দুই হাজার কত সালে আমি প্রথম স্পিডবোটে উঠছিলাম। প্রথম আর ওই একবারই। আমার আম্মার দুই বান্ধবী ও তাদের জামাই সহকারে আমরা গেছিলাম এক জায়গায়। ঢাকার কাছেই কোথাও।

জনবহুল কিন্তু খুব সুন্দর জায়গা। নদী বা লেকের তীরে উঁচু সিমেন্ট বালির কিনারা। সেখানে দাঁড়াইলে বাতাসে টিকা যায় না। চারিদিকে গাছ আর গাছ। এক মিনিটের রাইড স্পিডবোটের। শুরু হইতেই শেষ হইয়া যায়। এত স্পিড যে, স্পিডবোটে ওঠাটাই বুঝতে পারি নাই। তারপর আর স্পিডবোটে চড়ার সুযোগ হয় নাই।

আর নৌকায় এর আগে কখনো চড়ি নাই আমি। এর আগে বলতে, এই মাসে প্রথম নৌকায় চড়লাম। নৌকা খুব বেশি কোথাও যে দেখছি তাও না। তেমন জায়গায় যাওয়া হয় নাই। আমরা বহুদিন যদিও থাকছি তুরাগের পাড়ে, সেখানে নৌকা ছিল না আমার বাসার ধারেকাছে। গ্রামে বেড়াইতে গেছি সবসময় বাসে। সেখানে আশেপাশে নদী বা নৌকা নাই।

রোজা শুরুর পর কিছুদিন আগে বের হইছি বিকালে বাদাম আর চিয়া সিড কিনতে। ধানমণ্ডি আট নাম্বার ব্রিজ পার হইয়া যাওয়ার সময় দেখি একটা নৌকা। ধানমণ্ডি লেকের আশপাশ দিয়া গেলেও কখনো ঘুরতে যাওয়া হয় না লেকে। তারপরও যা দেখছি সব পা দিয়া চালাইতে হয় এমন বোট। এইবারই দেখলাম নৌকা, ধানমণ্ডি লেকে বৈঠা বাইতে বাইতে যাচ্ছে। দেইখা ভালো লাগল।

দেখতে দেখতেই ইউনিমার্টে গেলাম। বাদাম, চিয়া সিড, একটা বহুদিন ধইরা দেইখা আসা সল্টি বিস্কুট, কয়েক রকমের চা আরো কী কী যেন কিনলাম। ফেরার পথে মনে হইল হাঁটি একটু।

হাঁইটা আবার আট নাম্বার ব্রিজের পাশ দিয়াই যাচ্ছিলাম। তখন মনে হইল এখানে গাছের আশেপাশে কতক্ষণ ঘুরি, ভালো লাগবে। ইফতারের তখনো দেড় দুই ঘণ্টা বাকি, কিন্তু ভালোই মানুষ রবীন্দ্র সরোবরের ওখানে। কাপলরা মূলত।

ওই পাশটা আমার ভালো লাগে না। ময়লা হয়ে গেছে একদম। আমি এর উল্টা পাশটায় ঘুরাঘুরি করতে গেলাম। রোদ কইমা আসছিল আর চারপাশে অনেক গাছপালায় ঠাণ্ডা ছিল জায়গাটা। হাঁটতে হাঁটতে ছবি তুললাম কিছু। একটা ছেলে আমার পাশ দিয়া দৌড়ায়া গেল। শার্ট খুইলা ফেলতে ফেলতেই দৌড়ায়া যাইতেছিল। পনেরো বিশ সেকেন্ড জোরে দৌড়ায়া যাওয়ার রাস্তা পার হইয়া সে এক জায়গায় পানির কাছে গিয়া থামল। আরো কয়েকটা ছেলেমেয়ে ছিল সেখানে। একটা মেয়ে বাসন মাজতেছিল। একটা পিচ্চি ছেলে অলরেডি পানির মধ্যে ছিল, তার চেয়ে ছোট এক মেয়ে দুই পায়ের উপর বইসা বড় মেয়ের বাসন মাজা দেখতেছিল। দৌড়ানো ছেলে শার্ট খুইলা মাটির উপর রাখল। তারপর প্যান্টটা খুইলা মাটিতে রাইখা হাফপ্যান্ট পরা অবস্থায় এক লাফ দিয়া পানিতে ঝাঁপ দিল। পানিতে থাকা ছেলেটাও তার ঝাঁপের সঙ্গে তাল মিলায়া সেই দিকে আগাইল।

