পড়ি তখন ক্লাস ফোরে। প্রথমবারের মত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বেড়াতে গেলাম। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা আর মানুষজন দেখে আমি তখন খুব খুশি। ছেলেমেয়েরা টিএসসিতে মাটিতে বসে থাকে, একসাথে চা-সিগারেট খায়, গানবাজনা করে—সবসময়ই মনে হইল যেন কোন একটা উৎসব চলতেছে এইখানে।
তবে বেশি পছন্দ হয়ে গেল ভাস্কর্যগুলি। রাজু ভাস্কর্য আর অপরাজেয় বাংলার সামনে হা করে দাঁড়ায়ে ছিলাম আর সেই আমলের একটা ক্যামেরা হাতে নিয়ে অনেক ছবি তুলে ফেললাম।
মূর্তি এবং ভাস্কর্যের ব্যাপারে আমি বরাবরই অনেক কৌতূহলী। বাসায় ফিরে বার বার অপরাজেয় বাংলার ছবি দেখতাম। আমাদের বাসার ছাদে একটা ছোট কাঠের খাট টাইপের ছিল। সেইটা উপরে প্রায়ই বিকালে আমি, আশিকি আর টুনটুনি অপরাজেয় বাংলা স্টাইলে দাঁড়ায়ে থাকতাম। আর আশপাশ দেখতাম।
আশিকি আর টুনটুনি ছিল আমাদের প্রতিবেশী। আশিকি আমার সমবয়সী। ক্লাস ফোরে পড়ে। আর টুনটুনি ছোট ছিল। ক্লাস টুতে পড়ত। আশিকির পুরা নাম ছিল আশিকি সাংমা। ওরা গারো। প্রথম যেদিন ওর সাথে দেখা হইল ওর নাম ‘আশিকি’ শুনেই আমার খুবই হাসি পাচ্ছিল। আশিকি সেটা খেয়ালও করছিল। কিন্তু কিছু মনে করে নাই।
আশিকির নাম নিয়ে ওর স্কুলের ছেলেমেয়েরা, পাড়ার ছেলেমেয়েরা সবাই অনেক হাসাহাসি করত। আমরা যখন রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে কোথাও যেতাম তখন অনেক বড় বড় ক্লাস নাইন-টেনে পড়ুয়া ছেলেপেলেরাও ওকে দেখে “আশিক বানায়া”, “মেরি আশিকি” হেনতেন কী কী যেন বলত।
আশিকি এসব কখনোই পাত্তা দেয় নাই। কিন্তু আমার খুবই গায়ে লাগত। একদিন রাকিব নামের এক ছেলের বাসায় গিয়ে আমি বিচার দিয়ে আসলাম। ওর আম্মুকে গিয়ে বললাম, “এই যে আন্টি, আপনার ছেলে রাস্তাঘাটে মেয়েদেরকে দেখলে আজেবাজে কথা বলে। গান গায়। ওকে মানা করার পরেও আমার বান্ধবী আশিকিকে নিয়ে প্রতিদিন হাসি-তামাশা করে। ওকে দেখে ‘এই চাইনিজ, এই চাইনিজ’ বলে চেঁচায়—এইটা কি ঠিক? আপনিই বলেন, এরকম কাউকে নিয়ে হাসাহাসি করাটা তো ঠিক না, তাই না?”
