মনোবিজ্ঞানী সুসান টার্ক চার্লস গবেষণা করে দেখতে পেয়েছেন যে, বয়স্করা আবেগগত বা মানসিকভাবে বেশি সুস্থ থাকেন

তরুণ বয়সে বয়স এবং অভিজ্ঞতা বাড়ার সাথে সাথে আমাদের দক্ষতাও বাড়তে থাকে। কিন্তু একবার তারুণ্য কেটে গিয়ে বয়স বেড়ে গেলে তখন মনে হতে পারে যেন সেখান থেকে সবকিছুই নিচের দিকে নামছে। প্রতি বছরই একটু একটু করে আমাদের স্মৃতিশক্তি, মানসিকভাবে সাড়া দেওয়ার গতি এবং উদ্যম কমতে থাকে।
তবুও অন্তত একটি ক্ষেত্রে বয়স্করা এগিয়ে থাকেন। আবেগের রাজ্যে বয়স্করা সর্বোচ্চ শাসন করতে পারেন।
ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটি, আরভিন, এর মনোবিজ্ঞানী সুসান টার্ক চার্লস গত ২০ বছর ধরে একটি গবেষণা করছেন। এই গবেষণায় তিনি সব বয়সের মানুষের মেজাজ-মর্জির বদল, তৃপ্তির অনুভূতি, চিন্তা করার মুহূর্ত এবং রাগ, দুঃখ ও হতাশার বিস্ফোরণ প্রভৃতি পর্যবেক্ষণ করছেন। আর আমাদের বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমরা কীভাবে আবেগ নিয়ন্ত্রণ এবং অনুভব করি সে সম্পর্কে বিশেষ আগ্রহ নিয়ে পর্যবেক্ষণ করেন।
গবেষণায় তিনি এবং তার সহকর্মীরা দেখতে পান যে, গড়ে বয়স্ক ব্যক্তিদের কম কিন্তু বেশি সন্তোষজনক সামাজিক যোগাযোগ রয়েছে এবং তাদের আবেগগত স্থিরতা ও মানসিক সুস্থতাও বেশি।
সুসান টার্ক চার্লস-এর সাক্ষাৎকার
টিম ভার্নিমেন
বয়স্ক ব্যাক্তিদের এই মাথা ঠাণ্ডা থাকার নেপথ্যের রহস্য কী? কীভাবে আমরা এই রহস্য উদঘাটন করে অন্য মানুষদেরকেও তা থেকে উপকৃত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারি? এবং তরুণরা এ থেকে কী শিক্ষা নিতে পারে? চার্লস এবং স্ট্যানফোর্ডের মনোবিজ্ঞানী লরা কারস্টেনসেন মিলে ২০১০ সালে মনোবিজ্ঞানের বার্ষিক পর্যালোচনায় সামাজিক এবং মানসিক পরিপক্বতার ওপর একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন। ঘটনাটি সম্পর্কে আরো জানতে এবং গবেষণাটি কীভাবে প্রকাশ পেয়েছে সে সম্পর্কেও জানতে আমরা চার্লসের কাছে ফিরে গিয়েছিলাম। তার সঙ্গে আমাদের কথোপকথনটি এখানে গুছিয়ে তুলে ধরা হল।
কোন জিনিসটা তরুণ একজন বিজ্ঞানীকে বয়স্কদের আবেগ নিয়ে গবেষণায় অনুপ্রাণিত করল?
