আফ্রিকায় রেলপথ ঘিরে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এক নতুন ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। রেল প্রকল্প শুধু পরিবহন নয়—এটি আজ কূটনীতি, প্রভাব বিস্তার ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠার অস্ত্র। ঔপনিবেশিক যুগের মতই এখনও বাইরের শক্তিগুলি আফ্রিকাকে ব্যবহার করছে তাদের স্বার্থে।
সামুয়েল ডব্লিউ. ইয়াঙ্কি
দ্য ডিপ্লোম্যাট, ৫ মার্চ, ২০২৫
অনুবাদ. জুবায়েদ দ্বীপ
চীন আর আমেরিকা তানজানিয়া, জাম্বিয়া, অ্যাঙ্গোলা এবং গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্রে প্রবেশাধিকার, সম্পদ আর প্রভাব বিস্তার করার জন্য রেলপথগুলিকে কেন্দ্র করে লড়াই করছে। এই প্রতিযোগিতা ঔপনিবেশিক যুগের কথা মনে করিয়ে দেয়।
মুকুবা এক্সপ্রেস আট ঘণ্টা ধরে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। তানজানিয়া-জাম্বিয়া সীমান্তের প্রায় ৫০ মাইল পশ্চিমে একটা ছোট্ট গ্রামে আটকে আছে ট্রেনটি। “আমরা শিগগিরই চলতে শুরু করব,” একজন মেকানিক আমাকে বলেছিল, কিন্তু আসলে রেলটির বগি লাইনচ্যুত হয়ে গেছে, আর মেরামতের জন্য যে সরঞ্জাম দরকার তা এখান থেকে মাইল মাইল দূরে।
জাম্বিয়ার মধ্যাঞ্চলের শহর কাপিরি ম্পোশি থেকে আমি ঐতিহাসিক তানজানিয়া-জাম্বিয়া রেলওয়ে (TAZARA) এক্সপ্রেসে উঠি। দুই দিন ধরে আমি এই ট্রেনে ছিলাম। ট্রেন চালু হতে দেরি হলেও, চারপাশের জীবন থেমে ছিল না। রেললাইনের পাশে বাচ্চারা ফুটবল খেলছিল, নারীরা আম বিক্রি করছিল, আর বেশ কয়েকজন হাসিখুশি যাত্রী ভ্রাম্যমাণ রেস্তোরা থেকে শাক ভাজা আর উগালি খাচ্ছিল।
আটকে পড়া ট্রেনের চারপাশে যাত্রী, স্থানীয় মানুষ আর কর্মীদের ব্যস্ততা দেখে আমার মনে হল, আফ্রিকায় রেলপথ সর্বদা এই যাত্রীদের চাহিদার চেয়ে বড় কোনো শক্তির ইচ্ছায় গড়ে উঠেছে। ঔপনিবেশিক রেললাইন থেকে শুরু করে আজকের বিদেশী অর্থায়নে চলা বড় বড় প্রকল্প পর্যন্ত, এই রেলপথ কখনোই শুধু পরিবহনের মাধ্যম ছিল না; বরং এগুলি সবসময় প্রভাব, প্রতিযোগিতা আর নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হয়ে এসেছে।
তানজানিয়া-জাম্বিয়া রেলওয়ে হচ্ছে পূর্ব আফ্রিকার অসংখ্য রেল প্রকল্পের একটা। গত ১৫০ বছরে কোনো না কোনো বিদেশী শক্তি আফ্রিকায় রেলপথগুলি বানিয়েছে বা এতে ফান্ড দিয়েছে। ঔপনিবেশিক যুগের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত, আফ্রিকার রেল ব্যবস্থা বেশিরভাগ সময়ই বিদেশী বিনিয়োগের ওপর নির্ভর করেছে। এতে দরকারি পরিবহন সুবিধা পাওয়া গেছে, তবে বিদেশিীনিয়ন্ত্রণও বেড়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে, আফ্রিকার বাইরের দেশগুলি আফ্রিকার রেল প্রকল্পে কয়েক বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। এর মূলে আছে প্রাকৃতিক সম্পদের দখল, রাজনৈতিক প্রভাব আর অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে প্রতিযোগিতা।
