পাখিরা দলবদ্ধ ওড়ার সময় একটা ইংরেজি ভি (V) আকৃতি তৈরি করে। তা কমবেশি আমরা সবাই লক্ষ করেছি।
পাখিদের ভি ফরমেশন বা বিন্যাস নিয়ে অনেক রকম গবেষণা হয়েছে। তবে ঠিক কেন পাখি দলের এই বিন্যাস তার সঠিক ব্যাখ্যা এতদিন অজানাই ছিল। ২০১৪ সালে প্রথম বিশেষভাবে নির্মিত জিপিএস ও ডেটা লগার প্রযুক্তির সাহায্যে পাখিদের ওড়ার গতিপথ সম্পর্কে একটি বিস্তারিত গবেষণা হয়।
লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়্যাল ভেটেনারি কলেজের একটি গবেষক দল ১৬ জানুয়ারি ২০১৪ তারিখে Nature জার্নালে তাদের গবেষণার ফলাফল নিয়ে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে।
নিবন্ধে প্রাথমিক তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে গবেষকরা প্রমাণ করেন পাখিদের এই ভি-বিন্যাস সচেতন বিন্যাস। V-বিন্যাসে উড়ন্ত পাখিদলের শক্তিক্ষয়ের পরিমাণ সবচেয়ে কম।
ফারুক আব্দুল্লাহ
ইন্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ফিজিক্যাল রিসার্চ কাউন্সিলের অনুদানে জিপিএসের এই বিশেষ প্রযুক্তি তৈরি করা হয়।
গবেষণায় পাখিদের যে প্রজাতিটি ব্যবহার করা হয়েছে তার নাম ‘বল্ড আইবিস’ (বৈজ্ঞানিক নাম জেরোনটিকাস এরেমিটা), শিকারী প্রজাতির এই পাখিটি প্রায় ৩০০ বছর ধরে ইউরোপে অস্তিত্ব সংকটে, সারা পৃথিবীতে এই প্রজাতির মাত্র ৫০০ সদস্য টিকে আছে। অস্ট্রিয়ার একটি সংরক্ষণ সংস্থা এই গবেষণায় সহযোগিতা করে।
গবেষক দল ১৪টি পাখির শরীরে হালকা ওজনের ট্র্যাকার বসিয়ে অস্ট্রিয়া থেকে ইতালি পর্যন্ত তাদের গতিপথ পর্যবেক্ষণে সক্ষম হন; এবং চমকপ্রদ কিছু ঘটনা লক্ষ করেন।
২.
দলবদ্ধ ওড়ার ক্ষেত্রে যদিও যুদ্ধবিমানগুলি এই কৌশল (V ফরমেশন) প্রয়োগ করে আসছিল, কিন্তু পাখিদের বেলায় এই কৌশল সম্ভব নয় বলেই ধারণা করা হত। প্রথমত এই বিন্যাস জটিল, দ্বিতীয়ত এই বিন্যাস প্রয়োগ করার জন্য যে সংবেদী জ্ঞানেন্দ্রিয় দরকার তা পাখিদের ভেতরে অনুপস্থিত। তবে এই গবেষণায় দেখা গেছে পাখিরা ঠিক একই কারণে দলবদ্ধ ওড়ার সময় এই বিন্যাস অনুসরণ করে।
৩.
যেকোনো ডানা-বিশিষ্ট উড়ন্ত বস্তু বায়ুমণ্ডলে দুরকম প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। বাতাসের চাপের উপর নির্ভর করে এ দুটিকে বলা হয় ‘আপওয়াশ’ ও ‘ডাউনওয়াশ’; আপওয়াশ বায়ুচাপ ডানার দিকে সৃষ্টি হয়, এবং তা শূন্যে ভেসে থাকার অনুকূল। ডাউনওয়াশ নিম্নমুখী চাপ যা ভাসমান বস্তুকে নিচের দিকে ঠেলে দেয়।
যেকোনো ভাসমান বস্তুর ভেসে থাকার যেকোনো সময়ে একটা অবস্থান থাকে, যেখানে শক্তিক্ষয় সব থেকে কম, এই অবস্থানটাকে বলা হয়ে থাকে অ্যারোডায়নামিক অপটিমাল পজিশন বা উড্ডয়ন-অনুকূল অবস্থান।
সর্বনিম্ন শক্তিব্যয়ের মাধ্যমে ভেসে থাকা দলবদ্ধ পাখিদের জন্য অন্যতম শর্ত। খুব কম খাদ্য সংস্থান এবং বিশ্রামের আশ্রয় নিয়ে দীর্ঘ পথ অতিক্রমের সময়, বিশেষত যখন ঋতুকালীন মাইগ্রেশনে তাদের মহাদেশব্যাপ্ত পথ পরিভ্রমণ করতে হয়, তখন তাদের অস্তিত্বের জন্য এই কৃচ্ছ্রসাধন অবশ্যম্ভাবী।
৪.
