আমার বান্ধবীদের মধ্যে অন্যতম সুন্দরী টিনা। সবসময়ই তাকে কোনো না কোনো ছেলে লাইন মারতেছে আর সেও কোনো না কোনো ছেলের সাথে প্রেম প্রেম ভাব করতেছে।
সবসময় তার জুনিয়র ছেলেদের সাথে প্রেম হয়। মানে যখন সে ক্লাস নাইনে তখন তার প্রেম হয় ক্লাস সেভেনের ছেলের সাথে, যখন সে ক্লাস টেনে তখন হয় ক্লাস নাইনের ছেলের সাথে। এসব নিয়ে আমরাও হাসাহাসি করতাম, সেও হাসাহাসি করতো।
একসময় তার একটা ভালো প্রেম হইল। প্রেমিকের নাম সায়েম। তার চেয়ে বয়সে দুই বছরের বড়। লেখাপড়ায় ভাল কিন্তু দেখতে বাচ্চা বাচ্চা। তার উপর টিনা সায়েমের চেয়ে লম্বা। তাই আমরা ধরেই নিছি এই প্রেমের মেয়াদ সর্বোচ্চ তিন মাস।
কিন্তু কীভাবে কীভাবে যেন এই ছেলের সাথে তার প্রেম বেশ টিকে গেল। দেখতে দেখতে এক বছর গেল। অথচ আমাদের একবারও সেই ছেলের সাথে কথাবার্তা হইল না। দূর থেকে মাত্র একবার দেখছিলাম ওই ছেলেকে।
টিনা ইচ্ছা করেই আমাদেরকে ওই ছেলের সাথে মিশতে দিত না। তার আগের প্রেমিকদের কাউকেই আমরা দেখি নাই। কারণ টিনা তার প্রেমিকদের ধারেকাছেও অন্য মেয়েদের যাইতে দেয় না।
স্কুল শেষে আমরা একেকজন একেক কলেজে চলে গেলাম। পরে আমাদের যোগাযোগও অনেকটা কমে গেল। মাঝে মাঝে কথা হইলে জিজ্ঞেস করতাম “কীরে তোর ওই ছেলের সাথে প্রেম আছে এখনো?”
একদিন হঠাৎ টিনা আমাকে ফেসবুকে নক করল। প্রেম হবার পর থেকে সে খুব একটা খাতির-টাতির করে না আমাদের। আর এমনি এমনি ফেসবুকে নক তো সে করবেই না। আমি জিগ্যেশ করলাম, কীরে কী খবর?
টিনা: ভালো না রে। তোকে ওইদিন ফোন দিছিলাম, ধরলি না ক্যান?
আমি: কবে ফোন দিছিলি? আমি মে বি ক্লাসে ছিলাম তাই দেখি নাই।
টিনা: দোস্ত একটা খুব খারাপ ঘটনা হইছে। আজকে কলেজ শেষে আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে টিএসসিতে গেছিলাম। তারপর বন্ধুদের বিদায় দিয়ে আমি আর সায়েম সোহরাওয়ার্দী গেছিলাম। সেইখানে আমাদেরকে পুলিশে ধরছে।
আমি: পুলিশে ধরছে মানে? তোরা কী করতেছিলি? পুলিশে ধরবে ক্যান?
টিনা: আরে কিছু করি নাই। ওরা নাকি ইউনিফর্ম পরা ছেলেমেয়ে একসাথে দেখলে ধইরা থানায় নিয়ে যায়।
আমি: তারপর?
টিনা: তারপর আর কী? আমাদেরকে শাহবাগ থানায় নিয়া গেছে। গার্জিয়ান ছাড়া ছাড়বে না। আমি তোরে আর ন্যান্সিরে ফোন দিছিলাম। তোরা কেউই ধরলি না। পরে আর কী করব, আব্বারে ফোন দিয়া ডাইকা আনছি।
আমি: হায় হায়! আংকেল সায়েমরে দেখে কিছু বলে নাই?
টিনা: ওরে পুলিশ ধরতে পারে নাই। ও দৌড় দিয়া পালাইছিল। আর আমি কান্নাকাটি করে পুলিশকে রিক্যুয়েস্ট করছি সায়েমের কথা যেন আব্বারে না বলে। পুলিশটা ভাল ছিল। আব্বারে কিছু বলে নাই।
আমি: কী বলছে? আব্বু তোরে পিটায় নাই?
