(সামাজিক) শ্রেণী অনুধাবন বা পাঠের সমস্যা কী?
আজকে আমরা কয়েকটা ডায়ালগ দিয়ে শুরু করতে পারি। যদি আপনি হন এই ডায়ালগ প্রদানকারীদের একজন, তাহলে ”আপনাকেই খুঁজছে বাংলাদেশ” বলে যে আনন্দ করব সেই উপায় নেই। হতে পারে, আপনি এই সামান্য রচনার মাঝপথ পর্যন্ত এসেই গুটিকয় কষা-গালি আমাকে দিলেন। তা আমি কবুল করে নিচ্ছি আগাম।
তবে অস্বীকার করব না যে এই রচনার পাঠক আপনাকে ধরে নিয়ে আজকে আমাদের আলাপ শুরু করি নাই। আমি আসলে তাঁদের দলে নাই যাঁরা ভাবতে থাকেন কথাবার্তা বলে মানুষের চিন্তাভাবনা, আচার-আচরণ, জিজ্ঞাসা-মীমাংসা বদলানো যায়। আমার ধারণা মানুষের মাথায় এত ঘিলু যে, যে-যার মতো করে ভাবনার দুনিয়া বানানোর পরেই অন্যদের কথাবার্তা পড়েন। তবে আপনি যদি হন সেই বর্গে যাঁদের হতাশা কিংবা অন্যান্য কোনো কারণে আচমকা কোনো একদিন নিজের মুখ থেকেও এইসব কথাবার্তা বের হয়ে যায়, কিন্তু পরে অত শান্তি পান না, কেমন একটা গ্যাসের সমস্যার মতো বুকে চাপ লাগে, তাহলে আপনি এই রচনার দারুণ পাঠক।
তবে সবচেয়ে ভাল হয় যদি আপনি তাঁদের দলে হন যাঁরা নিজেরা এইসব কথা বলেন না বা ভাবেন না; কিন্তু আপনাদের আশপাশের লোকদের এগুলো বলা বা ভাবা লক্ষ্য করেছেন। আপনি আজকের আলোচনার এত ভাল সমঝদার যে আসলে আমাদের আলাপই আর করার তেমন একটা দরকার হবে না।
“এদের স্বভাবই এই রকম”, “আরে জানেন না আপা/ভাই, ইচ্ছা করে এইসব করে”, “কাজের কথা বললে দেইখেন করবে না”, “এত সমস্যা তাইলে তুই করস ক্যান”—কাজ চালানোর জন্য মোটামুটি এই চারখান ডায়ালগ দিয়ে আমরা শুরু করতে পারি। তবে এই খানকয় সংলাপ মাথায় আউড়ে নিলে দ্রুতগতিতে অন্যান্য বাণী মাথায় এসে ভিড় না করার উপায় থাকে না। বিশেষ করে সকল মানুষের সাধারণত সমান সংখ্যক হাত ও পা থাকার অবধারিত সত্যকে সামনে নিয়ে এসে খোঁটা দেবার ঘটনা এত বেশি ঘটে থাকে যে এইটা আপনার মনে পড়ে গেলে দোষ দেয়া যাবে না।
যাহোক, সেসব উত্তেজনায় আমরা মূল আলোচ্য যাতে ভুলে না যাই সেটা নিয়ে অবশ্যই সতর্কতার বিষয় আছে। গরিবের স্বভাব বিষয়ক অন্যান্য শ্রেণীর প্রপাগান্ডাগুলো নিয়ে কথা বলতে চাই আমরা। বস্তুত কোনো শ্রেণীরই কোনো নির্দিষ্ট ‘স্বভাব’ আছে ধরে নেয়া অত্যন্ত এক বদনিয়তের কাজ। যেমন কিনা, মাখনের মতো মনের শিল্পপতি থাকতে পারেন—মৃদু হাসেন, মৃদুমন্দ কথা কন, শ্রমিককে পয়সা/মজুরি দেবার সময়ে বাচ্চাবৌয়ের খবর জিজ্ঞাসা করেন, পরকালের কথা ভাবতে সুপারিশ করেন, আবার রাতের বেলায় ঘুমানোর সময় সন্তুরে বাজনা শোনেন এরকম গাদা গাদা শিল্পপতি থাকার রাষ্ট্রীয় আইনে তো কোনো বাধা নাই-ই, এমনকি সামাজিক চর্চাতেও কোনো কমতি নাই। তেমনি চাকায় চাকায় বেঁধে গেলেই পাশের রিকশাওয়ালাকে দুইটা নিজের সাইজের চেয়েও বড় কিল লাগিয়ে কথা শুরু করার রিকশাপতিও সমাজে সুলভ—বাসায় ঢুকতেই প্ল্যাস্টিকের বালতিতে হয়তো লাত্থি মারেন, থালা মেঝেতে ফেলেন কোদালের মতো করে, প্রতিবেশী কিছু বলতে আসলে অমুকের পুত বলে শুরু করেন ইত্যাদি সব ঘটারও কোনো গুরুতর প্রতিবন্ধক সমাজে নাই।
