অ্যাপার্থেইড বা কাঠামোগত বর্ণবাদ ছিল একটা আপাদমস্তক ব্যবসায়িক পরিকল্পনা—এবং সাউথ আফ্রিকায় জন্ম নেওয়া ইলন মাস্ক সেই পরিকল্পনাকেই আধুনিক যুগের জন্য নতুন করে সাজাইতেছেন।
ক্ষমতায় আসার পর ডোনাল্ড ট্রাম্প শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদ প্রতিষ্ঠা করতে যেসব বর্ণবাদী পদক্ষেপ নিছেন, তার মধ্যে সাউথ আফ্রিকা বিষয়ে নেওয়া সিদ্ধান্ত অন্যতম।
এলি মিস্টাল
দ্য নেশন, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
অনুবাদ: অর্ণব ফেরদৌস
গত ৭ ফেব্রুয়ারি ট্রাম্প একটা এক্সিকিউটিভ অর্ডারে সাউথ আফ্রিকায় এইচআইভি প্রতিরোধে সকল সহায়তা কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশ দেন। এর কারণ হিসাবে তিনি দেশটির ভূমি সংস্কার আইনের কথা উল্লেখ করেন। ট্রাম্প বলেন, কৃষ্ণাঙ্গ শাসিত সাউথ আফ্রিকায় শ্বেতাঙ্গরা “নির্যাতিত” হইতেছে, তাদের উচিত আমেরিকায় পুনর্বাসিত হওয়া। সেখানে তাদেরকে ‘শরণার্থী’ হিসাবে গ্রহণ করা হবে।
– – – – – –
“অ্যাপার্থেইড” শব্দটা আসছে আফ্রিকান্স ভাষা থেকে, যেখানে “Apartheid” অর্থ “বিচ্ছিন্নতা” বা “আলাদা থাকা”। এই শব্দটা বিশেষভাবে দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ শাসনাধীন সময়ের সেই সরকারি নীতিগুলিরে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়, যেখানে বর্ণবাদী নীতির ভিত্তিতে শ্বেতাঙ্গ ও অশ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীর মধ্যে কঠোর সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক বিভাজন তৈরি করা হইছিল। অর্থাৎ, “অ্যাপার্থেইড” হল প্রাতিষ্ঠানিক বর্ণবাদের একটি কাঠামোগত রূপ, যা আইন দ্বারা অনুমোদিত ছিল।
এর সঠিক উচ্চারণ হল /ˈɑːpɑːrtheɪd/ (আ-পার-থেইড)। যদিও অনেক সময় ইংরেজিতে কেউ কেউ “অ্যাপার্টহেইড” বলে, তবে আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত এবং বেশি ব্যবহৃত উচ্চারণ হল “অ্যাপার্থেইড”।
– – – – – –
একদিকে ট্রাম্প আমেরিকায় বসবাসকারী কৃষ্ণাঙ্গ আর ব্রাউন শরণার্থীদের দেশ থেকে বের করে দিতেছেন, অন্যদিকে সাউথ আফ্রিকান শ্বেতাঙ্গদের জন্য বর্ডার খুলে দিতেছেন। এই জাক্সটাপজিশন দেখে আমার মনে হয়, ট্রাম্প শুধু নীতিগতভাবেই না, ব্যক্তিগতভাবেও বর্ণবাদী। একই কারণে আমার এটাও মনে হয়, ট্রাম্প একজন পাপেট ডিকটেটর। যার মূল নিয়ন্ত্রণ আসলে সাউথ আফ্রিকান শ্বেতাঙ্গ ইলন মাস্কের হাতে। সম্প্রতি সাউথ আফ্রিকা নিয়ে ট্রাম্পের নির্দেশ ও টুইটগুলি দেখলেও এটা বোঝা যায়, যেন ইলন মাস্কের কথা উনি তোতাপাখির মত পুনরাবৃত্তি করতেছেন।