৯০-র দশকের গোড়ার দিকে যখন আমি আন্ডারগ্রাজুয়েটের ছাত্র ছিলাম আমি মানুষের আবেগগত উন্নয়ন নিয়ে সত্যিই আগ্রহী ছিলাম। সেই সময়ে বিজ্ঞান বলছিল যে, ১৮ বছর বয়সের মধ্যেই আমাদের ব্যক্তিত্ব এবং আবেগ সম্পূর্ণরূপে বিকশিত হয়ে যায়। আমি এটা শুনে ভাবলাম, “পরের ৫০ বছরে কি কিছুই বদলায় না? সব একই থাকে? এরপর আমি স্ট্যানফোর্ডে লরা কারস্টেনসেনের একটি ক্লাসে অংশগ্রহণ করি এবং তার কাছ থেকেই প্রথম শুনি যে, ১৮ বছর বয়সের পরেও মানুষের আবেগগত উন্নয়ন হয়। তিনি লক্ষ্য করেছেন যে, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শারীরিক ফিটনেস বা জ্ঞানগত দক্ষতার ক্ষেত্রে ধীর গতি বা অবনতি দেখা গেলেও আবেগগত নিয়ন্ত্রণ এবং অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে খুব বেশি উন্নতি না হলেও অন্তত অবনতি দেখা যায় না। তার সাথে কথা বলেই আমি এই বিষয়ে কাজ করার জন্য আগ্রহী হয়ে উঠি। আমি বার্ধক্য সম্পর্কিত এমন একটি প্রক্রিয়া নিয়ে গবেষণার জন্য অনুপ্রাণিত হই যেখানে কোনো অবনতি নেই।
বয়স্ক মস্তিষ্ক আবেগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে কেন বেশি দক্ষ হয়, তা কীভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে?
কিছু স্নায়ুবিজ্ঞানী বিশ্বাস করেন যে, বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমাদের তথ্য প্রসেস করার গতিও ধীর হয়ে আসে, যা আমাদেরকে কোনো কাজ করার আগে, দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখানোর পরিবর্তে সময় নিয়ে ভাবতে বাধ্য করে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমাদের মস্তিষ্কের ফ্রন্টাল লোবের সামগ্রিক আকারও ছোট হয়ে আসে, যে অংশটি আবেগ নিয়ন্ত্রণ, জটিল যুক্তি এবং প্রক্রিয়াকরণের জন্য দায়ী। কিন্তু সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মারা ম্যাথারের মতো গবেষকরা দেখতে পান যে, আবেগ প্রসেস করার সময় কম বয়সী প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় বেশি বয়সী প্রাপ্তবয়স্কদের প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স প্রায়ই বেশি সক্রিয় থাকে।

প্রচুর গবেষণাতেই দেখা গেছে যে, বয়স্কদের মধ্যে একটি ইতিবাচক প্রবণতা আছে, যা এমনকি তারা নিজেরাও বুঝতে পারেন না যে তারা আসলে তা করছেন। তাদের ডিফল্ট মোডটা এমন, আমরা যেমন বলি, “ছোট জিনিস নিয়ে তারা মাথা ঘামান না।” আমরা দেখতে পাই যে বয়স্ক ব্যক্তিরা প্রায়শই বন্ধু এবং পরিবারের সাথে নেতিবাচক পরিস্থিতিতে ছাড় দেন।
এমন কোনো নির্দিষ্ট বয়স আছে কি, যখন আমরা মানসিক তৃপ্তির চূড়ায় পৌঁছতে পারি?
