লেখালেখির অভ্যাসটা প্রায় হারিয়ে গেছে বললেও চলে। যারা নিয়মিত লেখে তাদের প্রতি সহজাত বিরক্তির কারণেও হতে পারে।

২০১০ সালের দিকে টাকা জমাইয়া আর এক বন্ধুর দেয়া উপহারের টাকায় একটা ক্যামেরা কিনিয়া বেশ ছবি তোলা শুরু করেছিলাম। ঝোঁকের বসে শুধু ছবি তোলার জন্য নানা জায়গা ঘুরতে যাওয়া হত। ২০১১ সালের দিকে ব্যাঙের ছাতার মত ফটোগ্রাফার গজাইল আর আমি ‘হিংসিত’ হইয়া ভাবলাম, সব লোকে যেই স্রোতে গা ভাসায় সেই দিকে গিয়া আমার কাজ কী?

লেখালেখিও ২০০৯ এর পরে তাই বন্ধ প্রায়।

ফেইসবুক স্ট্যাটাসকে লেখা বলাটা গুনাহের শামিল বলা যাইতে পারে। ২ দিন ধরে তথ্যবহুল লেখা তৈরি করার চেষ্টা করে মোটামুটি হাল ছেড়ে দিয়ে ভাবলাম তথ্যবহুল লেখা পরের কোনো সময়ের জন্য তুলে রাখা যাক, অগোছালো এলোমেলো যেমনটা সব সময় লিখে আসছি তেমনটাই লিখি।

প্রবাসজীবনের বাস্তবতা নিয়া লেখা যাইতে পারে, ২ লাইন লিখে ১ লাইন ডিলিট করি।

আচ্ছা একটা কৌতুক দিয়া শুরু হোক। গ্রাম্য অশ্রাব্য কৌতুক। যা ভদ্র সমাজে বলা হইলে ক্লাসি রমণীরা আঁচলে মুখ চাপিয়া হাসে আর ছেলেবন্ধুর গায়ে ধুম করিয়া কিল দিয়া বলে, “যাহ অসভ্য!”

ঘটনা হইল এই রকম। একবার এক ভদ্রলোক বিবাহ করবেন বলিয়া সিদ্ধান্ত লইলেন। তারপর দেখিলেন চারিদিকে সমাজের অবক্ষয়। শহুরে মেয়েরা কেউ সতীত্ব ধরিয়া রাখিতে পারিতেছে না। তাই দেখিয়া তিনি ভাবিলেন বিবাহের কাজটা উনি গেরামে গিয়া সম্পন্ন করবেন। সব দেখিয়া শুনিয়া উনি কইন্যা বিবাহ করিয়া পালকি করিয়া শহরের দিকে রওনা করলেন।

গ্রামের বালিকা বড্ড সরল। যাহাই দেখে আগ্রহ নিয়া প্রশ্ন করে, “আহা এইটা কী?” “এইটার এই রূপ কেন?” “এই বস্তুর কাজ কী?”

এই সকল প্রশ্ন শুনিয়া ভদ্রলোক মনে মনে মুচকি হাসিয়া ভাবেন সিদ্ধান্ত উপযুক্ত হইয়াছে বটে। মেয়ে বিয়ে করেছেন খাসা। কোনো ভাবেই ‘অসতী’ হইবার সম্ভাবনা নাই।

যাই হউক, মাঝপথে একদল বারবণিতা এবং নিশিকন্যা চড়া রঙের লিপস্টিক আর সুগন্ধী মেখে পাশ দিয়া হাঁটিয়া যাচ্ছিল। কন্যা আগ্রহ ভরিয়া প্রশ্ন করিল, “ইনারা এই রূপ রঙ মাখিয়াছেন কেন?” ভদ্রলোক থতমত খাইয়া বললেন, “ওইদিকে নজর দিয়ো না, ওরা খারাপ মেয়ে। ইনারা টাকার বিনিময়ে খদ্দেরের সাথে রাত্রিতে এক বিছানায় কাটায়।”

উত্তর শুনিয়া বালিকা চোখ কপালে তুলিয়া বলিলো, “তাই কি হয়? তাড়াতাড়ি পাল্কি ঘুরান, এইরূপ হইলে তো আমি আমগোর গেরামের কামাল ভাইয়ের কাছে কত্ত টাকা পাই। সেই টাকা উদ্ধার না করিয়া আমি কিছুতেই শহরে যাইব না!”

নাহ, আমি বহুল বিতর্কিত নারীর সতীত্বের সতীচ্ছেদ করিতে বসি নাই। সারাদিন খাটা-খাটুনি করে এসে জ্ঞানগর্ভ কিংবা সমস্যার আলোকপাত নিয়া কিছু লেখার রুচি হয় না। চারিদিকে মানুষ যা নিয়া লেখে তাই নিয়া লেখার চেষ্টা করা যাইতে পারে। যা লিখবো তা হইবে চর্বিত চর্বণ। যা বলা হইয়া গেছে তাহাই ইনাইয়া-বিনাইয়া বলা। কিছু শস্তা সারকাজম আর কুতর্ক করা।

