সময়ের কাজ সময়ে শেষ করতে আমাদের প্রায়ই হিমশিম খেতে হয়। অথচ একটু কৌশলী হলে আমরা এই দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারি।
এর মাঝে টু-ডু লিস্ট বা কাজের তালিকা তৈরি অন্যতম একটি কৌশল। টু-ডু লিস্টটি সবসময় পরবর্তী কাজের কথা মনে করিয়ে দিয়ে আপনাকে সঠিক পথে পরিচালনা করে। তবে যদি সেই লিস্টটি আপনি ভুলভাবে তৈরি করেন তাহলে পুরো কর্মক্ষম দিনটিই নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
‘লিস্টফুল থিংকিং: ইউজিং লিস্টস টু বি মোর প্রোডাক্টিভ, সাকসেস্ফুল অ্যান্ড লেস স্ট্রেসড’ বইয়ের লেখিকা পলা রিজোর মতে টু-ডু লিস্ট আপনার দিনের জন্য একটি রাস্তার নকশার মতো। এটি একটি লক্ষ্য তৈরি করে যেন আপনি কী করতে যাচ্ছেন তা বুঝতে পারেন। কিন্তু যদি সেই লিস্টটি সঠিকভাবে ব্যবহার করতেই না জানেন তবে আপনার পুরো দিনটিই মাটি হয়ে যেতে পারে।
তাই আপনার পরবর্তী টু-ডু লিস্ট তৈরির আগে একবার জেনে নিন সেই ৭টি সাধারণ ভুল কী কী?
১. সকাল বেলায় লিস্ট তৈরি
স্বভাবতই সকাল বেলা আপনার টু-ডু লিস্ট তৈরি করাটা স্বাভাবিক মনে হতে পারে। কিন্তু ‘অর্গানাইজিং ফর ডামিজ’-এর লেখিকা আইলিন রোথ এর মতে, “আপনি যদি সকাল বেলায় টু-ডু লিস্ট বানান, আর সকাল ৮ টায় আপনার একটি মিটিং থাকে, তবে আপনি সেখানে উপস্থিত হতে পারবেন না।” তাই, আপনার টু-ডু লিস্ট আগের দিন রাতে তৈরি করুন।
দিনের শেষে কাজের তালিকা তৈরি করলে আপনি কাজগুলিকে পেছনে রেখে নিজের জন্য কিছু সময় বের করে নিতে পারবেন। রোথ বলেন, “আপনি বাড়িতে যান, এবং টু-ডু লিস্ট নিয়ে সকল চিন্তা বন্ধ করে দিন, কেননা আপনি ইতোমধ্যেই আপনার টু-ডু লিস্টের সকল কাজ শেষ করে ফেলেছেন এবং আপনি জানেন আগামী দিন আপনাকে কী করতে হবে। সুতরাং এখন আপনি নিজের মনকে বিশ্রাম দিন।”
২. অনেক বেশি কাজ যোগ করা
আপনার টু-ডু লিস্টে যদি অনেক বেশি পরিমাণে কাজ থাকে যা শেষ করতে কয়েক সপ্তাহ, এমনকি কয়েক মাসও লেগে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে আপনি নিজেকে ব্যর্থ প্রমাণের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। রিজোর মতে, “যখন আপনি অনেক বেশি কাজ তালিকাভুক্ত করছেন, তখন তা ধ্বংসাত্মক হয়ে দাঁড়ায়।”
“৩টি কাজই আদর্শ। কেননা, মানুষের মস্তিষ্ক সবসময় ৩টি গ্রুপে বিভক্ত জিনিস বুঝতে পারে। তাই টু-ডু লিস্টের শুরুতে ‘শীর্ষ ৩’ এর ফায়দা নেয়া উচিত। বেশিরভাগ মানুষেরই কাজের তালিকায় ৩টির বেশি কাজ থাকে।” বলেছেন ওয়েল ডিজাইনড লাইফ: টেন লেসনস ইন ব্রেইন সায়েন্স অ্যান্ড ডিজাইন থিংকিং ফর এ মাইন্ডফুল, হেলদি, এন্ড পারপাসফুল লাইফ এর লেখিকা কাইরা ববিনিট।
