‘দহন’ মুভিটা দেখছিলাম মূল উপন্যাসটা পড়ার আগেই। ২০০২-০৩ সালে মেঝো মামার বাসায়। ওইখানে একটা সিনে ছিল, দাদি নাতনিরে একটা ঘটনা বলতাছে।

দাদির বিয়ের পরপরের ঘটনা। সে আর তার জামাই ট্যাক্সি নিয়া ঘুরতে বাইর হইছে। আসার সময় ওই দাদি পার্স ফালাইয়া আসছে ট্যাক্সিতে। বাসায় ফিরছে। তখন বাসার সবাই তো তারে ইচ্ছামতন ঝাড়ি দিতাছে—”এমন কাজ কী কেউ করে, কত টাকা ছিল, সোনার গয়না ছিল কিনা, যে দিন কাল পড়ছে, এখন কি সেই পার্স ফেরত পাওয়া যাবে”… ইত্যাদি ইত্যাদি।

কিন্তু ওইদিনই রাত্রে সেই ট্যাক্সি ড্রাইভার পার্সটা ফিরায়া দিতে আসছিল। বাড়ির সবাই অবাক! ট্যাক্সি ড্রাইভার কী মহৎ! সবাই মিলা তারে অনেক ধন্যবাদ দিতাছিল। দাদি চুপ কইরা ছিল; সবাই তারে বার বার বলতেছিল, “সে কি খুশি না?”

কিন্তু তার কথা হইল, “সবাই এত ওভার রিয়াক্ট কেন করতাছে?”


ধরেন আপনার গাড়িতে এমন একটা জিনিস পাইলেন, যেইটা আপনের না। তাইলে আপনে কী করবেন? যার জিনিস তারে ফেরত দিবেন। এটাই তো স্বাভাবিক, তাই না? এতে এত ধন্যবাদ দেয়ার কী আছে?

সেই থিকা মাথার মধ্যে ‘স্বাভাবিক-অস্বাভাবিক’, ‘ঠিক-বেঠিক’, ‘সত্য-মিথ্যা’র ঝগড়া শুরু। আমার টেবিলের উপরে যে কলিগ তার নোটবুকটা রাইখ্যা গেল, আর আমি যে বহু কষ্টে কৌতূহল দমন কইরা সেইটা খুইলা পড়লাম না—এইজন্য কি আমি আমার উপর কৃতজ্ঞ থাকব? নাকি ‘এই যে পড়লাম না’—এইটাই স্বাভাবিক?

আমার আর এক কলিগের ঘটনা বলি।

পুরাই ‘দহনে’র দাদির মত কাহিনি। উন্নত দেশের হাওয়া বাতাস খাইয়া সে আবার সেই দাদির থিকাও এক কাঠি উপরে। আমারে আইসা বলতাছে, “I lost my mobile. Someone thought its free and took it.” আমি তো শুইনা ভাবছি পকেটমার। জিগাইলাম কেমনে হইছে? সে যেইটা বলল তার অনুবাদ করলে এমন দাড়ায়—”আমি ট্যাক্সিতে কইরা বাসায় যাইতেছিলাম। ভুলে ফোনটা ট্যাক্সিতে ফালায়া আসছি। এইবারই প্রথম না, এই রকম আরও সাত আটবার হইছে। প্রত্যেক বারই ট্যাক্সিওয়ালা ফিরায়া দিয়া গেছে; যেটা তার করারই কথা ছিল। আমার জীবনে এই প্রথম যে ট্যাক্সিওয়ালা ফোনটা ফেরত দেয় নাই। এইটা কেমনে সম্ভব!”

আমি নগদে কইলাম, “ওহ মাই গোশ!” আমি পারতপক্ষে “ওহ মাই গোশ” বলি না, ওইটা আমার ছোট ছোট ভাইবোনদের বলতে শুনি। আমি, হয় “ওরে আল্লা” বলি নাইলে বলি “ওহ গড”।

তার বিচার দেয়ার নমুনা দেইখা মুখ থিকা “ওহ মাই গোশ” বাইরায়া গেছে। সে নিশ্চয়ই ভাবছে ট্যাক্সিওয়ালা মোবাইল ফেরত দেয় নাই এইজন্য আমি এত অবাক হইছি। ভাল প্রতিক্রিয়াওয়ালা শ্রোতা পাইয়া সে বেচারির কমপ্লেইন আরও বাড়তে লাগল। “আগে এই এলাকা নাকি এমন ছিল না, মানুষজন দিনে দিনে কেমন জানি হইয়া যাইতেছে, মানুষের গ্রিডিনেস এত বারতাছে কেন”—এইসব হাবিজাবি।

কিন্তু আমি যে কার বেকুবামি দেইখ্যা অবাক হইছি সেটা তো আমি জানি। মনে মনে কইলাম, “ভাল জায়গায় আছো তো বইন, কমপ্লেইন করতে পারতাছো। আমাদের দেশের পুলিশের কাছে গিয়া এই কমপ্লেইন দিও; চইদ্দগুষ্টি উদ্ধার কইরা দিব।”

