১৯৬৪ সালে সায়েন্স ফিকশনের কিংবদন্তী আইজাক আসিমভ ২০১৪ সালের পৃথিবী কেমন হবে তা নিয়ে নিউইয়র্ক টাইমসে একটি লেখা লেখেন। ১৯৬৪ সালে বসে ৫০ বছর পরের পৃথিবীতে আসিমভ দেখতে পান থ্রিডি টিভি, মাটির নিচে শহর, চাঁদে মানুষের উপনিবেশ এবং আরো অনেক কিছু।
২০১৪-এর ওয়ার্ল্ড’স ফেয়ার পরিদর্শন
আইজাক আসিমভ
অনুবাদ: আশরাফুল আলম শাওন
১৯৬৪ সালের নিউ ইয়র্ক ওয়ার্ল্ড’স ফেয়ার উৎসর্গ করা হয়েছে ‘বোঝাপড়ার মাধ্যমে শান্তি’ স্লোগান সামনে রেখে। সংক্ষেপে এর তাৎপর্য হলো আগামী দিনের পৃথিবীকে পারমাণবিক যুদ্ধ মুক্ত করা। এবং কেন নয়? যদি একটা পারমাণবিক যুদ্ধ হয়, ভবিষ্যৎ আর আলোচনা করার মতো অবস্থায় থাকবে না। সুতরাং মিসাইলগুলি তাদের নিজেদের জায়গায় ঘুমিয়ে থাকুক এবং আমরা পর্যালোচনা করি, আগামী দিনের পারমাণবিক যুদ্ধের ঝুঁকিবিহীন পৃথিবীতে কী কী আসতে পারে।
অন্তত এই মেলার মাধ্যমে যা আসতে পারে বলে বোঝা যায়, তা দারুণ। মানুষ যেদিকে ভ্রমণ করে সেদিকে প্রাণোচ্ছ্বল আশা নিয়ে তাকায়। জেনারেল ইলেকট্রিক প্যাভিলিয়নের চেয়ে অন্য কোথাও এই বিষয়টা বেশি দেখা যায় না। সেখানে দর্শকরা বারবার চারটি দৃশ্য দেখছে। প্রত্যেকটিতেই আনন্দদায়ক, প্রায় জীবন্ত ডামি এমনভাবে চলাফেরা করে এবং কথা বলে যে দেড় মিনিটের মধ্যে আপনাকে বিশ্বাস করিয়ে ফেলবে তারা জীবন্ত।
দৃশ্যগুলি ১৯০০, ১৯২০, ১৯৪০ ও ১৯৬০ সালে সেট করা অথবা সেই সালগুলি সম্বন্ধে। এগুলি ইলেক্ট্রিকাল যন্ত্রসামগ্রীর অগ্রগতি ও তারা জীবনযাত্রায় যে পরিবর্তন আনছে তা দেখায়। আমি এটা উপভোগ করেছি। আমার দুঃখও হয়েছে, যে তারা ভবিষ্যতের কোনো দৃশ্য নিয়ে আসেনি। ২০১৪ সালে জীবন কেমন হবে? আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পরে? ২০১৪ সালের ওয়ার্ল্ড’স ফেয়ার কেমন হবে? আমি জানি না। কিন্তু আন্দাজ করতে পারি।
একটা চিন্তা আমার মাথায় এসেছে। যে, মানুষ প্রকৃতি থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়া অব্যাহত রাখবে তাদের জন্য বেশি মানানসই এমন একটি পরিবেশ নির্মাণ করার উদ্দেশ্যে। ২০১৪ সালের মধ্যে ইলেক্ট্রোলুমিনিসেন্ট প্যানেল সাধারণভাবে ব্যবহারের আওতায় চলে আসবে। ছাদ ও দেয়ালগুলিতে নরম আলো জ্বলতে থাকবে। একটা বাটন চাপলেই আলো অনেকগুলি রঙে পরিবর্তিত হবে। ঘরে আলাদা জানালা থাকতে পারে, সেই ধারণাও হয়ে পড়বে অতীতের অংশ। জানালাগুলি সূর্যের কড়া আলো প্রতিরোধ করতে পারবে। জানালার ওপর যে পরিমাণ আলো পড়বে তার উপর ভিত্তি করে জানালার স্বচ্ছতা বাড়বে বা কমবে।
