ঘুম থেকে ওঠার পর আপনার রুটিন কী? ঘুমাতে যাবার আগেই বা আপনি ঠিক কী করেন? নিজেকে কি কোনো প্রশ্ন করে ঘুমাতে যান, নাকি দীর্ঘসময় ফোনে থেকে ক্লান্ত হলেই তবে ঘুমান? মনোবিজ্ঞানী বেঞ্জামিন হার্ডির মতে, ঘুমাতে যাওয়ার আগে ও পরের সময়টা আপনার সৃজনশীলতা বাড়াতে সাহায্য করতে পারে। যদি আপনি তার ১০ মিনিটের রুটিন অনুসরণ করেন।

২০১৯ সালে বেঞ্জামিন হার্ডির ‘১০ মিনিটের যে রুটিন আপনার স্বচ্ছতা ও সৃজনশীলতা বাড়িয়ে তুলবে’ লেখাটি প্রকাশিত হয় Medium ও Inc এর মত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ম্যাগাজিনে।
.

“আপনার অবচেতন মন সবসময়ই কাজ করতে থাকে, জাগ্রত ও ঘুমন্ত দুই অবস্থাতেই।”
— নেপোলিয়ন হিল

অবচেতন মন কখনো বিশ্রাম নেয় না, সবসময় কাজ করতে থাকে। কারণ এটা আপনার হৃদস্পন্দন, রক্ত সঞ্চালন ও হজম প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে। আপনার শরীরের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া ও কাজ নিয়ন্ত্রণ করে। তাছাড়া আপনার সব রকম সমস্যার উত্তরও অবচেতন মনের জানা আছে।


বেনজামিন হার্ডি, পিএইচডি
অনুবাদ: মাহতাবুল আলম


অবচেতন মনে যা কিছু ঘটে, তার প্রভাব পড়ে আমাদের সচেতন মনে। মনের গহীনে যা কিছু চলতে থাকে তা দিয়েই তৈরি হয় আমাদের বাস্তবতা। হিল আরো বলেন, “অবচেতন মনের চিন্তা-ভাবনার সরাসরি প্রতিফলন ঘটে বাস্তব দুনিয়ায় আমাদের কাজের ওপর।”

আপনার কাজ হচ্ছে অবচেতন মনকে নির্দেশনা দেওয়া। তা শুনে অবচেতন মন যেটা করে, যা চান আপনাকে তা’ই দেয়। সবাই চায় অবচেতন মনে ঢুকে মনের জট খুলে সব সমস্যাগুলির সমাধান করতে। কাজ শুরু করার জন্য এখানে একটা সাধারন রুটিন দেওয়া হলো

ঘুমাতে যাওয়ার আগের ১০ মিনিট

“অবচেতন মনকে কোন কিছু করার অনুরোধ না করে কখনো ঘুমোতে যাবেন না।”
— টমাস এডিসন

সারা বিশ্বের সফল মানুষেরা ঘুমাতে যাওয়ার আগে তাদের অবচেতন মনকে কিছু নির্দেশনা দিয়ে থাকে। এ কাজটি তারা প্রতিদিনের রুটিনে পরিণত করে। এটি তারা অনুশীলনের মাধ্যমে অভ্যাসে পরিণত করে।

কীভাবে?

ঘুমাতে যাওয়ার আগে কিছু সময় নিন। আপনি যে কাজগুলি করতে চান সেগুলি একটা কাগজে লিখে ফেলুন। তারপর সেগুলি নিয়ে কিছুক্ষণ গভীর চিন্তা করুন।

আরো পড়ুন: ওয়ান থিং অ্যাট এ টাইম: একবারে এক কাজ করার ৭টি টিপস

আপনি যা করতে চান সেই বিষয়ে নিজেকে হাজারটা প্রশ্ন করুন। এডিশনের ভাষায় এটা হচ্ছে অবচেতন মনের প্রতি কিছু ‘অনুরোধ’। আপনার প্রশ্ন ও চিন্তাগুলিকে কাগজে লিখে ফেলুন। প্রশ্ন যত বেশি সুস্পষ্ট হবে আপনার উত্তরও তত পরিষ্কার হবে।

