জার্মানিতে জন্মগ্রহণকারী ইহুদি বংশোদ্ভূত মার্কিন ডিপ্লম্যাট হেনরি কিসিনজারকে পলিটিক্যাল সায়েন্টিস্ট ধরা হয়। তার বয়স এখন ৯১। এ বছর, ২০১৪ সালের,  ৪ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয় হেনরি কিসিনজারের বই ওয়ার্ল্ড অর্ডার। এই বই নিয়ে ওই দিনই আমেরিকার পত্রিকা ওয়াশিংটন পোস্টে একটি রিভিউ প্রকাশিত হয় আমেরিকার সাবেক সেক্রেটারি অব স্টেট হিলারি রডহ্যাম ক্লিনটনের। এখানে সে রিভিউর পূর্ণ অনুবাদ থাকছে।

উল্লেখ্য ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তৎকালীন যুক্তরাষ্ট্র সরকার কিসিনজারের বুদ্ধিতে পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করেছিল।

হিলারি রডহ্যাম ক্লিনটন

আমরা আমেরিকানরা বর্তমান বিশ্বের দিকে যখন তাকাই, তখন একের পর এক সমস্যা দেখতে পাই। যেমন ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন, ইরাক এবং সিরিয়ার চরম সংঘাতময় পরিস্থিতি, পশ্চিম আফ্রিকার ভয়াবহ মহামারী, পূর্ব ও দক্ষিণ চীনে আঞ্চলিক উত্তেজনা বৃদ্ধি, গ্লোবাল অর্থনীতি যা এখনো পর্যন্ত যথেষ্ট প্রবৃদ্ধি বা সমৃদ্ধি’র বণ্টন দেখাতে পারে নি, ইত্যাদি। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে আমেরিকা যে উদার আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা তৈরি করার জন্য কাজ করছে এবং সেটা রক্ষার জন্যও যা করেছে তা চারদিক থেকেই চাপে রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। তাই এটা অবাক হওয়ার না যে বহু আমেরিকানই বিশ্বে আমাদের বর্তমান ভূমিকা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চিত, এমনকি তারা ভয়ও পাচ্ছে।

হেনরি কিসিনজার [প্রচলিত বাংলা বানানে কিসিঞ্জার – বি.স.] তার নতুন বই ওয়ার্ল্ড অর্ডার-এ, এই চ্যালেনজের ঐতিহাসিক লক্ষ্য ব্যাখ্যা করেছেন। কিছু সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপের ব্যাপারে পার্থক্য থাকলেও, তার বিশ্লেষণ, একবিংশ শতাব্দীতে নিরাপত্তা ও সহযোগিতার গ্লোবাল কাঠামো নির্মাণের জন্য গত ছয় বছরে ওবামা প্রশাসনের প্রচেষ্টার পেছনে যে বিশাল কৌশল রয়েছে তার সাথে, অনেকাংশেই খাপ খায়।

শীতল যুদ্ধের সময় মুক্তচিন্তা, বাজার অর্থনীতি ও পারস্পরিক সহযোগিতার প্রতি একনিষ্ঠ জাতিগোষ্ঠীসমূহকে সুরক্ষা ও প্রসারিত করতে আমেরিকার যে দ্বিপক্ষীয় প্রতিশ্রুতি তা আমাদের ও বাকি পৃথিবীর জন্য ফলপ্রসূ প্রমাণিত হয়েছিল। কিসিনজারের ভিশনের সারকথা এখানে প্রাসঙ্গিক শোনায়: ‘‘এটা রাষ্ট্রগুলির সহযোগিতাপূর্ণ এমন একটি অপ্রতিরোধ্য সম্প্রসারণশীল অর্ডার যেখানে রাষ্ট্রগুলি একই নিয়ম ও রীতি মেনে চলে। সেখানে মুক্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সমাদৃত হয়। তারা আঞ্চলিক প্রভুত্ব স্থাপনের চেষ্টা ত্যাগ করে, জাতিগত সার্বভৈৗমত্বে  শ্রদ্ধাশীল থাকে। এবং গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণমূলক শাসন ব্যবস্থা বজায় রাখে।’’