আমি ছোটবেলায় একজন আঁতেল বাচ্চা ছিলাম। তাই বিকালবেলায় আশিকি যখন পাড়ার অন্যসব ছেলেপেলেদের সাথে ফুটবল খেলত, তখন আমি এক কোণায় গালে হাত দিয়ে বসে থাকতাম। আর খেলার সময় কার কী ভুল হইছে, কার আচরণ কেমন হওয়া উচিত এইসব নিয়ে পণ্ডিতি করতাম।
পাড়ার কেউই আমাকে তেমন পছন্দ করত না। আশিকি আর তার ফুটবল খেলার সাথীরা সবাই এলাকার একটা কিন্ডারগার্টেন স্কুলে পড়ত আর আমি পড়তাম শহরের সবচেয়ে ভাল স্কুলটাতে। তার উপর কথায় কথায় শিক্ষকদের মত লেকচার দিতাম বলে আমার উপর সবাই বিরক্তই ছিল। একমাত্র আশিকি ছাড়া। ও আমার খুব ভাল বন্ধু ছিল।
আর পিচ্চি টুনটুনি ছিল আমার স্টুডেন্ট। টুনটুনির আসল নাম দৃষ্টি মারমা। ও খুবই আদুরে একটা পিচ্চি। ওর কথায় কিছুটা তোতলামো চলে আসত। ওকে এই তোতলামোর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে ও বলত, “ছো-ছোতোবেলায় যখন হা-হাউজে ছিলাম তখন দা-দাড়োয়ান আ-ঙ্কেলটা তোতলাতো তো উনাকে ভ্যা-ভ্যাঙ্গাতে ভ্যা-ভ্যাঙ্গাতে আমিও তোতলা হ-য়ে গেছি।”
টুনটুনি অনেক আগ্রহ নিয়ে ওর এই তোতলা হবার গল্প বলত। তবে ওর সবচেয়ে প্রিয় গল্প ছিল ওর বাবা-মা’র বিয়ে নিয়ে। আমরা অনেকবারই ওর কাছে এই গল্পটা শুনছিলাম।
ওর মা অনেক আগে একদিন রাঙামাটিতে গেছিল কী একটা অফিসের কাজে। সেখানে ওর বাবার সাথে দেখা হয়। ২ সপ্তাহ পরে যখন শহরে ফিরে আসবে ঠিক ঐসময় ওর বাবা বলে উঠল, আবার কখন আসবে? এক কাজ করো তুমি আর যেওই না। থেকে যাও এখানে। ওর মা ঐদিনই বাসে করে রাঙামাটি থেকে টাঙ্গাইলের দিকে রওনা দিয়ে দেয়। বাড়িতে গিয়ে বিয়ের কথা বলে। তারপর তেমন কোনো ঝামেলা ছাড়াই টুনটুনির ক্রিশ্চিয়ান মা আর বৌদ্ধ বাবার বিয়ে হয়ে যায়। টুনটুনির বাবা রাঙামাটিতে থাকে। উনার অনেক ফলের বাগান আছে, ঐগুলি দেখাশোনা করেন উনি। মাসে, দুইমাসে একবার শহরে আসেন বস্তাভরা ফলমূল নিয়ে। টুনটুনির মা মেডিকেলের সিনিয়র নার্স। আগে নার্সদের হাউজে থাকতেন টুনটুনিকে নিয়ে। টুনটুনি নামটা ওই হাউজের মহিলাদের দেয়া। ও নাকি সারাক্ষণ তিড়িং বিড়িং করত, তাই নাম টুনটুনি।
টুনটুনি একটু বড় হবার পর ওর মা ওকে নিয়ে আশিকিদের বাসায় সাবলেট থাকতে শুরু করে। আশিকির মা আর টুনটুনির মা ছোটবেলার বান্ধবী। তো টুনটুনি অনেকটা আশিকির ছোটবোনের মতই ছিল। একসাথে স্কুলে যেত, আসত। একই টিচারের কাছে পড়তে যেত। আমরা তিনজন সবসময় একসাথে থাকতাম। মাঝে মাঝে একসাথে বসে হোম ওয়ার্কও করতাম।
একদিন টুনটুনি ওর মা’র কাছে গিয়ে বলছে ও আর আগের টিচারের কাছে পড়বে না। ওর মা কারণ জানতে চাওয়ার পর বলছে, “সু-সুপ্তিদির কাছে পড়ব।” ব্যস! ওই থেকে টুনটুনি আমার স্টুডেন্ট হয়ে গেল। প্রতিদিন স্কুল থেকে এসে খাওয়া দাওয়া করে ও আমার বাসায় চলে আসত।
