আমেরিকার ইয়েলোস্টোন ন্যাশনাল পার্ক একসময় নেকড়েদের অভয়ারণ্য ছিল। কিন্তু শিকারীদের আক্রমণের মুখে ধীরে ধীরে নেকড়েরা নিশ্চিহ্ন হয়ে পড়ে। ১৯৯৫ সালে ব্যবস্থাপক কমিটির যথাযথ উদ্যোগে নেকড়েদের ফিরিয়ে আনা হলে পার্কের পরিবেশে ঘটে আমূল পরিবর্তন। তারই ভিত্তিতে ব্রিটিশ লেখক জর্জ মনবিয়ো একটি বিস্ময়কর জগতের ধারণা দিয়েছেন, যেখানে আদিম বন্য জন্তুদের পাশাপাশি থাকবে বনাঞ্চলে মানুষের আবাস গড়ার সুযোগ।

বিলুপ্ত উদ্ভিদ ও প্রাণীদের ফিরিয়ে আনতে পুনর্বনায়ন

জর্জ মনবিয়ো
অনুবাদ: আয়মান আসিব স্বাধীন

একজন তরুণ ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্ট হিসেবে বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াবার ছয় বছর পৃথিবীর সবচেয়ে আকর্ষণীয় কিছু অঞ্চল চষে বেড়ানোর সুযোগ হয়েছিল। অল্পবয়সীদের বেপরোয়া ভাব বা নির্বুদ্ধিতার কোনো অভাব আমার মধ্যে ছিল না। যুদ্ধের শুরুটা বোধহয় এসবের টানেই হয়। কিন্তু সেই সাথে নিজেকে প্রতি মুহূর্তে আগের চাইতে জ্যান্ত মনে হচ্ছিল।

জর্জ মনবিয়ো: (জন্ম. ১৯৬৩) ব্রিটিশ লেখক, পরিবেশবাদী ও রাজনৈতিক কর্মী। পুঁজিবাদ ও পরিবেশ সচেতনতা নিয়ে দশটিরও অধিক বই লিখেছেন। ১৯৯৫ সালে তার পরিবেশবাদী উদ্যোগের স্বীকৃতি হিসেবে নেলসন ম্যান্ডেলা তাকে জাতিসংঘের গ্লোবাল ফাইভ হান্ড্রেড অ্যাওয়ার্ড প্রদান করেন।

বাড়িতে ফিরে ডিশওয়াশারে থালাবাসন ভরতে গিয়েই অনেকটা বেসামাল হয়ে পড়লাম। জীবনে বৈচিত্র্যের পরিধি কতটা ছোট হয়ে আসছে বুঝতে আর বাকি রইল না। মনে হলো জীবনের দেওয়ালে আঁচড় কাটছি, যেন বাইরের ঐ বুনো জগতটায় যাবার পথ খোঁজার চেষ্টা। এই একঘেয়ে বাস্তুজগতে আমি যেন বড় ক্লান্ত।

এখন পৃথিবীটা আরো ধারালো হয়ে গেছে, যে পৃথিবী ঘুরে দেখার ভয় আর সাহস দু’টাই আমাদের মাঝে এখনো টিকে আছে। কিন্তু আমাদের নিরাপদ, আরামদায়ক আর লোকজনে ভরা জায়গায় থেকে সে সবের চর্চা করার সুযোগ কম, থাকলেও তা অন্যদের ক্ষতির কারণ হয় সহজেই।

আমি এই বাধা পার হওয়ার চেষ্টাই করছিলাম। সামনে কী হবে তা আগেভাগেই জেনে নেওয়া, যতদূর সম্ভব অনিশ্চয়তাগুলি দূর করে ফেলা। শিল্পায়ন একনাগাড়ে যেন এই লক্ষ্যেই কাজ করে এসেছে। আর সেই লক্ষ্যে পৌঁছে আমরা একেবারে নতুন কিছু অভাব টের পাচ্ছি। নিরাপত্তার জন্য অভিজ্ঞতার দাম কমিয়ে আমরা বহু জিনিস পেয়েছি ঠিকই, কিন্তু কিছু জিনিস হারিয়েও গেছে বলে মনে করি।