ওদের দেখতে দেখতে সিঁড়ি দিয়া নাইমা একটা ছোট ব্রিজ ধরনের লোহার বারান্দার উপর গিয়া দাঁড়াইলাম। এই জায়গাটা আমার ভয় করে। লোহাটাতে পা দিলেই কেমন ঝম ঝম করে। মনে হয় এখনই ভাইঙ্গা পড়বে। এই সমস্যা আমার যেকোনো ব্রিজে উঠলে হয়। একবার আমরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া গেছিলাম আমার আম্মার খালার বাড়ি। আরেক জায়গা থেকে বর্ডারের পাশ থেইকা ট্রেনে কইরা ওখানে যাইতেছিলাম।

স্টেশনে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করার সময় কে জানি আমাকে বলছিল ওই দেয়ালের পাশ দিয়া দেখো বর্ডার। বর্ডার শুইনা আমি খুব অবাক ও আনন্দিত হইছিলাম। দুই দেয়ালের ভাঙনের মধ্য দিয়া এক বিস্কুটের দোকানের পাশে দাঁড়ায়া দেখি, অনেক দূরে কাঁটাতার। কাঁটাতারের ওইপাশে ইন্ডিয়া। ট্রেন ছাড়ার পর জানালা দিয়া আমি ইন্ডিয়া দেখার চেষ্টা করতেছিলাম। ওইটাও আমার প্রথম ট্রেনে চড়া ছিল। প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে ট্রেন এক ব্রিজের ওপর দিয়া যাইতেছিল। কী প্রবল ঝম ঝম ঝম ঝম শব্দ। বৃষ্টির ঠাণ্ডা ফোঁটা গায়ে পড়তেছিল। জানলা দিয়া দেখলে ঘন বর্ষণের মধ্যে আবছা দেখা যায় বাড়িঘর, ক্ষেত। কোথাও লোকজন নাই। তার একটু পরেই ধাম কইরা এক ব্রিজের ওপর উঠলাম আমরা। জানলা দিয়া নিচে তাকায়া দেখি পানি আর পানি, এখন ওই বাড়িগুলি অনেক পিছনে পড়ে গেছে। পানিতে তাকায়া থাকতে ভয় লাগতেছিল।

সেই ভয়টা অনেক বছর পর ধানমণ্ডি লেকের লোহার বারান্দায় দাঁড়ায়া পাইলাম মনে হয়। পানি দেখলেই মনে হয় পইড়া যাবো কেন জানি।

একটু পরে হাতের ডান দিক থেইকা সেখানে ওই নৌকাটা ধীরে ধীরে আসতে লাগল। নৌকায় এক মেয়ে আর ছেলে। তিনজন মিলা অনেক গল্প করতেছিল। ছেলেটা হাসতেছিল সবচেয়ে বেশি। আঙুল নির্দেশ কইরা কী দেখাইতেছিল। নৌকাকে আমার পিঁপড়া মনে হয় গতির কারণে। এই পিঁপড়া পেটের মধ্যে মানুষ বসায়া, পা দিয়া পানির ওপর চলে।

নৌকা বারান্দা পার হইয়া হাতের বামে রবীন্দ্র সরোবরের সামনে গিয়া আবার ঘুইরা আসতে লাগল। আরো দূরে যাইতে পারত। গেল না বোধহয় রাইডের সীমার কারণে। এর মধ্যেই দুই ছেলে আইসা বারান্দায় এক পাশে দাঁড়াইল। ফোন বের করে সেলফি তুলতেছিল। ফোন বের করার পরেই আমি একটু চোখ কুঁচকায়া তাকানোর ভঙ্গিতে তাকায়া রাখালাম, যাতে ভুলক্রমেও আমার ছবি তোলার সাহস না করে। নৌকা একদম বারান্দার পাশ দিয়া যাচ্ছিল, আমি চিল্লায়া বললাম, রাইড কত মামা? সে বলল, প্রতি জন ১০০।

ওই ছেলে দুইটার একটা সঙ্গে সঙ্গে বলল, কয়জন নেন একবারে? সে বলল, তিনজন।

নৌকা বারান্দার পাশ দিয়া আবার হাতের ডানে চইলা গেল ব্রিজের নিচ দিয়া। তার আগেই ওখান থেকে আমি হাইটা চইলা আসলাম। ছেলেগুলি তারপর ওখান দিয়া আমার উল্টা দিকটায় গেল। নৌকা গেল পা চালিত বোটগুলির ওইদিকে। মনে হইল, নৌকা রবীন্দ্র সরোবরে আসবে আবার। দ্রুত গেলে ধরতে পারব। হাঁটার গতি বাড়ায়া দিলাম। ওখান দিয়া ব্রিজ দিয়া ঘুইরা ঠিক নৌকা যখন থামল সরোবরের কিনারায়, তখন আমিও পৌঁছলাম। ওই কাপল নামল। আমি বললাম, মামা উঠা যাবে এখন। সে বলল, হ্যাঁ। বললাম, তাইলে আমি উঠব।