কী কী হোমওয়ার্ক আছে সেগুলি নিয়ে কথা বলতে বলতে আমরা দুইজনই ঘুমায়ে যেতাম। তারপর বিকালে আশিকিসহ আমরা মাঠে চলে যেতাম। সন্ধ্যায় বাসায় এসে একসাথে পড়তে বসতাম। মাস শেষে ওর মা আমাকে একটা খামে ভরে ৫০০ টাকা দিয়ে যেত। এই বিষয়টা নিয়ে আমি এত বেশি লজ্জিত ছিলাম যে, কাউকেই কখনো কিছু বলতাম না। চুপচাপ আমার মা’র হাতে খামটা দিয়ে চলে আসতাম। দেখতে দেখতে আমি আর আমার স্টুডেন্ট দুইজনেরই পরীক্ষা চলে আসল। আমরা পরীক্ষা দিলাম। এবং দুইজনই খুব ভাল রেজাল্ট করলাম।
তো একদিন আমি, আশিকি আর টুনটুনি আমার রুমের বিছানায় শুয়েছিলাম। জানালার পাশেই একটা আমগাছ ছিল। আমরা ঐ গাছের নতুন টিয়া-সবুজ পাতা নিয়ে আলোচনা শুরু করলাম। একসময় আশিকির মনে হইল, এই টিয়া-সবুজ পাতা একটা খেয়ে দেখা যাক আমের মত টেস্ট পাওয়া যায় কিনা। আমরা তিনজন তিনটা পাতা ছিড়ে লবণ দিয়ে খাওয়া শুরু করলাম। পাতা খেতে খেতেই টুনটুনি ঐদিনের ঘটনা বলা শুরু করল।
“জানো আ-আজকে কি হইশে? বা-বাবা রাগ করে বা-বাসা থেকে চ-চলে গেশে।“
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কেন?”
টুনটুনি বলে, বাবা মা-মাটিতে বসে পা-প্রার্থনা করতেশিল। ত-তখন মা বাবার সামনে ব-বসে একটা বি-ইস্কিট খাচ্ছিল। তখন বাবা একদম রে-রেগে গিয়ে বলশে, “তু-তুমি আমার পা-প্রার্থনার সময় বি-ইস্কিট খাচ্ছো? এইরকম অস-সম্মান আমি স-অহ্য করব না।” বলেই বাবা বে-বের হয়ে চলে গেশে।
এইটুকু বলেই টুনটুনি হি হি করে হাসি শুরু করল। আমরাও হাসতে হাসতে অর্ধেক খাওয়া আমগাছের পাতা জানালার বাইরে ফেলে দিলাম। টুনটুনির বাবা প্রতি মাসেই এরকম রাগ করে বাসা থেকে চলে যেত। আর টুনটুনি আমাদের কাছে এসে ওর বাবার চলে যাওয়ার গল্প করত। তারপর আমরা একসাথে হাসাহাসি করতাম।
এর আগের মাসে ওর বাবা বাসায় এসে ওর মাকে বলছিল, শোনো, টুনটুনিকে একা একা আশিকির সাথে স্কুলে যেতে আসতে দিও না। রাস্তায় ছেলেধরা বের হইছে অনেক। শুনেই টুনটুনির মা বিরক্ত হয়ে বলছে, “তো তুমি মেয়েকে স্কুল থেকে আনা-নেয়া করো, এত ছেলেধরা বুঝলে!” এটা শুনেই ওর বাবা বাসা থেকে বের হয়ে গেছে।
এ রকম আরও অনেক কাহিনী আছে ওর বাবার বাসা থেকে বের হয়ে যাবার। টুনটুনি ওর বাবা বাসা থেকে চলে গেলেই খুব খুশি হত। কারণ বাবা থাকলে ওকে পড়তে বসায়, ত্রিপিটক পড়ে শোনায়, প্রার্থনা করতে বলে। টুনটুনি নিজেকে খ্রিস্টান বলতে পছন্দ করত। তাই বৌদ্ধদের প্রার্থনা, উৎসব এইগুলা ওর ভাল লাগত না। ও ওর বাবার বাড়ি রাঙামাটিতেও খুব একটা যেত না। ক্লাস থ্রিতে ওঠার পর ও খ্রিস্টান ধর্মের বোর্ড বই-ই পড়ছিল।