বিবর্তনের শুরুর সময় নিয়ে বাড়তি কোনো আবেগ আমার মধ্যে নেই। বন্য কোনো মহিষের সাথে আমার মারামারি হলে একটা বল্লম নিয়ে আমি কতদূর কী করতে পারব সেটা আন্দাজ করতে তেমন একটা কষ্ট করতে হবে না। তাই বলে যে আমি নির্ভেজাল জীবন খোঁজার ধান্দায় ছিলাম তাও না। অকৃত্রিমতা বা এই জাতীয় ধারণাকে আমার কখনোই কাজের জিনিস মনে হয় নি। আমি শুধু আমার ব্রিটেনের জীবনের চেয়ে আরেকটু টাটকা জীবন খুঁজছিলাম, শিল্পায়নের পাল্লায় পড়ে যা বিশ্বের বেশির ভাগ জায়গাতেই আর পাওয়া যায় না।

ঠিক এমন সময় অপরিচিত একটা শব্দ আমার চিন্তাগুলি সব সারিবদ্ধ করে দিল। শব্দটা যেন বুঝিয়ে দিল আমার বাকি জীবনটা কীসের পেছনে ছুটতে হবে।

শব্দটা ‘পুনর্বনায়ন’ (রিওয়াইল্ডিং)। যদিও একেবারেই নতুন সংযুক্তি, তবুও এর বেশ কিছু ভিন্ন অর্থ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে দু’টি বিশেষ অর্থ আমাকে আকৃষ্ট করে বেশি। তার প্রথমটি হলো ইকোসিস্টেমের পুনর্গঠন।

নেকড়ে
রিওয়াইল্ডিং এর একটি ছবি। যার অর্থ প্রকৃতিকে নিজের মত করে নিজের যত্ম নিতে দেয়া, মাটি ও নদীকে প্রাকৃতিকভাবে নিজের আকৃতি তৈরির সুযোগ দেয়া, ক্ষতিগ্রস্ত ইকোসিস্টেমকে সেরে ওঠার সময় দেয়া।

গত শতাব্দীর সবচেয়ে চমকপ্রদ বিজ্ঞানভিত্তিক আবিষ্কারগুলির একটা হলো ব্যাপক হারে ‘ট্রফিক ক্যাসকেড’ এর সন্ধান পাওয়া। এটি একটি বাস্তুতান্ত্রিক প্রক্রিয়া যা খাদ্য শৃঙ্খলের একদম উপরে থেকে শুরু হয়ে একে একে নিচে নামতে থাকে।

১৯৯৫ সালে যখন আমেরিকার ‘ইয়েলোস্টোন ন্যাশনাল পার্ক’-এ নেকড়ে নিয়ে আসা হলো, তখন এই ঘটনাটির স্পষ্ট একটি উদাহরণ দেখা দেয়।

হ্যাঁ, নেকড়ে অনেক প্রজাতির জীবন কেড়ে নেওয়ায় দক্ষ ঠিক, কিন্তু তাদের জন্য যে অনেক প্রাণী জীবন ফিরেও পায়—সেটিও কিন্তু সমান সত্যি। জানি খটকা লাগছে, তবুও আমার কথাগুলি আরো কিছুক্ষণ শুনলেই আশা করি ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে।

পার্কে নেকড়ে প্রায় ৭০ বছর গায়েব ছিল, ফলে সেখানে হরিণের সংখ্যা বাড়তেই থাকে; কারণটা সহজ—হরিণকে শিকার করে খাওয়ার মত কোনও প্রজাতিই সেখানে ছিল না। তো স্বাভাবিকভাবেই হরিণেরা পার্কের সব গাছপালা খেয়ে সাবাড় করে ফেলে। একপর্যায়ে দেখা যায় গাছপালা নেই বললেই চলে।

আরো পড়ুন: শতবর্ষী মানুষ কেন বেশিদিন বাঁচে?

নেকড়েরা সংখ্যায় অল্প হলেও তারা এসেই হরিণদের উপর হামলা চালায়। ফলে হরিণেরা অনেক বেশি সতর্ক হয়ে পড়ে। পার্কের অনেক জায়গাতেই তাদের চলাফেরা কমতে থাকে, বিশেষ করে উপত্যকার দিকটায়।

সেইসব জায়গার গাছগুলি আবার বেড়ে ওঠে, এমনকি ছয় বছরে তাদের উচ্চতা বেড়ে যায় পাঁচগুণ। ন্যাড়া জমিতে উইলো আর পপলার গাছ বাড়তে থাকে, আর তা দেখে পাখিরা আসতে থাকে দল বেঁধে। অতিথি পাখি দিয়ে ভরে যায় পার্ক। গাছ খেতে পছন্দ করে বলে বিবরের সংখ্যাও বৃদ্ধি পায়।

