লালনের নাম যে লালন সেটা কাকতাল হবারই কথা। মানে একদা আপনারা সকল শিক্ষিত, রুচিশীল, সাংস্কৃতিক-মনস্ক, শিল্পবোদ্ধা, শিল্পপতি, কর্পোরেট গোষ্ঠী, আন্তর্জাতিক স্মাগলার সবাই মিলে যে লালনকে এই হারে প্রতিপালন বা লালনপালন করবেন সেসব আগাম আন্দাজ করে নিশ্চয়ই তাঁর নাম লালন রাখা হয় নাই। তাছাড়া এই নাম লালনের পিতামাতা দিয়েছেন বলেও জানা যায় না। তাঁর ভক্তরা দিয়েছেন, নাকি তাঁর গুরুজি দিয়েছেন, নাকি মাবাবা বা নানানানি দিয়েছেন তা আবিষ্কার করার জন্য আমাদের মেলা মেলা ইতিহাসবিদের কাছে যেতে হবে। কেবল গেলেও হবে না; সেসব ইতিহাসবিদ যা আবিষ্কার বাতলাবেন তা নিয়ে পরের বছরগুলোতে মেলা মেলা ঝগড়াঝাঁটিও হবে। লালন লোক ছিলেন, তাঁর নিজের লোকজন ছিল। তারপরও তিনি ফোক সম্বন্ধে বিশেষ ওয়াকিবহাল ছিলেন বলে জানা যায় না। না থাকারই কথা।

ফোকলোর বলে একটা বিদ্যাধারা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আছে, এমনকি এখন বাংলাদেশেও সুলভ। এই বিভাগটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে একদা কলা অনুষদের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তারপর এর শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করে সমাজবিজ্ঞান অনুষদের অন্তর্ভুক্ত করে ফেলেন। ওই আন্দোলনের সময় এই বদলের একজন আনুষ্ঠানিক সমর্থক ছিলাম আমি। তবে একথাও ঠিক এগুলো বাংলাদেশের সমস্যা। পাশ্চাত্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ফলিত বিদ্যাধারার প্রভাব বা প্রকোপ এত বেড়েছে ‘মৌলিক’ বলে পরিচিত সকল শাস্ত্র একটা অনুষদের মধ্যে ভরে ফেলা হয়েছে, প্রায়শই। ‘ফ্যাকাল্টি অব আর্টস অ্যান্ড সায়েন্সেস’। কলা আর সমাজের মধ্যকার দাবড়াদাবড়িরই সুযোগ নাই। পদার্থবিদ্যা আর দর্শন একত্রে পানি খাচ্ছে করিডোরে কিংবা ক্লাসরুমে। ওদিকে আবার কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ঠিকই পাওয়া যাবে যেখানে ফ্যাকাল্টি অব আর্টস মুখ্যত পারফর্মিং আর্টের ডিব্বা। শান্তিনিকেতনের কলাভবন ধরুন খুবই কার্যকরী উদাহরণ। এগুলো নানাবিধ ভেজাইল্যা সব বিষয়। এক দুই আলাপে যে বলে সারতে পারব তা নয়। বাংলাদেশে যে সমাজবিজ্ঞান অনুষদের একটা আলাদা অনুষদ পাওয়া যায়, আর তার আপৎকালীন, ও তুলনামূলক, মানমর্যাদাও তৈরি হয়েছে, এতটাই যে কতিপয় লোকে আন্দোলন করে এই দরবারে আসতে চান, তা খুবই চাঞ্চল্যকর বৈশ্বিক ঘটনা। আপৎকালীন বলেই, আমার সমর্থন নিয়ে কোনো খেদ নাই আমার।

তবে তখনও একটা ঘোরতর অশান্তি আমার হয়েছিল। আমি ফোকলোরের বাংলা হিসাবে লোকশাস্ত্র পদটিকে খুবই গ্রাহ্য করে কথাবার্তা বলতাম। আসলে এখনো বলি। আপনাদের সঙ্গে আজকের আলাপেও আমার বিশেষ কোনো লজ্জাশরম কাজ করছে না একে লোকশাস্ত্র বলতে। আমি লক্ষ্য করলাম এটার বাংলা নামকরণ নিয়ে আন্দোলনকারী কিংবা তাঁদের সমর্থক শিক্ষক কারোরই বিশেষ উৎসাহ নাই। আমি গুরুতর কোনো স্বচ্ছতা আশাও করিনি। তারপরও একজন-দুজন সহকর্মী ফোকলোর আর লোকশাস্ত্রকে সমার্থক ভাববেন এই আশাটি আমার জাগ্রত ছিল। সেটা ঘটেনি। ফলে, রাজশাহী কিংবা জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভাগটির নাম ফোকলোর বিভাগ হিসাবেই থেকে গেছে। শেষোক্ত বিশ্ববিদ্যালয়টি নিজেই নামের একটা বিশাল চ্যালেঞ্জ। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার চাকরি করতে হলে নাম কামানোর সুযোগ আমার জন্য খুবই কঠিন হতো। ওই নাম জপার চাপ চাকুরিতে আমাকে ক্ষীণকায় ও হীনবল বানিয়ে দিত।