দক্ষিণ-মধ্য আফ্রিকায় বর্তমানে এই প্রতিযোগিতা আরও তীব্র হচ্ছে—যুক্তরাষ্ট্র আর চীন সমর্থিত ভিন্ন ভিন্ন প্রতিযোগী রেল উন্নয়ন প্রকল্পের পরিকল্পনা করা হচ্ছে, যাতে গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র কঙ্গো আর জাম্বিয়ার তামা আর কোবাল্ট সমৃদ্ধ খনিজ অঞ্চলে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থিত প্রকল্প ‘লোবিতো করিডর’ ইউরোপীয় ইউনিয়নেরও সহায়তা পাচ্ছে। এই প্রকল্পে অ্যাঙ্গোলার আটলান্টিক উপকূলে লোবিতো বন্দর থেকে জাম্বিয়ার কপারবেল্ট, আর সেখান থেকে কঙ্গোর কোলওয়েজি পর্যন্ত নতুনভাবে উন্নত একটি রেলপথ বানানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে। এই প্রকল্পে বিদ্যমান বেঙ্গুয়েলা রেলপথ পুনর্নির্মাণ করা হবে, যেটি অনেকাংশেই একই পথে চলে।
তানজানিয়া-জাম্বিয়া রেলপথ দার এস সালাম থেকে জাম্বিয়ার কাপিরি ম্পোশি পর্যন্ত বিস্তৃত। ১৯৭০-এর দশকে চীনের সরকার এটি নির্মাণ করে। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা আর রোডেশিয়ার জাতিবিদ্বেষী শাসনব্যবস্থাকে এড়িয়ে জাম্বিয়ার আকরিক তামা সরাসরি তানজানিয়ার বন্দরে নিয়ে যাওয়া। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে, তানজানিয়া, জাম্বিয়া আর চীনের রাষ্ট্রপ্রধানেরা একটা সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করেন, যেখানে ঠিক হয় যে তানজানিয়া-জাম্বিয়া রেলওয়ে পুরাপুরি চীনের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কর্পোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা হবে। তারা পরবর্তী ৩০ বছর এই রেলপথের উন্নয়ন আর ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকবে।
এই নতুন রেল প্রকল্পগুলি অনেকটা ঔপনিবেশিক যুগের রেল নির্মাণের মতই, যখন ব্রিটিশ, পর্তুগিজ, বেলজিয়ান আর জার্মানরা রেললাইন বানিয়েছিল—বেশিরভাগ সময় জোর করে বা বাধ্যতামূলক শ্রমের মাধ্যমে—সেনা ও প্রশাসকদের আনা-নেওয়া আর পণ্য রপ্তানিই ছিল এর মূল লক্ষ্য। আসলে, ২০১৭ সালে নির্মিত কেনিয়ায় স্ট্যান্ডার্ড গেজ রেলপথ আর ১৯০২ সালে ব্রিটিশদের তৈরি উগান্ডা রেলপথের রুট হুবহ একই। মূলত নীল নদের উৎস পর্যন্ত সেনা পাঠানোর জন্য ব্রিটিশরা রেলপথটি বানিয়েছিল। আর তানজানিয়া-জাম্বিয়া রেলওয়ে যদিও ১৯৭০-এর দশকে তৈরি, কিন্তু এর রুট আসলে ঔপনিবেশিক আমলে ত্যাঙ্গানিকা (আজকের তানজানিয়া) শাসনকালেই ব্রিটিশ আর জার্মানরা জরিপ করে যে রুটের ধারণা দিয়েছিল তার ওপর ভিত্তি করেই বানানো।
বর্তমান সময়ে ট্রেনের যাত্রীদের বদল হয়েছে, পণ্যও বদলেছে, তবে অতীতের সাথে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়নি। এখনকার বিদেশী বিনিয়োগে তৈরি রেল প্রকল্পগুলিও অনেকটাই তাদের ঔপনিবেশিক আমলের সংস্করণ। বিশাল ছাড়ের বিনিময়ে এসব চুক্তি হয়—সেটা হোক খনির অধিকার, জমি ইজারা চুক্তি, কিংবা গুরুত্বপূর্ণ পরিবহন পথের ওপর দীর্ঘমেয়াদী নিয়ন্ত্রণ।