টিনা: না পিটায় নাই। পুলিশ বলছে, আমাদের কলেজের কয়েকজনরে একসাথে পাইছে সবাইরে নিয়ে আসছে। বাকিদের ওদের বাপমা’রা নিয়া গেছে। পুলিশটা ভাল ছিল।
আমি: ভাল হইলে তোদের ধরত না।
টিনা: ওইটা তো টাকা খাওয়ার জন্য ধরছে।
আমি: তো সায়েমের কী অবস্থা?
টিনা: ওর আর কী? পালায়ে গিয়ে ভালই করছে। নাইলে সেই ধরাটা খাইতাম!
এরপরও নাকি একদিন ওদের সাথে আবার ওই পুলিশের দেখা হইছিল। পুলিশ নাকি ওদের দুইজনের দিকে তাকায়ে হাসছিলোও ।
এরপর এরকম আরো বেশ কয়েকটা ঘটনা এর-ওর মুখে শুনছি। অমুক কলেজের ছেলে তমুক কলেজের মেয়ে। একসাথে ঘুরাঘুরি করছে বলে তাদেরকে পুলিশ ধরে নিছে। মেয়ের কলেজ/কোচিং বন্ধ হয়ে গেছে। আরো বহু কিছু।
তবে সবচেয়ে বেশি যে ঘটনাটা ছড়াইছে সেইটা নটরডেম কলেজের ছেলে আর অন্য এক কলেজের এক মেয়ে নিয়ে। এরা দুইজনই নাকি কলেজ ইউনিফর্মে ছিল।
এবারের পুলিশ টিনাদেরটার মত ভাল ছিল না। এদেরকে আজিমপুর কলোনি থেকে ধরে থানায় তো নিয়ে গেছেই পাশাপাশি এমন সিন ক্রিয়েট করছে যে পুরা রাষ্ট্র হয়ে গেছে, নটরডেম কলেজের একজন ছাত্রকে অন্তরঙ্গ অবস্থায় পাওয়া গেছে!
আসলে কোন অবস্থায় পাওয়া গেছে সেই ব্যাপারে অবশ্য আমার সন্দেহ আছে। কারণ যাদের পোস্ট দেখে আমি খবরটা পাইছি তারা সবাই এনডিসিতে না-টেকা ছাত্র। তাই তারা ব্যাপারটাতে একটু বেশি লাফাবে সেটাই স্বাভাবিক। সেই ছেলেকে নিয়ে সব আজেবাজে কথায় তাদের স্ট্যাটাস ভর্তি ছিল। যেন তারা নিজেরা সব ধোয়া তুলসি পাতা!
এ ব্যাপারে অবশ্য আমার এক বন্ধু বলছিল, “অবশ্যই লাফাব। লাফাব না ক্যান? প্রেম করা খারাপ কিছু না। সবাই করে। আমরাও করি। কিন্তু ধরা খাইলেই সমস্যা। ধরা খাবে ক্যান? ধরা যখন খাইছে তখন তো লাফাবই, তাই না?”
আমার সব বান্ধবীরা এরপর আর কোন রিস্ক নেয় না। সব অ্যালার্ট হয়ে গেছে। কলেজ ড্রেসে ছেলেদের সাথে দেখা করতে হলে তারা ড্রেসের উপর বোরকা পড়ে নেয়। আমার অবশ্য কখনো কলেজ শেষে কোথাও যাইতে হয় নাই। কারণ কলেজে ঢোকা মাত্র আমার মাথায় একটা চিন্তাই ঘোরে সেইটা হচ্ছে কখন এই জেলখানা থেকে বের হয়ে বাসায় গিয়ে ঘুমাব! তাই কলেজ শেষে আমি একটুও সময় নষ্ট না করে বাসায় চলে যাই। ফার্স্ট সেমিস্টার পরীক্ষা শেষে আমার আঁতেল বান্ধবী মাইশা আবদার করে বসছে সে নীলক্ষেত যাবে বই কিনতে, আমি যেন যাই তার সাথে। তখন ঠাণ্ডায় আমার জ্বর-টর হয়ে, টনসিল ফুলে ঢোল হয়ে গেছে। পরীক্ষাই ভাল ভাবে দিতে পারি নাই। তার এই আবদার শুনে আমার খুব মেজাজ খারাপ হইল।
তখন সে কান্না করে করে আমাকে বোঝাইল ওর সাথে ওর দুই বন্ধু যাবে। দুইজনের গায়েই এনডিসির ইউনিফর্ম থাকবে কারণ ওরা কলেজ শেষে আসবে।
আমি বললাম, ওদের নেয়ার দরকার কী?