বাংলাদেশে এরকম আরো কিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে যেগুলোর নামোচ্চারণ করতে গেলে বুক ঢিপ ঢিপ করে। মনে হয় পাছে ভুল বলে কারো অবমাননার মামলা খেয়ে বসি! কোনো মতে একটা মুখস্থ করতে না করতেই আরেকটা একই রকম চ্যালেঞ্জের নাম নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় হাজির হয়ে বসে। আমি কোনোমতে বরিশালেরটার নাম মুখস্থ করতে না করতেই, হয়তো জামালপুরেরটা চালু হয়ে গেল। এর মধ্যে হয়তো কোনো কলিগের একটা চিঠি পেয়ে মনে পড়ল যে গোপালগঞ্জে আরেকটা আছে। মাথা পুরা খারাপ হবার জোগাড়। আমার ধারণা যদি ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি’র নামে একটা বিশ্ববিদ্যালয় হয়, সেটাই বরং আমার জন্য মনে রাখা সহজ হবে। শৈশবের এমনই গুণ, স্মৃতিতে খোদাই হয়ে আছে। হয়তো ইসলামি হওয়াই কমনসেন্সিক্যাল হবে। তবে বাংলাদেশে এখন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জোয়ার চলছে। মানে কিনা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জোয়ার। ফলে ওটা সেরকম হওয়াই প্রবণতাঘনিষ্ঠ হবে। তখন সংক্ষেপে বলব ই.উ.মু.বি.ব.খ.বি.প্র.বি। এত সব দুর্বহ পরিস্থিতির মধ্যে একটা বিভাগের নাম নিয়ে কদিনই বা আর মাথা ঘামানো যায়!

যাহোক, কথা হচ্ছিল ফোকলোরকে আমি লোকশাস্ত্র ভেবেছিলাম। এটা ভেবে যে শান্তিতেই ছিলাম, সেটা কেবল আমার সস্তায় সব সেরে ফেলার ইচ্ছার কারণে নয়। বরং, শাস্ত্রকে আমি ব্যবস্থা কিংবা প্রণালী কিংবা প্রবহমান সব ভাবেই দেখতে পারি বলেই। অন্যদিকে আমার গুরুতর মিত্ররাও যে এভাবে দেখতে পেলেন না বা চাইলেন না সেটাই বরং বেশ দুর্বোধ্য হয়ে থাকল আমার কাছে। তাঁদের দুয়েকজন যা বললেন তার সারাংশ মোটামুটি এই যে শাস্ত্র কথাটির মধ্যে লোর-এর ইয়েটা ঠিকমতো আসে না। আসে কি আসে না আরেকটা শাস্ত্রের বেতন খেয়ে বলা খুব শক্ত। মানে আমি বলতে থাকলে গুন্ডামির মতো হয়ে যেতে পারত। অবশ্যই আমি বলতে পারতাম যে ফোক তো লোকে আসে নাকি? তাতে কী লাভ হতো? যদি আমরা উভয়পক্ষ ঐকমত্য করতাম যে লোক শব্দে ফোক ধরা পড়ে, আর শাস্ত্র শব্দে লোর ধরা পড়ে না তাহলে বিভাগটার নাম হতে পারত গিয়ে লোকলোর। কারো কি শান্তি হতো এতে? দুইটা ‘ল’ কোনোরকম সময় না দিয়েই একটার ঘাড়ে একটা পড়ে অশান্তি বাড়িয়ে দিতে পারত। উপরন্তু একটা শঙ্কর শব্দের চাপ। কেউ বলতে পারেন ‘ফোকলোর বিভাগ’ও শঙ্করই তো হলো। হলো, তবু তো অন্তত দুইটা শব্দ; তাই শঙ্কর ফ্রেইজ, শঙ্কর শব্দের হাত থেকে লোকলোরকে রাখা গেল। ফলে, মানতেই হবে, সকল কাজেরই ভালমন্দ দিক আছে।