মাস্ক নিজের হাতে প্রচুর ক্ষমতা নিছেন। এখন প্রশ্ন হইল, এই ক্ষমতা উনি কীভাবে ব্যবহার করবেন? এই ব্যক্তি অলরেডি পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী লোক। তার আচরণ অনেকটা দ্য সিম্পসন অ্যানিমেশন সিরিজের মন্টি বার্নস এর মত। মন্টি বার্নসের ফিলসফি, “আরেকটু বেশি পাওয়ার জন্য আমি সবকিছুই বাজি ধরতে পারি।” কিন্তু শেষ পর্যন্ত টাকা সবসময় একটা লক্ষ্যে পৌঁছানোর মাধ্যম, চূড়ান্ত লক্ষ্য না।
মাস্ক তার ডজ (Department of Government Efficiency, DOGE) গ্রুপের সমর্থন ব্যবহার করে আমাদের আমেরিকা সরকার কাঠামোর ভিত্তি নড়বড়ে করেই থামবেন না—নব্য-বর্ণবাদ প্রতিষ্ঠার দিকে আগাবেন। তিনি কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানদের চাকরির ন্যায্য সুযোগ বন্ধ করতে চাইতেছেন। শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদের সেই বিতর্কিত ও ভুল ধারণা প্রচার করতেছেন যে, প্রতিটা শ্বেতাঙ্গ পুরুষ জন্মগতভাবেই যেকোনো নারী, ট্রান্সজেন্ডার বা অশ্বেতাঙ্গ পুরুষের চাইতে চাকরির জন্য বেশি যোগ্য।
অবশ্য এতে মাস্কের ব্যক্তিগত স্বার্থ আছে। মাস্ক তার ১৭ বছর বয়স পর্যন্ত শ্বেতাঙ্গ নিয়ন্ত্রিত সাউথ আফ্রিকায় বসবাস করছেন। তিনি সম্প্রতি সাউথ আফ্রিকার বর্ণবাদ পরবর্তী ভূমি সংস্কার আইনকে “রেসিস্ট ওনারশিপ আইন” বলে মন্তব্য করছেন। কোনো তথ্য-উপাত্ত ছাড়াই একটা সম্ভাব্য শ্বেতাঙ্গ “গণহত্যা” বিষয়ে সাউথ আফ্রিকানদের সতর্ক করছেন।
ট্রাম্প যখন সাউথ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গদের আমেরিকায় পুনর্বাসনের প্রস্তাব দিছেন, তখন শ্বেতাঙ্গ আর কৃষ্ণাঙ্গরা একসঙ্গে এই প্রস্তাবকে ‘রিডিকুলাস ও লেইম’ বলে জোহানেসবার্গের রাস্তায় প্রতিবাদ করছে। মাস্ক হয়ত জানেন না, যেসকল সাউথ আফ্রিকান শ্বেতাঙ্গ দেশ ছেড়ে পালায় নাই, তাদের জীবন এখন কেমন। শুধু এটাই জানেন যে, সাউথ আফ্রিকা একসময় রেসিস্ট শ্বেতাঙ্গদের স্বর্গ ছিল, এখন আর তা নাই। কারণ কৃষ্ণাঙ্গরা সমান অধিকার অর্জন করছে।
যদিও এই বিষয়টা আমার এত বিস্তারিত বলার প্রয়োজন নাই, তবু শ্বেতাঙ্গ পাঠকদের জন্য বলা যায়। বিশেষত, যারা ট্রাম্পের প্রকাশ্য বর্ণবাদকে বর্ণবাদ বলতে রাজি না—সাউথ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গরা নির্যাতিত নয়। সাউথ আফ্রিকার জনসংখ্যার মাত্র ৭ শতাংশ শ্বেতাঙ্গ, কিন্তু তারা প্রায় ৭৫ শতাংশ জমির মালিক। কয়েক শতাব্দী ধরে চলা আদিবাসী কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর শ্বেতাঙ্গদের সহিংসতা ও নিপীড়নই এর কারণ। যে শ্বেতাঙ্গ শ্রমিকশ্রেণীর জমি নাই, তারাও সাউথ আফ্রিকাতে বেশ ভাল আছে। একই অবস্থানে থাকা কৃষ্ণাঙ্গ শ্রমিকদের চাইতে তারা প্রায় তিনগুণ বেশি আয় করে। বরং বলা যায়, সাউথ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গরা ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় অনেক ভাল অবস্থায় আছে।