অনেক জাম্বিয়া নিবাসীর কাছে তানজানিয়া-জাম্বিয়া রেলপথ শুধুমাত্র পণ্য রপ্তানির একটি মাধ্যম নয়, গ্রামাঞ্চলের অনেক মানুষের বেঁচে থাকাও এই রেলপথের ওপর নির্ভর করে। কাপিরি ম্পোশি থেকে দার এস সালাম যাওয়ার পথে ট্রেনে ল্যারি বান্দা নামের এক ব্যক্তির সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল, তিনি একজন স্কুলশিক্ষক। ছোটবেলা থেকেই তিনি এই রেলপথে যাতায়াত করছেন—পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে, নিজের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে, আর এখন অন্যদের শেখাতে। তিনি বলেছিলেন, “রেললাইনটা এখন অত্যন্ত অনির্ভরযোগ্য হয়ে গেছে, কারণ বর্তমানে কোম্পানিতে অনেক সমস্যা চলছে—যেমন তারা সময়সূচি ঠিক রাখতে পারছে না, অবকাঠামো পুরোনো হয়ে গেছে, আর সক্ষমতাও কমে গেছে।” তারপর বললেন, “এই কারণেই এখন খুব কম মানুষ রেলে চড়তে চায়।”
রেলের ওপর মানুষের ভরসা কমে যাওয়ায় অনেক বড় প্রভাব রয়েছে। একসময় তানজানিয়া-জাম্বিয়া রেলওয়ে অসংখ্য গ্রাম আর ছোট শহরকে বাইরের বিশ্বের সঙ্গে যুক্ত করেছিল। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা আর কৃষিপণ্য বাজারে পৌঁছানোর সুযোগ করে দিয়েছিল। বান্দা বলছিলেন, চীনা কোম্পানির মাধ্যমে তানজানিয়া-জাম্বিয়া রেলওয়ের পুনর্গঠন নিয়ে জাম্বিয়ায় বেশ আলোচনা চলছে। এটা অর্থনৈতিক আর সামাজিক পরিবর্তনের একটা বড় সুযোগ হতে পারে বলে অনেকে মনে করছে। সহজ ও নির্বিঘ্ন পরিচালনার আশ্বাস, সহজে যাতায়াত আর নতুন কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি দেখে অনেকেই আশা করছে, নতুনভাবে চালু হলে এই রেলপথ তাদের জীবনে সত্যিকারের পরিবর্তন আনবে। বান্দাও তার আশা জানালেন—
“নতুনভাবে চালু হলে মানুষ আবার রেলের ওপর ভরসা করতে পারবে… আর এর ফলে মানুষের জীবনে আরও বেশি অর্থনৈতিক আর সামাজিক পরিবর্তন আসবে, বিশেষ করে সেই সব জায়গায়, যেখানে একমাত্র ট্রেনেই যাতায়াত সম্ভব। অনেক ছাত্রছাত্রী বোর্ডিং স্কুলে যাওয়ার জন্য টার্মের শুরুতে বা শেষে ট্রেন ব্যবহার করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, তারা প্রতিদিন ট্রেনে স্কুলে যাওয়া-আসা করতে পারে না। যদি তানজানিয়া-জাম্বিয়া রেলওয়ে আবার ঠিকমত চালু হয়… তাহলে হয়ত ছাত্রছাত্রীরা বাড়ি থেকে সরাসরি স্কুলে যাতায়াত করতে পারবে।”
তবে, সবাই কিন্তু তানজানিয়া-জাম্বিয়া রেলওয়ে নিয়ে এতটা আশাবাদী না। সায়মন সিয়ামে, একজন কৃষক এবং উদ্যোক্তা, ব্যবসার কাজে বাইরে থেকে ট্রেনে বাড়ি ফিরছিলেন। তিনি চীনা বিনিয়োগের একটা অন্ধকার দিক তুলে ধরলেন। “জাম্বিয়ায় চীনের কাছ থেকে নেওয়া ঋণ অনেক সমস্যা তৈরি করেছে। তারা একটা বিমানবন্দর ও তামার খনিগুলির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে। কারণ, সরকার তাদের টাকা শোধ করতে পারেনি,” সিয়ামে বললেন। “চীনারা কোনো কিছু হালকাভাবে নেয় না। তারা একটা জাতীয় সম্পদ নিয়ে নেয়, তারপর সেটার পুরো নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ফেলে… এটাই চীনা ঋণের সমস্যা। জীবনযাত্রার খরচ এত বেড়ে গেছে যে সাধারণ মানুষের টিকে থাকাই কঠিন হয়ে গেছে।”
