শাহবাগ থেকে বাসায় ফিরতে কখনো কখনো বেশ রাত হয়ে যায়। আমি যেখানে থাকি, সেখানে পৌঁছতে হলে সংসদ অ্যাভিনিউ দিয়ে যেতে হয়। তখন আমি বামদিকে তাকাই, কারণ গাছপালার আলো-আঁধারিময় শান্ত উদ্যানটি আমার বেশ প্রিয়। সব ঋতুতে প্রশান্তিকর ঠাণ্ডা হাওয়া সেখানে থাকেই। সংসদ ভবনের আশেপাশে সন্ধ্যার পর থেকে বেশ্যাদের (এনজিওর ভাষায় যৌনকর্মি) আনাগোনা শুরু হয়, এটা সবাই জানে এবং অনেকের এও জানা যে, দলবদ্ধ হয়ে তারা খানিকটা ভিতরের দিকেই অবস্থান করে।

আমি লক্ষ করে আসছি, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যখন এলোমেলো থাকে, বা, সরকারবিরোধী কোনো কর্মসূচি যথেষ্ট সফলতার সঙ্গে পালন করা হয়, তখন বেশ্যারা সন্ধ্যার পর-পরই লোকালয়ের খুব কাছে চলে আসে।

যেমন, তারা সংসদ ভবনের পুবদিকের ফুটপাতে হাঁটে, খামারবাড়ির কোণে দাঁড়িয়ে থাকে। অবরোধ-হরতাল যেসব দিনগুলিতে চলে, বেশ্যাদের চলাচল ও অবস্থান আরও সহজ হয়ে যায়, যেন তারা খুব কাছের কোনো এলাকার বাসিন্দা, সন্ধ্যায় বাইরের হাওয়ায় ঘুরতে এসেছে।

 

এই স্বতঃস্ফূর্ততা রাজনৈতিক অস্থিরতা কিংবা দেশের কোনো শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি বা স্থবিরতার সময় লক্ষ করেছি। স্বাভাবিক বা শান্তিপূর্ণ অবস্থায় এটা দেখা যায় না। আমার এই পর্যবেক্ষণ বেশ পুরনো, ১৯৯৪ সালে যখন সংসদভবন সন্নিহিত এলাকা মনিপুরীপাড়ায় বসবাস শুরু করি, তখন থেকে। মাগুরা ইলেকশন নিয়ে যে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা গিয়েছিল, তাতে, সেসময়, সংসদভবনের দক্ষিণ-পুবের কোণে, সন্ধ্যায়, প্রথমবারের মতো দেখি যে, বেশ্যাদের কেউ শসা খাচ্ছে, কেউ বাদামঅলার পাশে দাঁড়িয়ে আছে তাদের পরিচয়সম্মত মেকআপ নিয়ে।

কখনো কখনো দেখেছি, তারা পুলিশের সাথে কথা বলছে, সিগারেট টানছে। সাধারণত, স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে দেখেছি, পুলিশের পিকআপ কিংবা লরি আসতে দেখলে তারা দ্রুত পায়ে সংসদভবনের পাঁচিলের দিকে আলো-আঁধারির আড়ালে চলে যায়। ৯৪-৯৫ সালে সংসদভবনের প্লাজা ও ভিতরের দিকটায় সবাই ঢুকতে পারতো; সেখানে বেশ্যারা ঘোরাঘুরি করতো, দৃষ্টি আকর্ষণ করতো। সেসময় রাজনৈতিক অস্থিরতার দিনগুলিতে তাদেরকে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে এসে হাঁটাহাঁটি করতে দেখেছি। এমন-কি, তখনকার হরতালের দিনে জিগাতলায় আজকের কাগজ অফিসে হেঁটে-হেঁটে যেতে হতো মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ ধ’রে—এরকম একদিন বেলা এগারোটায় সেখান দিয়ে যাচ্ছিলাম। গাছের তলা থেকে সাদা সালোয়ার-কামিজ-পরা একটা মেয়ে এসে আমার পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো। একটু কেশে বললো, ‘কই যাও?’ কোনো জবাব দিলাম না। বরং হাঁটার গতি আরও দ্রুত করলাম। সে বললো, ‘ভয় পাও ক্যা? সেক্স করবা না? ট্যাকা বেশি লাগবো না। মোহাম্মদপুরে যাইতাছ?’

