সম্প্রতি ভার্জিন গ্যালাক্টিকের প্রতিষ্ঠাতা রিচার্ড ব্র্যানসন এবং তার প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কিছু ক্রু ‘স্পেসশিপ টু’ স্পেসপ্লেন নিয়ে মহাকাশে যাত্রা করেছিলেন। ১২ জুলাই রবিবার আমেরিকার নিউ মেক্সিকো অঙ্গরাজ্যে সফলভাবে অবতরণ করেছেন তারা।
এর মাধ্যমে ‘ইউনিটি ২২’ নামের মিশনে মহাকাশযানটি চতুর্থবারের মতো সফলভাবে উড্ডয়ন শেষ করল। এর মধ্য দিয়ে ব্র্যানসন প্রথমবারের মতো মহাকাশ ভ্রমণ করলেন। ৭০ বছর বয়সী উদ্যোক্তা ব্র্যানসন মহাকাশ ভ্রমণের জন্যে এক দশকেরও বেশি সময় অপেক্ষা করে আসছিলেন।
‘স্পেসশিপ টু প্লেন’ নামের এই মহাকাশযানের অপর নাম ‘ভিএসএস ইউনিটি’। ইস্টার্ন টাইম অনুসারে সকাল ১০:৪০ মিনিটে ভার্জিন গ্যালাক্টিকের টুইন-ফিউসলেজ হোয়াইট নাইট প্লেনের সাথে সংযুক্ত হয়ে মহাকাশযানটি উড্ডয়ন করে।
ভূমি থেকে ওড়া শুরু করার ৫০ মিনিট পরে প্রায় ৪৫ হাজার ফিট উচ্চতায় ওঠার পরে মূল মহাকাশযানকে বহন করা ক্যারিয়ার বিমান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এর কিছুক্ষণ পরই ‘ভিএসএস ইউনিটি’ মহাকাশযানটির সাথে সংযুক্ত সিঙ্গেল রকেট ইঞ্জিন চালু হয় এবং যানটি ভূমি থেকে ৫৩.৫ মাইল উচ্চতায় মহাকাশের প্রান্তে পৌঁছে যায়। অবতরণের আগে মহাকাশযানের ভেতরে থাকা ক্রুরা কিছুক্ষণের জন্যে ভরহীন থাকার অভিজ্ঞতা লাভ করেন। নিউ মেক্সিকোর ‘স্পেসপোর্ট আমেরিকা’য় ভার্জিন গ্যালাক্টিকের সদ্য চালু হওয়া মহাকাশ পর্যটন ব্যবসা কেন্দ্রে মহাকাশযানটি অবতরণ করে।
‘ভিএসএস ইউনিটি’ মহাকাশের ‘মাইক্রোগ্রাভিটি’ স্তরে প্রবেশের সাথে সাথেই ব্র্যানসন তার সহকর্মীদের সাথে করমর্দনের মাধ্যমে অভিবাদন জানান। গ্রাউন্ড কন্ট্রোলের সাথে যোগাযোগের সময় ব্র্যানসন জানান যে, “এটা তার জীবনের অনন্য এক অভিজ্ঞতা।”
ভূমিতে অবতরণের পর ব্র্যানসন তাকে বহন করা মহাকাশযান থেকে বের হয়ে আসেন। ‘স্পেসপোর্ট আমেরিকা’ মহাকাশ পর্যটন কেন্দ্রের বাইরে ফটোসাংবাদিক, শিশুকিশোর ও আত্মীয়স্বজনরা তার জন্যে অপেক্ষা করছিলেন। মহাকাশ ভ্রমণের পরে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে কথা বলতে গিয়ে ব্র্যানসন নিজের উত্তেজনা লুকিয়ে রাখতে পারেননি। “কিছুক্ষণ আগেও আমি উল্টা হয়ে ঝুলে ছিলাম” বাক্যটি দিয়েই নিজের বক্তব্য শুরু করেন ব্র্যানসন।
ব্র্যানসন বলেন, “আমার মনে হয়, বেশিরভাগ শিশুরা যেভাবে কল্পনা করে, সেভাবে আমিও একজন শিশুর মতোই এমন একটা মুহূর্তের জন্য স্বপ্ন দেখেছি, কিন্তু সত্যিকার অর্থে মহাকাশ থেকে পৃথিবীকে দেখার এই অভিজ্ঞতার জন্যে কোনো কিছুই আপনাকে আগে থেকে প্রস্তুত করতে পারে না।”
তারপর তিনি পুরোদস্তুর একজন বিক্রেতার মতো করে বলেছিলেন, “ভার্জিন গ্যালাক্টিক হচ্ছে পৃথিবী থেকে মহাকাশ ভ্রমণের একটা মসৃণ পথ।” তিনি আরো যোগ করেন, “আমি আমার কারখানায় প্রচুর চকলেট দেয়ার জন্যে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।”