লম্বা টু-ডু লিস্ট একটা সমস্যা, কারণ বেশিরভাগ মানুষই জানে না একটা দিনের ভেতর কতটুকু উৎপাদনক্ষম সময় সত্যিকার অর্থে তারা পাবে। বলেন প্রডাক্টিভিটি সফটওয়্যার অ্যামেজিং মারভিনের প্রতিষ্ঠাতা ক্রিস্টিনা উইলনার। তিনি আরো বলেন, “আমাদের মানসিক শক্তি সময়ের চেয়ে অনেক বেশি সীমাবদ্ধ। প্রতিদিন কাজ করার উপযোগী মাত্র ৩ থেকে ৬ ঘণ্টা আমাদের কাছে থাকে।”
উইলনারের মতে, কাজের তালিকাগুলি দীর্ঘ হওয়ার আরেকটি অন্যতম কারণ হলো, কোনো কাজ শেষ করতে কতটা সময় প্রয়োজন তা বুঝতে না পারা। তাই তিনি প্রতিটি কাজের সময় অনুমান করে তা কাজটির পাশে লিখে রাখার পরামর্শ দেন। পরবর্তীতে কাজের মূল সময়কে ট্র্যাক করে ভবিষ্যতে কাজের জন্য প্রয়োজনীয় সময়ের নির্ভুল অনুমান করা যেতে পারে।
৩. কোনো একদিনের সব কাজ অন্তর্ভুক্ত করা
উপন্যাস লিখতে চাইবার মত আকাঙ্ক্ষিত কাজগুলি টু-ডু লিস্টের তালিকায় রাখা উচিত না। বরং এসবের জন্য আলাদা একটা বাকেট লিস্ট তৈরি করা যেতে পারে। “যদি আপনার টু-ডু লিস্ট বলে, ‘মাউন্ট এভারেস্টে উঠুন এবং দুধ নিয়ে আসুন’, তবে তা দুইটি পৃথক তালিকা,” বলেন রিজো।
রিজোর মতে, প্রতিদিনের টু-ডু লিস্ট তৈরি করা উচিত প্রতিদিনের কাজের ভিত্তিতে। আপনার যদি কোনো বড় কাজ শেষ করার ইচ্ছা থাকে তবে সেই কাজকে ছোট ছোট অর্জনযোগ্য কাজে বিভক্ত করে টু-ডু লিস্টে রাখতে পারেন।
উইলনার বলেন, কোনো একদিন করবো এমন কাজগুলিকে একটা মাস্টার লিস্টে রাখা যেতে পারে যা ক্রমাগত বাড়তে বা কমতে পারে। “আপনি সরাসরি আপনার মাস্টার লিস্ট থেকে কাজ করবেন না। এত বিশাল বিশাল কাজ কেবলমাত্র ধ্বংসাত্মকই না, এগুলি শেষ করাটাও অনারামদায়ক। এরচেয়ে বরং পরের দিন কোন কোন কাজ শেষ করবেন তা ঠিক করে সেগুলি মোকাবিলার চেষ্টাটাই করা উচিত।”
৪. প্রতিটি কাজকেই সমান গুরুত্ব দেয়া
একটা সুন্দর টু-ডু লিস্টে অবশ্যই অগ্রাধিকার পাওয়া কাজের তালিকা থাকা উচিত, বলেছেন প্রডাক্টিভিটি প্রশিক্ষক ন্যান্সি গেইনস। তিনি বলেন “শুধু সেসব কাজই যুক্ত করুন যা আপনার ক্যারিয়ার বা ব্যবসাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। যদি কাজটি অগ্রাধিকার না পায়, তবে তা আপনার টু-ডু লিস্টে রাখা উচিত না। অগ্রাধিকার না পাওয়া কাজগুলি কেবল বিভ্রান্তিই তৈরি করবে।”
তিনি টু-ডু লিস্ট তৈরির সময় ৩-৩-৩ এর নিয়ম মেনে চলতে পরামর্শ দেন। গেইনস বলেন, “যে ৩টি কাজ আপনার জন্য জরুরি নয় সেগুলি টু-ডু লিস্ট থেকে বাদ দিয়ে দিন। যে ৩টি কাজ আপনার সময় এবং প্রতিভার উপযুক্ত নয়, তা অন্য কাউকে দিয়ে দিন। এবং সেই ৩টি কাজই করুন যা আপনার কাছে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাবে।”
৫. নির্দিষ্ট না হওয়া