এমনিতে ফোক আর লোকের ঝামেলা আসলেই কম। যেমন ইংরাজিতে বলে, ‘হাই ফোকস, আর ইউ রেডি?’ মানে কিনা হলো ‘ওহে লোকগণ, বা লোকজন, সবাই তৈরি তো?’ এখন আপনাদের যদি চলচ্চিত্রগত অভিজ্ঞতা হয়ে থাকে, যেমনটা আমারও, তাহলে নিশ্চয়ই মনে পড়বে যে এটা একটা সমমর্যাদার ইয়ারদোস্তমূলক আলাপসালাপে চলে আসছে। এটা কুলীন-ভদ্রাত্মা, শিক্ষিত-রুচিশীল কিংবা উচ্চপদমর্যাদাসীন পুরুষদের জলদগম্ভীর কণ্ঠের সম্ভাষণযোগ্য কোনো পদবাচ্য নয়। যতই ক্লাসিক শোনাক তাঁরা বলবেন “হেলো লেডিস অ্যান্ড জেন্টেলমেন”। যদি বেশি সেকেলে লাগে আপনাদের কানে, আপনারা বদলে নিন এভাবে ‘আওয়ার টুডেইজ ডিস্টিংগুইশড গেস্টস’ বা ইত্যাদি। এই যে কে বলবেন আর কে বলবেন না, কাকে বলবেন আর কাকে বলবেন না এইখানেই কিন্তু সকল জারিজুরি, আই মিন চাবিকাঠি, লুকিয়ে আছে।

শাস্ত্র নিয়েই ভেজালটা বেশি (ছিল)। আসলে এখনো ডিপার্টমেন্ট, ডিসিপ্লিন ইত্যাদি বা বাংলায় অমুক-তমুক বিভাগ এগুলো এত সোজাসাপ্টা জায়গায় নাই। এখনো বহু লোকেই এগুলোকে কমবেশি কোচিং সেন্টারের ম্যানুয়েল হিসাবেই দেখে থাকেন। বা হয়তো নিন্দুকেরা বলবে বিসিএসের সিলাবাসের মতো; তা যতই কিনা আমার মতো ভেজাইল্যা লোকে ‘শাস্ত্র’ শব্দ দিয়ে প্রতিস্থাপন করুন না কেন। সেসব আরেক ঝামেলার আলাপ। আপাতত আমরা অপেক্ষাকৃত সহজ আজকের আলোচ্যটা বুঝে নিতে পারি। ওহে লোকগণ, ওহে ফোকবৃন্দ ইত্যাদি কিছুতেই যে কুলীন-রুচিদারদের সম্ভাষণ নয় এটা যদি বুঝে নিতে পারেন তাহলে মেলা জটিল একটা পর্ব আপনাদের সহজেই মীমাংসা হয়ে গেল। বাঙ্গালা আর ইংরাজির সমস্যা নিয়ে আমাদের পরে ভাবলেও চলবে। হয়তো আগামী কয়েক বছরে সেটা সম্ভব হলো না, রিস্কি থেকে গেল। হয়তো কয়েক দশক পরে সেটা পারব, যখন হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব পড়ালেখার আর থোড়াই কেয়ার করে সিস্টেমরাজগণ।

এর মধ্যে কেউ এগিয়ে এসে নতুন ক্যাচালও বাঁধিয়ে দিতে পারেন: “বুঝলাম আপনে লোক-ফোক গুলায়ে মিলায়ে বুঝায়ে দিলেন, তাইলে ম্যাস কারা? যদি এটা সামরিকবিদ্যা কিংবা সিকুরিটি স্টাডিজ ইত্যাদির অধিবেশন হতো, আমি অনায়াসে বলে দিতে পারতাম যাদেরকে ম্যাসাকার করা যায় তারাই হলো গিয়ে ম্যাস। কিন্তু এখানে ম্যাস কমুনিকেশন ইত্যাদির লোকজন আছেন, এত সহজ কিস্তিতে বললে কেউ আমাকে ছাড়বেন না। পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের লোকজন থাকতে পারেন যাঁরা পাবলিক ভাল চেনেন। আবার পলিটিক্যাল সায়েন্সের লোকজন থাকতে পারেন যাঁদের কাছে ‘পিপুল’ ‘ম্যাসে’র থেকেও অধিক আকর্ষণীয় জমায়েত। ফলে অত সোজা নয়। তবে আপাতত আপনারা এটুকু দিয়ে কাজ চালালেও চালাতে পারবেন যে ‘ম্যাস’-এর অবস্থান বিজ্ঞজনেরা মোটামুটি শহরে রেখেছেন, শহরে দেখেছেন; হোক মুখ্যত গরিব-শ্রমিক, তাও শহরেই। পক্ষান্তরে, ‘ফোক’ ঐতিহাসিকভাবেই ‘গ্রামগন্ধী’। ওই যে মনে আছে রেডিও-টেলিভিশনের ‘পল্লীগীতি’গুলো? দেখুন, ঠিকই পল্লী বলা হলো। পল্লী মানে তো জানেনই। আবার ওই যে এফডিসিতে ফুক-ফ্যান্টাসিগুলো হতো, মনে পড়ে তো? ওখানে কোনোদিন বেদের মেয়ে জোসনা ধরন ছাড়া শহুরে কিছু কি পেয়েছেন? পাননি!

আদাবর, ১ জুন ২০২১
কভারে মানস চৌধুরী; ছবি. মেহেদী হাসান, ২০১৫