এটা ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র ইলেকশনের সময়ের ঘটনা, যখন লালবাগে ব্রাশফায়ারে ৬ জন মারা যায়। এখন ভাবছি, পরিস্থিতি কেমন হলে দিনের বেলায় বেশ্যাদের কেউ কেউ খদ্দের খুঁজতে রাস্তায় নামে! তা হলে ওদের অবস্থান কি রাষ্ট্র ও সমাজের দশা বোঝার নির্ভরযোগ্য একটি সূচক হয়ে আছে? যেমন,কোনো এক রাতে বাসায় ফেরার সময়, দেখলাম কোনো বেশ্যা সিঁড়িতে বসে আছে বা গেটের সামনে দাঁড়িয়ে, তখন কি ধরে নেবো, রাষ্ট্রের যন্ত্রপাতিগুলো অকেজো হয়ে গেছে; এবং বেশ্যার এই অবস্থানে সমাজের আপত্তি নাই, থাকলেও কাজে লাগছে না।

বেশ্যাদেরকে নিয়ে বাংলা ভাষায় কিছু ‘সাহিত্য’ রচিত হয়েছে। বেশির ভাগই তাদের প্রতি পাঠকের করুণা সংগ্রহের উদ্দেশ্য নিয়ে লিখিত। বা, তারাও যে মানুষ এবং তাদের যে একটা অতীত আছে, প্রেম-বিরহ, আনন্দবেদনা ইত্যাদি আছে এই থিসিস নিয়ে হাজির হয় আমাদের কথাসাহিত্য। তাতে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বেশ্যা হওয়ার মৌলিক তিনটি কারণ দেখানো হয়ে থাকে :
১. সমাজে যেভাবে নারীকে চলতে হয়, সেভাবে না চললে অর্থাৎ ‘বিপথগামী’ হলে;
২. মাতৃবংশানুক্রমিক, মানে মা বেশ্যা ছিল, ফলে মেয়েকেও একই পেশা নিতে হয়েছে;
৩. দুর্ঘটনাবশত বা ঘটনাচক্রে (প্রেমিক ফুসলিয়ে এনে পতিতালয়ে বিক্রি করে দিয়েছে; স্বামী তাকে দেহব্যবসায় বাধ্য করেছে; চাকরি দেয়ার নামে প্রতারক চক্র তাকে এ পেশায় নামিয়েছে; প্রেমে ব্যর্থ হওয়ায় নিজের শরীরকে বিশেষ কারুর জন্য সংরক্ষণযোগ্য মনে হয় না, ফলে এটি বিলিয়ে যাওয়াই তার পেশা হয়েছে ইত্যাদি)।

বেশ্যাবৃত্তির মূলে রয়েছে অর্থনৈতিক, (ক্ষেত্রবিশেষে শারীরিক) কারণ; সেটা এড়িয়ে যায় আমাদের সাহিত্য, যেন বাংলাদেশের মানুষের টাকার অভাব নেই, আমাদের মেয়েরা সোনার চামচ মুখে নিয়ে এই পেশায় এসেছে! সাহিত্যে বেশ্যাকে আনা হয় বিনোদনধর্মী করুণা সঞ্চারের মধ্য দিয়ে সামাজিক (কিছুটা ধর্মীয়) শুদ্ধি ও নৈতিক ‘মূল্যবোধ’ জাগিয়ে তোলার জন্য।

সামাজিক কিংবা নৈতিক উদ্দেশ্য কোনো রচনায় ধরা পড়লে তা আর সাহিত্য থাকে না, শিক্ষামূলক রচনা হয়ে যায়। বাঙালি পাঠক সাহিত্য চায় না, চায় সাহিত্যিকের নৈতিক অবস্থান ও উদ্দেশ্য। ফলে, বেশ্যার কাছে গেলে সে তার জীবনকাহিনি শুনতে চায়, যেন সে নিজেও রাজলক্ষীর কাছে এসেছে। কিন্তু কোনো সুস্থ মানুষ তার জন্য করুণাদায়ক কোনো আয়োজন পছন্দ করে না; বেশ্যারা সম্ভবত আরও সুস্থ, কারণ তারা অতিমানবীয় পরিস্থিতির মধ্যে থাকে, করুণার প্রতি তারা ঘৃণাই বরং বেশি পোষণ করে।

বেশ্যার সময় খুব, সম্ভবত সবচেয়ে বেশি মূল্যবান; তাদের হাতে ঘড়ি থাকেই, তবে এখন মোবাইলের স্ক্রিনের কাল। সময় তাদের কাছে খুব মূল্যবান, যদিও তারা থাকে সময়হীনতার মধ্যে।

বাঙালি ভদ্রলোক বেশ্যালয়েও যে ভদ্র থাকতে চায়, তা নিয়ে কমলকুমার মজুমদারের একটা গল্প আছে। গল্পটির নাম এই মুহূর্তে মনে করতে পারা যাচ্ছে না, তবে কাহিনিটা বলতে পারি। তা এই: এক অতিশয় ভদ্রলোকের বাড়ির প্রবেশপথের দুই পাশে বেশ্যালয় গড়ে উঠেছে। ফলে তার বাড়িকে আলাদা করা চেনা মুশকিল। নিজের বাড়িটিও লোকের কাছে বেশ্যালয়ের অংশ হয়ে যাচ্ছে, এমন উদ্বেগ থেকে সে বাড়ির সদর দরজার সামনে একটা সাইনবোর্ড লাগিয়ে দেয়—‘ইহা ভদ্রলোকের বাড়ী’। কিছুদিন পর সে লক্ষ করে, দীর্ঘ ই-কারের উপরের অংশ উধাও হয়ে গেছে, ফলে তাকে পড়তে হলো—‘ইহা ভদ্রলোকের বাড়া’। নিজের বিশেষ অঙ্গের অবস্থান কে এইভাবে জানাতে চায়!