কিন্তু এখন শ্বেতাঙ্গরা সরকারের ক্ষমতায় নাই। এবং আমার বিশ্বাস, এটাই শ্যাডো প্রেসিডেন্ট মাস্ক ও তার অনুসারীদের বিরক্তির কারণ। ২০২২ সালে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত একটা প্রতিবেদনে বলা হইছে, মাস্ক বর্ণবাদী সরকারের অধীনে সামরিক বাহিনীতে কাজ করতে চান না বলেই সাউথ আফ্রিকা ছাড়ছিলেন। শোনা যায়, মাস্কের বাবা-মা বর্ণবাদের সমর্থক ছিলেন না। কিন্তু তারা ঠিকই জাম্বিয়ার পান্না খনিতে (Emerald Mine) কৃষ্ণাঙ্গ শ্রমিকদের শোষণ করে সম্পদ বানাইছেন।
মাস্ক যদি এখন নিজেকে বর্ণবাদ বিরোধী দাবি করেন, তাইলে হয়ত ওনার মতাদর্শের পরিবর্তন হয়ে থাকবে। ইওইন হিগিন্সের লেখা ‘Owned’ বইয়ে মাস্ক কীভাবে MAGA-র কট্টর সমর্থকে পরিণত হইছেন, সে বিষয়ে কিছু ধারণা দেওয়া আছে।

তবে, যে ব্যক্তির পরিবার সাব-সাহারান আফ্রিকানদের ধর্ষণ ও লুণ্ঠন করে নিজেরা বিলিয়নিয়ার হওয়ার রাস্তা বানাইছে, তার ব্যক্তিগত ইন্টেলেকচুয়াল জার্নি নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নাই। একটা প্রবাদ আছে, সকল অত্যাচারীর রূপ অভিন্ন। মাস্ক বা তার অনুসারীরা যদি সত্যিই বর্ণবাদকে খারাপ মনে করত, তাইলে তারা সেই ব্লাডমানি ফেরত দিত। মাস্ক সাউথ আফ্রিকার বর্ণবাদ নিয়ে কী ভাবেন, বা কী ভাবেন বলে দাবি করেন, বা তার পাপেটদের দিয়ে কী বলাইতে চান—তা নিয়ে আমি মাথা ঘামাইতে রাজি না। বরং আমার কাছে উদ্বেগের বিষয় হইল, মাস্ক কীভাবে এই দেশে একটা নিও-অ্যাপার্থেইড বা নব্য-বর্ণবাদী কাঠামোর অর্থনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে যাইতেছেন।
১৯৯৪ সালে বর্ণবাদ বিলুপ্তির পর যাদের জন্ম, তারা এই ব্যবস্থাকে বিভাজন, নিষ্ঠুরতা এবং চরম সামাজিক ও রাজনৈতিক সহিংসতা হিসাবেই জানে। কিন্তু সাউথ আফ্রিকার বর্ণবাদ মূলত একটা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ছিল। এই সিস্টেম ডিজাইন করা হইছিল সাউথ আফ্রিকার কর্মজীবী শ্বেতাঙ্গদের স্বার্থ রক্ষার জন্য। যারা চাকরি বা অর্থনৈতিক খাতে কৃষ্ণাঙ্গদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পারতেছিল না।
সাউথ আফ্রিকার জনগণ বর্ণবাদকে অর্থনৈতিক নীতি হিসাবে ভাবতে পছন্দ করে না। এর কারণ, অর্থনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর শেতাঙ্গদের করা ভয়াবহ অত্যাচার, অবিচার ও সামাজিক বিভাজন। সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষ্ণাঙ্গদের সকল সরকারি সুবিধা থেকে বঞ্চিত করতে তাদের ওপর রাষ্ট্রীয় বর্বরতা চালাইত। এই প্রকাশ্য নৃশংসতার আড়ালে অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিষয়টা চাপা পড়ে যায়।