এই গবেষণায় লক্ষ করা যায় এই V-বিন্যাস দলবদ্ধ উড়ন্ত পাখিদের ভেতরে একটা মিথষ্ক্রিয়া ঘটায়। অগ্রগামী পাখির ডানা ঝাপটানি-জনিত আপওয়াশের সর্বোচ্চ ব্যবহারের জন্য V ফরমেশন একটি কার্যকরী অবস্থান, এতে দলের অন্য সদস্যের ডানার দ্বারা নিজের ডানার গতি কোনোভাবেই বাধাগ্রস্থ হয় না, আবার আপওয়াশের সবটুকু সুবিধা গ্রহণ করা যায়।
অস্ট্রিয়া থেকে ইতালি পর্যন্ত দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় বল্ড আইবিসের এই নিপুণ কৌশল গবেষক দলের প্রধান ড. স্টিভ পর্টুগালকে বিস্মিত করেছে। তার মতে, দলবদ্ধ উড়ন্ত পাখিদের এমন ভি-বিন্যাস দলের ভেতরে প্রতিটি পাখির নিজের এবং অন্যদের অবস্থান সম্পর্কে সচেতনতারই ইঙ্গিত দেয়। সামনের পাখিটির ডানাকে অনুসরণ করার ক্ষমতাও তারা রাখে বলে তিনি মনে করেন। কেননা আপওয়াশের সুবিধাটার সব থেকে ফলপ্রসূ ব্যবহারের জন্য বল্ড আইবিস সামনের জনের প্রায় সাথে সাথেই ডানা ঝাপটায়। এই ছন্দোবদ্ধ ডানা ব্যবহারে ছন্দপতন ঘটেনি দীর্ঘ পথে।
৫.
ব্যবহৃত প্রযুক্তিটি মূলত একটি জিপিএস ডেটা লগ ডিভাইস। ওজনে হালকা, সময় সমন্বয়ে সক্ষম খুদে ডিভাইসটি দলবদ্ধ পাখিদের গতি, ডানা ঝাপটানোর গতি ইত্যাদি ৩০ সে.মি. নির্ভুলতার সাথে পরিমাপ করতে সক্ষম। এমন নিখুঁত পুঙ্খানুপুঙ্খ পরিমাপ এই প্রথম গবেষকদের দলবদ্ধ পাখিদের উড্ডয়ন সম্পর্কে এমন বিস্তারিত গবেষণার সুযোগ দিয়েছে।
প্রায় ৩০০ বছর পর নর্দান বল্ড আইবিস প্রজাতিটিকে ইউরোপে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে ড. পর্তুগালের নেতৃত্বে গবেষকদল ও অস্ট্রিয়াভিত্তিক প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ সংস্থা ওয়ালড্র্যাপটিম (Waldrappteam) যৌথ ভাবে কাজ করে। অস্ট্রিয়া চিড়িয়াখানায় ওয়ালড্র্যাপটিম-এর নিবিড় তত্ত্বাবধানে ১৪টি অপরিণত বল্ড আইবিসকে মাইক্রোলাইট অনুসরণ করার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। যাতে করে বল্ড আইবিসের গ্রীষ্মকালীন আবাস থেকে শীতকালীন আশ্রয় ইতালির তুসকানি পর্যন্ত মাইক্রোলাইট অনুসরণ করে পৌঁছুতে পারে তারা। সাধারণ অবস্থায় এই পরিভ্রমণ পথ পাখিরা দলের প্রাপ্তবয়স্ক অভিজ্ঞদের সহায়তায় চিনে থাকে। বল্ড আইবিসের এই নতুন প্রজন্মের পক্ষে সে সুযোগ ছিল না।
তবে মাইক্রোলাইট নামের এয়ারক্রাফটটিকে অনুসরণ করানোর প্রশিক্ষণ ছিল চ্যালেন্জের। একটা যন্ত্রদানবকে মাতৃজ্ঞান করে তাকে অনুসরণ করানোর জন্য প্রয়োজন হয়েছে নিবিড় অনুশীলনের।
আরো পড়ুন: অস্ট্রেলিয়ায় বিড়ালেরা প্রতিদিন ১০ লক্ষ পাখি হত্যা করে
সলোভিয়ান সীমান্তের কাছে অস্ট্রিয়ার একটি ছোট গ্রামে বল্ড আইবিসদের নিয়ে প্রশিক্ষকদের কসরৎ গ্রামবাসীদের ভীষণ আমোদিত করেছে। যদিও মানুষ পরিচালিত দলবদ্ধ পাখির এই মাইগ্রেশন এটাই প্রথম নয়।
২০০৪ সালে প্রথম সফল মাইগ্রেশন ঘটাতে সক্ষম হন বিজ্ঞানীরা। বলতে গেলে প্রজাতিটির হারানো প্রবৃত্তি আয়ত্ত করাতে হয়েছে নতুন করে। এই মাইগ্রেশন প্রকল্পের প্রধান জোহানেস ফ্রিটয বল্ড আইবিসের আস্থা অর্জন করাকেই দেখেছেন প্রধান চ্যালেন্জ হিসেবে। এই বিশ্বাস অর্জন করতেই পাখিদের মানব অভিভাবকদের করতে হয়েছে কঠিন পরিশ্রম। বল্ড আইবিসের এই আস্থা না পেলে উড়ন্ত অবস্থায় তাদের রক্তচাপ শক্তিক্ষয় প্রভৃতির হিসাবে ঘটতে পারত বড় রকমের তারতম্য।
আরো পড়ুন: বছরে ১০০ কোটি পাখিমৃত্যু—জানালার কাচের কারণে
গবেষণায় কারিগরি অনুদান দেয়া প্রতিষ্ঠান ইন্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ফিজিক্যাল রিসার্চ কাউন্সিলের প্রধান নির্বাহী, অধ্যাপক ডেভিড ডিপলি এই গবেষণার উপাত্তকে অ্যারোডায়নামিক এবং প্রাণিবিজ্ঞানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন।
বল্ড আইবিসের ছোট্ট দলটি এখনো ইতালির তুসকানিতেই অবস্থান করছে। গবেষকদল আশা করছেন বল্ড আইবিস এই বছরের পরবর্তীতে নিজেরাই তাদের প্রজনন ভূমি সালজবার্গে পৌঁছানোর পথ খুঁজে নেবে, মাইক্রোলাইটের সাহায্য ছাড়াই।
ভিডিও: দ্য ফ্লাইট অব দ্য বল্ড আইবিস – দ্য সিক্রেট অব নেচার