‘ক্লাসিক্যাল’ শব্দটার সাথে আমি অনেক ছোটবেলা থেকেই পরিচিত। কিন্তু ক্লাসিকাল মিউজিক কী জিনিস সেই বিষয়ে তখনও আমার ধারণা অনেক কম। পুরান যত বাংলা, হিন্দি গান আছে সেই সবগুলিকেই আমি ক্লাসিক্যাল গান ভাবতাম। কখনো কখনো একটু অপরিচিত রবীন্দ্রসঙ্গীতকেও ক্লাসিক্যাল বলে ধরে নিতাম।
পরে বড় হবার পর বুঝতে পারছি ক্লাসিক্যাল হচ্ছে “অ্যা অ্যা ই ই” করা গানগুলা। ছোটবেলায় তো এই “অ্যা অ্যা ই ই”-কে কোনভাবেই গান বলে মনে হইত না। শুনলে উলটা হাসি পাইত। তখন আমি চকরিয়ায় দিদির বাড়িতে থাকি। নতুন নতুন রক মিউজিক শোনা শুরু করছি। সারাক্ষণ গিটার, ড্রাম এইসব নিয়া থাকতাম আর আমার দিদির পিচ্চি দুইটাকেও এসব শিখাইতাম। সব মিলায়ে আমাদের রক মিউজিকের প্রতি এত টান জন্মাইছে যে, আমরা প্ল্যান করছিলাম একটা ব্যান্ড দিব।
রামি (দিদির বড় ছেলে, তখন ওর বয়স ৯) আমাদের ব্যান্ডে ড্রাম বাজাবে, কাব্য (দিদির ছোট ছেলে, তখন ওর বয়স ৩) গিটার বাজাবে আর আমি গান গাব। আমরা সবসময় রুমের দরজা জানালা বন্ধ করে গান শুনতাম। কারণ বাসার সবাই শুধু পুরানো দিনের গানই শুনত। তাই তাদের “ঘ্যান ঘ্যান ছ্যান ছ্যান ” ভালো লাগত না।
দিদির বাড়ির অনেকেই ক্লাসিক্যাল গান শুনত। যশরাজ, রশিদ খান, অজয় চক্রবর্তী এ নামগুলি আমার ওদের কাছেই শোনা। ক্লাসিক্যাল শুনে বলে আমরা সবসময় ওদের টিটকারি মারতাম। আমরা পুরানো দিনের গান তো দূরে থাক একটু হালকা পাতলা মিউজিকওয়ালা গান শুনলেই হাই তোলা শুরু করে দিতাম।
একদিন টিভি চ্যানেলে দেখলাম, ঢাকায় ক্লাসিক্যাল মিউজিক ফেস্টিভ্যাল হবে। সেখানে বিভিন্ন ক্লাসিক্যাল শিল্পীরা এসে গান গাবে। এত মাথা ঘামানোর মতো কোন ব্যাপার না তাই মাথা ঘামাই নাই। এরপরে একদিন দেখলাম ক্লাসিক্যাল মিউজিক ফেস্টিভ্যালে আবার নাচও হয়। তখন ভাবতে বসলাম ক্লাসিক্যাল গানে না হয় “অ্যা অ্যা ই ই” করে কিন্তু নাচটা হয় কীভাবে?