আমি মনে করি, বর্ণবাদ কী ছিল তা বুঝতে এর ভিত্তিগুলি বোঝা জরুরি। এতে আমেরিকায় এখন কী ঘটতেছে তা বোঝা সহজ হবে। সাউথ আফ্রিকায় বর্ণবাদ চাপাইয়া দেওয়ার জন্য সেই সময়ের শ্বেতাঙ্গ সরকারকে যে বর্বর রাজনৈতিক পথ বেছে নিতে হইছিল, এই সময়ের আমেরিকায় তা অপ্রাসঙ্গিক। কারণ শ্বেতাঙ্গরা আমেরিকায় মাইনরিটি না—তার মানে, শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদীদের জন্য কৃষ্ণাঙ্গদেরকে ভোটাধিকারের মত অন্যান্য রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণে জোরপূর্বক বাধা দেওয়ার প্রয়োজন নাই। যতদিন শ্বেতাঙ্গরা রিপাবলিকানদেরকে ভোট দিতে থাকবে, ততদিন পর্যন্ত এমনিতেই আমেরিকার নিয়ন্ত্রণ শ্বেতাঙ্গদের হাতে থাকবে।
আমাকে ভুল বুইঝেন না, ট্রাম্পপন্থী শেতাঙ্গরা এই সহজ সমীকরণ বুঝতে পারলেও সহিংসতা কমাবে না। কারণ সহিংসতায় তারা আনন্দ পায়। তবে কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানদের সঙ্গে বর্ণবাদী সহিংস আচরণ তো MAGA রেজিমের জন্য নতুন কিছু না। অতীতে সাউথ আফ্রিকায় বর্ণবৈষম্য আর হিংস্রতা ছিল রাজনৈতিক হাতিয়ার, কিন্তু বর্তমান আমেরিকায় এগুলির দরকার নাই। যেহেতু এখন রিপাবলিকানদের হাতেই সরকারের সব ক্ষমতা, তারা চাইলেই কৃষ্ণাঙ্গ শ্রমিকদের অত্যাচার, শোষণ কিংবা অর্থনৈতিকভাবে কোণঠাসা করতে পারবে। অন্তত যতদিন পর্যন্ত শ্বেতাঙ্গরা, বিশেষ করে শ্বেতাঙ্গ নারীরা লাইন ধরে বিশ্বস্তভাবে এই শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যের পক্ষে ভোট দিয়ে যাবে।

মাস্ক এবং তার বেআইনি ডজ (DOGE) সংগঠনের কাজকর্ম দেখলে মনে হয় তারা আমেরিকাতেও অর্থনৈতিক বর্ণবৈষম্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়। আমার এই আশঙ্কা অনেকের কাছে বাড়াবাড়ি মনে হইতে পারে, আমিও আশা করি তাই হোক। কিন্তু একটা বর্ণবাদী প্রশাসনের সঙ্গে বর্তমান ট্রাম্প প্রশাসনের পার্থক্য যে কী, তা যেমন আমি বুঝতেছি না, আমার ধারণা, আপনিও বুঝতে পারবেন না।

যদিও DOGE একটা টেম্পোরারি সংস্থা, তারপরও ফেডারেল সরকারের কাঠামো আর নীতিতে এর বড় ধরনের প্রভাব পড়তে পারে।
ট্রাম্প আর ইলন মাস্ক সাউথ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গদেরকে বলতেছেন, আমেরিকা তাদের “বাড়ি”। এই দুইজন ব্যক্তি আর কী করলে লোকজন তাদের আসল উদ্দেশ্য বুঝতে পারবে? নেলসন ম্যান্ডেলাকে কবর থেকে তুলে আবার জেলে ভরলে?