মেলায় একটি আন্ডারগ্রাউন্ড বাড়ি আছে, এটা ভবিষ্যতের চিহ্ন। এর জানালায় স্বচ্ছতার এই প্রযুক্তি না থাকলেও এতে আলো পরিবর্তনের মাধ্যমে দৃশ্য বদলানো যাবে। মফস্বল এলাকার আন্ডারগ্রাউন্ড বাড়িগুলিতে নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রা থাকবে, আবহাওয়ার পরিবর্তন থেকে মুক্ত থাকবে। পরিষ্কার বাতাস আর আলো নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা থাকবে। এ ধরনের বাড়ি বেশ সাধারণ একটি ব্যাপার হবে।
২০১৪ সালের নিউ ইয়র্ক ওয়ার্ল্ড’স ফেয়ারে, জেনারেল মটরসের ‘ফিউচারামা’ বা ভবিষ্যতের প্রজেক্টটি হয়তো আলো-নিয়ন্ত্রিত সবজি-বাগান সহ সম্পূর্ণ আন্ডারগ্রাউন্ড শহরের দৃশ্য উপস্থাপন করবে। জিএম (জেনারেল মোটরস) হয়ত দ্বিমত করতে পারে, কিন্তু বেশিরভাগ জায়গা দেওয়া হবে কৃষিতে, পশুদের চারণভূমির জন্য এবং উদ্যানের জন্য। কম জায়গা নষ্ট হবে মানুষের থাকার জন্য।
যন্ত্রপাতি মানুষকে ক্লান্তিকর ও বিরক্তিকর কাজ থেকে মুক্তি দিবে। রান্নাঘরের ইউনিটগুলি এমনভাবে পরিকল্পনা করা থাকবে যে একা একাই খাবার তৈরি হবে। পানি গরম করা আর সেই গরম পানি দিয়ে কফি বানানো, পাউরুটি টোস্ট করা, ডিম ভাজা অথবা পোঁচ করা, গ্রিল করা ও আরো অনেক কিছু একা একাই হবে রান্নাঘরে। পরের দিন সকালে নাস্তার সময় ঠিক করে অর্ডার করে রাখা যাবে এবং সকালে তা সময়মতো পাওয়া যাবে। পুরোপুরি তৈরি হওয়া লাঞ্চ ও ডিনার, সেইসাথে অর্ধেক তৈরি হওয়া খাবার প্রসেসিংয়ের জন্য ফ্রিজে জমা হবে।
আমার মনে হয়, ২০১৪ সালেও রান্নাঘরে আলাদা ছোট একটি কর্নার রাখার উপদেশ দেওয়াটা কাজের হবে। সেখানে আলাদাভাবে খাবার হাতে তৈরি করা যাবে, বিশেষ করে যখন কেউ বেড়াতে আসছে।
২০১৪ সালে রোবট খুব কমন ব্যাপার হবে না, আবার খুব ভালোও হবে না। কিন্তু তাদের অস্তিত্ব থাকবে। এখনকার এই মেলায় আইবিএম এর স্টলে প্রদর্শনের জন্য কোনো রোবট নেই। বরং এই স্টলে মূলত কম্পিউটার রাখা হয়েছে। কম্পিউটারগুলি রাশিয়ান থেকে ইংরেজীতে অনুবাদ করার মতো জটিল বিভিন্ন কাজ করে দেখাচ্ছে। যদি মেশিন এখনই এত স্মার্ট হয় , পঞ্চাশ বছর পরে কোন কাজটিই বা তারা করতে পারবে না। কম্পিউটার এমন ধরনের হবে যে এর আকার অনেক ছোট হয়ে আসবে। এগুলি রোবটের মস্তিষ্ক হিসাবে কাজ করবে।