ভার্জিন গ্যালাক্টিকের প্রেসিডেন্ট মাইক মোজেস সাংবাদিকদের বলেন, “এন্টেনার সামান্য ত্রুটির কারণে কেবিনের ভেতরে লাইভ ভিডিও ধারণের সময় কিছুটা আটকে গিয়েছিল। এছাড়া অবতরণের পরে মহাকাশযানটি ছিল সম্পূর্ণ নিখুঁত অবস্থায়।”
মহাকাশ যাত্রার আগে ব্র্যানসন খুব চাঙ্গা এবং উত্তেজনা বোধ করছিলেন। মানসিকভাবেও তিনি পুরাপুরি প্রস্তুত ছিলেন। সূর্যোদয়ের আগেই তিনি দুপাশে দুটি সাদা রেঞ্জ রোভার রেখে তার বাইক চালিয়ে মহাকাশযান উৎক্ষেপণ কেন্দ্রে যান। তিনি বলছিলেন, মহাশূন্য ভ্রমণের দিন তার সকালটি শুরু হয়েছিল ইলন মাস্কের সাথে সাক্ষাতের মধ্যে দিয়ে। ইলন মাস্ক ব্যক্তিগতভাবে এই অভিযানটি দেখার জন্যে সেদিন নিউ মেক্সিকোতে আসেন।
‘স্পেসশিপ-টু’ মহাকাশযানে ব্র্যানসনের সাথে ডেভ ম্যাকেই ও মাইকেল মাসুচি নামের দুজন বৈমানিক ছিলেন। তাছাড়া কেবিনে ছিলেন আরো তিনজন সদস্য। তারা হলেন, প্রধান নভোচারী প্রশিক্ষক বেথ মোজেস, প্রধান অপারেশন প্রকৌশলী কলিন বেনেট এবং গভমেন্ট অ্যাফেয়ার্স ও রিসার্চ অপারেশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট শিরিষা ব্যান্ডলা। এরা ভার্জিন গ্যালাকটিকের কেবিনের ভেতরের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে দেখছিলেন।
২.
যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল অ্যাভিয়েশন প্রশাসন ভূমি থেকে ৫০ মাইল উঁচু স্থানকে মহাশূন্য শুরুর বিন্দু হিসেবে চিহ্নিত করে। সরকার নির্ধারিত এই সীমা অতিক্রমের মাধ্যমে ব্র্যানসন ও তার ক্রুরা বাণিজ্যিক নভোচারী হিসাবে মহাশূন্য ভ্রমণ করেছেন। এজন্যে কানাডিয়ান নভোচারী ক্রিস হ্যাডফিল্ড তাদেরকে সোনালি রঙের পিনের মাধ্যমে পুরস্কৃত করেন।
মহাশূন্যে ব্র্যানসনের এই ভ্রমণের মাধ্যমে ভার্জিন গ্যালাক্টিকের মহাকাশ পর্যটন ব্যবসার জন্যে সম্ভাব্য মহাশূন্য ভ্রমণকারীদের আকর্ষণ করার একটা সুবর্ণ সুযোগ তৈরি হয়েছে। কাজেই গত রবিবারে স্পেসপোর্ট আমেরিকার পরিবেশ ছিল বিভিন্ন ধরনের মার্কেটিং ও নানান ধরনের আনুষ্ঠানিকতায় পরিপূর্ণ।
মহাকাশযানের এই যাত্রা উপভোগ করতে যারা অংশ নিয়েছেন, তাদের জন্যে এটি ছিল অনেকটা জমকালো সঙ্গীত অনুষ্ঠানের মতোই। রানওয়ের পাশে বসে সম্পূর্ণ একটি অনুষ্ঠানের মতোই তারা উপভোগ করেছেন। ‘স্পেসপোর্ট আমেরিকা’র প্রধান ভবনের পাশে স্থাপিত মঞ্চে উপস্থিত অতিথিরা বিশাল এক পর্দায় সম্পূর্ণ মিশনটি উপভোগ করেন। অভিনেতা এবং কমেডিয়ান স্টিফেন কোলবার্ট মিশনের অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন এবং সংগীতশিল্পী খালিদ সেখানে তার একটি নতুন গান পরিবেশন করেন। অবতরণের পর ‘ভিএসএস ইউনিটি’ মহাকাশযানটিকে রেঞ্জ রোভার গাড়ির একটি বহর ‘স্পেসপোর্ট আমেরিকা’ উৎক্ষেপণ কেন্দ্রের দিকে টেনে নিয়ে যায়।
৩.