ব্যবসায় বর্ণবৈষম্য চর্চার ইতিহাস ডোনাল্ড ট্রাম্পের চাইতে ইলন মাস্কের বেশি। বর্ণবৈষম্যের কারণে ক্যালিফোর্নিয়ায় তার টেসলা ফ্যাক্টরির বিরুদ্ধে ইকুয়াল অ্যামপ্লয়মেন্ট অপরচুনিটি কমিশনের করা একটা মামলা আছে। মামলায় করা অভিযোগ দেখলে মনে হয়, মাস্কের কর্মসংস্থান প্র্যাকটিস যেন সরাসরি বর্ণবাদী হ্যান্ডবুক থেকে কপি করা। ২০২৩ সালের একটা প্রেস রিলিজে কমিশনের অভিযোগটা এইভাবে প্রকাশ হয়:
“EEOC-এর মামলা অনুসারে, ২০১৫ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত, ক্যালিফোর্নিয়া টেসলার ফ্রেমন্ট উৎপাদন কেন্দ্রে কৃষ্ণাঙ্গ কর্মচারীরা নিয়মিত রেসিয়াল অ্যাবিউজ, ব্যাপক স্টেরিওটাইপিং এবং শত্রুতার শিকার হতেন। সেই সঙ্গে এন-ওয়ার্ডস, মাঙ্কি, বয় এবং ব্ল্যাক বিচের মত বিভিন্ন শব্দ ব্যবহার করে গালিগালাজ করা হত। হাই ট্রাফিক এরিয়া এবং ওয়ার্কার হাবের মত পাবলিক প্লেসে এই ধরনের অপমানজনক শব্দ কৃষ্ণাঙ্গদের বিরুদ্ধে ক্যাজুয়ালি ও প্রকাশ্যে ব্যবহার করা হত। EEOC আরও জানায়, বাথরুমের দেয়াল, ব্যবহার্য ডেস্ক, সরঞ্জামাদি, লিফটের ভিতরে, এমনকি প্রডাকশন লাইন থেকে বের হওয়া নতুন গাড়িতেও এন-শব্দের বিভিন্ন রূপ, স্বস্তিকা চিহ্ন, থ্রেট এবং ফাঁসির দড়ির মত গ্রাফিতি কৃষ্ণাঙ্গ কর্মচারীরা নিয়মিতই দেখতে পাইতেন।”
ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় এসেই টেসলা ফ্যাক্টরিতে চলমান সকল তদন্ত বন্ধ করে দেন। এইটা তো হওয়ারই কথা। যে জানে, সাউথ আফ্রিকার ওল্ড স্কুল বর্ণবাদ কীভাবে কাজ করত, তার জন্য টেসলা ফ্যাক্টরির ঘটনাকে বর্ণবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক চেষ্টা হিসাবে রিকগনাইজ করতে অসুবিধা হবার কথা না। মাস্ক বড়জোর ডিজিটাল যুগ ও আমেরিকান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় সেই পুরোনো বর্ণবাদেরই আধুনিকায়ন করবেন।
প্রথম এবং সবচে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হল, অ্যাপার্থেইড বা কাঠামোগত বর্ণবাদ একটা আপাদমস্তক ব্যবসায়িক পরিকল্পনা। কৃষ্ণাঙ্গ শ্রমিকদের শোষণ করতে বর্ণবাদী সিস্টেম ডিজাইন করা হইছিল। যেন কৃষ্ণাঙ্গদের কঠোর পরিশ্রমের বিপরীতে তাদেরকে আর্থিক ও সামাজিক সুবিধাগুলি থেকে বঞ্চিত করা যায়। সাউথ আফ্রিকায় বর্ণবাদ যেভাবে ফাংশন করত, শ্রমিক পদ থেকে