নৌকার কাপল নামল। আমার পিছনে সিমেন্টের সিঁড়ি বা গাছের বেড়ির উপর আরেক কাপল বসা ছিল। তাদের মধ্যে ছেলেটা জিজ্ঞেস কর রাইড কত নেয়। তারপর তারাও উঠতে চাইল। একটা জিন্স পরা হুগনা ছেলে পাশে বইসা মাটি দিয়া চতুর্ভূজ বানাইতেছিল, সে উইঠা আইসা কাপলের ছেলেটার প্যান্ট টাইনা ধরল, বাই আমি নৌকায় উঠমু, আমারে লন। আমি সবার আগে গিয়া উঠলাম। নৌকায় তখনো বসি নাই, উইঠা দাঁড়ায়া আছি। পিচ্চিকে বললাম, অ্যাই আসো, আমি ভাড়া দিচ্ছি। সে আমার কথাই শুনল না।

কাপলের ছেলেটা পিচ্চিকে একটা ছোট ঠ্যালা মাইরা বলল, সরো সরো। তারপর তারা প্রথমে মেয়েটা তারপর ছেলেটা আইসা বসল। নৌকা একটু দুলল। এই দুলুনি খুব ভয় লাগল আমার, যদিও জানি পড়ব না। নৌকার প্রান্তে উইঠা স্যান্ডেল খুইলা হাতে নিয়া তারপর আরেক প্রান্তে গিয়া পাটির ওপর বসলাম। পিছনে ওই কাপল।

মাঝি জমিতে পা দিয়া ঠ্যালা মাইরা নৌকা আগায়া দিল। উইঠা চালাইতে শুরু করল। আমি ভাবতাম নৌকা চললে অন্য রকম লাগবে। কিন্তু নৌকার চলাচল খুব শান্ত আর আরামের। ভালো লাগে। খালি নৌকার যেই চঞ্চলতা আমি ভাবছি এতকাল আছে, তা পাই নাই। কিন্তু ভালোই লাগতেছিল। পানির উপরে থাইকা কম উচ্চতা থেইকা পানি দেখার আলাদা অনুভূতি তখন বুঝলাম। অনেক কাছে মনে হয় পানিকে।

কিন্তু সরোবরের কাছে আসার পর থেইকাই একটা অস্বস্তি হচ্ছিল। নৌকায় ওঠার পর বুঝলাম, একটা বাজে গন্ধ এখানে। মামাকে বললাম, মামা গন্ধ কি পানিতে? সে বলল, মাছ মরছে একটা। আমি বললাম, একটা মাছে এত গন্ধ!

সে তারপর হাত দিয়া নির্দেশ কইরা যেইখান থেইকা আমরা উঠছিলাম ওইখানের পাশেই এক জায়গা দেখাইল। দেখি একটা মাঝারি আকৃতির মাছ মইরা পইড়া আছে। তার পাশে কাউয়া ভরা, মাছের পেটের অংশটা ঠোঁকরায়া অনেকটুকু খাইয়া ফেলছে।

কাপলের মেয়েটা কী জানি আস্তে শাপলা শাপলা বলতেছিল। ওনাকে মাঝি বলল, না মামা, শাপলা ছিঁড়ন যাইব না। শাপলা ছিঁড়লে সমস্যা আছে। ছেলেটাও তাকে তাই বলল, যে শাপলা না ছিঁড়াই ভালো।

তারপর তারা আমার আর মাঝির উপস্থিতিতেই এত গভীর মনোযোগ সহকারে কথা বলতেছিল যেন তারা নৌকায় একা। ছেলেটা বলতেছিল, আপনাকে বলছিলাম না একটা বার নৌকায় চড়লে বুঝবেন। মেয়েটা অন্য দিকে তাকায়া হাসতেছিল। তো তাতে মনে হইল, তাদের প্রেম হচ্ছে হচ্ছে। এরকম কাপল দেখলে আমার খুবই আনন্দ হয়।

তো ছেলেটা বলতেছিল, একবার …(কোথাও একটা গেছে সে) গেছি, ঝুম বৃষ্টি, সবাই রাস্তার মাঝে বাইক থামিয়ে ভিজতেছিলাম আমরা। বৃষ্টিতে ভিজতে যে ভালো লাগে, আপনার ভিজা উচিত একদিন। মেয়েটা তেমনই হাসল, এইবার লজ্জা পাচ্ছে মনে হইল।

আমি ওর মধ্য বইলা উঠলাম, আপনারা একসঙ্গে জীবন উপভোগ করতে আগ্রহী দেখে খুব ভালো লাগল। কেন বলছিলাম কে জানে।