আপনাদের মধ্যে যাঁরা এতক্ষণে “হ্যাঁ হ্যাঁ সেই কথাই তো বলছি” ভাবতে শুরু করেছেন, তাঁদের জন্য এটুকু বলারই আছে যে এর উল্টা চিত্রও ততখানি সুলভ যতখানি এতক্ষণের চিত্র দেখলেন। জুম্মা শেষ হতে না হতেই মসজিদের সামনে ফোন অন করে “হালারে বসতে ক, আমি আইসা গুণতেছি ওর ওইডা কয়ডা নিয়া জন্মাইছে” বলার মতো শিল্পপতি বাঁশবাড়িতে দুর্লভ হতে পারে, বনানীতে একদমই নয়। হাঁটাচলা করুন, কান খাড়া করুন, সব টের পেয়ে যাবেন। তেমনি এরকম রিকশাপতিও রাস্তাঘাটে অনেক সুলভ যিনি একটু উৎসাহী সওয়ার পেলেই নিজের ফেলে আসা গ্রামের গল্প করবেন, এমনকি বাচ্চার স্কুলের। অবাক হবেন না যদি এমনকি নিজ এলাকার মহৎ বড়লোকের গল্প করে আপনার ভিতরে মহত্ত্বের খানিক লোভও ধরিয়ে দিতে পারেন এমন রিকশাওয়ালাই একজন আজ পেয়ে যান। ‘স্বভাব’ অতিশয় বিচিত্র জগতে। একে শ্রেণীর বস্তায় ভরে বোঝার চেষ্টা করার পণ্ডশ্রম করবেন না। যাহোক, গরিবের পেশা নিয়ে বলার সময় অন্যান্য শ্রেণীর যে ক্রোধ পরিলক্ষিত হয় সেটা নিয়ে আলাপ করতে গিয়ে এত শত কথা চলে আসলো। আশা করি তাতে গুরুতর কোনো সমস্যা হবে না।
গরিব যে চাইলেই তাঁর সমস্যাক্রান্ত পেশা থেকে সরতে পারেন না, এই দুরবস্থাটা যদি দুচারজনাও বোঝেন তাহলেও আমাদের আজকের অধিবেশন সফল হয়। তাছাড়া গরিব কেন, ধরুন আমি, ২৬ বছর রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে মাস্টারি করলাম (সরকারী বলতে হয় ইদানীং, নাহলে সরকারের ভক্তরা খুব রাগ করেন)। ধরুন, আমার আর মাস্টারিগিরি ভাল লাগে না, অন্য কিছু চাকরি করে জীবন চালাতে চাই। তো এখন চাইলেই মোড়ের ওই কফির দোকানে আমাকে ম্যানেজার করে নেবেন ওটার মালিক? নাকি, অমুক বা তমুক ব্যাঙ্কের বা মহাএনজিওর কর্মকর্তা পান সাজিয়ে আমাকে ডিরেক্টরদের একজন বানানোর জন্য অপেক্ষা করে বসে আছেন? কীভাবে আমার পেশাবদল হতে পারে তাহলে! পারে। ধরা যাক আমার কোনো নটরডেমিয়ান-সেন্টযোসেফিয়ান-ক্যাডেটিয়ান-শাহীনিয়ান-সানবিমিয়ান বা অন্তত কাপাশিয়ান গোপালগঞ্জিয়ান মেহেরপুরিয়ান শৈশবের বন্ধু, বা অন্তত ‘জাবিয়ান’ যৌবনের-বন্ধু বাপের-শ্বশুরের স্থাবর থেকে কিংবা নিজের স্মার্টনেসের কারণে গাজীপুরে ৪ একর জমিতে গার্মেন্টের সফল মালিক হয়ে পড়েছেন; কিংবা হয়তো আলাদিনের চেরাগের মতো কিছু একটা পেয়ে ১৪ একরের রিসর্ট/রিজর্ট-এর মালিক হয়ে পড়লেন। তিনি তাঁর লেখক-শিক্ষক বন্ধুর এই বাসনায় এমন স্নেহশীল-আর্দ্র হয়ে পড়লেন যে ওই কারখানার ক্রিয়েটিভ বা হিউম্যান রিসোর্স ডিরেক্টর কিংবা ওই রিজর্টের ক্রিয়েটিভ রেসিডেনশিয়াল চিফ বানিয়ে দিলেন আর জিজ্ঞাসা করলেন, “বল দোস্ত, তোর বেতন কত লাগবে?”
