বৃষ্টি শুরু হবার পর থেকেই বর্ষা নিয়ে নানা রকম কথাবার্তা শুনছি। বাঙালি বোধহয় সবচেয়ে বেশি স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ে এ মাসে। আর শৈশব—এইটার একটা বিশেষ অংশ মনে হয় এই মাস।

কারো মাছ ধরার স্মৃতি, কারো জ্বর কিংবা বন্যা কিংবা এরকম কোনো দুর্যোগের কথা। যাই হোক, বর্ষা এসে পড়লেই আমার সবচেয়ে বেশি ইচ্ছা করে বিয়েতে যেতে। উহু! যেমন তেমন বিয়ে না — হিন্দু বিয়ে, গহীন গ্রামের মধ্যে, কনে বাড়ি যাওয়ার পথে হাঁটু সমান কাদা পার হতে হবে আর বহুদূর থেকে কনে বাড়ির ঢাকঢোলের শব্দ শোনা যাবে।

এ রকম একটা ঘটনা আমার জীবনে আছে। কিন্তু এতই ছোটকালের সেই কথা যে বুঝিয়ে লিখতে গেলে কল্পনা মেশানো ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

তখন আমার মা খুব নিষ্ঠুর ছিল বলে মনে হয়। আর সম্ভবত আমি টু কিংবা থ্রি-তে পড়ি। দুষ্টের দুষ্ট-লঙ্কার রাজা বলে স্কুল ছুটি থাকলেই মা আমাকে এদিক-সেদিক পাঠায়ে দিত। এইটুকু মনে পড়ে, কারণ এই সময়ের যেসব স্মৃতি আমার মনে পড়ে বেশিরভাগই আত্মীয় স্বজনদের বাসায় মা-বাবা-বোনদের ছাড়া স্মৃতি।

যাই হোক, যেই আন্টির বাসায় আমাকে পাঠানো হল তিনি আমাদের দূরসম্পর্কের আত্মীয়। এবং তার বাসায় বিদ্যুৎ সংযোগ নাই। টয়লেট বাসার বাইরে পুকুর পাড়ে। এবং বাসা থেকে বের হয়ে বাজার পর্যন্ত যেতে আসতে একটামাত্র বাঁশ দিয়ে তৈরি সাঁকো পার হতে হত।

শহরে বড় হওয়া মেয়ের পক্ষে এরকম পরিবেশ সহ্য করা খুবই কঠিন। সাঁকো পারের ভয়ে বাইরে যেতাম না। কারেন্ট নাই সুতরাং টিভি নাই। কোনো বই নাই। কোন সমবয়সী নাই। তবে আংকেল ছিল। উনি বোধহয় কিছু করতেন না। সারাদিন পত্রিকা পড়তেন আর দুপুরে আমাকে নিয়ে মাছ ধরতে যেতেন। তাও বাড়ির পেছনের পুকুরেই। পুকুরের সামনে বড়শি নিয়ে অনেকক্ষণ বসে থাকতেন তিনি। আমিও। কিন্তু কখনোই একটা মাছও ধরতেন না। বড়শি কতবার নড়ে উঠত! আর উনি দেখতাম পুকুরের ওই পাড়ে লতাপাতার দিকে তাকিয়ে আছে তো আছেই।

তারপর ঘণ্টা তিন চারেক পরে জাল ফেলতেন আর নানা রকম মাছ ধরা পড়ত তাতে। আমার আন্টি আবার পুকুরে জাল মারা একদম পছন্দ করতেন না। বড়শি দিয়ে মাছ ধরলে এলিট কাজ, বংশমর্যাদা থাকে। আর জাল দিয়ে নাকি কেবল ‘জাইল্যা’ মানে জেলেরাই মাছ ধরে। জেলে একদম নিচু বংশের লোক। সুতরাং মাছগুলো নেয়ার পর আন্টি প্রতিদিনই ঘ্যান ঘ্যান করে।

বাড়ির সামনে ছিল বিশাল বাগান। সেখান থেকে সবজি তুলে আর পুকুর থেকে মাছ তুলে রান্না আর এরপর খাওয়া আর ঘুম ছাড়া কোন কাজ ছিল না। তাই বোধহয় হুদাই আন্টি ঝাড়তো আংকেলকে। কথায় কথায় তার বংশ, স্ট্যাটাস এসব নিয়ে নানা কথা বলত। তবে এসবের উত্তরে আংকেলকে কখনো একটা শব্দও বলতে শুনি নি।

পুরো সন্ধ্যা আংকেল একটা পিড়িতে বসে পানদানিতে নিঃশব্দে পান ছেঁচতেন, যাঁতা দিয়ে সুপারি কাটতেন। এখন তো ওই পরিবেশকে স্বর্গ মনে হচ্ছে। কিন্তু তখন সত্যি অসহ্য লাগত। প্রতি সন্ধ্যায় কান্নাকাটি শুরু করতাম — আমার ভালো লাগে না। ভালো লাগে না। আন্টি কী করবে!

