউরিটান না। আমার মতে চা মুডের উপর নির্ভর করে। অনেক সময় নিয়ে চা বানানোর বিপক্ষেও আমি। তবে, অনুবাদক হিসাবে আমি যেহেতু মাইনর, তাই আমার মতামত বিষয়ে দীর্ঘ লেখা না দিয়া অনুবাদ শুরু করলাম।—নাদিয়া ইসলাম]

ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার বেঙ্গল প্রভিন্সের বিহারের মতিহারে জন্ম নেন জর্জ অরওয়েল, ১৯০৩ সালের ২৫ জুন। ছবিতে জর্জ অরওয়েলের যে বাড়িতে জন্ম নিয়েছিলেন তার ছবি।

সুন্দর এক কাপ চা

জর্জ অরওয়েল

আপনি একটা রান্নার বই হাতে নিলেন।

আপনার হাতে যে বইটা র‍্যানডমলি প্রথমে এসেছে, তাতে যদি আপনি ‘চা’ শব্দের অস্তিত্ব খোঁজেন, তাহলে বেশিরভাগ সময়েই দেখবেন, চা শব্দটাই উহ্য থেকে গেছে, বা তাতে পেন্সিল স্কেচে আঁকা কিছু ধোঁয়াটে ইনস্ট্রাকশান পাবেন, যেখানে চা বানানোর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলিই উবে গেছে।

ব্যাপারটা মজার। কারণটা এটা নয় যে ‘চা’, এদেশের সাথে—এই সভ্যতার সাথে হাজার বছর টিকে গেছে, কিন্তু, এমনকি আয়ারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া বা নিউজিল্যান্ডের চা বানানোর সর্বোৎকৃষ্ট উপায় নিয়েও আমাদের সঙ্গে দারুণমতবিরোধ আছে ওদের।

যখন আমি আমার রেসিপিতে আমার জন্য এক কাপ ‘নিখুঁত’ চা বানাই, তখন আমি অবশ্য কম বেশি এগারোটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় পয়েন্ট পাই। বেশিরভাগই অবশ্য দুই তিনটা পয়েন্টে আমার সাথে একমত হবেন, কিন্তু নিদেনপক্ষে চারটা পয়েন্টে যে বিতর্ক শুরু হবে, তা বলাই বাহুল্য। নিচে আমার এগারটা পয়েন্ট বা রুল উল্লেখ করলাম। প্রত্যেকটা রুলকেই আমি ‘গোল্ডেন রুল’ বলে মনে করি।

• প্রথমত, ভালো চা বানানোর জন্য আপনার দরকার ইন্ডিয়ান বা সেইলনিজ চা পাতা। চীনাদের চা পাতাও বেশ ভালো, ইদানিং সেটা অস্বীকার করার উপায় নাই—বেশ সাশ্রয়ী, দুধ ছাড়াই খাওয়া যায়—কিন্তু এতে তেমন উত্তেজক কিছু নাই। চা খাবার পরে নিজেকে আপনার বিজ্ঞ বা সাহসী বা আশাবাদী কোনোটাই মনে হবে না। যেই মানুষ ‘সুন্দর এক কাপ চা’য়ের মত উষ্ণ বা আরামদায়ক একটা প্রবাদ ব্যবহার করছেন, তিনি নিঃসন্দেহে ইন্ডিয়ান চায়ের কথাই বলছেন।

• দ্বিতীয়তঃ, চা বানাতে হবে কম পরিমাণে। অর্থাৎ কিনা, চায়ের ছোট কেতলিতে। কড়াই বা হাঁড়ি জাতীয় পাত্রে বানানো চা সবসময়েই বিস্বাদ লাগে—আর্মির চা, বিশাল কড়াই মত পাত্রে বানানো হয়, তাতে আপনি সবসময় তেল আর চুনকামের স্বাদ পাবেন। চায়ের কেতলি চায়নিজ হলে ভালো, অথবা মাটির তৈরি হতে হবে। রুপার পাত্রে বা ব্রিটানিয়া ওয়্যারে, অর্থাৎ—টিন, এ্যন্টিমনি, কপার ধাতুর সমন্বয়ে একধরনের চকচকে রুপালি রঙের শংকর ধাতুর তৈরি কেতলিতে চা বানানো হলে তাতে নিম্নমানের স্বাদ পাওয়া যায়, আর অ্যানামেলের কেতলি ততধিক নিম্নমানের চা দেবে আপনাকে। তবে বিলুপ্তপ্রায় পিউটার পাত্রে, অর্থাৎ, টিন, সীসা, বিসমাথ এবং কপারের তৈরি পাত্রে বানানো চা অবশ্য, আশ্চর্যজনক ভাবেই, তেমন খারাপ না খেতে।