মাইশা বলল, ওদের মধ্যে একজন নাকি দোকান-টোকান চিনে ভাল। আরেকজন ওর প্রতিবেশী। সেও বই কিনবে। ওর বাসা যেহেতু যাত্রাবাড়ি তাই দুইজনে একসাথে ফিরলে সুবিধা। (ওদের দুইজনকে একসাথে বাসায় ফিরতে দেখলে কেন পুলিশ ধরবে না সেই প্রশ্ন আমার মাথায় আসছিল। কিন্তু আমি ওকে কিছু বললাম না।) ও বলল, অন্য এরিয়া হলে নাকি আমাকে নিত না। কিন্তু যেহেতু এই এরিয়ায় পুলিশের উৎপাত বেশি তাই আমাকে অবশ্যই যাইতে হবে।
আমরা চারজন বাসে উঠলাম। মাইশা পকেট মানি জমায়ে গল্পের বই কিনে তাই জমানো টাকার এক পয়সাও সে বাজে খরচ করবে না। বাসে বসে মাইশার কাঁধে মাথা রেখে, ঝিমাতে ঝিমাতে আমি আমার চিটাগাং আর কক্সবাজারের কোচিংগুলির কথা ভাবতেছিলাম। আমরা কীভাবে ছেলেমেয়েরা একসাথে ক্লাস করতাম, মারামারি করতাম। বড় বোনদের দেখছি কলেজ কোচিং শেষে বন্ধুবান্ধব সবাই একসাথে বাসায় ফিরত। কলেজ ফাঁকি দিয়ে বন্ধুবান্ধব নিয়ে ঘুরতে চলে যাইত।
ঢাকা ছাড়া আর কোথাও আমি ছেলে-মেয়ের আলাদা ব্যাচের কলেজ/কোচিং দেখি নাই। আমি ছোটবেলা থেকে সবসময়ই ছেলেদের সাথে মিশে মিশে বড় হইছি। আমার বেস্ট পাঁচজন ফ্রেন্ডের লিস্ট যদি আমাকে করতে হয় তাইলে দেখা যাবে পাঁচটাই ছেলে।
ঢাকায় আসার পরে প্রথম দিকে সমবয়সী কারো সাথেই আমার তেমন বন্ধুত্ব হয় নাই। আমি সবসময়ই বড় বোনের বন্ধুবান্ধবদের সাথে ঘুরে বেড়াতাম। একদিন আমি আর এক ভাইয়া নিউমার্কেট থেকে কেনাকাটা শেষে ফুচকা খাইতে যাই। সেখানে আমার এক ক্লাসমেটের সাথে দেখা। সে আমাকে দেখে কথাবার্তা কিছু না বলে মুচকি মুচকি হাসতে থাকে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করি, কীরে কী খবর? সে আরও বেশি মুচকি হেসে আমাকে উত্তর দেয়, ভাল। তুমি ফুচকা খাও। টা টা।
বলেই চলে গেল। তার বলার ভঙ্গিটা এতই অড ছিল যে আমি নিজেই ওই ভাইয়ের সামনে বিব্রত হয়ে গেছিলাম। চিটাগাংয়ে থাকার সময়ও আমি অনেক ভাইয়াদের সাথে একেক সময় একেক জায়গায় ঘুরতে গেছি, তখনও বিভিন্ন বন্ধুবান্ধব, ক্লাসমেট, পরিচিত লোকজনের সাথে আমার দেখা হইত। কিন্তু এমন বাজে হাসি শুনতে হয় নাই কখনো।
কয়েকদিন আগে আমি মানিকগঞ্জ এক দাদার বাসায় গেছিলাম। মানিকগঞ্জের একেবারে ভিতরের একটা গ্রামে। একদিন ছিলাম। ওইখানে কারেন্ট নাই। ভাল রাস্তা নাই। ছোট ছোট ছেলেমেয়ে থেকে শুরু করে বড় বড় ছেলেমেয়েরাও সাইকেল চালায়। সবাই একসাথে মাঠে খেলে। গান গায়। অথচ ঢাকায় এইটা ভাবাই যায় না। ছেলেদের সাথে মিশি বলে আমার নামকরা কলেজে পড়ুয়া সহপাঠী, সহপাঠিনীরাই আমার নামে বিভিন্ন কথাবার্তা বলে বেড়ায়।
ক্লাস নাইনে আমি ঢাকায় এসে একটা গার্লস স্কুলে ভর্তি হইছিলাম। আর সব কোচিংয়ে ছেলে-মেয়েদের ব্যাচ আলাদা। কেন জানি আমার এখানে তেমন ভাল কোনো বন্ধু হয় নাই। কাউকেই বেশি ভাল লাগত না বলে মিশতামও কম। পরে পরে আমার অবশ্য কিছু ভাল বন্ধু হইছিল।