নেকড়ের মত বিবরকেও ‘ইকোলজিক্যাল ইন্জিনিয়ার’ বলা হয়ে থাকে। নদীতে তারা যে বাধ তৈরি করে তা খাটাশ, ভোঁদড়, হাঁস, মাছ, সরীসৃপ আর উভচরদের বাসস্থানের সুযোগ করে দেয়।

নেকড়েরা কায়োটিদের মেরে ফেলে, তাই ইঁদুর আর খরগোশেরা সংখ্যায় বেড়ে যায়। তার মানে বাজপাখি, বেজি আর শেয়ালদের আনাগোনাও বাড়তে থাকে।

নেকড়েদের ফেলে রাখা বাড়তি খাবারে ভাগ বসাতে নেমে আসে দাঁড়কাক আর ঈগল। ভাল্লুকরাও ওসব খায়। তারাও বৃদ্ধি পায় দলে দলে, কারণ তাদের খাওয়ার জন্য ঝোপগুলিতে বেরীর সংখ্যা ততদিনে অনেক বেড়ে গেছে। সেই সাথে হরিণের বাচ্চাদের মেরে ফেলায় নেকড়েদের আক্রমণের প্রকোপ বেড়ে যায় বহুগুণ।

তবে এই জায়গায় এসেই ব্যাপারটা হয়ে যায় আরো ইন্টারেস্টিং। নেকড়েদের কারণে কিন্তু নদীর স্বভাবেও পরিবর্তন আসে। নদীক্ষয় কমে যায়, খালগুলি আরো চিকন হয়, এমনকি নদীর এঁকেবেঁকে বয়ে চলাও ধীরে ধীরে কমে আসে।

এ সবকিছুর ফলে জলাশয় বাড়তে থাকে, যা বন্য প্রাণীদের বাসস্থানের জন্য আদর্শ। নেকড়েদের কারণে নদীর উপর এই ধরনের প্রভাব শুরু হয় মূলতঃ গাছপালা বৃদ্ধির ফল হিসেবে। বেশি বেশি গাছ থাকায় নদীর কিনারা আরো দৃঢ় হয়ে যায়, ফলে ভাঙন হয় কম। সেই জন্যেই নদীগুলির গমনপথ হয়ে যায় সোজাসাপ্টা।

একই ভাবে বহু জায়গায় হরিণদের আগমন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আর উপত্যকাগুলিতে গাছপালা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে সেই জায়গাগুলিতে মাটিক্ষয়ও কমে যায় ব্যাপকভাবে। কাজেই দেখা যাচ্ছে, নেকড়েদের আগমন শুধু পার্কের ইকোসিস্টেমই পাল্টে দেয় নি, সেখানকার ভূগোলেও পরিবর্তন এনেছে।

দক্ষিণ মহাসাগরের তিমিও একই রকম সুদূরবিস্তৃত প্রভাব রাখে। তিমি মেরে ফেলার অজুহাত হিসেবে জাপানি সরকারের অন্যতম বক্তব্য, “তিমিরা যেহেতু চিংড়ী জাতীয় মাছ খেয়ে ফেলে, তাই তাদের সংখ্যা কমলে সাধারণ মাছের সংখ্যা বাড়বে। মানুষ খাবার পাবে বেশি।”

যদিও হাস্যকর যুক্তি, তবুও শুনলে মেনে নেওয়ার মতোই মনে হয়, তাই না? কারণ তিমি কমে গেলে চিংড়ী ও অন্যান্য মাছের প্রজনন তো বাড়ারই কথা, যেহেতু তাদেরকে মেরে ফেলার মতো কেউ থাকছে না।

নেকড়েকিন্তু ঘটনা হলো উল্টা। আসলে তিমি গোটা ইকোসিস্টেমকে ধরে রাখার জন্যই প্রয়োজনীয়। তারা সাগরের একদম গভীরে খাদ্যগ্রহণ করে চলে আসে উপরে। উপরে এসে তারা তাদের মল ছেড়ে দেয় কিংবা ভদ্র ভাষায় বলা যায় ‘ফিকাল প্লুম’ উৎপাদিত করে। ‘ফোটিক জোন’ নামের পানির একেবারে উপরিভাগের এই অংশে ব্যাপক পরিমাণ মলের বিস্ফোরণ ঘটে। ফলে সেখানে সালোকসংশ্লেষণের উপযোগী আলো থাকায় যে ব্যাপক পরিমাণ সার তৈরি হয়, তা খাদ্যশৃঙ্খলের একদম নিচে থাকা ফাইটোপ্ল্যাংক্টনের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করে, যা পর্যায়ক্রমে জুওপ্ল্যাক্টনের বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। এই জুওপ্ল্যাংক্টন চিংড়ী ও অন্যান্য সকল মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়, ফলে তাদের সংখ্যাও বেড়ে যায়। অন্যদিকে তিমিদের এই ক্রমাগত উপরে-নিচে আসা যাওয়ার ফলে উদ্ভিদ প্ল্যাংক্টনগুলি পানির উপরিভাগে আসার সুযোগ পায়। সেখানে তারা সহজেই প্রজননের মাধ্যমে টিকে থাকতে পারে।