• তৃতীয়তঃ, চা বানানোর আগে চায়ের পাত্র গরম করে নিতে হবে। কেতলির ভেতর গরম পানি ঘুরিয়ে গরম করার চাইতে চুলায় দিয়ে পাত্র গরম করাই শ্রেয়।

• চতুর্থতঃ, আপনার বানাচ্ছেন কড়া এক কাপ চা। এক কোয়ার্ট (আমেরিকান হিসাবে ০.৯৪ লিটার, ব্রিটিশ হিসাবে ১.১৩ লিটার) পানিতে, আপনি যদি কেতলি প্রায় কানায় কানায় পুরোটা ভরেন, তাহলে চা চামচে উঁচু করে প্রায় ছয় চামচ পাতা দিলে হিসাব ঠিক থাকে। রেশনের সময়, হয়তো সপ্তার প্রতিদিন ব্যাপারটা বিলাসিতা হয়, কিন্তু আমার কাছে এক কাপ কড়া চা বিশটা দুর্বল হালকা পাতলা ঢিলেঢালা চায়ের চাইতে অনেকগুণে উত্তম। সত্যিকারের চা-প্রেমিকরা শুধু যে তাদের চা ‘কড়া’ ভালোবাসেন তা না, প্রত্যেক বছর পার হওয়ার সাথে আগের বছরের চাইতেও একটু বেশি কড়া ভালোবাসেন তারা। ব্যপারটা যে সত্য, তা বুড়ো মানুষদের রেশনিং-এর পরিমাণ বেড়ে যাওয়া থেকেই বোঝা যায় ভালোমত।

• পঞ্চমতঃ, চা পাতা ঢালতে হবে সরাসরি কেতলিতে। কোনো ছাঁকনি ফাঁকনি না, কোনো মসলিনের ব্যাগ না, এমন কিছুই না যাতে চা পাতা আটকে যায়। কোনো কোনো দেশে কেতলির সাথে একধরনের ঝুলন্ত ঝুড়ির মত জিনিস কেতলির নলের তলায় লাগানো থাকে, ঝুড়ঝুড়ে খাপছাড়া নিঃসঙ্গ পাতা ধরে রাখার জন্য, মানুষ বলে এসব নাকি ক্ষতিকর। তবে সত্যি কথা বলতে, আমরা কোনো প্রকার অসুস্থ হওয়া ছাড়াই বেশ ভালো রকমের চা পাতা গিলতে পারি। যেসব নিঃসঙ্গ পাতার কথা বলা হচ্ছে, তারা চায়ের পানিকে ইনফিউস করতে পেরেছে বলেই নিঃসঙ্গ।

• ষষ্ঠতঃ, আপনাকে চায়ের কেতলিকে গরম পানির পাত্রের কাছে নিতে হবে, এবং কোনোভাবেই সেটা উলটা রাস্তায় হবে না। যেই মুহূর্তে আপনি পানি ঢালছেন পাতার উপরে, সেই মুহূর্তে পানিকে তার স্ফূটনাংকের কাছাকাছি সময়ে থাকতে হবে, তার মানে, পানির কেতলিকে থাকতে হবে চুলার আগুনের উপরে। কেউ কেউ বলেন, আগে ফুটানো পানি দিয়ে ভালো চা হয় না, এবং সবসময় নতুন পানি ফুটিয়ে ব্যবহার করা উচিৎ, তবে, আমি তার কোনো ঊনিশ-বিশ পাই নাই।

• সপ্তম পয়েন্ট, চা বানানোর সময়েই আপনাকে ভালোমত নাড়াতে হবে চা পাতা। অথবা, ভালো হয়, যদি চায়ের পাত্র ধরে ভালোমত একটা ঝাঁকি দিতে পারেন। তারপর অপেক্ষা করুন পাতাগুলির ধীতস্থ হবার।

• অষ্টমতঃ, আপনার দরকার ভালো একটা চায়ের কাপ। ব্রেকফাস্ট কাপ, অর্থাৎ, সিলিন্ডার আকৃতির কাপ, যেগুলি খুব বেশি ছড়ানো এবং নিচু না। ব্রেকফাস্ট কাপে অনেকখানি চা ধরে, যেখানে অন্যান্য কাপে চা শেষ করার আগেই তা ঠাণ্ডাহয়ে যায়।