ক্লাস টেনের মাঝামাঝি সময়ে এক বান্ধবীর মাধ্যমে আমার গভমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুলের এক ছেলের সাথে পরিচয় হয়। আমি তাকে বলছিলাম, “তুমিই আমার পরিচিত একমাত্র ছেলে সহপাঠী। ক্লাস টেনের আর কোনো ছেলেকেই আমি চিনি না।”
পরে কথায় কথায় জানা গেল আমি যেই কোচিংয়ে ফিজিক্স-কেমিস্ট্রি পড়ি সেও একই কোচিংয়ে ফিজিক্স-কেমিস্ট্রি পড়ে। আমি যেই কোচিংয়ে ইংলিশ পড়ি সেও একই কোচিংয়ে ইংলিশ পড়ে। অথচ আমরা কেউই কাউকে চিনি না।
এ ব্যাপারে অবশ্য গার্জিয়ানদের ভূমিকাই বেশি বলা যায়। আমি এখন যে কয়টা স্যারের কাছে পড়ি উনারা সবাই মোটামুটি ছেলেমেয়ে একসাথে ব্যাচ পড়ান। আমার অনেক বান্ধবীদের বাবামা তাদের ওই কোচিংগুলিতে পাঠান নাই। কয়েকজনের বাবা মা বেছে বেছে এমন ব্যাচ নির্বাচন করছেন যে-ব্যাচে ছেলের সংখ্যা সবচেয়ে কম। এদের বাবামা এদের ক্লাসে পাঠায় স্যারের পিছনে পিছনে। ক্লাসে পাঠাবার পরে বাবা/মা ক্লাসরুমের বাইরে দাঁড়ায়ে থাকেন। ক্লাস শেষ হওয়া মাত্রই মেয়েকে নিয়ে চলে যান।
আমাদের টিনার বাবামা’ও এরকম। টিনা সবসময় বলে, “আমি তো অবশ্যই বাসা থেকে পালায়ে যেয়ে বিয়ে করব? ক্যান জানিস? আমার আম্মারে টাইট দেয়ার জন্য।” ওর ভাষ্যমতে, সব সময়ই ওর সাথে একটা করে বডিগার্ড থাকত বলেই সে জেদ করে স্কুল পালায়ে, কোচিং পালায়ে এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়াইত।
শুধুমাত্র মেয়েদের ক্ষেত্রেই যে এমন হয় সেটা কিন্তু না। ঢাকায় আমি এমন অনেক ছেলেকেও চিনি যাদের মা সবসময় তাদেরকে কলেজ/কোচিংয়ে দিয়ে যায়, নিয়ে যায়।
আর আমার মা… জীবনে কোনদিনও আমার স্কুলে যান নাই। শুধু আমার মা কেন চিটাগাংয়ে আমার অনেক বান্ধবীর মা-ই বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কখনো মেয়েদের পিছে পিছে স্কুল/কলেজে গিয়ে হাজির হন না।
আর চকরিয়ার গ্রামের স্কুলে তো এই দৃশ্য নাই-ই। ওইখানে বাবামা’রা ছেলেমেয়ে কোন স্যারের কাছে পড়ে সেইটা জানেও না। শুধু ঢাকাতেই আমি এই দৃশ্য দেখলাম। আমার মা শুধু এসএসসি পরীক্ষার সময় আমাকে আমার পরীক্ষার হল পর্যন্ত নিয়ে গেছিল। আমার সব কোচিং/স্কুল/কলেজ সবখানেই আমি সবসময় একা একা গেছি।
ঢাকায় আসার পর প্রথম যেদিন আমি আমার স্কুলে গেছি ভর্তি হইতে ওইদিনই আমার বড় বোন আমাকে বলছিল, ভাল করে চিনে রাখ কালকে থেকে তোকে একাই আসতে হবে কিন্তু!
একটু হাবাগোবা টাইপ বলে স্কুল/কোচিং/কলেজে যাওয়ার সময় আমি বহুবার রাস্তা হারায়ে ফেলছি! নিজে নিজে আবার রাস্তা খুঁজে বের করছিও। আর খুঁজে না পাইলে চুপচাপ রিকশা নিয়ে বাসায় চলে আসতাম।