আসলে ২০১৪ সালের ওয়ার্ল্ড’স ফেয়ারে আইবিএম ভবনের অন্যতম প্রদর্শন হবে বড় গৃহস্থালী রোবট। এগুলি হবে আনাড়ি ধরনের, আস্তে আস্তে চলবে কিন্তু সাধারণ জিনিসপত্র তোলা, সাজানো, গৃহস্থালির ছোটখাটো কাজ করতে সক্ষম হবে। মেলায় যারা যাবে তারা মেঝেতে জিনিসপত্র ইতস্তত ছুড়ে ফেলবে এবং দেখে মুগ্ধ হবে রোবট জিনিসপত্রগুলি জড়ো করে সরাচ্ছে এবং ফেলে দেয়া ও রেখে দেয়ার জিনিস দুইভাগে ভাগ করছে। বাগানের কাজের জন্যও তখন রোবট ব্যবহার হবে।
আরো পড়ুন: কারাকুরি: কেমন ছিল ২৫০ বছর আগের জাপানি রোবট কালচার
২০১৪ সালের মেলায় জেনারেল ইলেক্ট্রিক ‘রোবটস অব দ্য ফিউচার’ এর ত্রি-মাত্রিক মুভি দেখাবে। সেখানে দেখা যাবে রোবটগুলি দেখতে একদম পরিষ্কার এবং সাজানো। পরিচ্ছন্নতার কাজগুলি এগুলিতে বিল্ট-ইন ভাবে থাকবে এবং সব কাজ দ্রুত করবে। (কিছু জিনিস কখনোই বদলায় না, তাই সেখানকার মুভি দেখার লাইনে তিন ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে।)
২০১৪ সালে বাড়িতে ব্যবহৃত ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রপাতির কোনো তার থাকবে না। কারণ সেগুলি রেডিওআইসোটোপের মাধ্যমে চলা দীর্ঘমেয়াদী ব্যাটারির মাধ্যমে চালু থাকবে।
আইসোটোপগুলির দাম আর বেশি থাকবে না কারণ সেগুলি ফিশন পাওয়ার প্ল্যান্টের বাইপ্রোডাক্ট হিসেবেই পাওয়া যাবে। আর ২০১৪ সালের মধ্যে এই ফিশন পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে পুরো মানবজাতির চাহিদার অর্ধেক শক্তি পাওয়া যাবে। কিন্তু একবার আইসোটোপ ব্যাটারিগুলি ব্যবহৃত হয়ে গেলে সেগুলি শুধুমাত্র প্রস্তুতকারকদের নির্ধারিত এজেন্টদের মাধ্যমে ফেলে দেওয়া যাবে।
২০১৪ সালে দুয়েকটা এক্সপেরিমেন্টাল ফিউশন-পাওয়ার প্ল্যান্ট থাকবে (আজকের দিনেও, এই ১৯৬৪ সালের মেলায় জি.ই. প্রদর্শনীতে ছোট হলেও নির্দিষ্ট বিরতিতে প্রায়ই সত্যিকার ফিউশন বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে)। আরিজোনা, নেগেভ, কাজাখস্তানের মত মরু এবং আংশিক মরু এলাকায় বড় বড় সোলার পাওয়ার স্টেশনগুলি দেখা যাবে। বেশি জনবহুল, মেঘলা ও কুয়াশাময় এলাকায় সোলার পাওয়ার ব্যবহারে ভালো ফল পাওয়া যাবে না। ২০১৪ সালের মেলায় একটি প্রদর্শনী মহাকাশে পাওয়ার স্টেশনগুলির মডেল প্রদর্শন করবে। প্যারাবোলিক ফোকাস করে এমন ডিভাইসের মাধ্যমে সূর্যালোক সংগ্রহ করবে এবং ভূ-পৃষ্ঠে সেই শক্তি বিকিরণ করবে।
পঞ্চাশ বছরের মধ্যে পৃথিবী আরো ছোট হয়ে যাবে। ১৯৬৪ সালের ফেয়ারে, জি.এম. (জেনারেল মোটরস) অন্যান্য জিনিসের মধ্যে ক্রান্তীয় অঞ্চলে রাস্তা নির্মাণের জন্য ‘রোড-বিল্ডিং ফ্যাক্টরি’র চিত্র দেখাবে। দেখা যায়, ভিড়পূর্ণ হাইওয়ে দিয়ে বড় বড় বাস বিশেষ সেন্ট্রাল লেন দিয়ে চলে। সব ধরনের সম্ভাবনাই আছে যে ২০১৪ সালে অন্তত পৃথিবীর উন্নত দেশগুলিতে হাইওয়ে অনেক কার্যকরভাবে কাজে লাগানো হবে। পরিবহন ব্যবস্থার ওপর বাড়তে থাকা গুরুত্বের কারণে ভূমির সাথে যানবাহনের স্পর্শ ঘটবে না।