জাম্বিয়া সরকার কোভিড-১৯ মহামারির সময় ঋণ শোধ করতে না পেরে তখন থেকেই ঝামেলায় আছে। চীন এখনও তাদের সবচেয়ে বড় ঋণদাতা, আর এই দুই দেশ এখন বকেয়া ঋণ কীভাবে সামলানো যায় সেটা নিয়ে দরকষাকষি করছে।

আমি যেখান থেকে তানজানিয়া-জাম্বিয়া রেলওয়ের ট্রেনে উঠেছিলাম, তার হাজার মাইল উত্তর-পূর্বে কেনিয়ার স্ট্যান্ডার্ড গেজ রেলওয়ে (SGR) দেখিয়ে দেয়, চীনের নেতৃত্বে রেলপথের পুনর্গঠন কেমন হতে পারে। এই রুটটি একশ বছরের বেশি সময় ধরে কেনিয়ার প্রধান বাণিজ্যিক রুট হিসাবে বিবেচিত হয়ে আসছে। কেনিয়ার সরকার চীনকে এই রেলপথ পুনর্গঠনের দায়িত্ব দেয়। ২০১৭ সালে শেষ হওয়া এই প্রকল্পটি আধুনিক, বাজারকেন্দ্রিক উন্নয়নের একটা উদাহরণ। তবে, চীনের রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলির সঙ্গে ব্যবসা করলে তার মূল্য কেমন হতে পারে এটি তার একটা সতর্কবার্তাও বটে।
চীনের এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যাংক এবং কেনিয়া সরকারের মধ্যে স্বাক্ষরিত মূল চুক্তিতে এই রেলপথ নির্মাণের জন্য ৩.৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ অনুমোদন করা হয়েছিল। ২০২০ সালে ঋণ শোধের সময়সীমা শেষ হওয়ার পর থেকে কেনিয়া সরকার আর কেনিয়া রেলওয়ে কর্পোরেশন ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হিমশিম খাচ্ছে। কেনিয়া রেলওয়ে কর্পোরেশন জানিয়েছে, ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ চীনের ঋণের বকেয়া পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬১৭ বিলিয়ন কেনিয়ান শিলিং, যা ২০২৫ সালের হিসাবে প্রায় ৪.৭৮ বিলিয়ন ডলারের সমান।
কেনিয়া সরকারের এই পরিস্থিতি তানজানিয়া-জাম্বিয়া রেলওয়ে প্রকল্প চীনের কাছে হস্তান্তর করার আগে জাম্বিয়া আর তানজানিয়া সরকারের জন্য একটা সতর্কবার্তা হতে পারে। কেনিয়ার স্ট্যান্ডার্ড গেজ রেলওয়ে ঋণের কিস্তি শোধ করতে না পারায় দেশটিকে তীব্র রাজনৈতিক অস্থিরতা আর অর্থনৈতিক চাপের মুখে পড়তে হয়েছে। এবং যার ফলশ্রুতিতে সরকার জরুরী আর্থিক পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়, যা শেষ পর্যন্ত দেশজুড়ে বিশাল বিক্ষোভের জন্ম দেয়।
কেনিয়া সরকারের কাঁধে এখন বিশাল ঋণের বোঝা। যার পরিমান দেশের জিডিপির প্রায় ৬৮ শতাংশ। এই বিশাল ঋণের চাপ সামলানোর জন্যই ২০২৪ সালের জুন মাসে বিতর্কিত একটি অর্থ বিল পাশ করা হয়। এই বিলের উদ্দেশ্য ছিল কর বাড়িয়ে জাতীয় ঋণের কিস্তি শোধ করা। কিন্তু দেশজুড়ে ব্যাপক আন্দোলনের পর সরকার শেষ পর্যন্ত বিলটা বাতিল করে, আর এর ধাক্কায় প্রায় পুরো মন্ত্রিসভাকেই বরখাস্ত করা হয়।
কেনিয়া এখনও ঋণের বোঝা টানতে হিমশিম খাচ্ছে, তাই প্রশ্নটা আসতেই পারে—জাম্বিয়া, যার জিডিপি কেনিয়ার এক-তৃতীয়াংশেরও কম, কি এই একই পথে হাঁটার সামর্থ্য রাখে?