এর আগে ভার্জিন গ্যালাক্টিক ব্র্যানসনকে পরবর্তী পরীক্ষামূলক ফ্লাইটে যাত্রী হিসাবে নেয়ার পরিকল্পনা করছিল। তবে চলতি মাসের শুরুর দিকে প্রতিষ্ঠানটি হঠাৎ করেই ঘোষণা দেয় যে, পূর্বের পরিকল্পনার পরিবর্তে ব্র্যানসনকে ‘ইউনিটি – ২২’ এর সদস্য হিসেবে মহাকাশ ভ্রমণ করানো হবে।
এই সিদ্ধান্তের ফলে অ্যামাজনের প্রধান জেফ বেজোসের আগেই ব্র্যানসন মহাশূন্য ভ্রমণ সম্পন্ন করেন। ২০ জুলাইয়ে জেফ বেজোস তার স্পেস প্রতিষ্ঠানের ‘নিউ শেপার্ড’ নামের একটি রকেটকে মহাশূন্যে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন।
প্রতিযোগিতার বাজারে ভার্জিন গ্যালাক্টিকের এই মহাকাশ ভ্রমণ অনেক বড় একটি প্রদর্শনী হিসেবে স্থান পেয়েছে। কিন্তু আগামি ২৮ জুলাইয়ে ৭১ বছর পূর্ণ হতে যাওয়া ব্র্যানসনের জন্যে মহাশূন্যে এই ভ্রমণটি ছিল এক দশকেরও বেশি সময় ধরে লালিত স্বপ্নের বাস্তবায়ন।
ভার্জিন গ্যালাক্টিকের প্রতিষ্ঠাতা ব্র্যানসনের মহাশূন্যে ভ্রমণ করার ব্যাপারটি মূলত অনেকের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দেবে, যারা নিরাপদে ‘স্পেসশিপ-টু’ মহাকাশযানে ভ্রমণ করতে চায়। ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠানটি তাদের একটি পরীক্ষামূলক উড্ডয়নের মাঝামাঝি পর্যায়ে বিপর্যয়ের শিকার হওয়ায় তাদের একজন বৈমানিক মারা যায় এবং আরেকজন গুরুতর আহত হয়। সেই ঘটনার পরে ভার্জিন গ্যালাক্টিক গ্রাহকদের নিয়ে ফ্লাইট শুরু করার আগে ব্র্যানসন নিজে মহাশূন্যে ভ্রমণের শপথ নিয়েছিলেন।
‘ইউনিটি – ২২’ নামের এই মিশনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটির স্পেসশিপ শিল্পের উন্নয়ন ঘটানোর ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি বিত্তবান অ্যাডভেঞ্চার পিপাসুদের কাছে মহাকাশ পর্যটনের সম্ভাবনা বাস্তবে পরিণত করতে যাচ্ছে।
ভার্জিন গ্যালাটিক ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। মহাশূন্য ভ্রমণের জন্য ইতিমধ্যেই ২,৫০,০০০ ডলার মূল্যের প্রায় ৬০০ টিকিট বিক্রি করেছে ভার্জিন গ্যালাক্টিক। কিন্তু সেসব যাত্রীর কেউই এখনো পর্যন্ত মহাশূন্য ভ্রমণ করেননি।
২০২২ সালে বাণিজ্যিকভাবে মহাকাশ পর্যটন শুরু করার আগে চলতি বছরে আরো দুটি পরীক্ষামূলক মিশনের পরিকল্পনা করছে ভার্জিন গ্যালাক্টিক। ২০২২-এ বাণিজ্য শুরুর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হবে কিনা, তা রবিবারের পরীক্ষামূলক ফ্লাইটের ফলাফলের ওপর নির্ভর করবে। প্রতিষ্ঠানটি আরো জানিয়েছে, এই অভিযানের ফলাফল হিসেবে হাতে পাওয়া তথ্য থেকে মহাকাশযানটি পরিদর্শন করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে কীভাবে প্রতিষ্ঠানটি ভবিষ্যতে এর মিশন নিয়ে এগিয়ে যেতে চায়।