আমি প্রতি শুক্রবার সকালে ওদের সাথে গীর্জায় যেতাম। সবাই একসাথে উচ্চস্বরে “যীশু ডাকেন তোমায় স্নেহের দুটি হাত বাড়িয়ে বারে বার” গাইতাম। তারপর ছবি আঁকতাম। কোনো অনুষ্ঠান থাকলে সেটার জন্য নাটক, গান, নাচ ইত্যাদি রিহার্সেল দিতাম। ওখানে আমাদের বেশ কিছু বন্ধুবান্ধব ছিল। একদিন আশিকি ওখানে একটা নতুন খেলা খেলতে শুরু করল। খেলার নাম হাই জাম্প। কে কত বেশি উঁচু সিঁড়ি থেকে লাফ দিতে পারে এইটাই ছিল ওদের খেলা। আশিকি এই খেলা নিয়ে খুবই এক্সাইটেড। আমাদেরকে বলত, ও অলিম্পিকে গিয়ে “হাই জাম্প” দিবে। পিটার আর নীতিশ ছিল ওর এই হাই জাম্প খেলার সঙ্গী। আশিকির সাথে ওরা হাই জাম্প দিত। এই খেলা আমার মোটেও পছন্দের ছিল না। তাই আমি সবসময়ই আশিকিকে মানা করতাম। কিন্তু আশিকি আমাকে পাত্তা দিতো না। তো আমি আমার পণ্ডিত স্বভাব মত একদিন আশিকির মা’কে গিয়ে বিচার দিয়ে আসি। সেই থেকে আশিকি আর আমার সাথে কথা বলে না। শুধু আমার সাথে না, টুনটুনির সাথেও ও কথা বলা বন্ধ করে দিছিল।
আর আমাদের পাড়ার যে ছেলেটাকে আমি সবচেয়ে বেশি অপছন্দ করতাম সেই রাকিবের সাথে গিয়ে বন্ধুত্ব করছিল। অথচ এই রাকিবই কিনা ওকে আগে সারাক্ষণ “এই চাইনিজ”, “মেরি আশিকি” বলে টিজ করত। আশিকির উপর আমার তখন খুবই রাগ। আমি আর টুনটুনি কেউই ওর সাথে কথা বলি না। চার্চেও যাই না আর।
এরকম কথাবার্তা ছাড়াই আমরা দুইজন ক্লাস ফাইভে উঠে গেলাম। আর টুনটুনি ক্লাস থ্রিতে। নতুন বছরের শুরুতেই টুনটুনির একটা ছোটভাই হইল। ছোটভাইয়ের নাম রাখা হইল প্রীত মারমা। তো প্রীত মারমা জন্ম নেয়ার পর থেকেই টুনটুনির মা আর বাবার ঝগড়া আরও বেড়ে গেল।
একদিন টুনটুনি কাঁদতে কাঁদতে আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গেল। ওরা বাসা ছেড়ে দিচ্ছে। টুনটুনি এখন থেকে ওর বাবার সাথে রাঙামাটিতে থাকবে। আর ছোটভাই প্রীত থাকবে মা’র সাথে। আশিকিদের বাসা ছেড়ে ওর মা অন্য কোথাও উঠবে শুনলাম। টুনটুনি যাওয়ার সময় সবচেয়ে বেশি মন খারাপ করছিল, ও আর খ্রিস্টান হয়ে থাকতে পারবে না বলে। রাঙামাটিতে গেলে ওকে পুরাপুরি বৌদ্ধ ধর্মই পালন করতে হবে।
টুনটুনি চলে যাওয়া নিয়ে আমি খুব বেশি মাথা ঘামাই নাই। তখন ক্লাস ফাইভ। বৃত্তি পরীক্ষা। নতুন কোচিং, বাসার টিচার, স্কুলের এক্সট্রা ক্লাস—সবকিছু নিয়ে তখন মহা ব্যস্ত। এদিকে আশিকিরও একই অবস্থা। ওর সাথে আমার দেখাই হয় নাই বহু দিন। সেই বছর, টুনটুনি চলে যাওয়ার এক-দুই মাস পরে আশিকিরাও বাসা ছেড়ে অন্য এলাকায় চলে যায়। যাওয়ার আগে ওর সাথে আমার দেখাও হয় নাই। শুধু একদিন খেয়াল করলাম পাশের বাসার সামনের পাপোশ আর জুতার বক্সটা নাই। সেখানে অন্য একটা পাপোশ পড়ে আছে।