অবশ্যই তখন যানবাহন হিসাবে এয়ারক্রাফট থাকবে, তবে গ্রাউন্ড-ট্রাভেল মাটির এক ফুট অথবা দুই ফুট উপর দিয়ে চলার প্রচলন বাড়তে থাকবে। ১৯৬৪ সালের মেলার দর্শনার্থীরা ‘অ্যাকুয়াফয়েল’-এ চড়ছে, ‘অ্যাকুয়াফয়েল’ চারটি দণ্ডের মাধ্যমে সম্ভাব্য সবচেয়ে কম ফ্রিকশনে নিজেকে পানির উপর টেনে তুলতে পারছে। এটা নিশ্চিতভাবেই একটি সাময়িক সমাধান। ২০১৪ সালের মধ্যে এই দণ্ড চারটি প্রতিস্থাপিত হবে কমপ্রেসড এয়ারের চারটি জেট দ্বারা। এর ফলে এই যানটির মাটি বা পানি কোনো কিছুর সাথেই স্পর্শ ঘটবে না।
কমপ্রেসড এয়ারের জেটগুলির কারণে হাইওয়ের যানবাহনগুলিও মাটির ওপরে থাকবে। এতে অন্যান্য জিনিসের মধ্যে পায়ে চলার রাস্তার সমস্যা আগের চেয়ে কমে যাবে। মসৃণ মাটি অথবা সমান করা লন পায়ে চলার রাস্তার কাজ করবে। ব্রিজের গুরুত্বও অনেক কমে যাবে কারণ গাড়িগুলি তাদের জেটের মাধ্যমে পানি পার হতে পারবে, যদিও স্থানীয় আইন এই প্র্যাকটিস নিরুৎসাহিত করবে।
রোবট ব্রেইন দিয়ে যানবাহন ডিজাইন করায় বেশি জোর দেওয়া হবে। যানবাহনগুলির গন্তব্য নির্ধারণ করে দিলে কোনো বাধা ছাড়াই গাড়ি গন্তব্যে পৌঁছে যাবে। এ প্রক্রিয়ায় যানবাহন মানুষের নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই চলবে। আমি মনে করি, ২০১৪ সালের মেলার একটি প্রধান আকর্ষণ হবে ছোট রোবটিসাইজড গাড়িতে চড়া। এগুলি হবে দুই ফুট উচ্চতার এবং ভিড়ের মধ্য দিয়ে কৌশলে, মসৃণভাবে একা একাই অন্যান্য গাড়ি এড়িয়ে চলাচল করবে।
অল্প দূরত্বে যাতায়াত করার জন্য সবসময় চলতে থাকা সাইডওয়াক (সাইডওয়াকের দুই পাশেই বেঞ্চ থাকবে, মাঝখানে থাকবে স্ট্যান্ডিং রুম) দেখা যাবে শহরতলিগুলিতে। এগুলি রাস্তায় যানবাহনের উপরে থাকবে। তবু কিছু কিছু জায়গায় যানবাহন থাকবে কারণ সব ধরনের পার্কিং হবে রাস্তার বাইরে এবং শতকরা আশি ভাগ ট্রাক ডেলিভারির জায়গা শহরের প্রান্তের দিকে নির্ধারিত থাকবে। কমপ্রেসড এয়ার টিউবের মাধ্যমে নির্দিষ্ট গন্তব্যে নির্দিষ্ট পণ্য পৌঁছে দেয়া সম্ভব হবে এবং এটা হবে শহরের সেরা বিস্ময়গুলির একটি। যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হবে।