কৃষ্ণাঙ্গদের কখনও উচ্চ পদে পদোন্নতি হত না। শ্বেতাঙ্গরা এটাকে বলত ‘কালার বার’। ১৯১১ সালে অফিসিয়ালি মাইন অ্যান্ড ওয়ার্কস অ্যাক্ট ঘোষণার অনেক আগে থেকেই এই প্রথা চালু ছিল। খনি শিল্পের ম্যানেজারিয়াল পদে কোনো কৃষ্ণাঙ্গ ছিল না। মজার বিষয় হল, মাইন অ্যান্ড ওয়ার্কস অ্যাক্টে স্পষ্টভাবে এরকম কিছুর উল্লেখ নাই যে, কৃষ্ণাঙ্গদের পদোন্নতি দেয়া যাবে না। শুধু বলা হইছিল, খনি শিল্পে উচ্চ পদে নিয়োগ পাইতে কিংবা এর জন্য প্রশিক্ষণ নিতে হইলে আবেদনকারীকে সরকারী প্রত্যয়নপত্র সংগ্রহ করতে হবে। এই আইনের সুযোগ নিয়েই শ্বেতাঙ্গ সরকার কোনও কৃষ্ণাঙ্গকে উচ্চ পদের জন্য প্রত্যয়ন করে নাই।
বিংশ শতাব্দীতে সাউথ আফ্রিকার সবচেয়ে বড় কর্মসংস্থান ছিল খনি শিল্প। একবিংশ শতাব্দীর আমেরিকায় জাতীয় এবং রাজ্য পর্যায়ে কর্মসংস্থানের বড় উৎস ফেডারেল সরকার। ফলে, নব্য-বর্ণবাদ আমেরিকায় বাস্তবায়ন করতে হলে সাউথ আফ্রিকার মত অন্ততপক্ষে একটা আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠান লাগবে। যাদেরকে বলা যাবে, সরকারি দক্ষতা বিভাগ। এই প্রতিষ্ঠানের কাজ হবে, সরকারি চাকরি কারা করতে পারবে তাদেরকে খুঁজে বের করে প্রত্যয়নপত্র দেয়া। তাইলে সহজেই কৃষ্ণাঙ্গদের আটকানো যাবে। এমনকি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে আলাদা করে উল্লেখও করতে হবে না, যে “নো ব্ল্যাক নিড অ্যাপ্লাই”—যদি দক্ষতা বিভাগে যোগ্য কর্মী প্রত্যয়নে সঠিক লোকটি থাকে। কাজটা আরও সহজ হয়ে যাবে, যদি ট্রাম্প সরকার শিক্ষা বিভাগকে নিয়ন্ত্রণে নেয়। এতে কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানদের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা অর্জন অত্যন্ত জটিল কিংবা অসম্ভব করে ফেলা যাবে। এতে কৃষ্ণাঙ্গরা কখনও সরকারি চাকরির যোগ্যই হইতে পারবে না।
ফেডারেল সরকার বড় কর্মসংস্থানের জায়গা হইলেও, বেসরকারি কোম্পানিগুলি সরকারের চাইতে বেশি লোক নিয়োগ করে। EEOC’র মত যেসকল সরকারি প্রতিষ্ঠান বর্ণবৈষম্য বন্ধে কাজ করে সেগুলি ডিসফাংশনাল করে দিলে, বর্ণবাদ সমর্থনকারী কোম্পানিগুলি মাস্কের টেসলা ফ্যাক্টরির রেসিস্ট কালচার অনুসরণ করবে। ইতিমধ্যেই মেটা ও টার্গেটের মত কোম্পানিগুলি DEI পলিসি বাতিল করছে। তার মানে, কৃষ্ণাঙ্গদেরকে চাকরিতে না নিলে আর আইনি জটিলতা