এর পরের বছর থেকে আমি ঢাকায় থাকতে শুরু করি। একদিন ইলা আপু এসে বলল উনি ক্লাসিক্যাল শুনতে যাচ্ছে আমি যাব কিনা! তখন আমি টিএসসিতে একটা মহা আড্ডাবাজ ভাইয়ার সাথে আড্ডা দিতে যাচ্ছিলাম। পরে ফোন দিয়ে জানলাম ওই আড্ডাবাজ ভাইও আর্মি স্টেডিয়াম গেছে। তো আর কী! আমিও ইলা আপুর সাথে আর্মি স্টেডিয়াম গেলাম।
যেহেতু আমি একটু বেকুব টাইপের তাই আমার ধারণা ছিল, শিল্পকলা টাইপ কোন একটা জায়গায় ওইরকমই এসিওয়ালা কোন একটা গ্যালারি হবে। লোকজন সব গম্ভীর মুখে চুপচাপ থাকবে।
গিয়ে দেখি পুরা উল্টা কারবার! খোলা মাঠের উপর গ্যালারি। সেখানে সবাই আড্ডা দিচ্ছে, সিগারেট খাচ্ছে, গল্প করতেছে, প্রেম করতেছে। পুরাই টিএসসি নাম্বার টু।
ইলা আপুরা অবশ্য খুব সিরিয়াস। তারা গান শুনতেই ওইখানে গেছে। তাই আড্ডাবাজির ভিতরে না বসে যত সামনের দিকে বসা যায় ওইদিকেই বসছে। আমি ওদের সাথে বসি নাই। গ্যালারির দিকে অনেক আপু-ভাইয়ারা ছিল তাদের সাথে বসে কথাবার্তা বলতেছিলাম। তখন কেউ একজন ক্লাসিক্যাল গান গাইতেছিল আর আমিও টুকটাক শুনতেছিলাম। কিছুক্ষণ পরে গিয়ে আমি ইলা আপুদের সাথে বসছি। যেহেতু ইলা আপুরা সিরিয়াসলি ক্লাসিক্যাল গান শোনে তাই ওদের সাথে বসার পর থেকে আমিও মনোযোগ দিয়ে ঝিমায়ে ঝিমায়ে শুনতে থাকি।
হঠাৎ আমাদের সামনে একদল মেয়ে এসে দাঁড়াল। হেভি ডিশডাশ মারা, স্মার্ট মেয়ে। তারা আমাদের সামনে দাঁড়ায়ে মাত্র আইফোন বের করে ছবি তোলা শুরু করল। এত পিছন থেকে অত সামনের ক্লাসিক্যাল সিঙ্গারের কী টিকির ছবি যে তুলছেন সেইটা উনারাই জানেন। সামনে দাঁড়ায়ে দাঁড়ায়ে ছবি তুলতেছেন তো তুলতেছেনই। পিছনের সবাই খুবই বিরক্ত। উনাদের জন্য পিছনের লোকজন কিছু দেখতে পায় না। তাছাড়া গান শোনার ক্ষেত্রে মনোযোগ নষ্ট হচ্ছে।
ইলা আপুরই একজন বন্ধু উনাদের ভদ্রভাবে ব্যাপারটা বললেন। স্মার্ট আপুগুলাও চুপচাপ বসে গেলেন। কিন্তু তাদের ক্যামেরা তখনও বন্ধ হয় নাই। ভিডিও মোডে অন আছে। কিছুক্ষণ গায়কদের ভিডিও করেন কিছুক্ষণ অডিয়েন্সদের ভিডিও করেন। যখন দেখলেন এসব আচরণে লোকজন বিরক্ত হচ্ছে তখন উনারা এক মুহূর্তের জন্য ক্যামেরা রেখে দিলেন। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই আবার ক্যামেরা বের করে সেলফি তোলা শুরু করে দিলেন। সেলফি তোলা শেষ করে উনারা উঠে গেলেন। পিছনে চলে গেলেন। আর ১৫/২০ মিনিট পর দেখলাম উনারা বের হয়ে যাচ্ছেন। ইলা আপুর রাগ এরপর হাসি হয়ে গেছে। আমার দিকে তাকায়ে বলছে “ওদের ক্লাসিক্যাল মিউজিক শেষ!”