ঘুমানোর সময় আপনার অবচেতন মন সেই বিষয়গুলি নিয়ে কাজ করবে।

ঘুম থেকে ওঠার পরের ১০ মিনিট

গবেষণা থেকে জানা গেছে, মানুষের মস্তিষ্ক বিশেষ করে প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স খুবই সক্রিয়। ঘুমের পর পরই মস্তিষ্কের এই অংশটি কাজ শুরু করে দেয়। মানুষের অবচেতন মন সবসময় অস্থির থাকে। ঘুমের সময় এটা সজাগ থেকে প্রাসঙ্গিক ও ক্ষণস্থায়ী ঘটনাগুলির সাথে যোগাযোগ তৈরি করে। মস্তিষ্কের এই সৃজনশীল অংশটি মস্তিষ্কের অন্যান্য অংশের সাথেও সংযোগ তৈরি করে।১০ মিনিটের যে রুটিন আপনার স্বচ্ছতা ও সৃজনশীলতা বাড়িয়ে তুলবে

জশুয়া ওয়েইজকিন একজন বিখ্যাত দাবাড়ু ও তাইচি ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ন। টিম ফ্যারিস এর নেয়া এক সাক্ষাৎকারে জশ তার সকালের রুটিন নিয়ে বলেন। ঘুমানোর সময় অবচেতন মন যে সমস্ত কর্মকাণ্ড ও যোগাযোগ করে সেই অভিজ্ঞতাগুলিকে তিনি সকালে আবারো মনে করতে চান।

১৮ থেকে ৪৪ বছর বয়সী শতকরা ৮০ ভাগ মানুষই ঘুম থেকে ওঠার ১৫ মিনিটের মধ্যে স্মার্টফোন ঘাঁটাঘাটি করে। কিন্তু ঘুম থেকে ওঠার পর ওয়েইজকিন একটা নীরব জায়গায় চলে যান। সেখানে তিনি কিছুক্ষণ ধ্যান করেন। তারপর হাতে নেন তার লেখার খাতা।

আরো পড়ুন: চেষ্টা করা এবং করে ফেলার মধ্যে পার্থক্য

এরপর কয়েক মিনিট ধরে তিনি চিন্তাগুলিকে খাতায় লিখে ফেলেন। বেশিরভাগ লোকই সকালবেলায় নোটিফিকেশন দেখে মস্তিষ্কে কিছু নতুন ধারণা যোগ করে। কিন্তু জশ করেন ঠিক তাদের উল্টা। তিনি মাথায় কিছু ঢোকানোর পরিবর্তে বরং মাথার চিন্তাগুলিকেই খাতায় লেখেন। এভাবেই তিনি তার চিন্তার জট খুলে স্বচ্ছ চিন্তার জগতে ঢুকে পারেন। সেখান থেকে কিছু শেখেন। তার শেখার জিনিসগুলি হয়ে থাকে সৃজনশীল। আর এটাকে তিনি বলেন “ক্রিস্টালাইজড ইন্টেলিজেন্স”।

ডায়েরি লেখার অভ্যাস না থাকলে এভাবে কাগজে লেখা আপনার জন্য কঠিন হতে পারে। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, সরলভাবে চিন্তাগুলিকে খাতায় লিখতে পারলে তবেই আপনি কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবেন।

ঘুমাতে যাওয়ার আগে অবচেতন মনকে যে অনুরোধগুলি করছেন তা মাথায় রাখুন। নিজেকে হয়তো হাজারটা প্রশ্ন করেছেন আপনি। যে কাজগুলি করতে চান সেগুলি নিয়ে ভেবেছেন এবং তা ডায়েরিতে লিখে রেখেছেন।