আরো পড়ুন: সাহারায় ৪ পা বিশিষ্ট হিংস্র তিমি’র জীবাশ্ম আবিষ্কার

আমরা সবাই জানি যে উদ্ভিদ প্ল্যাংক্টন প্রকৃতি থেকে প্রচুর পরিমাণে কার্বন শোষণ করে যা বিশোধিত হয়ে সাগরের গভীরতম স্থানে পৌঁছে বিলুপ্ত হয়ে যায়। কাজেই সর্বোচ্চ সংখ্যক তিমির সময়কালে প্রতি বছর কোটি কোটি টন কার্বন বায়ুমণ্ডল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত।

এখন আপনি হয়তো ভাবছেন যে, একদিকে নেকড়ে গোটা একটি পার্কের চেহারাই পাল্টে দিচ্ছে, অন্যদিকে তিমি পুরো বায়ুমণ্ডলকে পরিষ্কার করে ফেলছে—ভালোই তো। একটু দাঁড়ান, তার মানে জেমস লাভলক এর ‘গায়া তত্ত্ব’, যা সম্পূর্ণ পৃথিবীকে পরস্পর সহযোগিতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা একটি একক অরগানিজম হিসেবে ঘোষণা করে, সেই তত্ত্ব প্রমাণের উপযুক্ত সব নিদর্শন কি আমরা চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি না?

ট্রফিক ক্যাসকেড আমাদেরকে জানাচ্ছে যে, পৃথিবীটা আমাদের কাছে যতটা চমকপ্রদ ও জটিল মনে হতো, আসলে তা হয়তো তার চাইতেও বেশি। আমরা বুঝতে পারি খাদ্যশৃঙ্খলের উপরের প্রাণীদের বিলুপ্তি আমাদেরকে কতটা ভিন্ন একটা পরিবেশের মুখোমুখি করে। এর মাধ্যমে আমরা বিলুপ্ত প্রাণীগুলিকেও নতুন চোখে দেখার সুযোগ পাই।

আমার কাছে পুনর্বনায়ন বা রিওয়াইল্ডিং হলো হারানো কিছু উদ্ভিদ ও প্রাণীকে ফিরিয়ে আনা, বেড়া ভেঙে ওপারে যাওয়া, সমুদ্রের বিশাল জায়গা জুড়ে বাণিজ্যিকভাবে মাছ ধরা বন্ধ করা ও সবশেষে সরে আসা।

আরো পড়ুন: যেভাবে কোনো বস্তুর বয়স বের করেন বিজ্ঞানীরা

পুনর্বনায়ন আমাদের জন্য নিখুঁত ইকোসিস্টেম গড়ার কোনও প্রক্রিয়া নয়, এটি তৃণভূমি বা রেইন ফরেস্ট বা কোরাল রীফ উৎপাদনেও ব্যস্ত নয়, বরং প্রকৃতির সিদ্ধান্ত প্রকৃতির হাতে ছেড়ে দেওয়াই এর কাজ। আর আমার জানা মতে, প্রকৃতি তার সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে কোনো আপোস করে না।

আমি আগেই বলেছি যে পুনর্বনায়নের দু’টি অর্থ আমাকে আকৃষ্ট করে। তার মাঝে দ্বিতীয়টি হলো মানব জীবনের পুনর্বনায়ন। এটি সভ্যতার কোনো বিকল্প নয়। আমরা আমাদের প্রযুক্তিগত উন্নয়ন যেভাবে ভোগ করছি সেভাবেই করতে থাকব, কিন্তু সেই সাথে আমরা চাইলেই আরেকটি প্রাকৃতিক অভিযানে নামতে পারি, উপভোগ করতে পারি একটি পূর্ণ জীবন।