এটা নির্ভর করছে আপনি কোন দিকগুলি দেখছেন তার ওপর। তবে ৫৫ থেকে ৭০ বছর বয়সের মধ্যেই আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ইতিবাচক এবং সবচেয়ে কম নেতিবাচক আবেগ দেখা যায়। এরপর “জীবন নিয়ে সন্তুষ্টি”-র পরিমাপও রয়েছে, যার মধ্যে সুখ এবং দুঃখ উভয়ই রয়েছে, যেমন, আপনার জীবন কেমন চলছে তার জ্ঞানভিত্তিক মূল্যায়ন। মধ্যজীবনে আমাদের মাঝে জীবনে নিয়ে সন্তুষ্টি একটু কমই থাকে। ৫০ এর দশকের গোড়ার দিকে (৫০ থেকে ৫৫ বছর বয়সের মধ্যে) তা সর্বনিম্ন স্তরে থাকে। এরপর অবশ্য জীবন নিয়ে সন্তুষ্টি বাড়তে থাকে। ৭৫ বছর বয়স পর্যন্ত জীবন নিয়ে সন্তুষ্টি সর্বোচ্চ স্তরে থাকে। ৭৫-এর পরই আবার নেতিবাচক আবেগ বাড়তে শুরু করে।
তবুও শতবর্ষী মানুষরা মানসিকভাবে অনেক বেশি সুস্থ থাকেন, যা আপনি আপনার রিভিউতে লিখেছেন। এ থেকে অনেকে হয়তো ভাবতে পারেন যে, যারা জীবনভর ইতিবাচক মনোভাব ধরে রাখতে পারেন, বা যারা কম প্রতিকূলতার মুখোমুখি হন, তারাই বেশি দিন বাঁচেন।
হ্যাঁ, সন্তোষজনক সম্পর্ক এবং ইতিবাচক আবেগের মানুষ বেশি দিন বাঁচে, তা সত্য। এর ব্যাখ্যা কী হতে পারে তা নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে গবেষকরা দেখতে পেয়েছেন যে, শরীরে স্ট্রেস হরমোন কর্টিসোলের নিঃসরণ কম হলে এবং হার্ট সুস্থ থাকলে মানসিক স্বাস্থ্যও ভালো থাকে। অন্যান্য গবেষকরাও আবেগগত স্থিরতার সঙ্গে বেশি বয়সের সম্পর্ক দেখতে পেয়েছেন।
তাহলে আমরা বার বার দেখতে পাচ্ছি যে, বয়স বাড়ার সাথে সাথে আবেগের ওপরও আমাদের নিয়ন্ত্রণ বাড়ে। এগুলি ছোট ছোট প্রভাব, তবে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বেশিরভাগ মানুষের মধ্যেই বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই উন্নতি দেখা গেলেও তা সবার জন্য নয়। আমি জানি না ঠিক কত শতাংশ মানুষের মধ্যে এই উন্নতি ঘটে। তবে সম্ভবত ৪০ শতাংশ মানুষের মধ্যে আবেগের উপর নিয়ন্ত্রণ স্থিতিশীল থাকে, ৪০ শতাংশের মধ্যে আবেগের উপর নিয়ন্ত্রণ বাড়ে এবং বাকি ২০ শতাংশের মধ্যে নিয়ন্ত্রণ কমে। তবে গড়পড়তাভাবে মানুষের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আবেগের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণও সাধারণত বাড়তে দেখবেন আপনি।
কিন্তু যাদের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আবেগগত পরিস্থিতির এই উন্নতি হয় না, তদের বেলায় ব্যাখ্যাটা কী?
যাদের উপর এই গবেষণা চালানো হয়েছে গবেষকরা তাদের নাম দিয়েছেন উইয়ার্ড (WEIRD= Western, Educated, Industrialized, Rich and Democratic Societies), অর্থাৎ, তাদের অধিকাংশই পশ্চিমা, শিক্ষিত, শিল্পায়িত, ধনী এবং গণতান্ত্রিক সমাজের মানুষ। আমরা এও জানি যে তারা শুধুমাত্র WEIRD সমাজের নয়, তারা প্রায়শই প্রভাবশালী শেতাঙ্গ সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করেন। তার মানে তাদের বেশিরভাগেরই অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ছিল, পেনশন ছিল, সামাজিক ব্যবস্থা ছিল এবং প্রায়ই আমরা যাদের সাক্ষাৎকার নিতাম তারা ছিল মধ্যবিত্ত শ্বেতাঙ্গ যারা চাকরি করতেন, যাদের উচ্চশিক্ষা ছিল। একই আর্থ-সামাজিক অবস্থায় তরুণদের তুলনায় বয়স্কদের মানসিক অবস্থা অনেক ভাল দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু যেসব বয়স্ক মানুষের জীবন সুরক্ষিত নয়, যাদের স্থিতিশীল আবাসন নেই, যারা ক্রমাগত মানসিক চাপের মধ্যে অথবা যন্ত্রণায় থাকেন, তাদের মধ্যে আবেগগত এই উন্নতি দেখা যায় না। ফলে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যও খুব একটা ভাল থাকে না।
তরুণদেরও সাধারণত স্থিতিশীল আবাসন থাকে না। এই ধরনের সমস্যা কি তাদের মনের ওপরও ভর করে?