মেয়েটা সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটার দিকে তাকায়া শব্দ না কইরা হাইসা ফেলল, লজ্জা আনন্দ দুইজনই পাইছে। ছেলেটা বলল, আসলে আমি একজন ট্রাভেলার। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরি তো, প্রকৃতি খুব ভালো লাগে। সেজন্যই বলা।

নৌকা তখন সরোবর ধইরা আরো ডানে গিয়া ঘুইরা গেল। মাঝিকে বললাম, মামা আর সামনে যাবেন না? সে বলে, ওইখানে ৩২ নাম্বার যে! ওই দেখেন না নৌকা দেইখাই লোক খাড়ায়া গেছে। কাছে যাওয়া যাবে না।

আমি ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলাম, দেশের কয়টা জেলায় ঘুরেন নাই এখনো?

সে বলল, এখন পর্যন্ত ৪৮টা জেলায় ঘুরেছি। আর আমি একজন সাইক্লিস্ট। এই সবগুলো জায়গা কিন্তু সাইকেল চালিয়ে ঘুরছি।

মেয়েটা পানির দিকে হাসিমুখে তাকায়া আমাদের কথা শুনতেছিল। সে বৌয়ের মত বইসা ছিল নৌকার উপর। আমি দেখলাম আমিও ওইভাবে বসছি।

আমরা কিছুক্ষণ সবাই চুপ। তখন মাঝিকে জিজ্ঞেস করলাম, উনি এখানে কবে আসছেন। তো উনি বললেন, উনি নাকি এখানে অনেক বছর ধইরাই আছেন। আমি বললাম, আমি তো এখানে সবসময়ই আসি, আপনাকে তো দেখি নাই কখনো। সে বলল, সে এখানেই নৌকা চালায় অনেক দিন।

কিছুক্ষণ পরে ছেলেটা বইলা উঠল, আমি আসলে রিসেন্টলি বাইক কিনছি। তো এখন আর সাইকেল চালাচ্ছি না। কিন্তু বাইক কেনার পর তেমন কোথাও আর যাওয়া হয়নি।

আমি বলললাম, কেন? করোনার কারণে? সে বলল, করোনা, আরো নানা কারণে। তবে কুয়াকাটা গেছি শুধু একবার।

আমি বললাম, কুয়াকাটা মোট কয়বার গেছেন এই পর্যন্ত?

মেয়েটা ছেলেটার দিকে তাকাইল তার হাঁটুর উপর মাথা দিয়া। ছেলেটা বলল, পাঁচ ছয়বার তো হবেই।

আমি বললাম, আশা করি নেক্সট বার আপনারা একসঙ্গে যাইতে পারবেন। দুইজন দুইজনের দিকে তাকায়া হাসল। মেয়েটা মাথা তুইলা আবারো হাঁটু জড়ায়া বসল। তারপর তারা আবার নিজেদের আলাপে ঢুকল।

ততক্ষণে একটা পানির উর্ধ্বমুখী ঝর্নার মত আসল। ছেলেটা মাঝিকে বলল, কাছ দিয়ে গেলে কি অনেক ভিজে যাব? মাঝি বলল, একটু তো ভিজবেনই।

মেয়েটা বলল, না ভিজা যাবে না। ছেলেটা বলল, পানির ফোঁটা অনেক ছোট, ভিজবেন না, গায়ে লাগবে অল্প।

মাঝি ঝর্নার একটু বেশিই কাছ ঘেইষা গেল মনে হয়। ছোট ছোট ঠাণ্ডা পানির ফোঁটা গায়ে লাগতে শুরু করল আমাদের। মনে হইল আগের সব চেঞ্জ হয়ে গেছে। নৌকা একটা ঝর্নার মধ্যে ঢুকে গেছে।

আমি কুঁচকায়া চোখ বন্ধ করলাম কয়েক সেকেন্ডের মত। একজন সুন্দর চুলের লোককে সামনে বসা দেখতে পাইলাম। পানির আনন্দ আরো আরো বাড়ল। এই পানির মধ্যে কেন আসি নাই কখনো তাই ভাবলাম।

কাপলের দুইজনই বৃষ্টির ফোঁটা ধরার মত দুই হাতের তালু দুইদিকে দিয়ে রাখছে। ঝর্নার পানি ঝড়ার শেষ প্রান্তে আইসা তারা নিজেদের দিকে তাকাইল। ছেলেটা মেয়েটাকে বলল, দেখছেন দেখছেন!

মেয়েটা হাসতেছিল, বলল, ভিজি নাই একদম ভালো হইছে, ভিজলে খবর ছিল।

ঢাকা, ৯ মে ২০২১

(কভারে অর্জয়িতা রিয়া; ধানমণ্ডি লেক ২০২০)