তবে ভার্জিন গ্যালাক্টিককে ইলন মাস্কের স্পেস এক্সের পাশাপাশি জেফ বেজোসের মহাকাশ পর্যটন সংস্থা ব্লু অরিজিনের সাথেও টেক্কা দিতে হচ্ছে, যেই প্রতিষ্ঠানটি এখনো তাদের টিকিটের মূল্য ঘোষণা করেনি।
ভার্জিনের ‘স্পেসশিপ-টু’ এর মতো ব্লু অরিজিনের মহাকাশযানটিও উপকক্ষপথে ভ্রমণ করবে। তবে এর গামড্রপ আকৃতির ক্যাপসুলটি একটি ৫ তলার সমান উঁচু রকেটের মাধ্যমে উলম্বভাবে নিক্ষেপ করা হবে। এভাবে মহাকাশযানটি ভূমি থেকে ৬২ মাইল উচ্চতায় পৌঁছাতে পারবে।
২০ জুলাইয়ে বেজোসের ব্লু অরিজিনে বহন করা প্রথম ফ্লাইটটিতে থাকবেন তার ভাই মার্ক এবং কিংবদন্তি বৈমানিক ওয়ালি ফাঙ্ক। এবং রকেটযানটির চতুর্থ আসনে থাকবেন ২৮ মিলিয়ন ডলার নিলাম বিজয়ী একজন ব্যক্তি, যার নাম এখনও ঘোষণা করা হয়নি। স্পেস এক্সের মহাকাশ ভ্রমণের পরিকল্পনা আরো বেশি বিস্তৃত: এর ব্লু ড্রাগন ক্যাপসুল কয়েকদিনের জন্যে কক্ষপথে নিক্ষেপিত হবে, যার প্রতিটি সিটের মূল্য ৫৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার নির্ধারণ করা হয়েছে।
মহাকাশ পর্যটন শিল্পের এই প্রতিযোগিতামূলক পরিস্থিতিতে এক সপ্তাহের মধ্যেই বিশেষ একধরনের উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। যেই পরিস্থিতির শুরুটা হয়েছে ‘ইউনিটি – ২২’-এর অভিযানের মাধ্যমেই।
ব্র্যানসনের ফ্লাইটের দুইদিন আগে ব্লু অরিজিন তাদের এক সমালোচনামূলক টুইট বার্তায় ভার্জিন গ্যালাক্টিকের এই অভিযান নিয়ে লিখেছিল যে, ব্র্যানসন সত্যিকার অর্থে মহাকাশে যাচ্ছে না। এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছিল, ‘স্পেসশিপ টু’ ‘আন্তর্জাতিক স্পোর্টস অর্গানাইজেশন’ নামের একটি সংস্থা কর্তৃক চিহ্নিত মহাকাশের সীমানার কয়েক মাইল নিচ দিয়েই উড়তে পারে।
তবে জেফ বেজোস রবিবারে ব্র্যানসনকে অভিবাদন জানিয়ে ইনস্টাগ্রামে একটি ইতিবাচক পোস্ট করেন।
এদিকে ইলন মাস্ক জনসম্মুখে প্রতিযোগিতামূলক এই অবস্থান থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখে এই অভিযানের ব্যাপারে সর্বোপরি আন্তরিক থেকেছেন এবং নিউ মেক্সিকোতে ব্র্যানসনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। তার ফ্লাইটের সময় ব্র্যানসন ইলন মাস্কের প্রতি এক টুইট বার্তায় বলেন, “Thanks for being so typically supportive and such a good friend, Elon.”
দ্য ভার্জ অবলম্বনে মাহতাবুল আলম