আমেরিকার সেনাবাহিনী ও কূটনৈতিক শক্তি এবং সমমনা জোট শক্তির মাধ্যমে যে সিস্টেমে এগিয়েছে, তা ফ্যাসিজম ও কম্যুনিজমকে পরাজিত করতে আমাদের সহায়তা করেছে। যার ফলে আমেরিকা ও আরো কোটি কোটি মানুষের জন্য তা প্রচুর মুনাফা নিয়ে এসেছে। তারপরও, সারা বিশ্বের অনেক লোক—বিশেষত লাখো তরুণ—এই সাফল্যের গল্পগুলি জানে না। তাই এটা আমাদের দায়িত্বে পরিণত হয়েছে তাদেরকে দেখানো, এবং সাথে সাথে বলা যে আমেরিকান নেতৃত্ব দেখতে কেমন।

বিশেষত এটা আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে যখন তা নিয়ে অনেকেই বিস্মিত হয়ে ভাবছেন। যেমন কিসিনজার বলেছেন, ‘আমরা কি এমন একটা সময়ের মুখোমুখি যেখানে ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণের বাইরের কোনো শক্তি ভবিষ্যৎ নির্মাণ করছে?’

আমার কাছে এটা খুবই স্বাভাবিক প্রশ্ন। ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে যখন স্টেট ডিপার্টমেন্টে যোগ দিলাম তখন সবাই জানতো এটা চরম-হতবুদ্ধিকর পরিবর্তনের সময়। কিন্তু সেই পরিবর্তনগুলি আসলে কী বোঝায় এ ব্যাপারে কেউ একমত হতে পারছিলেন না। অর্থনৈতিক সংকট কি সহযোগিতার নতুন কোন রূপ বয়ে নিয়ে আসবে নাকি আত্মরক্ষাবাদ ও অনৈক্যকে ফিরিয়ে আনবে? নতুন প্রযুক্তি কি নেতৃবৃন্দকে দায়িত্বশীল রাখতে নাগরিকদের সহায়তা করবে, নাকি স্বৈরশাসককে বিরোধিতাকারীদের ওপর নজর রাখার টুল হিসেবে কাজ করবে? চায়না, ইন্ডিয়া বা ব্রাজিলের মত অগ্রগামী শক্তিগুলি বৈশ্বিক সমস্যার ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হবে নাকি অনিষ্টকারী হিসেবে?

অ-রাজনৈতিক নায়কদের ক্রমবর্ধমান প্রভাব কি টেরোরিস্ট ও অপরাধী চক্রের হুমকি দিয়ে বেশি নির্ধারিত হবে, নাকি সাহসী এনজিওর অবদান দিয়ে? ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক পারস্পরিক-নির্ভরতা কি সংহতির নতুন ধারণার জন্ম দেবে নাকি তা নতুন দ্বন্দ্বের উৎস হবে?

২০০৯ এর ডিসেম্বরের নোবেল লেকচারে প্রেসিডেন্ট ওবামা, মাথার ওপর চেপে বসা এই চ্যালেনজটি নিয়ে বুঝিয়ে বলেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের সময় নিয়ে তিনি বলেন, ‘বিশ্বে শান্তি টিকিয়ে রাখার একটা কাঠামো নির্মাণে আমেরিকা নেতৃত্ব দিয়েছে এবং এখন এই শতাব্দীর প্রথম দশকেই এই প্রাচীন নকশা নতুন নতুন হুমকির ভারে আটকা পড়ছে।’

ক্রমবর্ধমান পারস্পরিক-নির্ভরতার এই যুগের চাহিদা পূরণে পুনরায় গ্লোবাল অর্ডারের চিন্তা করায় এবং তা আরো শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্টকে সহায়তা করতে পেরে আমি গর্বিত। প্রেসিডেন্টের প্রথম মেয়াদে আমরা গ্লোবাল অর্ডারের ভিত্তিটি দাঁড় করিয়েছিলাম। জোড়া লাগিয়ে চালানো একটি ঐক্যজোট থেকে একে আপডেটেড আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছি আমরা। যাতে, তা চ্যালেনজের র মুখে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারে, যেমন ইরানের নিউক্লিয়ার প্রোগ্রাম ও ওসামা বিন লাদেনের হুমকির মতো বিষয়।

