মোনা লিসার প্রতি মানুষের আকর্ষণ এতই তীব্র যে লুভর মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ তাকে বুলেটপ্রুফ কাচের ভিতর সংরক্ষিত রেখেছেন। তাকে বছরে মাত্র একবার মুক্ত বাতাসে আনার উদ্দেশ্যে বের করা হয়। আর মোনা লিসাকে যখন বাইরে আনা হয় তখন অনেক গবেষকই মোনা লিসাকে নিজের হাতে ছুঁয়ে দেখতে চান। তারা বের করতে চান কীভাবে মোনা লিসাকে আঁকা হয়েছে।
দীর্ঘ সময় ধরে বিজ্ঞানী এবং কিউরেটররা অবাক হয়েছেন যে কোনো তুলির আঁচড় অথবা কোনো রেখা না টেনে দা ভিনচি কীভাবে মোনা লিসার মুখে ছায়া তৈরি করলেন।
আর্ট এক্সপার্টরা এই টেকনিককে বলে থাকেন ‘স্ফুমাতো’ (sfumato)। এটি এসেছে ধোয়ার ইতালিয়ান অর্থ ‘স্ফুমো’ থেকে।
বিশেষজ্ঞরা অনেকদিন থেকে ধারণা করছেন ‘স্ফুমাতো’ টেকনিকের মাধ্যমে এই ছায়া তৈরির সাথে ভিনচি ছবির উপরের স্তরে যে কাচের প্রলেপ ব্যবহার করেছেন তার কোনো সম্পর্ক আছে। কিন্তু এটা প্রমাণ করা সবসময়ই কঠিন ছিল কারণ কেমিক্যাল অ্যানালাইসিসের জন্য মোনা লিসার মুখের স্যাম্পল যোগাড় করা সম্ভব না।
ফিলিপ ওয়াল্টারের নেতৃত্বে লুভরের বিজ্ঞানীরা এই রহস্য সমাধানের চেষ্টা করেছেন ছবিটির গায়ে হাত না লাগিয়েই। এই টেকনিকের নাম এক্স-রে ফ্লুরোসেন্স। এই টেকনিকের মাধ্যমে আর্টওয়ার্কের কোনো ক্ষতি না করেই শিল্পীর প্রতিটি তুলির আঁচড়ের রাসায়নিক কম্পোজিশন এবং পুরুত্ব সম্পর্কে নিখুঁত তথ্য বের করে আনা সম্ভব।
মোনা লিসা সহ দ্য ভিনচির ৭টি মাস্টারওয়ার্কের ওপর এক্সরে ফোকাস করে ড. ওয়াল্টারের দল দেখেছেন যে দ্য ভিনচি প্রথমে বেসিক ফ্লেশ টোনে আঁকতেন। তারপর এই ফ্লেশ টোনের ওপরে দ্য ভিনচি তুলি দিয়ে ৩০ বার কাচের হাল্কা প্রলেপ দিয়েছেন—মাত্র কয়েক মাইক্রোমিটার এই প্রলেপের পুরুত্ব।
এই প্রলেপ স্বচ্ছ, অর্থাৎ এর ভিতর দিয়ে আলো আসতে পারে। কিন্তু দ্য ভিনচি এর সাথে সামান্য পরিমাণে ম্যাঙ্গানিজ ও লেড অক্সাইডের মত রঞ্জক পদার্থও দিয়েছেন।
ছবিতে এরকমভাবে কাচের পাতলা প্রলেপের মাধ্যমে দ্য ভিনচি ধোঁয়াশা ধরনের ছায়া তৈরি করতেন।
আঙ্গেওয়ান্দতে কেমিয়ে পত্রিকার ইন্টারন্যাশোনাল এডিশনে ভিনচির এই ছায়া তৈরির বিজ্ঞানের বর্ণনা দিয়ে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। সেখানে বলা হয়েছে তার এই প্রলেপের রেসিপির ব্যাপারে ভিনচি খুঁতখুঁতে ছিলেন। যেমন ‘দ্য ভার্জিন উইদ সেইন্ট অ্যানে’ ছবিতে ভার্জিনের মুখের ছায়া তৈরির প্রলেপে এক ধরনের রঞ্জক এবং শিশুদের মুখের ছায়া তৈরির প্রলেপে আরেক ধরনের রঞ্জক পদার্থ ব্যবহার করা হয়েছে।
হয় ভিনচি ইচ্ছা করেই দুই প্রলেপের ক্ষেত্রে দুই ধরনের রঞ্জক ব্যবহার করেছেন অথবা ভিনচি হয়ত দীর্ঘ সময় নিয়ে ছবিটি এঁকেছেন যে প্রলেপ তৈরির উপাদানের ক্ষেত্রে তার রুচি বদলে গিয়েছিল।
লুভর মিউজিয়ামের বেজমেন্টে ৬০ জন বিজ্ঞানী, একটি পার্টিকেল একসিলারেটর এবং কিছু যন্ত্রপাতি ও সেগুলির ব্যাটারি সবসময় ফ্রান্সের বিভিন্ন মিউজিয়ামের বিভিন্ন জিনিস নিয়ে গবেষণারত থাকে। ফলে যেসকল বিজ্ঞানীদের মোনা লিসাকে নিয়ে কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছিল তাদের বেশি দূরে যেতে হয় নি। তারা লুভর মিউজিয়ামের নিচেই, ভূগর্ভস্থ সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড রিস্টোরেশন অব মিউজিয়াম অব ফ্রান্স-এ কাজ করেছেন।