আপনি যাকে ফোন করবেন তার কথা শোনার পাশাপাশি তাকে চোখে দেখতেও পাবেন। স্ক্রিন শুধু যাকে কল করা হবে তাকে দেখার জন্যই ব্যবহৃত হবে না, স্ক্রিনে ডকুমেন্টস দেখা যাবে, ফটোগ্রাফ দেখা যাবে এবং বই-এর অংশও পড়া যাবে। মহাকাশে ঘুরতে থাকা সিনক্রোনাস স্যাটেলাইটের কারণে অ্যান্টার্কটিকার আবহাওয়া স্টেশন সহ পৃথিবীর যেকোনো স্থানে ফোন করা সম্ভব হবে। (৬৪ সালের মেলার জেনারেল মোটরের প্রদর্শনীর অংশ হিসাবে দেখা গেছে)
এর ফলে এমনকি চাঁদে অবস্থিত মুন-কলোনি’র কারো সাথে যোগাযোগ করা যাবে। এ প্রসঙ্গে বলা যায়, আমাদের প্রাকৃতিক উপগ্রহ বা চাঁদের অসমতল ভূখণ্ডে চলাচলের উপযোগী করে বানানো বড় আর নরম টায়ারওয়ালা আকর্ষণীয় যানবাহন মডেল আকারে রাখা হয়েছে ‘জেনারেল মোটরস’ এর ডিসপ্লেতে। পৃথিবী ও চাঁদের মধ্যে যেকোনো সংখ্যক দ্বিপাক্ষিক কথোপকথন মডুলেটেড লেজার বিমের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। এই লেজার বিম খুব সহজেই মহাকাশে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। আর পৃথিবীতে এই লেজার বিমগুলিকে প্লাস্টিকের পাইপের মধ্য দিয়ে নিতে হবে। ইঞ্জিনিয়াররা ২০১৪ সালেও এই ব্যাপারে কাজ করতে থাকবে।
চাঁদে কথা বলা সামান্য একটু সমস্যার হবে, কিন্তু দুইপাশের কথা শুনতে পাওয়ার মধ্যে সময়ের মধ্যে ব্যবধান থাকবে ২.৫ সেকেন্ড। কারণ চাঁদ থেকে পৃথিবীতে আলো গিয়ে ফিরে আসতে এতটা সময় লাগে। ৩.৫ মিনিট দেরিতে একই ধরনের কনভার্সেশন মঙ্গল গ্রহেও সম্ভব হবে যখন মঙ্গলগ্রহ পৃথিবীর সবচেয়ে কাছে থাকবে। যাই হোক, ২০১৪ সালের মধ্যে মানুষবিহীন যানই শুধু মঙ্গলে অবতরণ করবে, যদিও মঙ্গল অভিযানের ব্যাপারে মানুষের তৎপরতা থাকবে। ২০১৪ সালে “ফিউচারামা” বা ভবিষ্যতের চিত্র মঙ্গলে কলোনির একটি বিস্তারিত মডেল দেখাবে।
আরো পড়ুন: যখন বন্দি থাকতে হচ্ছে কী করবেন তখন—নভোচারীরা কী বলেন
একই কথা টেলিভিশনের বেলায়ও। ওয়াল স্ক্রিন সাধারণ টেলিভিশন সেটের জায়গা নিয়ে নিবে। কিন্তু ট্রান্সপারেন্ট কিউবও তখন দেখা যেতে থাকবে, এটাতে ত্রি-মাত্রিকভাবে দেখা সম্ভব হবে। সত্যিকার অর্থে ২০১৪-এর ওয়ার্ল্ড ফেয়ারের একটি জনপ্রিয় প্রদর্শনী হবে একধরনের থ্রিডি-টিভি, লাইফ সাইজ বা মানুষের আকারের হবে সেটা, যাতে ব্যালে পারফরমেন্স দেখা যাবে। কিউবটি সব অ্যাঙ্গেল থেকেই যেন দেখা যায় এ কারণে ধীরে ধীরে চক্রাকারে ঘুরতে থাকবে। এসব শুনে ভবিষ্যতের পৃথিবী কতটা সুখের হবে, তা নিয়ে যে কেউ স্বপ্ন দেখতে পারে। কিন্তু ভবিষ্যতের সবটাই ইতিবাচক হবে না।