দ্বিতীয় মেয়াদে, সঙ্কটের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল এর প্রজন্মব্যাপী দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্প। যুক্তরাষ্ট্র এবং মিত্রদের কাছে এই প্রকল্প অনাগত বছরের জন্যে একই ঐকান্তিক প্রচেষ্টা দাবি করে। কিসিনজার লিখেছেন, বৈদেশিক নীতি ‘শুরু ও শেষ নির্ধারিত কোনো গল্পের মত নয়’ বরং ‘চিরন্তন সমস্যাগুলি নিয়ন্ত্রণে ও আয়ত্ত্বে নিয়ে আসার একটি চলমান প্রক্রিয়া।’ এটা জন এফ কেনেডির কথা মনে করিয়ে দেয়। কেনেডির পর্যবেক্ষণ হলো, শান্তি ও প্রগতি ‘মানব প্রকৃতির কোনো হঠাৎ বিপ্লবের ফল নয় বরং মানব প্রতিষ্ঠানগুলির একটি ধারাবাহিক বিবর্তন থেকে আসে… একটি প্রক্রিয়ায়—যা সমস্যা সমাধানের উপায়।’

আমেরিকানরা, সর্বোচ্চ পর্যায়ে সমস্যা-সমাধানকারী একটি জাতি। গ্লোবাল অর্ডার ধরে রাখতে এবং এর সংস্কার করতে এর ধারাবাহিক দায়বদ্ধতাই নির্ধারণ করবে একটি শান্তি, সমৃদ্ধি ও উন্নয়নশীল ভবিষ্যৎ আমরা নির্মাণ করতে পারবো কিনা। যেখানে সব জায়গার মানুষের স্রষ্টা-প্রদত্ত সামর্থ্য অনুযায়ী বেঁচে থাকার সুযোগ থাকবে।

ওয়ার্ল্ড অর্ডার বইয়ের বেশিরভাগ জুড়েই এই চ্যালেনজ দেখানোর চেষ্টা আছে। ব্যাপ্তি এবং তীক্ষ্ণতার মিশেলে, আর সাথে সাথে হেডলাইন এবং ট্রেন্ড-লাইনকে, এক্ষেত্রে অনেক লম্বা ট্রেন্ড-লাইনে, যুক্ত করায় দক্ষতা দেখিয়েছেন বর্ষীয়ান কিসিনজার। ওয়েস্টফেলিয়া শান্তিচুক্তি থেকে বর্তমানের মাইক্রোপ্রসেসিং, সান জু থেকে ট্যালিরন্ড থেকে টুইটার তার বিচরণক্ষেত্র। ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গিকে তিনি খুঁজেছেন প্রাচীন হিন্দু মহাকাব্যের অবস্থানে; মুসলিম দৃষ্টিভঙ্গিকে মোহাম্মদের ‘ইসলাম প্রচারে’; ইউরোপীয়দের দৃষ্টিভঙ্গিকে ‘ত্রিশ বছরের যুদ্ধকালীন ধ্বংসযজ্ঞে’ (বর্তমান মধ্যপ্রাচ্যের অবস্থার সাথে যার তুলনা চলে আসে); এবং রাশিয়ার দৃষ্টিভঙ্গিকে ‘বিরাণভূমির কঠিন শিক্ষায়, যেখানে নোম্যাডিক যাযাবররা সম্পদের জন্য লড়াই করতো খোলা ও বিস্তৃত প্রান্তরে, যার সীমারেখার খুব অল্পই নির্দিষ্ট।’ এই বিস্তৃত দৃষ্টিভঙ্গি, “কীভাবে নানান ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা এবং মূল্যবোধকে একটা সর্বজনীন অর্ডারে অন্তর্ভুক্ত করবে”—এ ধরনের প্রশ্নের জন্ম দিলেও, ভ্লাদিমির পুতিনের আগ্রাসী মনোভাব থেকে নিয়ে ইরানের দরকষাকষি কৌশল পর্যন্ত বুঝতে আমাদের সাহায্য করে।

আজকের চ্যালেনজিং পরিস্থিতিতে, বিশেষত এশিয়া প্যাসিফিক এবং মিডেল ইস্ট নিয়ে, কিসিনজারের বিশ্লেষণ তাই খুবই মূল্যবান।

এশিয়া অঞ্চলের ক্রমবর্ধমান শক্তির বিষয়ে, যার মধ্যে চায়নাও অন্তর্ভুক্ত, তিনি খেয়াল করেন, আঞ্চলিক এবং গ্লোবাল অর্ডার বিষয়ে তাদের নিজ নিজ লক্ষ্য রয়েছে। আর এই অবস্থান তাদের ইতিহাস এবং বর্তমান পরিস্থিতি দিয়ে তৈরি। এত বৈচিত্র্যপূর্ণ লক্ষ্য সামাল দিয়ে—কীভাবে চায়নার সাথে সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা যায় এবং সাথে সাথে আমাদের অন্য সম্পর্ক, স্বার্থ, এবং মূল্যবোধ টিকিয়ে রেখে একটি স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধ অঞ্চলে এগিয়ে যাবো—এসবই ঠিক করবে আমরা বড় মাপের বৈশ্বিক চ্যালেনজ মোকাবিলা করতে পারব কিনা।

এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের জন্য তৈরি করা কৌশলের কথা হার্ড চয়েসেস বইতে আমি বিশদ বলেছি। আমি এবং প্রেসিডেন্ট ওবামা মিলেই কৌশলগুলি ডেভেলপ করেছি। এর মূল ভিত্তি ছিল আমাদের ঐতিহ্যগত জোটকে আরো জোরদার করা। বিভিন্ন আঞ্চলিক সংগঠনের বর্ণানুক্রমিক মিশ্রণ, যেমন ‘আসিয়ান’ (অ্যাসোসিয়েশন অব সাউদ-ইস্ট এশিয়ান নেশানস) এবং ‘অ্যাপেক’ (এশিয়া-প্যাসিফিক ইকোনোমিক কো-অপারেশন) ইত্যাদির মধ্যে সমন্বয় সাধন এবং উন্নয়ন, এবং চায়নার সাথে আরো ব্যাপকভাবে যুক্ত হওয়া—দ্বিপক্ষীয় আর বহুপক্ষীয়, দু’ভাবেই। দ্বিপক্ষীয়ভাবে, নতুন মাধ্যমে যেমন কৌশলগত এবং অর্থনৈতিক সংলাপের মধ্য দিয়ে; আর বহুপক্ষীয়ভাবে, যেমন, আঞ্চলিক চাপ দেয়াতে যা গঠনমূলক আচরণ করায় আরো উৎসাহিত করবে এবং সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ব্যাপারে, যেমন, পরিবহনের স্বাধীনতা থেকে শুরু করে আবহাওয়া পরিবর্তন, বাণিজ্য, মানবাধিকার ইত্যাদি বিষয়ের ফয়সালায় যুক্ত হওয়া। আমাদের ‘পিভট টু এশিয়া’ নামের প্রকল্পের মূল লক্ষ্য হল এমন একটি নিয়ন্ত্রিত অর্ডার প্রতিষ্ঠা করা যেন নতুন শক্তির শান্তিপূর্ণ উত্থান ঘটতে পারে, এবং সাথে সাথে বিশ্বজনীন নিয়ম এবং মূল্যবোধগুলিও তুলে ধরা যায়।

এই ধরনের পদ্ধতিগত, বহুপাক্ষিক কূটনীতি, মাঝে মাঝে খুব সময়সাপেক্ষ এবং হতাশা সৃষ্টি করে। আর এটা কখনোই খুব বেশি আলোচিত কিংবা খবরের শিরোনাম হয় না তবুও এটা ভবিষ্যতের লভ্যাংশ, যা লাখো মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করতে পারে। কার্যকরী আঞ্চলিক শৃঙ্খলা ছাড়া চ্যালেনজ আসলে বাড়তেই থাকে। শুধুমাত্র মধ্যপ্রাচ্যের দিকে তাকালেই এটা বোঝা যায়। কিসিনজারের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, “আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা বজায় রাখা ‘আর কোথাও’ এতটা জটিল নয়। এই অর্থে যে, অর্ডার গঠন করা এবং এর উপযুক্ততা নিশ্চিত করে শান্তি ও স্থিতিশীলতা নির্বিঘ্ন রাখার ক্ষেত্রে বাকি দুনিয়ার আর কোথাও এত জটিলতা নেই।”

কিসিনজার আমার বন্ধু। সেক্রেটারি অফ স্টেট হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তার পরামর্শের ওপর আমি নির্ভর করেছি। তিনি নিয়মিত আমার সাথে দেখা করতেন। এবং বিদেশী নেতাদের ব্যাপারে তার তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ শেয়ার করতেন, আর তার সফরগুলির লিখিত রিপোর্ট আমাকে পাঠাতেন। যদিও আমরা অনেক সময়ই সম্পূর্ণ পৃথক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্ব ও এর কিছু চ্যালেনজকে দেখেছি, এবং ভিন্ন মত দিয়েছি—বর্তমানে এবং অতীতেও—তবুও যা এই বইতে পরিষ্কারভাবে এসেছে তা হচ্ছে এই দৃঢ় বিশ্বাস যেটা আমরা এবং প্রেসিডেন্ট ওবামা শেয়ার করি: ন্যায্য এবং উদার অর্ডারের দায়িত্ব পালনে আমেরিকার নেতৃত্বের অপরিহার্যতায় বিশ্বাস।