কেনিয়া এখনও স্ট্যান্ডার্ড গেজ রেলওয়ে প্রকল্পের পরিণতি সামলানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু তবুও পুনর্নির্মিত এই রেলপথে ট্রেন চলাচল চালু হয়ে গেছে। আমি যখন মোম্বাসা থেকে নাইরোবি পর্যন্ত স্ট্যান্ডার্ড গেজ রেলওয়ের ট্রেনে উঠেছিলাম—এয়ার কন্ডিশনড কেবিনে আমার পাশেই বসে ছিলেন এক চীনা ব্যবসায়ী—দেখলাম যাত্রীরা গুছিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে ঝকঝকে কমলা-সাদা রঙের ট্রেনে উঠছে। ট্রেনটি একদম সময়মত মোম্বাসা টার্মিনাল ছাড়ল, আর ঠিক সময়মত নাইরোবিতে পৌঁছাল—এক মিনিটও দেরি হয়নি।
ট্রেনে যাদের সঙ্গে কথা বলেছিলাম, তারা সবাই নতুন লাইনের আরাম আর সুবিধার প্রশংসা করছিল, বিশেষ করে আগের সংকীর্ণ গেজের ট্রেন লাইনের তুলনায়, যা ১৯০২ সালে চালু হওয়ার পর থেকে প্রায় একটানা চলেছে। আর সেই সময়, তানজানিয়া-জাম্বিয়া রেলওয়ের ট্রেন ঘণ্টায় ৩০ মাইলের বেশি গতিতে উঠতেই পারছিল না, ধীরে ধীরে চলছিল, রেললাইনের পাশে পড়ে থাকা লাইনচ্যুত, জং ধরা মালবাহী ওয়াগনগুলির পাশ দিয়ে ধীর লয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল।
চীনের রেল প্রকল্প নিয়ে যতই আলোচনা হোক, যুক্তরাষ্ট্রও কিন্তু অবকাঠামোগত উন্নয়নের প্রতিযোগিতায় ঢুকে পড়েছে। তারা ‘লোবিতো করিডর’ রেল প্রকল্পে ৮০৩ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এই টাকা যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন আর্থিক সংস্থার (ডিএফসি) মাধ্যমে ‘লোবিতো আটলান্টিক রেলওয়ে’ আর ‘আফ্রিকা ফাইন্যান্স কর্পোরেশন’কে ঋণ হিসাবে দেওয়া হবে। এই প্রকল্পকে চীনের আগ্রাসী বিনিয়োগ কৌশলের একটা পাল্টা ব্যবস্থা হিসাবে দেখা হচ্ছে, যাতে চীনা প্রভাব আর কঠিন শর্তের ঋণ নিয়ে সন্দিহান আঞ্চলিক সরকারগুলির জন্য একটা বিকল্প তৈরি করা যায়।
এরপরেও এখন এই প্রকল্প বড় রকমের সমস্যার মুখে পড়েছে—একদিকে গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র কঙ্গো সরকার আর এম-২৩ নামে পরিচিত বিদ্রোহীদের মধ্যে দ্রুত ছড়িয়ে পড়া সংঘাত, আর অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিগত পরিবর্তন। ২০২৫ সালের ২০ জানুয়ারি, নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাহী আদেশ জারি করে বললেন, “যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সহায়তা ইন্ডাস্ট্রি আর আমলাতন্ত্র আসলে আমেরিকার স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এবং অনেক ক্ষেত্রে এটি আমেরিকান মূল্যবোধের বিপরীত। এসব সহায়তা বিদেশী রাষ্ট্রসমূহে এমন ধারণা ছড়িয়ে বিশ্বশান্তি অস্থিতিশীল করে, যা দেশের অভ্যন্তরীণ এবং দেশগুলির মধ্যে সুসম্পর্ক ও স্থিতিশীলতার সম্পূর্ণ বিপরীত।” এই ঘোষণার পর পরই ট্রাম্প সব ধরনের বৈদেশিক সহায়তা আর উন্নয়ন প্রকল্পের ফান্ডিং বন্ধ করে দেন, যার ফলে লোবিতো করিডরের মত প্রকল্পগুলি পুরাপুরি অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যায়।