নাই। বর্তমান ট্রাম্প-মাস্ক ডুয়ো শাসনে শ্বেতাঙ্গ অ্যামপ্লয়ারদের সিভিল রাইটস অ্যাক্ট এবং ১৪তম সংশোধনী উপেক্ষা করতে আর বাধা নাই। এবং এইটা শ্বেতাঙ্গ অ্যামপ্লয়াররা বেশ উদযাপন করতেছে। আসলে, অনেক শ্বেতাঙ্গ আমেরিকান কোম্পানি কখনও কৃষ্ণাঙ্গদের নিয়োগই করতে চায় নাই। মামলার ভয়ে এতদিন তা করতে বাধ্য হইছিল। এখন সেই ভয় না থাকায় “অনলি ফর হোয়াইট” সময়ে ফিরে যাইতে পেরে তারা খুশি।
বর্ণবাদ মডেলের একটা মূল অর্থনৈতিক দিক হয়ত মাস্ক এবং তার সাউথ আফ্রিকান শ্বেতাঙ্গ সমর্থনকারীরা এখনও বুঝতে পারেন নাই। সাউথ আফ্রিকার বর্ণবাদ ব্যবস্থা তাদের ধনীদের পাশাপাশি শ্বেতাঙ্গ শ্রমিকশ্রেণীর জন্যও লাভজনক ছিল। কিন্তু আমেরিকার নব্য-বর্ণবাদের পরিকল্পনাগুলি এরকম না। যেই ভুলটা সবাই করে, চিপ লেবার এক্সপ্লয়েট করার সুবিধাকে খনি মালিকের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে। সাউথ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ কিংবা গরীব শ্বেতাঙ্গদেরকে শস্তা কাজের জন্য কৃষ্ণাঙ্গদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয় নাই। তারা ছিল তাদের সমাজের সচ্ছল কৃষক, মধ্যস্তরের ব্যবস্থাপক। এবং মেজরিটি কৃষ্ণাঙ্গদের কাছ থেকে এসব ক্ষেত্রে কোনো প্রতিযোগিতা না থাকায়, শ্বেতাঙ্গ শ্রমিকশ্রেণী সেখানে ভাল ছিল। সাউথ আফ্রিকায় অ্যাপার্থেইডের অবসানের প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান করতে গেলে দেখা যাবে, এর সঙ্গে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাগুলির বড় ভূমিকা ছিল। যা তাদের শ্বেতাঙ্গ ব্যবসায়ীদের প্রফিট মার্জিনে বড় আকারের কামড় বসায়।
মাস্ক তার বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গ ব্যবসায়ীদের জন্য যে সম্পদ ও সুবিধা তৈরি করছেন, তা ব্যবসায়ীদের জন্য কতটা ধ্বংসাত্মক হতে পারে—এই বিষয়ে মনে হয় তিনি তেমন ভাবতেছেন না। সম্ভবত, ভাবার প্রয়োজন আছে বলেও মনে করেন না। নিজের চিন্তার বিপর্যয় ঢাকতে, আমেরিকান শ্বেতাঙ্গদেরকে অর্থনৈতিক সংকটের ভয় দেখাইয়া, মাস্ক একের পর এক সরকারি পরিষেবা বন্ধ করতেছেন। যা কিনা কৃষ্ণাঙ্গ-শ্বেতাঙ্গ উভয়েরই দরকার। কিন্তু শ্বেতাঙ্গরা এইটা বুঝতেছে না, শুল্কজনিত মুদ্রাস্ফীতি ছাড়াও আরো ভয়াবহ কিছু তাদের জন্য অপেক্ষা করতেছে। আধুনিক আমেরিকায় শ্বেতাঙ্গ বিজনেস টাইকুনদের স্ম্যাশ-অ্যান্ড-গ্র্যাব স্টাইল পুঁজিবাদ শ্বেতাঙ্গ শ্রমিকশ্রেণীর জন্য তেমন কিছু অফার করে না।
