(সামাজিক) শ্রেণী অনুধাবন বা পাঠের সমস্যা কী?
আজ, বন্ধুগণ, যা নিয়ে আলাপ করতে যাচ্ছি তা একটি গুরুতর সঙ্কট। শ্রেণী বিষয়ক আলাপ সহজে শেষ করতে পারছি না, এবং আরও কিছু আলাপ করার বাসনা আমার আছে।
ঢাকা শহরের কিছু প্রতিষ্ঠান আছে যেখানে নাকি ফর্মা মেপে লেখকের মজুরি নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। ফলে কিছু পুস্তক সেই প্রতিষ্ঠানের যে বেখাপ্পা ও অপ্রয়োজনীয় রকমের বড় হয়ে পড়ে তার কারণ আন্দাজ করা আমাদের পক্ষে আর কঠিন থাকে না। ওদিকে জাতিসংঘের মত সংগঠন শব্দ মেপে অনুবাদের মজুরি নির্ধারণ করে থাকেন। এখন অংকের হিসাবে যদি মেলাতে চান, তাহলে যদি জাতিসংঘ অনূদিত ভাষার সংখ্যা গণনা করেন, অনুবাদের মান যাতা হবার সম্ভাবনা থেকেই যায়। হয়তো তাঁরা বুদ্ধি খাটিয়ে অনুবাদেয় ভাষার রচনাটির সংখ্যা গণনা করে থাকেন। আমার ঠিক জানা নেই। কিন্তু এখানে আমাদের সঙ্কটটি এর কোনোটিই নয়। এসব রচনা বাবদ আমাকে কেউ পয়সা দিচ্ছে না। তথাপি শ্রেণী বিষয়ক আলাপ আমার বার বার করার ইচ্ছা হবে।
স্থাবর বা উত্তরাধিকারের ব্যাপারটা আসলেই অনেক রকমের গোলমাল পাকানিয়া। পর্যাপ্ত স্থাবর থাকা যতটা গোলমালের, সেই থাকাথাকিটা খেয়াল না-করতে পারা অনেক বেশি রকমের গোলমালের। মানে থাকলে তো অন্যদের হিংসা হতে পারে, সমতার আন্দোলনের কারণ তৈরি হতে পারে, নানান কিছু হতে পারে। সেসব মনুষ্য-অনুভূতির গোলমাল আর কতই বা! কিন্তু যদি অন্য লোকে শ্রেণী-ট্রেণী বুঝতে গিয়ে ওগুলো খেয়াল না করেন, কিংবা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি যদি পর্যাপ্ত ভাবে লুকিয়ে ফেলতে পারেন কথাবার্তা আচার-আচরণে, তাহলে যে কত ভুলভাল হয়ে থাকে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
ওই যে ধরুন, নির্বাচনের আগে সহায়-সম্পদের বিবরণী দিতে বলে নির্বাচন কমিশন! খুবই তমিজের সঙ্গে বলে। তারপর প্রার্থীরা সেসব ঘোষণা দিলে চারদিকের লোকজন হেসে আর বাঁচে না। আয়করের পাঠানো প্রশ্নের উত্তরেও একই সব ঘটনা ঘটে। তখন আমরা, মানে অন্যরা, জানতে পেলেই হাসিতামাশা করি। এজন্য না যে আমরা তাঁদের গরিবিকে তামাশা করে হাসি। অন্য সময় সেটা ঘটতে পারে বটে, কিন্তু এই বিশেষ ক্ষেত্রে তা নয়। আবার আমাদের হয়তো হিংসা হয় ওসব নেতাদের সম্পদের আসল পরিমাণে। কিন্তু বাস্তবে হাসিতামাশা আমরা হিংসা থেকেও করি না। ওই লোকজনের সহায়সম্পদের যে পরিমাণ আছে বলে আমরা ভাবি, তার তুলনায় ওগুলো যা-তা রকমের কম হয়ে থাকে। যে সম্পদ বাড়ানোর জন্য তাঁরা জীবন-যৌবন-আইনকানুন সব জলাঞ্জলি দিলেন, সেগুলোকে লুকানোর জন্য তাঁদের ব্যতিব্যস্ততা দেখে হয়তো আমাদের একটা প্রতিহিংসামূলক আনন্দ হয়ে থাকে। আমরা সেই কারণে হাসি।