আমি মনে করি, মানসিকভাবে আপনি তখনই ধীর-স্থির ও সুস্থ থাকতে পারবেন যখন আপনি ভবিষ্যৎ সম্পর্কে চিন্তিত না হওয়ার মতো অবস্থা অর্জন করতে পারবেন এবং আপনার ভবিষ্যৎ নিরাপদ তা বুঝতে পারবেন। যখন আপনি বয়সে ছোট, তখন অনেক কিছুই চিন্তা করার আছে। আমি মাঝে মাঝে আমার আন্ডারগ্র্যাড শিক্ষার্থীদের বলি, বয়স্ক লোকেরা যখন বলেন, “এটা আপনার জীবনের সেরা সময়, সুতরাং এই সময়টাকে উপভোগ করুন,” তখন তারা আসলে আপনাদেরকে ভুল কথা বলেন, এটা একধরনের অ্যাবিউজ। অনেক অল্পবয়সী মানুষেরই কষ্টের হার বেশি থাকে।
আমার প্রাক্তন মেন্টর লরা কারস্টেনসেনের “সোসিও ইমোশনাল সিলেক্টিভিটি থিওরি”তে জীবনের আর কতটা সময় বাকি আছে সে সম্পর্কে আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই যে একটা সচেতনতা থাকে সে সম্পর্কে বলা হয়েছে। অল্প বয়স্ক মানুষ যারা সুস্থ এবং সামনে দীর্ঘজীবন প্রত্যাশা করেন তারা কঠোর পরিশ্রম করেন এবং তথ্য সংগ্রহ ও ভবিষ্যতের জন্য পরিকল্পনা করাকেও তারা মূল্য দেন। বয়স বাড়ার সাথে সাথে লোকে যখন দেখতে পায় যে জীবনের সময় কমে আসছে এবং খুব বেশি সময় বাকি নেই তখন লোকে আবেগগত লক্ষ্যগুলিকে বেশি মূল্য দিতে শুরু করেন। বয়স্করা নতুন নতুন ইন্টারেস্টিং মানুষের সাথে মিলিত হওয়ার চেয়ে বরং পরিবার এবং বন্ধু-বান্ধবদের সাথে সময় কাটাতে বেশি আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
বিজ্ঞানের একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে যে, মানুষের মতোই বয়স্ক শিম্পাঞ্জিদেরও কম সংখ্যক কিন্তু বেশি ইতিবাচক সামাজিক সম্পর্ক থাকে। এ থেকে গবেষকরা সিদ্ধান্ত নেন যে, মানুষের আবেগগত বিকাশ সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে এমন উপলব্ধির ওপর নির্ভর করে না। আপনিও কি একমত যে এই পরিবর্তনের পেছনের মেকানিজমটি আমরা যা ভেবেছি তার চেয়েও বেশি মৌলিক কিছু একটা হতে পারে?