আরো পড়ুন: আফ্রিকান-আমেরিকানদের প্রতি চলমান বর্ণবৈষম্য নিয়ে র্যালফ রিচার্ড ব্যাংকস
আমেরিকায় বসবাসকারী সকল শ্বেতাঙ্গের জন্য পর্যাপ্ত মিডল ম্যানেজমেন্ট পদ নাই। বর্ণবাদ শাসনে হয় তাদের নিম্ন শ্রেণীর কাজ থেকে কৃষ্ণাঙ্গ ও ল্যাটিনদের সরাইতে হবে, অথবা শ্বেতাঙ্গদেরকেও চিপ লেবার কাজের জন্য অন্য সবার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হবে। প্রশ্ন হইল, আমেরিকার শ্বেতাঙ্গরা কি টমেটো চাষ কিংবা লাইসেন্স প্লেট বানানোর মত পরিশ্রমের কাজ করতে চাইবে? মাস্ক ও তার অলিগার্কশ্রেণী একটা নব্য-বর্ণবাদী সিস্টেম থেকে যেভাবে প্রচুর অর্থ উপার্জন করতে পারবে, অন্যরা সেভাবে পারবে না।
এই জন্য আমার নিঃশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করতে হবে না যে শ্বেতাঙ্গরা কবে বুঝতে পারবে, তাদের কেন ডিম কেনার টাকা নাই! আমেরিকার ইতিহাস বলে, এই দেশের গরীব শ্বেতাঙ্গরা ততক্ষণ পর্যন্ত সবকিছু সহ্য করতে পারবে যতক্ষণ দেখবে কৃষ্ণাঙ্গরা তাদের থেকেও খারাপ অবস্থায় আছে।

ইতিহাসের ঘটনা সবসময় পুনরাবৃত্তি না হলেও, প্রায়শই তাদের মধ্যে একটা অন্তর্নিহিত মিল থাকে। এখন আমি যা বুঝতেছি, সাউথ আফ্রিকান ইলন মাস্ক তার জন্মভূমির পুরোনো বর্ণবাদী সিস্টেমকে লেইট-স্টেজ-ক্যাপিটালিজম আর ডিজিটাল যুগের সঙ্গে সমন্বয় করে আমেরিকায় নতুন ভাবে চালু করতে চাইতেছেন। আমেরিকার নব্য-বর্ণবাদ সাউথ আফ্রিকার মত বর্ণবৈষম্য তৈরি না করলেও অর্থনৈতিক বৈষম্য তৈরি করতে পারে। যার সামাজিক প্রভাব হবে আরও বেশি ভয়ঙ্কর ও নিপীড়নমূলক।
তবে, বর্ণবাদের মত কিছু একটা আমেরিকাতে ঘটতে পারে, বা ইতিমধ্যেই তা আছে। শ্বেতাঙ্গরা চাইলে, এই ধারা অব্যাহত থাকবে। আমি তাদের এই চাওয়া থেকে বিরত রাখতে পারব না। শুধু মনে করিয়ে দিতে পারি, শ্বেতাঙ্গদের জানা উচিত, তারা আসলেই কী চাইতেছে। একইসঙ্গে কৃষ্ণাঙ্গদের মনে রাখতে হবে, ইলন মাস্ক যতই ক্রিপ্টোকারেন্সির লোভ দেখাক না কেন, এই ব্যক্তি যদি অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতা পাইতে থাকে, তাইলে তাদেরকে দিয়ে আবার খনিতে কাজ করাবে।
ইলন মাস্ক এর ভিশন: আমেরিকা যেভাবে নব্য-বর্ণবাদের দিকে আগাইতেছে