“অনেক সময় আমরা টু-ডু লিস্টে বিক্ষিপ্তভাবে অনির্দিষ্ট অনেক কিছু লিখে রাখি যা কাজ করার সময় আমাদের থামিয়ে দেয়। আর ভাবনায় ফেলে দেয় যে কীভাবে কাজটি সম্পন্ন করা যায়।” বলেছেন মোরা থমাস, “পারসোনাল প্রডাক্টিভিটি সিক্রেটস” এর লেখিকা। তিনি বলেন, “আপনার হাতে যদি ১০ মিনিট সময় থাকে একটা কাজ শেষ করার এবং আপনার সবটা সময়ই তালিকার কাজগুলি নিয়ে ভাবতে ভাবতে চলে যায় তবে আপনারই সময়টাই বৃথা নষ্ট হবে।”
তিনি বলেছেন, টু-ডু লিস্ট তৈরি করার সময় যথেষ্ট সময় নিয়ে ভেবে একদম নির্দিষ্ট করে কাজগুলি সাজাতে হবে যেন দেখামাত্রই আপনি বুঝতে পারেন আপনি কোন কাজটা কীভাবে করবেন। যেমন, লিস্টে “খরচের হিসাব” না লিখে লিখুন “খরচের হিসাব স্প্রেডশিটে লিখতে হবে।”
এবং কিছু বিক্ষিপ্ত শব্দ বাদ দেওয়ার চেষ্টা করুন। যেমন, “পরিকল্পনা”, ” বাস্তবায়ন” অথবা, “উন্নয়ন”। থমাসের মতে এইসব কঠিন শব্দ আপনার স্বল্প সময়ের কাজ করার আগ্রহকে নষ্ট করে দিতে পারে। কেননা এইসব শব্দ বড় দীর্ঘমেয়াদী কাজের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় এবং কম সময়ের মধ্যে এগুলি সম্পন্ন হয় না৷
৬. একই লিস্ট সম্পন্ন না হওয়া অব্দি ব্যবহার করে যাওয়া
দেখা গেছে অনেকেই একই টু-ডু লিস্ট শেষ না হওয়া অব্দি ব্যবহার করেন। রথ বলেন, “এই কাজের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে যে প্রতিদিন আমাদের জীবনে একটা নতুন পরিবর্তন আসে। যা আমরা আজ করেছি, কাল আমরা তা নাও করতে পারি। এবং কাল আমরা যা করার পরিকল্পনা করছি তা আজকের দিনের শেষের দিকে বদলে যেতে পারে।”
তাই ভালো হয় প্রতিদিনের জন্য একটা নতুন লিস্ট তৈরি করা। তিনি আরো বলেন, “অনেকেই যারা একটা প্রজেক্টে কাজ করছেন তারা পুরা সপ্তাহের একটা টু-ডু লিস্ট অনুসরণ করেন। কিন্তু এক্ষেত্রেও সপ্তাহজুড়ে প্রতিদিন কিছু পরিবর্তন আনা উচিত।”
৭. ক্যালেন্ডারের সাথে কাজ জুড়ে না দেয়া
ক্যালেন্ডারের সাথে কাজের লিস্ট না জুড়ে দেয়া আরেকটা ভুল। বলেছেন ‘রিভোলুশনারি প্রডাক্টিভিটি: হাউ টু ম্যাক্সিমাইজ ইওর টাইম, ইম্প্যাক্ট অ্যান্ড ইনকাম ইন ইওর স্মল বিজনেস’ এর লেখিকা ক্যাটি মাজুকু।
তিনি আরো বলেন, “মনে রাখবেন প্রতিদিনই যথেষ্ট সময় আমাদের হাতে থাকে। কিন্তু যদি আপনার পুরো ক্যালেন্ডারের সাথে আপনার পরিকল্পিত কাজের কোনো সম্পর্ক না থাকে আপনার হাতে টু-ডু লিস্টের কাজ সঠিক সময়ে শেষ করার জন্য একদম সময় থাকবে না। তখন হয়তো আপনাকে আপনার ঘুমের, পারিবারিক সময় অথবা আরামদায়ক ছুটির দিন বা ঘুরে বেড়ানোর সময় থেকে সময় চুরি করতে হবে।”
তাই ক্যালেন্ডারের পাতায় আপনার টু-ডু লিস্টের কাজ সম্পন্ন করার জন্য সময় বরাদ্দ করে রাখুন।