তারপর বাসায় ফিরলাম। খাইয়া-দাইয়া মাথা ঠাণ্ডা হবার পর আবার শুরু হইল ‘ঠিক-বেঠিক’ এর ঝগড়া।

আমার কলিগই কি ঠিক? ফোনটা কি ট্যাক্সিওয়ালার ফিরায়া না দেয়াটাই ‘অস্বাভাবিক’? নাকি আমার মনভোলা কলিগের ফোন ‘নাই’ হয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক? এই স্বাভাবিক-অস্বাভাবিক আর ঠিক-বেঠিক এর ঝগড়া মিটানোর জন্য ভাবলাম পড়াশুনা করি।

গুগল বলল, ফ্রয়েড দেখতে, রুথ বেনিডিক দেখতে। আবেগ মনে হয় বেশি ছিল। এক বসের একটা আর্টিকেল বাইর কইরা পড়াও শুরু করলাম। যাই হোক, আমারে ওই দিনের মত বাঁচায়া দিয়া আমার আবেগ এক পৃষ্ঠাতেই শেষ হইয়া গেল। কিন্তু ‘ঠিক-বেঠিক’ এর ঝগড়া তো মিটে না। সুযোগ পাইলেই চুলার ভাতের মত বলক দিয়া ওঠে। এই বলকানিতে আবার জ্বাল দেয় মাইয়ার গাদা গাদা প্রশ্ন—”কেন বাম হাত দিয়ে খাওয়া ঠিক না?,” “কেন আমি সব ধরনের জামা পড়তে পারি?,” “কেন ছেলেরা সব জামা পড়তে পারে না?,” “কেন বাবার চুল ছোট?,” “কেন রূপকথা আপুর অস্ট্রেলিয়াতে আসতে ভিসা লাগবে?”

আমার কপাল ভাল এখনও বেসিক ঠিক-বেঠিকের মধ্যেই আছে। আরও কোটি কোটি ঠিক-বেঠিক, স্বাভাবিক-অস্বাভাবিক আর সত্য-মিথ্যাতে এখনও যায় নাই। তার উপর যদি দেশের খবর রাখতো তাইলে তো প্রশ্নের ঠেলায় আমি পুরাই কাইত হইয়া যাইতাম। মানুষ কুপায়া মাইরা ফালাইতাছে, আর কয়জন দাঁড়াইয়া গেল ‘ঠিক-বেঠিক’ নিয়া—“হুম মারাটা হয়ত ‘ঠিক’ হয় নাই… কিন্তু প্রফেসর কেন সেঁতার বাজাইত? সেঁতার বাজানোটা আসলে উনার ‘ঠিক’ হয় নাই।”

যাই হোক ‘ঠিক-বেঠিক’ অথবা ‘সত্য-মিথ্যা’র একটা অভিজ্ঞতা দিয়ে শেষ করি। গত বছর ময়মনসিংহের ঘটনা। পার্কে বেড়াইতে গেছি মেয়ে আর তার বন্ধু-বান্ধব নিয়া। ভ্যাঁপসা গরম পড়ছে। একটা মানুষ লেবুর আইসক্রিম বেচতেছিল। আমি কাছে গিয়া বললাম, মামা দাম কত?

—তিন টাকা।

আমি পুরাই খুশি! মাত্র তিন টাকা কইরা দাম! কইলাম, চাইরটা আইসক্রিম দেন। তাকায়া দেখি সে পানি রঙের চাইরটা আইসব্লক বাইর করতাছে। আমি হাইস্যা ফেললাম। আমার হাসিটায় যত না তাচ্ছিল্য ছিল তার চেয়ে বেশি আকাঙ্ক্ষার বাইরের কিছু দেইখ্যা অবাক হওয়া ছিল।

আমার জীবনে পানি রঙের লেবুর আইসক্রিম দেখি নাই। আমার কাছে ‘সত্য’ বা ‘স্বাভাবিক’ হইল সবুজ রঙের লেবুর আইসক্রিম। মামারে তাই বললাম। শুইন্যা সে যে মুখ ব্যাকায়া হাসিটা দিল! সেই হাসিরে যদি ভাষায় অনুবাদ করা যাইত তাইলে যা বলা হইত তা হইল—”এই বেকুবটা কইত থিকা আসছে?”

যাই হোক সে হাসি লুকায়া আমারে বলল, “লেবুর রসের রঙ কি সবুজ?”

আমি ভাবি ‘সত্য’ বা ‘স্বাভাবিক’ কী? ‘সত্য’ কি সবুজ লেবুর আইসক্রিম? যা অভ্যাস, যা দেইখ্যা আসতাছি, যা শিখাইছে তাই কি সত্য?