জশ ওয়েইজকিন

সকালে আপনার মস্তিষ্কের সৃজনশীল অংশটি অনেক বেশি সতেজ থাকবে। তার কারণ ঘুমানোর সময় আপনার মনের অবচেতন অংশটি কেবল সক্রিয় ছিল। কাজেই সকালের সতেজ মনে যে চিন্তাগুলি আসছে তা লিখে ফেলতে শুরু করুন।

আমি যা আর্টিকেল লিখি সেগুলির বেশিরভাগ লেখা সকালের চিন্তা থেকে। আমি ধারণা লাভ করি কীভাবে ভাল স্বামী ও তিনজন পালিত সন্তানের ভাল বাবা হওয়া যায়। যে সমস্ত লক্ষ্যের পেছনে ছুটি সেগুলি সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পাই। যাদের সাথে মিশতে চাই তাদের সম্পর্কে অনেক কিছু অনুমান করতে পারি। এমনকি মানুষের সাথে সম্পর্ক ভাল করার জন্য ধারণা লাভ করি।

আরো পড়ুন: আপনার কি সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হয়?

নিশ্চিত হওয়ার জন্য এই জিনিসগুলি আপনাকে প্রতিদিন অনুশীলন করতে হবে। দক্ষ হয়ে ওঠার আগে আপনাকে হয়ত অনেকবার চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু কাজের ধারাবাহিকতা থাকলে আপনি একসময় অনায়াসে সৃজনশীলতা অর্জন করতে পারবেন। এমনকি এক পর্যায়ে আপনার সহজাত গুণাবলী বিকশিত হতে থাকবে।

উপসংহার

“একজন মানুষ সরাসরি তার চারপাশের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। কিন্তু সে তার চিন্তাকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারে। আর এভাবেই সে পরোক্ষভাবে পরিস্থিতিকে হাতের মুঠোয় নিয়ে আসতে পারে।”
—জেমস অ্যালেন

শারীরিকভাবে সৃষ্টিশীলতা প্রকাশিত হওয়ার আগে মানুষ মানসিকভাবে সৃষ্টিশীল হয়। একটা ভবন বাস্তবে তৈরি হওয়ার আগে তার জন্য একটা নকশা লাগে।

মানুষের বেলায় তার চিন্তাই হচ্ছে সেই নকশা, যা দিয়ে তার জীবন তৈরি হয়। সচেতন ও অবচেতন, দুই অবস্থাতেই মানুষকে তার চিন্তা নিয়ন্ত্রণ করতে শিখতে হয়। কেবল তখনই কোনো পরিকল্পনা সফলতার মুখ দেখে।

আপনি নিজেই আপনার ভাগ্যের নির্মাতা। এই সাধারণ রুটিনটি আপনাকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষে পৌঁছতে সাহায্য করবে। আপনি কীভাবে সেখানে পৌঁছাবেন তাও আপনি এই রুটিনের মাধ্যমে জানতে পারবেন।

লেখক পরিচিতি

বেঞ্জামিন হার্ডি একজন সাংগঠনিক মনোবিজ্ঞানী ও বেস্ট সেলিং বই ‘Willpower Doesn’t Work‘ এর লেখক। স্ত্রী লরেন ও ছয় সন্তান সহ মধ্য ফ্লোরিডার অরল্যান্ডোতে থাকেন। নেতৃত্ব ও লিডারশিপের ওপর পৃথিবীর সেরা বিশেষজ্ঞদের একজন তিনি। ২০১৯ সালে পিএইচডি শেষ করার পর আরো ৫টি বই লিখেছেন তিনি, যার মধ্যে তিনটি সহ লেখক হিসেবে লিখেছেন বিখ্যাত এন্ট্রাপ্রেনিয়াল কোচ ড্যান সুলিভানের সাথে।

সূত্র: ইনক