এর কিছুক্ষণ পরেই দুই ভদ্রলোকের চিৎকার চেঁচামেচি ধমকাধমকি শোনা গেল। আমরা সবাই ওইদিকেই তাকাইলাম। দেখি দুই লোক মহা সিরিয়াসলি বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করতেছেন। আলোচনা এতই সিরিয়াস ছিল যে একটু পরেই তারা নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাটি করে আর্মি স্টেডিয়াম ত্যাগ করলেন।
এই জায়গার আরও একটা বিশেষত্ব আমি প্রথম দিনই বুঝে গেছিলাম। সেইটা হচ্ছে, এইখানে আসলে স্পেশালি মেয়েদের ইংরেজিতে কথা বলতে হয়। আমি আমার অপরিচিত দুই একজন মেয়েকেই দেখছি যে আমার সাথে “এক্সকিউজ মি, মে আই সিট হেয়ার?”, “ইজ দ্যট বুকড?” এগুলি বাংলায় বলছে। আমার আশেপাশে বেশিরভাগ মেয়েদেরই কথাবার্তা সব ইংরেজিতে।
ক্লাসিক্যাল মিউজিক ফেস্টিভ্যালে আমি খুব মন দিয়ে শুনছি ইন্সট্রুমেন্টগুলি। বাঁশি, মৃদঙ্গ, তবলা, সরোদ আরো সব ইন্সট্রুমেন্ট শুনতে খুব ভাল লাগে। এরপর যতবারই গেছি এই ইন্সট্রুমেন্টের টানেই গেছি।
গত বছর, মানে ২০১৩ সালে, ক্লাসিক্যাল মিউজিক ফেস্টিভ্যালের শেষ দিনের দিন। রশিদ খান তখন পারফর্ম করতে উঠবেন। আমার সাথে তখন এক ভাই, আরেক আপু ছিল। ভাইয়া আবার মাছরাঙ্গা চ্যানেলে চাকরি করে। তাই সেই সুবাদে আমরা একদম সামনে সেকেন্ড সারির ভিআইপি সিটে গিয়ে বসছি। শীতের রাতে আমরা সবাই রীতিমত প্যাকেট হয়ে আছি। তার উপর আমি প্যাকেটেরও প্যাকেট। ডাবল সোয়েটার, মাফলার, হাত মোজা, পা মোজা, ক্যাপ, চাদর সব পেঁচায়ে জবুথবু হয়ে ক্লাসিক্যাল গান শুনি।
হঠাৎ শুনলাম পাশের আপু গান গাচ্ছে “ও লায়লা তুঝে লে লে গি তু লিখকে লে লে”—আমি রীতিমত অবাক হয়ে উনার দিকে তাকাইলাম। উনি আমাকে একটা মেয়ের দিকে ইশারা করলেন। তাকায়ে দেখলাম ৩৫/৪০ বছরের এক মহিলা একধরনের স্লিভলেস, ব্যাকলেস টপস আর হাঁটু পর্যন্ত স্কার্ট পরে আছেন। এই শীতের সময়ে আরও অনেকেই হাত ছাড়া জামা পরে আসছেন বটে কিন্তু তাকে দেখে আমি বাকি সবাইকে ভুলে গেলাম।
শেষ দিনের দিন একটা স্বল্পদৈর্ঘ্য প্রেম কাহিনীও ঘটে গেছিল।
আমার সাথে যে ভাইয়াটা ছিল সে একটু ঘাউরা টাইপের। আমাকে দিয়ে চা কফি আনায়। তো একসময় ওরা আমাকে চা কফির জন্য লাইনে দাঁড়া করায়ে দিল। আমিও লাইন ধরে ধরে কফি নিলাম তিন কাপ। কফি নিয়ে ওদেরকে দিলাম নিজেও নিলাম। যেই কফিতে চুমুক দিতে গেছি তখনই দেখি আমার সামনে এক জাপানি ছেলে দাঁড়ায়ে আছে।
ছেলের চেহারা দেখে আমি এত মুগ্ধ হইছি যে গরম কফিতে চুমুক দিতে গিয়ে আমার জিভ, তালু সব পুড়ে গেছে।
সেই ছেলে আবার বিষয়টা খেয়াল করছে আর খুব মজা পাইছে। একটু পর পর আমি যেদিক যেদিক যাই ওই ছেলেও তার বন্ধু নিয়ে সেদিক সেদিক হাজির হয়। একটু পর পর তাকে দেখতে পেয়ে আমার তো খুশিতে পুরাই গদ গদ অবস্থা। এবার আর আমার প্রেম ঠেকায় কে? সেও ঘুরে ফিরে আমার দিকে তাকায়ে তাকায়ে হাসে, আমিও ঘুরে ফিরে তার দিকে তাকায়ে তাকায়ে হাসি। পুরা রাত এমন ঘুরে ঘুরে, তাকায়ে তাকায়ে গেল।
রাত শেষে, দিনের শুরুতে সব ক্লাসিক্যাল গান শেষ করে আমরা আর্মি স্টেডিয়ামের বাইরে সিএনজির আশায় দাঁড়ায়ে আছি। আরও অনেক ক্লাসিক্যাল শ্রোতারাও দাঁড়ায়ে আছে। আমি সেদিকেই হাসি হাসি মুখ করে তাকাচ্ছিলাম সেই জাপানি বালকের আশায়। আমরা সিএনজি পাইলাম। সিএনজিতে উঠলাম। সিএনজি যখন স্টার্ট দিল তখন দেখি আমার জাপানি প্রেমিক এক জাপানি সুন্দরীর হাত ধরে দাঁড়ায়ে আছে।
আমি আশা ছাড়ি নাই অবশ্য। মনে মনে ঠিক করছিলাম এরপরের বছর আবার আসব। যদি এক বছর পরে ওই ছেলেরে সিঙ্গেল পাওয়া যায়!