আমি যেমন ১৯৬৪ সালের মেলার জেনারেল ইলেক্ট্রিক প্রদর্শনীতে ঢুকতে লাইনে দাঁড়িয়ে ‘ইকুইটেবল লাইফ’ এর সাইনবোর্ডে ইউনাইটেড স্টেটসের জনসংখ্যার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ১৯ কোটি জনসংখ্যার সাথে প্রতি এগারো সেকেন্ডে একজন করে বাড়ছে। আমি যতক্ষণ সময় জেনারেল ইলেক্ট্রনিক্সের প্যাভিলিয়নে কাটিয়েছি আমেরিকার জনসংখ্যা ততক্ষণে ৩০০ বেড়ে গিয়েছে এবং পৃথিবীর জনসংখ্যা বেড়ে গিয়েছে ৬০০০।
দেখা যাচ্ছে ২০১৪ সালে পৃথিবীর জনসংখ্যা হবে সাড়ে ছয়শ কোটি এবং ইউনাইটেড স্টেটসের জনসংখ্যা হবে পয়ত্রিশ কোটি। বোস্টন থেকে ওয়াশিংটন পৃথিবীর মধ্যে হবে এই সাইজের সবচেয়ে ভিড়পূর্ণ এলাকা, এই একটা শহরের জনসংখ্যা হবে চার কোটি।
জনসংখ্যার চাপের ফলে মরুভূমিতে এবং মেরু অঞ্চলে মানুষের দখল বাড়তে থাকবে। সবচেয়ে বিস্ময়কর এবং কিছু দিক দিয়ে উদ্বেগের ব্যাপার যে ২০১৪ সালে মহীসোপান অঞ্চল বা কনটিনেন্টাল শেলফ এলাকাতেও মানুষের দখলদারিত্ব বাড়তে থাকবে। যারা পানি বা ‘ওয়াটার স্পোর্টস’ পছন্দ করে তাদের জন্য আকর্ষণীয় হবে পানির নিচের বসতি। এবং এর ফলে সামুদ্রিক সম্পদ যথা খাবার এবং খনিজ উভয়ই আরো কার্যকরভাবে কাজে লাগানো সম্ভব হবে।
জেনারেল মোটরস ১৯৬৪ সালের প্রদর্শনীতে পানির নিচের একটি হোটেলের মডেল দেখিয়েছে যেটার নাম হতে পারে ‘মাউথ ওয়াটারিং লাক্সারি’। ২০১৪ সালের মেলায় সমুদ্রের গভীরে শহরের প্রদর্শনী থাকবে। বিশেষ জলযানগুলি মানুষ আর পণ্যদ্রব্য সাগরের তলদেশে নিয়ে যাবে।
সাধারণ কৃষি কঠিন সমস্যার মুখোমুখি হবে এবং ‘ফার্মে’ আরো দক্ষভাবে মাইক্রো-অর্গানিজম উৎপাদন শুরু হবে। প্রক্রিয়াজাত ইস্ট এবং শৈবাল জাতীয় পণ্য বহু ধরনের ফ্লেভারে প্রচুর পাওয়া যাবে। ২০১৪ সালের মেলায় একটি অ্যালজি বার থাকবে এবং সেখানে ‘মক-টার্কি’ এবং ‘স্যুডো-স্টেক’ সার্ভ করা হবে। সেগুলি একেবারে খারাপ হবে না, যদি আপনার সেগুলির দাম দেওয়ার ক্ষমতা থাকে , কিন্তু এগুলির প্রতি এক ধরনের মানসিক বাধা থাকবে অনেকের মধ্যে।
যদিও ২০১৪ সালে জনসংখ্যার সাথে প্রযুক্তিও বাড়তে থাকবে, এটা হবে শুধুমাত্র প্রযুক্তিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার কারণে এবং সফলতা আসবে আংশিক। পৃথিবীর সবাই ভবিষ্যতের এই গ্যাজেটে ভর্তি পৃথিবী সম্পূর্ণভাবে উপভোগ করতে পারবে না। এখনকার চেয়ে আরো বেশি সংখ্যক মানুষ তখন সুবিধাবঞ্চিত থাকবে। যদিও বস্তুগত দিক দিয়ে তারা এখনকার চেয়ে ভালো অবস্থায় থাকবে। তবে এখনকার পৃথিবীর সুবিধাপ্রাপ্ত বাসিন্দাদের তুলনায় তারা অনেক পিছিয়ে থাকবে। অর্থাৎ, তুলনামূলকভাবে তারা আরো পিছিয়ে যাবে।
আরো পড়ুন: আইজাক আসিমভ: কীভাবে মানুষ নতুন আইডিয়া পায়?
