মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরা স্বভাবতই বড় হবার আগেই বাবার থেকে দূরে যেতে থাকে। তাদের ভাব জমতে থাকে মায়ের সাথে, মায়ের কাজের সাথে। তারা শিখে যায় কীভাবে ঘর ঝাড়ু দিতে হয়, কীভাবে থালাবাসন ধুতে হয়, কীভাবে কাপড় কাচতে হয় ইত্যাদি।
আমাদের বাড়িতে ঘটত সব উল্টো। ভাই প্রথমেই মায়ের কাছে থাকতে থাকতে রান্না শিখে নিল। তারপর এক এক করে ঝাড়ু দেয়া, কাপড় কাচা, থালাবাসন ধোয়া, ঘর গোছানো সব। মানুষের মতে শুধু আমি এক অঘারাম নিষ্কর্মা ঢ্যাঙা মেয়ে হয়ে বড় হতে থাকলাম। তবে আমাকে এই অঘারাম বানানোর পেছনের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ কারণ ছিল বুবু আর বাবা।
দাদিকে আমরা সবাই বুবু ডাকতাম। আমরা চাচাতো-ফুপাত ভাইবোনরা জন্মের পর থেকেই জানতাম বুবুর মাথার ব্রেইন শর্ট। এই ব্রেইন শর্টের ব্যাপারটা আমরা কেউই পুরোপুরি বুঝতাম না, শুধু বুঝতাম সংসারে খাওয়া দাওয়ার বিষয় ছাড়া আর কোনো ব্যাপারে বুবুর গুরুত্ব তেমন একটা নেই। তা স্বত্বেও বুবু কখনো তার নাতি- পুতিদের কাউকে সংসারের কোনো কাজে না লাগানোর গুরুদায়িত্ব আমৃত্যু পালন করে গেছেন।
আমি নিজের ইচ্ছেয় একদিন আমার ঘর ঝাঁট দিয়েছিলাম বলে সেই ঝাড়ু দিয়েই মাকে সপাৎ করে এক ঘা বসিয়ে দিয়েছিলেন বুবু।
বুবুর বড় ছেলে আমার বাবা। বাবা পেশায় শিক্ষক থাকলেও আমার বিশ্বাস তিনি শিক্ষকতার জন্য জন্ম নেন নি। তিনি জন্মেছিলেন গাছের জন্য, মুরগীর জন্য, গরুর জন্য আর আমের জন্য।
বাবার ছিল, মানে এখনো আছে, অসম্ভব গাছ লাগানোর শখ। গ্রামের টিনশেড চারকোনা বাড়ির ভেতরে বাইরে মেহেগনি, শিশু, ফুনিয়া, জাম, পেয়ারা সব মিলিয়ে ছিল ২৯টি গাছ। প্রতিটি গাছ বাবার নিজ হাতে লাগানো। তাদের কেউ কেউ ছিল আমার সিনিয়র আর কেউ কেউ জুনিয়র। এগুলো সব ছিল কাজের গাছ।
বাবার অনেকগুলো ক্যাটাগরির গাছের সবচেয়ে প্রধান্য যোগ্য ক্যাটাগরিতে পড়ে মানুষের সেবায় নিয়োজিত থাকার ফলে এসব নিয়ে কেউ কখনো কিছু বলেন নি। মা’র কথা অবশ্য ভিন্ন। মা’র বিশ্বাস বাবার মাথার ঘিলুর পুরোটা তার মেজাজে থাকার ফলে উনি জীবনে বেশিদূর এগোতে পারেন নি।
এক গ্রীষ্মে বাবা স্কুল থেকে এসে আমাকে ডেকে বললেন, “বাড়ির বাইরে ১৫ হাত জায়গা নিয়ে কচুর গাছ লাগিয়ে ফেললে কেমন হয় বল তো? দেখি তোর মাথায় কত বুদ্ধি!”