আমার ধারণা যে, যেসব শিম্পাঞ্জি বেশি বয়স পর্যন্ত টিকে আছে তারা এমন কিছু স্বাস্থ্যকর অভ্যাস গ্রহণ করেছে যা বেঁচে থাকতে সহায়ক। জীবনের সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে শিম্পাঞ্জিরা এটা বুঝতে পারে বলে মনে হয় না আমার। আমার অনুমান হল যে, কয়েকটি জিনিস ঘটতে পারে। তরুণ বয়সে মানুষেরা সত্যিই অভিনবত্ব দিয়ে উদ্দীপিত হয়। তারা আবেগের প্রবলতা পছন্দ করে এবং ঝুঁকি নিতে পছন্দ করে। শিম্পাঞ্জিদের ক্ষেত্রেও এটা সত্য হতে পারে, যা তাদেরকে নতুন জিনিসের অভিজ্ঞতা পেতে, আধিপত্য ও মর্যাদার পুনরুৎপাদন এবং সম্মান অর্জন করতে সহায়তা করতে পারে। তবে এটা ক্লান্তিকর এবং এতে অনেক শক্তি ক্ষয় হয়। সুতরাং বৃদ্ধ বয়সে পরিচিত এবং আরামদায়ক পরিবেশ ও জিনিসের সাথে থাকাই ভাল। শক্তির মাত্রা হ্রাস মানুষের মধ্যেও সমানভাবে ভূমিকা পালন করতে পারে। উপরন্তু, স্ট্যানফোর্ড গবেষক রবার্ট সাপোলস্কি গবেষণায় দেখতে পেয়েছেন যে, বয়স্ক পুরুষ বন্য বেবুনদের মধ্যে অন্যদের প্রতি যে যত্নমূলক আচরণ দেখা যায় তা তাদের কম মানসিক চাপের সাথে সম্পর্কিত। সম্ভবত যেসব শিম্পাঞ্জি আরো বেশি সামাজিক এবং এমন সঙ্গীর প্রতি মনোযোগী ছিল তারাই এই সামাজিক সহায়তার সুবিধা পেয়েছিল।
তবে অবশ্যই, আমাদের এই অবিশ্বাস্য মস্তিষ্কও আমাদেরকে সবকিছু ঠিকঠাক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখতে সহায়তা করে।

আপনার গবেষণা নিশ্চয়ই মানুষকে আরও ইতিবাচক মনোভাব ধারণ করতে অনুপ্রাণিত করবে। তবে যাদের অনেক বয়স হয়ে যাওয়ার পরও জীবন নিয়ে অসন্তুষ্টি রয়ে গেছে, এটা পড়ে তাদের হয়তো ভাল নাও লাগতে পারে।
যারা অসুখী তাদেরকে তাদের দিনগুলিকে আরও পরিপূর্ণ অনুভব করার জন্য কীভাবে গঠন করা যায় সেদিকে নজর দিতে হবে। আমরা যখন স্বাস্থ্যকর আচরণের তালিকা তৈরি করব তখন পর্যাপ্ত ঘুম, ব্যায়াম এবং সঠিক খাবার খাওয়াকে অবশ্যই বেশি গুরুত্ব দেব এবং এসব ব্যাপারে কোনো দ্বিমত করার সুযোগ নেই। তবে সামাজিক সম্পর্কও এমন কিছু যা শরীরে কোলেস্টেরলের স্তর ঠিক রাখার মতোই গুরুত্বপূর্ণ, তবুও আমরা তা প্রায়ই ভুলে যাই। আপনি যে বয়সেরই হোন না কেন, ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং পরিবারের সদস্যদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য সময় ব্যয় করার বিষয়টি নিশ্চিত করুন। জীবনের উদ্দেশ্য এবং অর্থ খুঁজে পাওয়াও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা ভিন্ন ভিন্ন মানুষের জন্য ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। কিন্তু একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য খুঁজে বের করা এবং তা অনুসরণ করা আবেগগত দিক থেকে খুবই সন্তুষ্টিজনক হতে পারে।
এর মানে কি আবেগগতভাবে বেশি সুখী হওয়াটাও ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে?
হ্যাঁ, আপনার এতটা সুখী হওয়া উচিত না যে আপনি আর কোনো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন না। আর আপনাকে জ্ঞানগত চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবিলায়ও সত্যিই নিযুক্ত থাকতে হবে। সম্প্রতি প্রকাশিত একটি গবেষণা করার সময়, আমরা আট দিন ধরে মানুষকে অনুসরণ করেছি। প্রতি রাতে, তাদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছিল, এবং আমরা তাদেরকে মানসিক চাপগুলির বিষয়ে জিজ্ঞেস করেছি। তারা কি কোনো বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন? তারা কি এমন কোনো পরিস্থিতিতে পড়েছিলেন যেখানে তারা তর্ক করতে পারতেন, কিন্তু না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন? বাড়িতে বা কর্মক্ষেত্রে কোনো সমস্যা আছে কিনা?