ভদ্রলোকরা বেশ্যার কাছে যায়, বেশ্যারা কিন্তু তাদের কাছে আসে না। এই হলো উভয়ের মধ্যেকার প্রচলিত বা স্বাভাবিক সম্পর্ক। যাদেরকে কলগার্ল বলা হয়, তারাও না, কারণ ভদ্রলোকরা তাদেরকে ডাকে, তারা হয়তো ডাকে; কিন্তু ভদ্রলোকরাই তাদেরকে ডেকে নিয়ে আসে। বেশ্যাগমন ব’লে একটা শব্দ আছে; ‘বেশ্যাপ্রস্থান’ ব’লে কোনো শব্দের ব্যবহার দেখা যায় না। ভদ্রলোকরা এই শব্দের প্রচলন চাইবে না এবং ভাষাটা যেহেতু তাদের হাতেই, এটা চালু হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নেই। কারণ ‘বেশ্যাপ্রস্থান’ বললে এই অর্থ সৃষ্টি হওয়ার ঝুঁকি আছে যে, বেশ্যা ভদ্রলোকের কাছে এসেছিল; না এলে তো প্রস্থান হয় না।

কোনো মেয়েকে বেশ্যা হতে হলে তাকে লাইসেন্স নিতে হয়, কিন্তু বেশ্যার কাছে যাওয়ার জন্যে তা লাগে না। মদ খেতে হলে আমাদের দেশে লাইসেন্স লাগে, কিন্তু টাকার বিনিময়ে যৌনানন্দ উপভোগের জন্য ভোক্তার বৈধতার দরকার নেই। এটা খুব ভারসাম্যহীন ব্যবস্থা।

শহরের মানুষ এখন বেশ্যালয় থেকে বের হয়ে আসা বেশ্যাদের দেখে না। এক সময় দেখা যেত, যখন তারা শহরে ‍ঘুরতে বের হতো, ভিড় করতো কাপড় নয়তো কসমেটিকসের দোকানে। তাদের পায়ে তখন নূপুর ছাড়া কিছু নাই; ফলে তাদের চেনা যেত।

এক সময়ের বেশ্যাসমৃদ্ধ শহর নারায়ণগঞ্জে দেখেছি দল বেঁধে তারা রাস্তা পার হচ্ছে, দোকানে ঢুকছে, তাদের পায়ে কিছু নাই, নূপুর বা আলতা ছাড়া। তবে এখনকার মতো খদ্দের খুঁজতে তারা বের হতো না, খদ্দেররাই রওনা দিতো তাদের আস্তানার দিকে। এখন বেশ্যালয় নেই, তবে বেশ্যা আছে; তাদের পায়ে স্যান্ডেল, হাই হিলেও বেশ মানায়; তারা বোরকা পরে, তবে সবাই নয়। একবার সংসদ ভবনের সামনে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে দরদাম ঠিক হওয়ার পর বোরকা পরা এক বেশ্যাকে গাড়িতে উঠে দরজা বন্ধ করামাত্র বোরকার উপরের অংশ খুলে ফেলতে দেখেছি, বুঝেছি পোশাকটায় তাদের আপত্তি আছে; কিন্ত এটা তাদের পরতে হয়, যেমন বহু ব্যাপারে সমাজের আপত্তি থাকলেও সমাজ তা বহন করে চলে।

যা হোক, তারা প্রায়ই আমাদের খুব কাছে চলে আসে। যে লরি বা পিকআপ দেখলে উদ্যানের ভিতরে ঢুকে যেতো, কখনো কখনো তারা সেই বাহন ঘেঁষে দাঁড়িয়ে তারই আরোহীর সাথে কথা বলে, সিগারেট টানে। তখন হয়তো হরতাল, নয়তো অবরোধ; অথবা এমন অবস্থা, সরকার আছে কি নেই, বোঝা যায় না। সমাজের কি আপত্তি আছে তাতে?

বেশ্যাদের স্বাধীনতার ব্যাপারে সমাজের আপত্তি সব সময় থাকে না; আর রাষ্ট্রের যন্ত্রপাতি, যেগুলো বাধানিষেধে সক্রিয়, সেগুলো সাময়িক অলস, নিষ্ক্রিয় হলে তো সমাজের শান্তি লাগারই কথা! যে-রাতে এরশাদের পতন হয়, লোকজন দরজা খোলা রেখে উল্লাস করতে করতে স্লোগান দিতে দিতে পাড়ার বাইরেও চলে গিয়েছিল, রাত গভীর হলে তারা ফিরে এসে দেখে, দরজা খোলা; কিন্তু ক্ষতিকর কিছুই ঘটে নি; মিরপুর থানার কোণে একটা গাছ ছিল, গভীর রাতে সেই আগুন, হল্লা ও শীতের মধ্যে গাছটির নিচে দাঁড়িয়ে বেশ্যারা গল্প করছিল, দেখেছি। সমাজের তাতে আপত্তি ছিল কি?

মনিপুরী পাড়া, ঢাকা, ১/২/১৫