আমার তো ইলিশ মাছের সাথে কচুর তরকারি অমৃত লাগে। কচুর ভর্তার স্বাদও কোনো অংশেই কম নয়। বাড়ির বাইরে কচুক্ষেত থাকলে আমার তো বগল বাজানোর দিন আসবে।
আমি উৎসাহ নিয়ে বললাম, “কচুক্ষেত বানিয়ে ফেলো, যত্ন-আত্মির দায়িত্ব আমার।”
যেই কথা সেই কাজ। বাবার ব্যবস্থাপনা জ্ঞান তো অবাক করার মত। ১০ মিনিটের মাথায় কোথা থেকে বড় গামলা ভর্তি কচুর মুখী এনে কোদাল দিয়ে বাড়ির বাইরে কচুক্ষেত প্রকল্পে হাত লাগালেন। আমি সহকারী হিসেবে কাজও মন্দ করলাম না। বাবা কোদাল দিয়ে মাটি কোপালেন, আর আমি কচুর মুখী মাটির ভেতর পুঁতে রাখলাম। বাবা আর আমি ঝারি এনে তাতে পানি দিলাম।
ঠিক কতদিন পর জানি না, একদিন সকালে উঠে দেখলাম ছোট ছোট গাছ। পুরো জায়গা জুড়ে কটকটে টিয়েরঙা কচুগাছ।
আমি আর বাবা একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাসলাম, যেন এই সাফল্যে আমরা কেউ কারো চেয়ে কম নই তার একটা অভিনন্দন ছিল এই হাসিটা। বলতে ভুলে গেছিলাম, বাড়ির বাইরের সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যাবে প্রসঙ্গের উপর মা আমাদের কচুক্ষেতকে কেন্দ্র করে বিশাল হুমকি ধামকিওয়ালা বিশাল এক বক্তব্য দিয়েছিলেন আমাকে আর বাবাকে শুনিয়ে শুনিয়ে। আমি আর বাবা অসহায়ের মত একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে খাবার শেষ করে স্কুলে চলে গিয়েছিলাম।
মা’র অবশ্য বিশাল দয়ার শরীর। হুমকি ধামকি সে পর্যন্তই ছিল, যা হুমকি ধামকি দিয়েছিলেন তার কোনোটারই বাস্তবায়ন ঘটান নি।
বাবা একদিন হন্তদন্ত হয়ে স্কুল থেকে এসে আমাকে ডেকে বললেন, তার মনে হচ্ছে কচুর গাছগুলোর ঠিকঠাক যত্ন নেয়া হচ্ছে না। তার উপর আমরা না থাকলে কতিপয় দুষ্টু ছেলেপুলে পাতা ছিড়ে নিয়ে যায়। এসবের বিরুদ্ধে আমাদের দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।
মাকে রাগানো ঠিক হবে না, কে জানে কচুক্ষেত উৎখাতের ষড়যন্ত্র হিসেবে মা-ই এসব ছেলেপুলে লেলিয়ে দিয়েছেন কি না! তাই মাকে কোনো কিছু না জানিয়েই আমার আর বাবার গোপন পরিকল্পনা হিসেবে সর্বসম্মতিক্রমে মনস্থির করলাম আমরা কালই কচুর পাতায় গোবর ছিটিয়ে দেব। তাতে করে গাছের গোড়ায় সারের উপস্থিতি গাছকে দ্রুত বাড়তে সাহায্য করবে এবং দুষ্টু ছেলেপুলের পাতা ছেঁড়াও আটকানো যাবে। এক ঢিলে দুই পাখি যাকে বলে!
পরদিন পরিকল্পনা মাফিক আমরা বড় বালতিতে গোবর-পানি গুলিয়ে পাতায় ছিটাতে লাগলাম। অবাক হয়ে আমি আর বাবা মুখ চাওয়াচাওয়ি করে হেসে উঠলাম, কচুর পাতায় তো কোনোভাবেই গোবর পানি ধরে না।
মা কোথা থেকে এসে হো হো করে হেসে বললেন, “ঠিকই বলি, মাথার বুদ্ধিটা মেজাজে না থেকে বুদ্ধির জায়গায় থাকলে জীবনে অনেক কিছু করা সম্ভব হত!”
বাবা সেই যে আমতা আমতা করে সটকে পড়লেন, তারপরে আর কখনো কোনো গাছেই গোবর দেবার চেষ্টা করেন নি!