এরপরের বছর মানে এই বছর ২০১৪ সালে এমন সময় ফেস্টিভ্যাল ডেট পড়ল, যখন আমার ফার্স্ট সেমিস্টার এক্সাম চলেতেছে। কড়াকড়ির ব্যাপারে আমাদের কলেজ নামকরা। আর এইটা কলেজের প্রথম পরীক্ষা। তার উপর আমার পড়াশোনার অবস্থাও খুব একটা ভাল না। সব মিলায়ে আমার আর ক্লাসিক্যাল মিউজিক ফেস্টিভ্যালে যাওয়া হয় নাই।
প্রতিদিন টিভিতে, ফেসবুকে ক্লাসিক্যাল ফেস্টিভ্যালের চিত্র দেখি আর মা’র সাথে চিল্লাচিল্লি করি, আর কলেজকে গালি দেই।
ফেস্টিভ্যালের শেষ দিনের দিন আমার শেষ পরীক্ষা ছিল। তাই পরীক্ষা দিয়েই আর্মি স্টেডিয়াম চলে যাওয়ার আনন্দে লাফাচ্ছিলাম। কিন্তু এমন কপাল আমার! ওইদিন আমাকে আর্মি স্টেডিয়াম নিয়ে যাওয়ার মত কেউই ছিল না। রাগে দুঃখে আমি একের পর এক ক্লাসিক্যাল শ্রোতাদের ফোন দিতে থাকলাম। কিন্তু কেউই ওইদিন যাওয়ার নাই। আমার দুঃখ দুর্দশা দেখে এক ভাইয়া আমাকে এক ঘণ্টার জন্য নিয়ে যাইতে রাজি হইলো। আমি বললাম, আচ্ছা। মনিরুজ্জামানের বাঁশি শুনেই চলে আসব।
তারপর আর্মি স্টেডিয়াম গেলাম ১০টায়। গিয়ে দেখি রেজিস্ট্রেশন করা যাচ্ছে না। আমাদের দুইজনের একজনেরও রেজিস্ট্রেশন কার্ড নাই। দুইজনেই ফেসবুক চেক করা শুরু করছি। পরিচিত কারো চেক ইন আছে কিনা দেখতে। কিন্তু সেরকম ক্লোজ কাউকে ওইদিন পাওয়া গেল না। ৩০ মিনিট বাইরে দাঁড়ায়ে থাকার পর একজনকে পাওয়া গেল সে তার বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে কার্ড এনে আমাদের ভিতরে ঢুকাইল।
ভিতরে ঢুকে আমার আবার টিএসসি টিএসসি মার্কা খুশি লাগতেছিল। আমরা কফি নিয়ে চুপচাপ গ্যালারিতে পিছন দিকে গিয়ে বসলাম। একটু পরে খেয়াল করলাম, পারফরম্যান্সের মাঝে মাঝে সবাই যখন তালি দিচ্ছেন তখন কয়েকজন এক্সাইটেড শ্রোতা দাঁড়িয়ে নেচে নেচে শিসও বাজাচ্ছেন।
আমার পাশের ভাইয়া মোটেও ক্লাসিক্যাল শ্রোতা না, তবুও তিনি খুব বিরক্ত হইছেন। তার বিরক্তি দেখে আমি বললাম “এরা হানি সিং এর কনসার্টে আসছে।” এইটুক পর্যন্ত ঠিকই আছে। চলে। কিন্তু একটু পর খেয়াল করলাম, কোথায় যেন গান বাজতেছে! একটু পর বুঝলাম কেউ একজন ক্লাসিক্যাল শুনতে এসে গ্যালারিতে বসে ফোনে অন্য গান শোনা শুরু করছে।
আমি বাসায় ফিরছিলাম রাত সাড়ে বারোটায়। মনিরুজ্জামানের বাঁশি শুনে আমি মুগ্ধ কিন্তু আমার হতাশ হতাশও লাগতেছিল।
জাপানি ছেলেটাকে এবার আর খুঁজে পাই নাই।