আশেপাশে ব্যাঙের ছাতার মত লেখক গজাইতেছে, সবাই সমস্যা লইয়া সোচ্চার, এত অ্যাক্টিভিজম সত্ত্বেও কাজের কাজ কিছু হইতেছে না। এত লেখকের অসুবিধা হইলো:

১) সবাই লেখক হইবার কারণে পাঠক কেউ হইতেছে না। যারা পড়ে তারাও চোখ বুলায় শুধু কোন দৃষ্টিকোণ থেকে কোন মন্তব্য বলা যায় সেইটা বুঝবার জন্য। কিছু পাঠক নাই এমনটা না, কিন্তু পাঠকের সমালোচক হইবার প্রবণতা অধিক কিংবা বিনা বাক্যে অন্ধ সমর্থক হইয়া যায়।

২) ছেলেমেয়েরা ভার্চুয়াল আর রিয়েল লাইফের তফাৎ ধরতে পারতেছে না। লিখিতভাবে এক্সট্রোভার্ট হইলেও আদতে তারা ইন্ট্রোভার্ট হয়ে পড়তেছে। লিখিত এক্সপ্রেশন মানুষজনকে আদত ইন্ট্রোভার্ট করে ফেলে।

৩) লিখে নিজেকে “হনু” প্রমাণের চেষ্টার মাঝেই সবাই আটকে যাচ্ছে। সত্যিকার “হনু” হবার আকাঙ্ক্ষা লোপ পাইতেছে।

৪) সবচাইতে বড় অপকার বলিয়া যেইটা চোখে পড়ে তা হইলো মধ্যবিত্তদের দুঃখ-বিলাসিতা। আমি একবেলা রিকশাওলার সাথে চা খাইছি! এইটা নিয়া দুঃখ-বিলাসিতা করিয়া দুরন্তর গল্প ফাঁদিয়া বাহবা পাইবার বাসনাটা ঠিক ‘সুস্থ’ না। কিংবা আমি বাল্যকলে অর্থকষ্টে ভুগছি—এইখানে দুঃখ বিলাসিতা নাই। বাংলাদেশে খুব উচ্চবিত্তের ঘর ছাড়া খুব কম ছেলেমেয়েই অর্থকষ্টের মুখ দেখা ছাড়া বড় হয়। বিল গেটসের একটা উক্তি বেশ পছন্দ হয়: “If you are born poor it’s not your mistake, But if you die poor it’s your mistake.” দুঃখ-বিলাসিতা করিয়া গরিবি উপভোগ করা অবশ্যই সমস্যা তৈরি করবে। দুঃখ-বিলাসিতা এই প্রজন্মকে অলসতা বাদে কিছু দিবে না।

এত কথা বলার পরেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শো অফ নামের ব্যাপারটা থেকেই যায়। ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজেও এর বাইরে নই। কিন্তু তার প্রভাব বাস্তবজীবনকে যেন ক্ষতিগ্রস্ত না করে ফেলে সেই দিকে একটু খেয়াল করা যাইতে পারে। লেখাতে উপদেশ কিংবা সমালোচনা অধিক হচ্ছে কি? হউক বা, কী আসে যায়?

লেখালেখিতে আমিও কী হনু ভাব নিয়া আসতেছি? তাও হইতে পারে। আজকাল লেখককুলের বড় সমস্যা উহারা যদি বলেন আমি পাঠকের জন্য লিখি না নিজের জন্য নিজের মত লিখি তাহা হইলে তাহাকে বলা হইবে বেটা সেলফিশ। ‘খাইলে খা না খাইলে যা’ মনোভাব নিয়া লিখিয়া আপনি আগাইতে পারবেন না। কিন্তু আপনি যদি পাঠকের মন রক্ষার জন্য লেখেন তা হইলে আপনি বাজারি। এই দুই ফাঁদে পড়িয়া লেখক-জাতি সমস্যায় পড়ে গেছে।

তাই লেখালেখির দুরূহ কাজ থেকে সরে গিয়ে সবাই ‘ব্লগ’ লেখে। কেউ আর কবিতার খাতা মুড়ে কবিতা লেখে না। ল্যাপটপে খটাখট কি বোর্ডের ঝড়। এর মাঝে কি কিছু প্রকৃত লেখক তাদের সত্তা হারাইয়া ফেলতেছে?

তেমনটাই মনে হয়।

এক কথা থেকে আরেক কথায় গিয়ে মনে হয় বড্ড এলোমেলো লিখে ফেললাম। আসল কথা হইল, লেখক জাতির সংরক্ষণ দরকার মনে হয়। সব লেখকের রাজনৈতিক হবার বাসনাও বন্ধ করা দরকার।

অভিমত প্রকাশ এবং লেখার চরম শক্তিটার বড় বাজে ব্যবহার হয় আজকাল। সেলফ ক্ল্যারিফিকেশন করা সম্ভব হলে ভালো হইত। সবাই টাকার বিনিময়ে খদ্দেরের বিছানায় যাইতেছে কিন্তু কেউ নিজের ক্ষুধাটা স্বীকার করতেছে না। লেখক জাতিরও এই খদ্দের কিংবা ভিকটিম হইবার চেষ্টাটা বন্ধ করিয়া নিজে যা তা স্বীকার করিয়া নিলে সবার জন্য সুবিধা হইবে।