সত্যিকার অর্থে বললে এছাড়া আর কোন টেকসই বিকল্পই নেই। আর কোন জাতিই আজকে বিশ্বের জটিল সব হুমকি মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় ঐক্য এবং সামর্থ্যের যোগান দিতে পারে না। কিন্তু এই নেতৃত্ব কোন জন্মগত অধিকার নয়, প্রতিটি প্রজন্মেই এটা দৃঢ় সংকল্প এবং বিনয় দিয়েই অর্জন করতে হয়।

সৌভাগ্যক্রমে, একুশ শতকে নেতৃত্ব দেয়ার মত অনন্য অবস্থানে রয়েছে আমেরিকা। টিকে থাকার মত সামরিক বাহিনীর শক্তি বা অর্থনীতির স্থিতিস্থাপকতা এই দুটিই এক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও এ-ই একমাত্র কারণ নয়। এর কারণ আরও গভীরে। যে জিনিসগুলি নির্মাণ করে জাতি হিসাবে আমরা প্রতিষ্ঠিত—তা হল আমাদের বৈচিত্র্যপূর্ণ ও স্বাধীন সমাজ, মানবাধিকারে নিষ্ঠা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ। এগুলি আজকে এমন এক অবস্থানে এনেছে যা জাতি হিসেবে আমাদেরকে একক সুবিধা দিচ্ছে ভবিষ্যত নির্মাণে—যেখানে মুক্তি এবং সহযোগিতার শক্তি প্রভাব বিস্তার করবে বিভাজন, স্বৈরতন্ত্র আর ধ্বংসাত্মক শক্তিগুলির উপরে।

এটা শুধুই আদর্শবাদ নয়। আন্তর্জাতিক অর্ডার বজায় রাখা ও স্থায়ী করাতে কিসিনজার অবশ্য মত দেন—এটাকে অবশ্যই ‘ক্ষমতার বৈধতা’র সাথে সম্পৃক্ত হতে হবে। নামকরা বাস্তববাদী কিসিনজার, শেষ পর্যন্ত, দারুণ ভাবে আদর্শকে প্রাধান্য দেন। এমনকি যেখানে আমাদের মূল্যবোধ এবং অন্যান্য উদ্দেশ্যের মধ্যে টানাপোড়েন রয়েছে সেখানেও আমেরিকা, তিনি মনে করিয়ে দেন, আমাদের মূল্যবোধ রক্ষার্থে সফল হয়। সমস্যা এড়িয়ে না গিয়ে, সরকার একা চেষ্টা করার পরিবর্তে যারা বৈধতার উৎস সেই জনগণ এবং সমাজকে সম্পৃক্ত করে নেতৃত্ব দেয়ার মাধ্যমেই বরং এই সফলতা অর্জন করেছিল তারা। আমাদের ‘শক্তি’ যদি ক্ষমতার ভারসাম্যকে নিরাপদে রাখায় সহায়তা করে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে মজবুত রাখে, সেখানে আমাদের ‘মূল্যবোধ’ এবং ‘আদর্শ’ই বাকিদের কাছে সেই ব্যবস্থাকে গ্রহণযোগ্য ও আকর্ষণীয় করে তোলে।

সুতরাং আমাদের ‘নেতৃত্বের সামর্থ্য’ শুধুমাত্র আমাদের সামরিক কাঠামো শক্তিশালী করাতে ও কূটনীতি সক্রিয় রাখার জন্যই নয়। মানবাধিকারের জন্য সোচ্চার হতে, নারী ও মেয়েদের অধিকার ও অবদানকে অগ্রসর করতে, উঠতি সুশীল সমাজের জন্য স্থান তৈরি করতে, এবং মহৎ উন্নয়নের প্রয়োজনীয় শর্তও তৈরি করে তারা।