সে যাকগে! কথা হচ্ছিল শ্রেণী বুঝতে স্থাবরের জটিলতা নিয়ে, এমনকি চাকুরির দরদামের জটিলতা নিয়েও। ধরুন আশিক আর রসিকের সদ্য পরিচয় হলো। হয়তো এটাও ধরে নিলেন যে দুজনই ‘আর্ট-কালচার’ মার্কা লোক। তারপর বাদাম খুঁটতে-খুঁটতে বা বিড়ি ফুঁকতে-ফুঁকতে ওঁরা দুজন পরস্পরকে নিয়ে গল্প করে রাস্তায় হাঁটছেন। তো আশিক রসিকের ঠিকানা জানতে চাইলেন। রসিক বললেন “ঠিকানার কথা আর কী বলব! গত ৬ বছরে ৭টা বাসা বদলালাম। যে ভাড়া দিই তাতে মাথা গোঁজার মতো বাড়ি পাওয়া যায় না। বাড়িওয়ালার আপত্তি তো আছেই। একেক সময় মনে হয় একটা পোঁটলা নিয়া গিয়া টাউনহল বাজারের সামনে গিয়া ঘুমায়া থাকি। বাদ দেন ভাই, আপনার কথা কন।” এখন আশিকের পালা। তিনি বললেন, “হুমম আমারও কোনো ঠিকানা নাই। একটা জায়গায় মাথা গুঁইজা বয়া থাকার মানেও নাই কোনো। আখাম্বা মিডিওকারদের কাজ ওইটা। এই আইজকা আপনার সঙ্গে রাস্তায় বাদাম খাইতেছি। এখনো জানি না মন কোনখানে যাইতে ইচ্ছা করবে। যেখানে রাত্তির বেলা পা টাইনা নিয়া যাবে, সেইখানেই ঘুম দিয়া দিব আরকি!” রসিক আগেই জানতেন আশিকের কোনো নির্দিষ্ট পেশা নাই; এটা-সেটা করে থাকেন জীবিকার জন্য। গম্ভীর হয়ে তিনি ভাবতে শুরু করলেন বুঝি বা তাঁরই মতো আর্টকালচারওয়ালা আধাগরিব এক সহচরের সঙ্গেই তাঁর মুলাকাত হলো। এই ভেবেই তিনি নিজের সেই বাসাতে ফিরলেন, যেখানে বাড়িওয়ালা সারাবেলা খেঁকাতে থাকেন।
রাত্রিবেলা রসিকের সঙ্গে কমন-বন্ধু আবিদের সাড়ে তিন টাকার মোবাইল আলাপ হয়। আবিদ তো হেসেই পাগল। “আপনের মাথা খারাপ হইছে রসিক? আপনে ভাবতেছেন আশিকের সমস্যা আর আপনার সমস্যা এক?! আশিক তো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না ধানমণ্ডিতে বাপের দেয়া ওর নিজের খালি ফ্ল্যাটে খালি ফ্রিজের মধ্যে যাবে, নাকি রান্না কইরা বইসা থাকা ফুপুবাড়িতে মগবাজার যাবে, নাকি গুলশান একে বোনের বাসায় রাতটা কাটাই দিবে, নাকি পিতার দুই নম্বর গুলশানগৃহে দেরি কইরা ঢোকার কারণে কিছুমিছু বকাবকি শোনা মাইনা নিয়া যাবে।” রসিক নিজেকে আহাম্মুক ভেবে সেদিনের মতো ফোন রাখেন। রসিক আহাম্মুক হয়তো; তবে এই বিশেষ উদাহরণে আশিকের আর্টকালচারগিরির মধ্যে একটা সুপ্ত প্রতারণা আছে যার কারণে রসিক ফাঁপড় খেয়েছেন।
আমাদের আজকের বেচারি কবি রসিক যখন তাঁর কোনোমতে নগরে-টিঁকে-থাকার কিসসা আশিককে শোনান, আশিক তখন কিছুতেই খোলাদিলে নিজের নগরে-জাঁকিয়ে-বসে-থাকার বাস্তবতাটি খোলাসা করেন না। নিজের বলবান শ্রেণীটি কিছুতেই রসিকের সামনে বোধগম্য করে তুলে ধরেন না তিনি। এটাও আমাদের মাথায় রাখা কর্তব্য হবে যে, আশিকের পিতা ছেলের এই আর্টমার্টগিরিতে যতই বিরক্ত হোন, যতই না কেন তিনি চান যে ছেলে ‘প্রপার’ কিছু করুক, এমনকি দুয়েকদিন যদি রাগের মাথায় তিনি ছেলেকে ‘ত্যাজ্যও’ বলে দেন, দেশের প্রচলিত আইনে (এবং ইসলামী আইনেও) এই ‘নিজেকে বাউন্ডুলে ভাবতে ভালবাসে’ কবি বা চলচ্চিত্রনির্মাতা পুত্রকে তিনি সম্পত্তিবঞ্চিত করতে পারবেন না। আসলে তিনি তা চানও না। ফলে ভবিষ্যতের যে আশিক যে পরিমাণ বড়লোক, বর্তমানের সেই আশিক সেই পরিমাণই বড়লোক।
শ্রেণীর একটা মানে অবশ্যই আগাম সিকুরিটি, যাকে বলে একুমুলেশন। মেহেরবানি করে এটা মনে রাখবেন।