আর সেই সম্ভাবনা কিন্তু দিন দিন ব্যাপক হারে বেড়েই চলেছে। এক গবেষণার সূত্র মতে, যুক্তরাষ্ট্রের দুই-তৃতীয়াংশ জায়গা যা একসময় বনাঞ্চল ছিল, সেখানকার কৃষকেরা চলে যাওয়ায় তা আবার বনাঞ্চলে রূপ নিয়েছে। আরেকটি সূত্র থেকে ইউরোপের তিন কোটি হেক্টর জমিতেও ২০০০ সাল থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে একই রকম প্রভাব পড়বে বলে জানা যায়।

তো এই বিশাল সম্ভাবনার মুখোমুখি হয়ে কেবল নেকড়ে, ভাল্লুক, বিবর, বাইসন আর অন্যান্য যেসব প্রজাতি ইতোমধ্যেই ইউরোপজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে, শুধু সেগুলি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা কি অনেক কম আশা করা হচ্ছে না? বরং আমাদের উচিৎ কিছু হারানো মেগাফুয়ানা ফিরিয়ে আনা।

নেকড়ে
মেগাফুয়ানা

প্রশ্ন উঠতে পারে, ঠিক কোন ধরনের মেগাফুয়ানা? আসলে অ্যান্টার্কটিকা বাদে বাকি কোনো মহাদেশেই মেগাফুয়ানার কোনো অভাব ছিল না। এমনকি লন্ডনের ট্রাফালগার স্কয়ার খননের সময় সেখানকার নদীর নুড়িপাথরের সাথে প্রচুর পরিমাণ জলহস্তী, সিংহ, হায়না, গণ্ডার আর হাতির হাড় পাওয়া গিয়েছিল। জ্বী হ্যাঁ, ট্রাফালগার স্কয়ারে একসময় সিংহ ঘুরে বেড়াত। এই সবগুলি প্রজাতিই কিন্তু সর্বশেষ ইন্টারগ্লেসিয়াল পিরিয়ডেই সেখানে ঘুরে বেড়িয়েছে, যে পিরিয়ডের তাপমাত্রা ও আমাদের বর্তমান তাপমাত্রার বিশেষ কোনো ফারাক নেই। মানে মেগাফুয়ানার হারিয়ে যাওয়ার পেছনে জলবায়ুর চাইতে মানুষের হাতই বেশি।

আমাদের ইকোসিস্টেমে এখনো সেইসব মেগাফুয়ানার চিহ্ন ছড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। যেমন ধরুন পর্ণমোচী বৃক্ষের কথা। তাদের ভেঙে যাওয়া যে কোনো কাণ্ড থেকেই আবার অঙ্কুরিত হবার কারণটা কী? তাদের খসে যাওয়া ছালের ক্ষতিপূরণই বা তারা কীভাবে করে? কিংবা যেসব গুল্ম ক্যানোপি বৃক্ষের নিচে জন্মায়, তারা নিম্নমুখী বাতাসের প্রবল চাপের মুখে থেকেও আর ক্যানোপি বৃক্ষের চেয়ে অনেক কম ওজন বহন করার পরও কীভাবে ক্যানোপি বৃক্ষের চাইতে শক্ত হয়? কারণটা হলো হাতি। ইউরোপের সোজা দাঁতের হাতির আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্যই তারা এভাবে গড়ে উঠেছে।

আপনি যখনই একটি পার্ক বা কোনো গাছে ঘেরা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাবেন, তখনই সেসব বিশালাকার জন্তুদের ছায়া আপনার চোখে ভাসবে। প্যালিওইকোলজি বা অতীতের ইকোসিস্টেম সংক্রান্ত যে গবেষণা, তা যেন কোনো জাদুকরী জগতে ঢুকে যাবার দরজা। আর যদি সত্যিই এত ব্যাপক পরিমাণ জায়গা বনাঞ্চল ফিরে পায়, তাহলে মেগাফুয়ানা কিংবা তার কাছাকাছি বিলুপ্ত কিছু পশু ফিরিয়ে আনার চিন্তাটা মোটেও অবাস্তব নয়।

হয়তো এটিই পুনর্বনায়নের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেই অংশ যা আমাদের জীবন থেকে আজ হারিয়ে গেছে—আশা। প্রকৃতিকে টিকিয়ে রাখতে মানুষকে অনুপ্রাণিত করায় এক ছটাক আশাও এক টন হতাশা দূর করে দিতে পারে। পরিবেশের পরিবর্তন যে কেবল একমুখী নয়—রিওয়াইল্ডিং আমাদের সেই গল্পই শোনায়। আমাদের জানিয়ে দেয়, যে হয়তো একটি নীরব বসন্তের বদলে আমরা চাইলে একটি আনন্দঘন গ্রীষ্মও পেতে পারি।

ধন্যবাদ।