আট দিন ধরে প্রতি রাতে আমরা ২,৫০০ জনেরও বেশি মানুষকে অপেক্ষাকৃত ছোটখাটো মানসিক চাপ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছি। যেমন কর্মক্ষেত্রে সমস্যা বা তর্ক। প্রায় ১০ শতাংশ মানুষ জানিয়েছেন যে তারা কখনো কোনো চাপের মুখোমুখি হননি। তারা এমনকি জীবনে একটি মাত্র চাপের মুখোমুখি হওয়া মানুষের চেয়েও বেশি সুখী হওয়ার খবর দিয়েছেন। কিন্তু তারা কগনিটিভ টেস্ট বা জ্ঞানীয় পরীক্ষায় একটি মাত্র মানসিক চাপের মুখোমুখি হওয়া লোকদের তুলনায়ও খারাপ করেছেন। তারা অন্যদের কম সাহায্য পেয়েছেন বা দিয়েছেন বলেও জানিয়েছেন এবং তারা টিভি দেখে অনেক বেশি সময় ব্যয় করেছেন।
বিশ বছর আগেও আমরা ভেবেছিলাম আপনার যদি ইতিবাচক সম্পর্ক এবং একটি নির্দিষ্ট জীবনধারা থাকে তাহলে আপনি আবেগগত ও জ্ঞানগত দিক থেকে সর্বোচ্চ কার্যকর থাকতে পারবেন, সর্বোত্তম শারীরিক স্বাস্থ্য পাবেন এবং নিখুঁত জীবনযাপন করতে পারবেন। কিন্তু এখন এসে দেখা যাচ্ছে যে বিষয়টি বেশ জটিল। এখন যারা সুখী হওয়ার খবর দিচ্ছেন তারাও জ্ঞানগত কার্যক্রমে ততটা উচ্চ দক্ষতা সম্পন্ন নন।
এর কারণ হতে পারে যাদের মানসিক চাপ নেই তারা অন্য মানুষের সাথে কম সময় কাটাচ্ছেন। আপনি যাদের চেনেন এবং ভালোবাসেন তারাও মাঝে মাঝে আপনার মানসিক চাপের উৎস হয়ে ওঠেন। কিন্তু তারা আপনাকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয় এবং আপনাকে সমস্যা সমাধানের কাজে বাধ্য করে। সুতরাং এমন নয় যে আপনি সমস্ত ক্ষেত্রেই সর্বোত্তম কল্যাণ খুঁজে পাবেন। আপনাকে কিছু না কিছু ছাড় দিতেই হবে। বিষয়টা অনেকটা এমন, “আমি একজন স্বেচ্ছাসেবক হতে চাই, এটা আমাকে আবেগগত অর্থ দেয়, আমার জীবনের অনেক উদ্দেশ্য আছে, কিন্তু আমি এমন কিছু লোকের কাছেও যাচ্ছি যারা আমাকে বিরক্ত করতে পারে।“
তাহলে মানুষকে কি ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য চেষ্টা করা উচিত? আপনি তাদেরকে কীভাবে এটা অর্জন করার পরামর্শ দিবেন?