চাকরি-বাকরি নিয়ে শ্রেণীর ধারণার গোলমালও কিছুমাত্র কম নয়। ধরা যাক মধু আর কদু দুজনেই বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টারি করেন। এমনিতেই বাংলাদেশের সমাজে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টারদের এমন একটা গালভরা ‘মর্যাদা’ চালু আছে যে এই চাকরি করে অপেক্ষাকৃত গরিবির ঘোষণা দেয়াও খুব চাপের। সেটা নাহয় আজ বাদই দিই। মধু স্যার ২০ বছর হয়তো মাস্টারি করার পরও ধরা যাক সাড়ে ষোল হাজারে বাসা ভাড়া পেলে, আর সতেরো হাজারের বাসা নিতে চান না। এসব দেখেশুনে কেউ তাঁকে বলতেই পারে, “বুঝলাম না, আপনার কলিগ কদু স্যার তো একখান সুইমিংপুলওয়ালা চৌদ্দ কাঠার বাড়িতে থাকেন। একই তো বেতন পান আপনারা।” এই পর্যন্ত তিনি বলে ফেলার পর আপনার কত শত কথা যে খরচ করতে হবে, সেই ভেবেই আপনার আর কিছুই বলতে ইচ্ছা না-করতে পারে। নিতান্ত নিরুপায় হয়ে আপনার যদি কিছু বলতেই হয়, এবং আপনি স্বল্প কথায় সারতে চান, তাহলে বলতে পারেন, “ভাইরে, বাপের টাকা তো চাকরি থেকে পায়নি।” এটুকু বলতে পারলে অন্তত ওই বক্তার সঙ্গে শ্রেণী বিষয়ক আলাপে খানিকটা স্পষ্টতা কোনোদিন আনতে পারলেও পারতে পারেন। কিন্তু যদি কোনো কারণে, হতাশা ঢাকতে গিয়ে, আপনি বলে বসেন, “ভাইরে, আমি তো আর কদুর মতো স্মার্ট না। হে বেডা পারছে, আমি পারি নাই।” এইরকম একটা ঝামেলা পাকালে কিন্তু আর রক্ষা নাই। অবশ্যই স্মার্টনেসের কারণে সম্পদ বাড়তে পারে। বাংলাদেশে অমুক মন্ত্রণালয়ের ড্রাইভার, তমুক মন্ত্রীর পিওন, তমুক মন্ত্রণালয়ের খোদ মন্ত্রী ইত্যাদি সব মানুষের কোটি কোটি টাকা বানানোর পর আর এটা না-মানার উপায় থাকে না। কিন্তু শ্রেণীকে নিছক দুর্নীতি আর স্মার্টনেস দিয়ে বুঝলে খুবই যা-তা ভুলভাল বোঝাবুঝি হয়ে যাবে।
বাস্তবে এমন হতে পারে যে কদুর পিতা, হয়তো মধুর পিতার মতোই, ঢাকার কেউ নন, দৃষ্টিগ্রাহ্য কোনো সম্পদও দেখেননি কেউ আপনারা। কিন্তু কদু শিক্ষকতা পাবার পর জেলা শহরের প্রতিপত্তিশীল পিতা চমকে গেছেন। এমনও হতে পারে কদুর শিক্ষকতাপ্রাপ্তিতে তিনি দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে দুশ্চিন্তা করতেও শুরু করেছেন। সেসব যাই হোক, তিনি যে খুশি হয়েছেন তাতে সন্দেহ নেই। তারপর তিনি টিভি, ফ্রিজ, খাট, ওয়াশিং মেশিন, বাসা ভাড়ার আগাম সিকুরিটি টাকা ইত্যাদি সকলকিছু সমেত ছেলেকে মুবারকবাদ জানাতে আসলেন। এমনকি তিনি হবু বেয়াইকেও নিয়ে আসতে পারেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের সঙ্গেই সম্বন্ধ করবেন এমন আরেক জেলা-খান্দান। হতেই পারে। পরে যখন কাঠাপ্রতি মাত্র দশ লাখেই পাওয়া যাচ্ছে জানলেন, তিনি নিজে উদ্যোগী হয়ে পুত্রের নামে কাঠা দশেক বুকিং দিয়ে ফেললেন। জেনে হয়তো কদু নিজে আরো চার কাঠা বাড়াতে বাবাকে বললেন। এটা কদুর হবু শ্বশুরও করতে পারেন, ভালবাসার টানে। আপনারা এই উদাহরণের জেন্ডার-ডাইমেনশন নিয়ে অহেতু মাথা ঘামিয়েন না। মূল বিষয় হলো, কদুর আর মধুর চাকরি একই হলেও, কুড়ি বছরের একটা যাত্রাপথ খুব ভিন্ন হবে। স্থাবরের ঠেলা আপনি বুঝতে না পারলেও, সেই স্থাবরের ঠেলা কদুকে বহুদূর ঠেলে দিয়েছে যা গুণিতক হারে পরে বিকশিত হয়েছে; হতে থেকেছে, আরও হতে থাকবে। মধুর আর কদুর ঢাকাগমণ ও সমরূপ চাকুরিলাভ আখেরে বিভিন্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আদাবর, ২৪-২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০
কভারে মানস চৌধুরী; ছবি. ফাতেমা সুলতানা শুভ্রা, ২০১৮