রাষ্ট্রের সেক্রেটারি হিসেবে এই কৌশলগত যুক্তিই আমার তরফে সকল পররাষ্ট্রনীতি ব্যবহারে প্রভাব রেখেছে, যদিও কখনো কখনো তা নরম-নীতি বিবেচিত হয়ে ধোপে টেকে নি। আমি একে বলি ‘স্মার্ট পাওয়ার’ এবং এখনও বিশ্বাস করি আমেরিকার নেতৃত্বকে যুগের পর যুগে টিকিয়ে রাখতে এটি একটি ব্লু-প্রিন্ট হিসেবে কাজ করবে। আমাদের সামর্থ্য দিয়েই খেলতে হবে আমাদের। এবং এমন এক যুগে যেখানে বৈধতা অর্থাৎ লেজিটিমেসি ধার্য হচ্ছে নিচ থেকে উপরের দিকে, উপর থেকে নিচে নয়। এক্ষেত্রে আমেরিকা বেশি স্বৈরতান্ত্রিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের চেয়ে অনেক ভাল অবস্থানে রয়েছে।

কিসিনজার নিজেও এটা চিহ্নিত করেছেন। তিনি বুঝতে পেরেছেন তার দায়িত্বকালীন সময়ের চেয়ে পৃথিবী কতটা বদলে গেছে। বিশেষত ক্ষমতা ছড়িয়ে যাওয়া এবং জাতীয় সরকারের বাইরের শক্তিগুলির ক্রমবর্ধমান প্রভাব বিস্তারের বিষয়টি। আন্তর্জাতিক সমস্যা এবং এর সমাধানগুলি, ভাল-মন্দ উভয় রকমেই, বেসরকারী সংস্থা, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান এবং পৃথক পৃথক নাগরিককে কেন্দ্র করে বেড়ে চলেছে।

ফলে, এখন, পররাষ্ট্রনীতি যতখানি রাষ্ট্রের ঠিক ততটাই জনগণের। কিসিনজার ঠিকই ধরেছিলেন, এই পরিবর্তন অতীতের চেয়ে অনেক বেশি প্রশস্ত এবং গভীর শৃঙ্খলার দাবি রাখে। তিনি লিখেছেন, ‘ওয়ার্ল্ড অর্ডারের যে কোন সিস্টেম টেকসই হতে গেলে তা শুধুমাত্র নেতা নয়, নাগরিকদের দ্বারাও সমানভাবে গৃহীত হওয়া আবশ্যক।’

দেশ ও দেশের বাইরে, দু’ ক্ষেত্রেই এটা সত্য। আমাদের রাষ্ট্র এর অবস্থার শীর্ষে ওঠে এবং আমাদের নেতৃত্ব সারাবিশ্বে সবচেয়ে শক্তিশালী হয়ে ওঠে যখন সাধারণ উদ্দেশ্যে আমরা একত্রিত হই এবং কর্তব্য ভাগ করে নিই এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও পারস্পরিক উন্নয়নে অগ্রসর হই। আমেরিকার এই অবস্থান টিকে থাকা নির্ভর করে আমাদের সব জনগণের জন্য আমেরিকার স্বপ্ন পুনরায় জাগিয়ে তোলার ওপর।

অতীতে, আমরা পৃথক থাকা ও সরে আসার নীতিতেই মগ্ন ছিলাম, কিন্তু সর্বোচ্চ প্রয়োজনে সবসময়ই নেতৃত্বের আহবানে সাড়া দিয়েছি। সময় এসেছে, বিশ্বের কাছে আমেরিকা কী আর আমেরিকার কাছে বিশ্ব কী, সেই বড় তর্কটি ফয়সালা করে নেয়ার। একসাথে বসে একটি আন্তরিক আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে আমাদের সবার। বিশ্বনেতৃত্বে বাজেট ও অত্যাবশ্যকীয় করণীয় সম্পর্কে এবং একই সাথে আমাদের দেশকে নিরাপদ আর শক্তিশালী রাখতে সত্যিকার অর্থে ঠিক কী কী দরকার, তার জন্য এ আলোচনার প্রয়োজন।

আমাদের কথা বলার অনেক কিছু আছে। অনেক সময় আমরা হয়তো ঐক্যমতে আসব না। কিন্তু সবকিছু নিয়ে এটাই গণতন্ত্র। ২১ শতকের সংকট মোকাবিলায় এবং প্রতিশ্রুতি পূরণের জন্য, আমাদের রাজনৈতিক ঐক্য পুনর্নির্মাণে সক্ষম হতে হলে একটি সত্যিকার জাতীয় সংলাপই এর একমাত্র উপায়। এটা কেন করতে হবে এবং কীভাবে এর সফলতা আসবে তার একটা আশু চিত্র তৈরি করেছে হেনরি কিসিনজারের বইটি।