লোবিতো প্রকল্প পুরোপুরি ব্যবসাবান্ধব—এটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সম্পদের প্রবেশাধিকার বাড়াবে আর দেশটির বিনিয়োগ বাড়ানোর দরজা খুলে দেবে। কিন্তু এরপর কী হবে, সেটা এখনও দেখার বাকি। আগের রেল প্রকল্পগুলি যেখানে ব্যর্থ হয়েছে, সেখানে সফল হতে হলে ট্রাম্প প্রশাসনকে ব্যবসার লাভজনকতা আর স্থানীয়দের প্রয়োজনের মধ্যে একটা ভারসাম্য আনতে হবে।
আফ্রিকায় রেলপথ ঘিরে এই নতুন প্রতিযোগিতা কেবল কৌশলগত আধিপত্য আর প্রাকৃতিক সম্পদ দখলের বিষয় নয়। এর ফলে লাখো মানুষের দৈনন্দিন জীবন প্রভাবিত হবে—বান্দা আর সিয়ামের মত যাত্রীদের, যারা প্রতিদিন স্কুল, বাজার আর কাজের জায়গায় আস্থার সাথে যেতে চায়। তাহলে, লোবিতো করিডর আর নতুনভাবে চালু হওয়া তানজানিয়া-জাম্বিয়া রেলওয়ে আসলেই কি সাধারণ মানুষের কাজে আসবে? নাকি আগের অনেক রেল প্রকল্পের মত এগুলিও বিদেশী স্বার্থকে এগিয়ে রাখবে, আর স্থানীয়দের চাহিদা যথারীতি উপেক্ষিত থেকেই যাবে?
লেখক পরিচিতি
সামুয়েল ডব্লিউ. ইয়াঙ্কি ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। তিনি সেখানে ইতিহাস এবং আরবি ভাষা নিয়ে পড়াশোনা করছেন। তিনি নৌবাহিনীর রিজার্ভ অফিসার প্রশিক্ষণ কর্পস (NROTC) প্রোগ্রামের সদস্য। তার গবেষণার মূল ক্ষেত্র অবকাঠামো, ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার এবং বিশ্ব প্রতিযোগিতা। তিনি পূর্ব আফ্রিকায় রেলওয়ে বিনিয়োগ ও বিদেশী প্রভাব নিয়ে কাজ করেছেন।
হেনরি কিসিঞ্জার ট্র্যাভেল ফেলোশিপ থেকে তিনি গবেষণার জন্য সহায়তা পেয়েছেন। তার লেখা ইউ.এস. নেভাল ইনস্টিটিউটের প্রোসিডিংস এবং ইয়েল হেরাল্ড-এ প্রকাশিত হয়েছে।
ইউ এস নেভাল ইন্সটিটিউটের ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, তিনি মেইনের উপকূলীয় পানিতে নৌকা চালিয়ে বড় হয়েছেন। ভবিষ্যতে ইন্টেলিজেন্স বা সারফেস ওয়ারফেয়ার শাখায় অফিসার হিসাবে যোগ দিতে চান।
পত্রিকা পরিচিতি
আন্তর্জাতিক অনলাইন সংবাদ ম্যাগাজিন দ্য ডিপ্লোম্যাট (thediplomat) ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের রাজনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতি নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করে। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন, ডিসি থেকে প্রকাশিত হয়। ম্যাগাজিনটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ২০০১ সালে, অস্ট্রেলিয়ায়। শুরুতে এটি ছিল দ্বিমাসিক কাগজের পত্রিকা। ২০০৯ সালে আর্থিক কারণে পুরাপুরি অনলাইন ম্যাগাজিনে রূপ নেয়।
আফ্রিকায় রেলপথ নির্মাণের প্রতিযোগিতায় চীন ও আমেরিকা