এখন এই যে দোস্ত থাকতে পারল জীবনে, এটা কিন্তু দোস্তের যতখানি কৃতিত্ব ততখানিই ওই ‘ইয়ানমূলক’ সম্প্রদায়গুলোর কৃতিত্ব। তার থেকেও বড় কৃতিত্ব হলো আমার। কীভাবে? পাঁচ বছরেই আলাদিনের চেরাগ ঘষে-ঘষে যে বন্ধু গার্মেন্টের কারখানা দিয়ে প্রাদো চড়তে পারেন এমন বন্ধুদের সঙ্গে ‘সম্পৃক্ত’ থাকতে পারার কৃতিত্ব এটা। এটাকেই নয়া যুগের তাত্ত্বিকেরা ‘কালচারাল ক্যাপিটাল’ বলে থাকেন, ‘সোশ্যাল ক্যাপিটাল’ও বলেন। একাডেমিকদের একটা কাজই হলো, রাজনীতিকদের মতোই, আপনাকে বুঝিয়ে দেয়া যে “জগতের কোনো অমুকডাও তুমি বুঝো না।” সেজন্য কালচারাল আর সোশ্যালের মধ্যকার সূক্ষ্ম পার্থক্য বিষয়ে সাড়ে তিন ঘণ্টা বলতে পারবেন এমন তাত্ত্বিক ঢাকা শহরেও পাওয়া যাবে। কিন্তু আজকে তাঁর শরণাপন্ন না-হয়েও আশা করি আপনারা বুঝলেন আমাদের জীবনে চেরাগওয়ালা নটরডেমিয়ান (পুরুষ) বন্ধু থাকার গুরুত্ব কতখানি। এখন আপনি এর নাম তালের ক্যাপিটাল দিতে পারেন, কিংবা পার্টনার্স-ইন-ক্রাইমও দিতে পারেন। আপনার ব্যাপার।
এতক্ষণে কেউ কেউ হয়তো রাগ করতে শুরু করেছেন। ভাবছেন গরিব নিয়া আলাপ করবে বলে এইলোক তো কীসব আগড়-বাগড় শুরু করল। আসলে আমি বলতে চাইছি, ওই যে আপনি চন্দ্রিমা উদ্যানের পাশে-থাকা ১৪ বছরের বালিকাটিকে গৃহে “নিজের মেয়ের মতো” রাখতে চাইবার ঘোষণা দেবার পরও ব্যাক্কল বালিকাটি আসতে চাইলেন না, তার কারণ “এ্যারা কাজ করতে চায় না” নহে; বরং তিনি তাঁর কালচারাল (বা সোশ্যাল) ক্যাপিটালটুকু হারাতে চান নাই। ওই বিজয় সরণীর মোড়টাতেই তো তাঁর নিকটবর্তী বয়সের বালকবালিকারা ফুল নিয়া দৌড়াদৌড়ি করে; ওই তো হেথা বিয়ারিং লাগানো বাক্সে হাঁটুহীন চাচা কেমন এমপির মতো যাইতেছেন! ওসব ছেড়ে তিনি আপনার বাসায় গেলে যে বান্ধবহীন জীবন যাপন করবেন সেইটার কারণে যান না।
ওই যে সেদিন আপনার বন্ধু হিসাব করে দেখালেন যে রিকশাওয়ালারাও এখন মাসে ত্রিশ হাজার টাকা আয় করে থাকেন, তিনি অঙ্কে একটু ভাল হলেও, এই কথা অংকবিদ্যার উৎসাহে বলেননি। তিনি বলেছেন উত্তরবঙ্গের কৃষিজ মজুরদের কয়েকমাস ঢাকা থাকার বিষয়ে যাতে আপনি জটিল কোনো আলাপ যাতে না তুলে বসেন তা প্রতিরোধের আগাম বজ্জাতি হিসাবে। এই যে সিএনজিওয়ালার খাসিলত বিষয়ে আপনি ঘণ্টাখানেক বিরক্ত থাকলেন, তিনি সিএনজিতে ২০ ট্রিপ দেবার পরও বাড়ি নেবার মতো টাকা তুলতে না-পারার জীবনেই যে প্রাণপণ থেকে যাচ্ছেন, সেটার কারণও ওই যন্ত্রটার প্রতি কোনো বাড়তি স্নেহ নয়। তাঁকে এক্ষুনি আপনি আপনার গাড়ি চালাতে ডাকবেন তার সম্ভাবনা নাই। এমনকি আপনার গাড়ি থাকার সম্ভাবনাও কম, যেহেতু সিএনজিতে চড়লেন। নিউ এম্পায়ার ব্যাংকের এমডি যে তাঁকে দারোয়ান হতে ডাকবেন না, সেটাও আন্দাজ করা যায়। মামাদের সকল হালিমের পাশে নতুন কোনো হালিম বানানোর অনিশ্চয়তাও তাঁর জানা। এমনকি হালিম বানানোটাই বরং অজানা থাকতে পারে তাঁর। তিনি নতুন পেশায় যাবার ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো সুড়ঙ্গ পান না; আর তার কালচারাল/সোশ্যাল ক্যাপিটাল বড়জোর যন্ত্রচালিত তিনচাকা থেকে মানবচালিত তিনচাকাতে নিতে পারতে সক্ষম।
বাস্তবেই বহু সিএনজি চালক গত কয়েক বছরে রিকশাওয়ালা হয়েছেন।
আদাবর, ১৯ এপ্রিল ২০২১
কভারে মানস চৌধুরী; ছবি. সাজিন আহমেদ কৌশিক , ২০১৭