• নয় নাম্বার রুল, চায়ের দুধকে সবসময়েই ননী ছাঁকা দুধ হতে হবে। যেই দুধে প্রচুর ফ্যাট বা ক্রিম, সেই চা অবসাদ তৈরি করে।

• দশম ধাপ—কাপে চা আগে ঢালবেন। এইটা নিয়ে সবার বিতর্ক খুব, এবং ব্রিটেনের প্রত্যেক পরিবারেই এই নিয়ে দুই ধরনের মতধারা চালু আছে। ‘দুধ আগে’ মতধারার মানুষ ভালোই যুক্তি দিতে পারেন, কিন্তু আমার নিজস্ব তর্ক আমি ‘উত্তর দেব না’ যুক্তিতে আটকে রাখি। সেটা বলেও বলতে হয়, চা আগে ঢেলে দুধ পরে ঢাললে আপনি সবসময় দুধের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, যেখানে আপনার দুধ এবং চা রেশিও ঠিক থাকার সম্ভাবনা কমে যায় বা দুধের পরিমাণ বেড়ে যেতে থাকে, যদি আপনি উলটো রাস্তায় আসেন।

• সর্বশেষে—আপনি যদি রাশান না হয়ে থাকেন—তাহলে চা পান করা উচিৎ চিনি ছাড়া। আমি জানি, আমি এই পয়েন্টে সংখ্যালঘু। কিন্তু আপনি যদি চিনি দিয়ে চায়ের আসল স্বাদ, গন্ধ পালটে ফেলেন, তাহলে নিজেকে কীভাবে আপনি চা-প্রেমিক বলবেন? একই ভাবে তো আপনি তাতে লবণ বা মরিচও ঢালতে পারেন, তাই না? চায়ের স্বাদ তিতা, এবং সেভাবেই তাকে পান করার কথা। বিয়ারও ঠিক যেমনভাবে তেতো, এবং সেভাবেই তার থাকার কথা। আপনি যদি চায়ে চিনি মেশান, তাহলে আপনি আর চায়ের স্বাদ পাচ্ছেন না, পাচ্ছেন চিনির স্বাদ, আর তাই যদি আপনি চান, তাহলে চা বাদে গরম পানিতে চিনি গুলে খেতেও আপনার একই রকম লাগবে।

কেউ কেউ হয়তো বলবেন, তারা আসল চায়ের ভক্ত না, তারা উষ্ণতার জন্য বা স্নায়ুর উত্তেজনার জন্য চা খান, তাই তাদের চিনি দরকার। সেই সমস্ত পথভ্রংশ মানুষদের আমি বলবো, দুই সপ্তা চিনিছাড়া চা খেয়ে দেখুন, এরপরে মনে হয় না আপনি আর কখনো চিনি দিয়ে চা’র মাহাত্ম্য নষ্ট করতে চাইবেন।

চা বানানোর বা খাবার বিতর্কের অবশ্য এখানেই শেষ না। তবে, এই ক’টা পয়েন্টই এই পুরো ব্যাপারটা কতটা নিগূঢ়, তা দেখানোর জন্য যথেষ্ট। চা পাত্র ঘিরে অনেক রহস্যজনক সামাজিক আচার চালু আছে (যেমন চায়ের পিরিচে চা খাওয়াকে কেন অসভ্যতা ধরা হয়?), কিংবা চা পাতার সম্পূরক ব্যবহার নিয়ে আমার প্রশ্ন আছে অসংখ্য, যেমন ধরা যাক, ভাগ্য পরীক্ষার জন্য চা পাতা কেন ব্যবহৃত হয়, বা চা বানানোর সাথে অতিথি আসার কুসংস্কারের কী সম্পর্ক, বা পোষা খরগোসকে চা খাওয়ানো, চা দিয়ে পোড়া ক্ষতস্থান আরোগ্য করা, চা দিয়ে কার্পেট ঝাড়ু দেওয়া এসব কোথা থেকে আসলো ইত্যাদি। সেসব যাহোক, কথা হচ্ছিল চা বানানোর জরুরি দিকগুলি নিয়ে! আমার মতে, সুন্দর এবং নিখুঁত এককাপ চা বানানোর সময় পাত্র গরম করা বা পানির তাপমাত্রা ইত্যাদি পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনার দিকে নজর দেওয়া অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, যাতে এক জনের রেশন চিপড়ে বের করা—সেই কড়া বিশ কাপের দুই আউন্স যা প্রতিনিধিত্ব করছে, তাকে যথাযথ ভাবে সিদ্ধ হাতে কায়দা করায় খামতি না থাকে একটুও।

ইভনিং স্ট্যান্ডার্ড, ১২ জানুয়ারি ১৯৪৬