সবকিছুতেই মানুষকে অবশ্যই একটা ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য চেষ্টা করা উচিত, কিন্তু সব ক্ষেত্রে একই পদ্ধতি খাটবে না। যেমন, আমরা জানি যে দৃঢ় সামাজিক বন্ধন থাকার ফলে মানুষ উপকৃত হয়। কিন্তু ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সংখ্যা এবং অন্যদের সাথে সময় কাটানোর ক্ষেত্রে মানুষভেদে ভিন্নতাও আছে। আমরা জানি যে মানুষকে শারীরিকভাবে সক্রিয় থাকতে হবে; তবে এই ক্ষেত্রে কেউ সাঁতার এবং অন্যরা জগিং করতে পছন্দ করতে পারে। আমরা জানি যে, কারো জন্য যে কাজটা চ্যালেঞ্জিং অন্যদের জন্য সেই একই কাজ বিরক্তিকরও হতে পারে।
ভারসাম্য অর্জনের জন্য মানুষকে আগে নিজেকে জানতে হবে এবং এমনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যাতে গতিশীল জীবন তৈরি হয়। যেখানে তারা সামাজিকভাবে সক্রিয় এবং এমনভাবে সম্পৃক্ত থাকতে পারবেন যা তাদেরকে অন্যের সঙ্গে একাত্মতার এবং নিজেকে মূল্যবান মনে করার অনুভূতি এনে দেবে। তাদের এমন ক্রিয়াকলাপও দরকার যা তাদের জন্য চ্যালেঞ্জিং, যেখানে তারা নতুন তথ্য শিখবে এবং সেই তথ্য মনে রাখতে হবে। যেমন তা হতে পারে একটি নতুন বাদ্যযন্ত্র শেখা বা একটি নতুন পার্কের লে-আউট শেখা বা এমনকি কোনো ভিডিও গেমের বিকল্প জগৎ। তাদেরকে এমন শারীরিক তৎপরতায়ও সম্পৃক্ত হতে হবে যা তাদের শারীরিক সুস্থতা এবং কার্যকারিতা বজায় রাখবে বা বাড়াবে।
তাদেরকে দৈনন্দিন জীবন এবং কীভাবে জীবনযাপন করা যায় সে সম্পর্কেও চিন্তা করতে হবে। যাতে তারা এমন আচরণে সম্পৃক্ত থাকে যা তাদের শারীরিক স্বাস্থ্য ভালো রাখবে এবং জ্ঞানীয় কার্যকারিতা ও আবেগগত সুস্থতা বজায় রাখবে।
বয়স্করা নিজেদের আবেগের ওপর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার জন্য যে সুবিধা পান তরুণ বয়সেই তা অর্জনের বিকল্প কোনো উপায় আছে কি? নাকি আমাদেরকে শুধু বয়স বাড়ার জন্য ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করতে হবে?
আবেগ নিয়ন্ত্রণের কৌশল হিসাবে মানুষ গত ১০ বছরে মাইন্ডফুলনেস বা মননশীলতা সম্পর্কে বেশি কথা বলেছে। এই কৌশলটি বেশ ইন্টারেস্টিং। এই কৌশলে ভবিষ্যৎ নিয়ে দুঃশ্চিন্তা না করে বরং আপনাকে মনে করিয়ে দেওয়া হয় যে বর্তমান মুহূর্তই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
আরো পড়ুন: মানুষের আয়ুর সীমা—১৫০ বছর?
এই কৌশলে শুধু বর্তমানেই বাস করতে বলা হয়। আমি মনে করি, বয়স্ক মানুষরা প্রায়শই এই কৌশল অবলম্বন করেন। অল্পবয়স্করাও এই কৌশল প্রয়োগ করে উপকারিতা পেতে পারেন। তবে তাদেরকে বিষয়টি মনে করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। “এই মুহূর্তে, সব কিছু ভাল চলছে―আসুন আজকের জন্য তা উপভোগ করা যাক”, সপ্তাহ শেষে এমন কথা বলার জন্য একটু সময় পেলে তা তরুণদের জন্য বেশ সহায়ক হতে পারে। তরুণরা যদি বয়স্কদের কাছ থেকে এই জিনিসটা শিখতে পারে তাহলে তাদের জন্য তা বেশ বিস্ময়কর হবে।
আমি মনে করি, আমার বয়স যত বাড়ছে ততই আমি সত্যিই এটা আরও গভীরভাবে বুঝতে পারছি। গবেষণায় যা দেখানো হয়েছে তা আমি সবসময় অনুভব করি।
সূত্র. নোয়েবল ম্যাগাজিন, ৫ মে ২০২১
অনুবাদ: মাহবুবুল আলম তারেক