একদিন খবর পেল উনার প্রতিবেশীর মাসীর কী এক আত্মীয়ের বিয়ে। বলল, চল যাই বিয়েতে। কী আশ্চর্য! কেন ওই রকম ঘুরানো-প্যাঁচানো আত্মীয়ও না এমন লোকের বিয়েতে গেছিলাম কে জানে! আংকেল যাবে না। আন্টি তারে মুখ ঝামটা দিয়ে আমাকে নিয়ে রওনা হলেন।

বর্ষায় বিয়ের নৌকা, ছবিসৌজন্য. কামাল উদ্দিন

যাই হোক, বিয়েতে গেলাম লঞ্চে। ঘনঘোর বর্ষা তখন। চারিদিকে থই থই পানি। আর অনেক উঁচুতে তীর। মনে আছে আমাদেরকে দড়ি বেঁধে তীরে ওঠানো হইছিল। এরপর দীর্ঘ পথ হাঁটতে হইল। আর পথে সে কি কাদা! দূর থেকে বাজনার শব্দ কানে আসতেছিল। আর সবুজ গ্রামটাকে বৃষ্টিতে ভেজা একটা ছবির মতন লাগতেছিল।

আমি বাইরে অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছি। বরযাত্রীদের দেখা নাই। ক্রমেই সবাই বিরক্ত হতে শুরু করল। মেয়েদের মেকাপ গলে গলে পড়ছে। এদিকে সময়ের সাথে সাথে বাড়ছে বৃষ্টির তোড়জোড়। এমন সময় কে যেন খবর আনল কাদার জন্য আসতে পারছে না বরযাত্রীরা। খোদ বরের মা কাদায় পিছলা খেয়ে পড়ে গেছে! আর এদিকে সে খবর শুনে সে কী হাসাহাসি! চট্টগ্রামের ভাষায় পা পিছলে পড়াকে বলে—চচ্চড়ি খাওয়া। বিয়ে খাওয়ার আগে চচ্চড়ি কেমনে খেল হবু শাশুড়ি সেইটা নিয়ে অনেক মজার মজার কথাও হল!

কিন্তু আমি কী করি! ওখানে যে আমার কোনো পরিচিতই নাই! সুতরাং একবার দেখতে যাই বাবুর্চিরা কী রাঁধছে, আরেকবার দেখে আসি কনে কী করছে, আরেকবার দেখি কনেপক্ষের লোকজনদের সাজুগুজু। এমন সময় গরুর গাড়িতে করে বর আসতে দেখা গেল। আহা সে যে কী দৃশ্য!

প্রবল বৃষ্টি, সানাই বাজছে আর সেই সাথে কাদা পেরিয়ে হেলতে দুলতে গরুদের তালে তালে দৃশ্যমান হচ্ছে মুখে রুমাল দেয়া, কপালে সাজগোজ আঁকা বর। এদিকে হুড়োহুড়ি—গেইট তো ধরতে হবে। শেষ মুহূর্তে গেইট ধরার ফিতা পাওয়া গেল না। কেউ একজন সালোয়ারের ফিতা নিয়ে আসল। আবার দেখা গেল মেয়ে কম। শালী বেশি হইতে হবে সেইজন্য আমারে টেনে সামনে দাঁড় করানো হইল। আর আমিও একদম সামনে দাঁড়ায়ে গেলাম। যদিও কনেপক্ষ বরপক্ষ কারো সাথেই আমার কোনো পরিচয় নাই।

বর এসে দাঁড়ানো। আমরা গেইট ধরেছি। এদিকে এমন বৃষ্টি। সবার জামাজুতা ভিজে একাকার। তারপরেও টাকা না দিয়ে ঢুকতে পারবে না বর। সবচেয়ে করুণ অবস্থা তারই। পড়ে এসেছে সাদা ফিনফিনে পাজামা পাঞ্জাবি। বৃষ্টিতে ভিজে তার সর্বাঙ্গ দৃশ্যমান। এদিকে দরকষাকষি চলছে সমানে। হঠাৎ বরের দুলাভাই গেল ক্ষেপে। কারণ উনারা এই বৃষ্টির মধ্যে অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। বুঝলাম না মুহূর্তেই দুই পক্ষের তর্কাতর্কি—এরপর তুমুল ঝগড়া শুরু হল।

চিৎকার চেঁচামেচি আর ঠেলাঠেলিতে কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না। কিন্তু একটু পর কনের মা এসে অনুরোধ করল ওদের আর না ভেজাতে — লগ্ন পেরিয়ে যাচ্ছে।

বাইরে বৃষ্টির দাপট বেড়েই চলেছে। আর বিয়ে মণ্ডপে আগুন জ্বলছে। পণ্ডিত মন্ত্র পড়া শুরু করল। আর বর-কনে গড় গড় করে তার সাথে সাথে মন্ত্র পড়া শুরু করে দিল। এদিকে ওই উঠোনের আরেক পাশে খাওয়া-দাওয়া শুরু হয়ে গেছে। আমি খুব মনোযোগ দিয়ে বিয়ে দেখছি। ধূপের গন্ধ, আগুনে চন্দনকাঠ আর এদিকে সমান তালে বাজছে ঢাক-ঢোল। মাঝে মাঝে মহিলারা উলুধ্বনি দিয়ে ওঠে। তখন আমার কাছে মনে হয় কী যেন একটা সুখের ধোঁয়া আকাশের দিকে উঠে যায়।

বর্ষার বিয়ে
কনের মুখ ধরে দেখছি আমি (১৯৯৫)

আন্টি শুরু করল খাওয়ার জন্য ডাকাডাকি। কী মজা! যে চেয়ারে বসলাম তার নিচেই মাটিতে হাত ধুয়ে ফেললাম। আমার জীবনে ওই রকম ঘটনা ওই প্রথম। নিচে থক থক কাদা আর তার উপরে সাদা কাপড়ের ওপর গরম গরম পোলাও, মুরগী, রেজালা। হুমম! খেতেও মজা। আর মাংসের বড় টুকরা সন্তানদের দেওয়া নিয়ে মায়েদের কাড়াকাড়ি। খাওয়া শেষ তো বিয়ে শেষ!

আন্টি আর একটুও বসবে না। অথচ যাওয়ার তো উপায়ই নাই। বৃষ্টিতে পানি জমে গেছে। পানি নামলে এরপরই না আমরা যাব! তাই প্রতিবেশীর বাড়িগুলোতে দলে দলে অতিথিদের পাঠানো হল। আমার মনে আছে আমি যে বাড়িতে গিয়েছিলাম তাদের পুজোর ঘরের জানালায় খুব সুন্দর একটা জবাফুলের গাছ ছিল। রক্তলাল ফুলগুলো দেখতে দেখতে আন্টিকে বললাম, মানুষ কেন বর্ষাকালে বিয়ে করে? এত ঝামেলা! তার চেয়ে তো শীতকালে বিয়ে করলেই পারে!

আন্টি বলল, আরে বর্ষায় বিয়ে করলে সেই বিয়ে সুখী হয়। মানুষ তো চায় তার বিয়ের দিন একটু হলেও বৃষ্টি হোক!

আমি অবাক হয়ে বললাম, তাই নাকি?

আন্টি বলল, হুমম, আমার বিয়ের দিনেও তো অনেক বৃষ্টি ছিল!

আমি মনে মনে হেসে ফেললাম। এরপর খুব সম্ভবত আন্টির কোলেই আমি ঘুমিয়ে গেছিলাম। কারণ ওইখান থেকে ফেরার কোনো স্মৃতিই আমার মনে পড়ে না।

মনে পড়ে পরদিন সকালে ঘুম ভাঙার কথা। চোখ খুলে দেখি আংকেল পান পেষার ওই দানিতে তুলসি পাতা ছেঁচছেন। আর সেই মাছ ধরার সময়ের মতই অর্থহীন চোখে সামনের দিকে তাকিয়ে আছেন। কবেই ভর্তা হয়ে গেছে তুলসী পাতাগুলো! উনি একবার সেইদিকে খেয়ালও করলেন না। আন্টি এসে রামধমক দিলেন, ওইগুলার কি বাপ বাইর করে ছাড়বা? দাও ওরে খেতে।

আমি বললাম, কী হইছে? সাথে সাথে মুখে থার্মোমিটার। জ্বর তখন একশ চার।

টিনের চালে তখনও তুমুল ঝমঝমাঝম শব্দ। কালকে না বিয়েতে গেছিলাম! জ্বরের ঘোরে কিছুটা মনে পড়ে, আবার কিছুটা পড়ে না। বিয়েটা কি স্বপ্ন, না সত্যি ছিল কে জানে!