প্রযুক্তিও জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে তাল মিলাতে পারবে না যদি না জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। ১৯৬৪ সালের ম্যানহাটনের কথা বিবেচনা করলে, সেখানে রাতে প্রতি বর্গ মাইলে আশি হাজার মানুষ থাকে এবং কর্মব্যস্ত দিনে প্রতি বর্গ মাইলে এক লাখ মানুষ থাকে। যদি সাহারা মরুভূমি, হিমালয়ের চূড়া, গ্রীনল্যান্ড, অ্যান্টার্কটিকা এবং সমুদ্রের তলদেশের প্রতি বর্গমাইল, ভূগর্ভের গভীরে সহ সারা পৃথিবীতে ম্যানহাটনের দুপুরের মত ভিড় থাকে আপনি নিশ্চয়ই একমত পোষণ করবেন যে কোনোভাবেই আমাদের গ্রহের পক্ষে এই জনসংখ্যা সামাল দেয়া সম্ভব না, সেখানে স্বস্তিতে থাকা তো দূরের কথা। সত্যিকার অর্থে পুরো পৃথিবী ম্যানহাটনের অবস্থায় পৌঁছানোর অনেক আগেই সাপোর্ট সিস্টেম ভেঙে পড়বে।
এখন পৃথিবীর জনসংখ্যা তিনশ কোটির কাছাকাছি এবং প্রতি চল্লিশ বছরে তা দ্বিগুণ হচ্ছে। যদি দ্বিগুণ হওয়ার এই হার অনিয়ন্ত্রিত থাকে তাহলে আগামী পাঁচশ বছরের মধ্যে একটি ওয়ার্ল্ড-ম্যানহাটন আসছে। ২৪৫০ সালের মধ্যে পুরো পৃথিবীটাই একটি বদ্ধ ম্যানহাটনে পরিণত হবে এবং সমাজ ব্যবস্থা তার আগেই ধ্বসে পড়বে।
এই অবস্থা প্রতিরোধ করার মাত্র দুইটি উপায়ই আছে, ১. মৃত্যু হার বাড়াতে হবে; ২. জন্ম হার কমাতে হবে। নিঃসন্দেহে ২০১৪ সালের পৃথিবী একমত হবে দ্বিতীয় উপায়টিতে। প্রকৃতপক্ষে দুর্বল হয়ে আসা হার্ট ও কিডনি স্থানান্তরে যন্ত্রপাতির ব্যবহার বেড়ে যাওয়া, ক্ষতিগ্রস্থ ধমনী বা নার্ভের চিকিৎসা মৃত্যুহার কমিয়ে দেবে অনেক এবং পৃথিবীর অনেক অংশেই কাঙ্ক্ষিত আয়ু পঁচাশি বছর বয়সে নিয়ে যাবে।
সুতরাং তখন সারা পৃথিবী জুড়ে জন্মনিয়ন্ত্রণের পক্ষে যুক্তিসঙ্গত এবং মানবিক পদ্ধতিতে প্রোপাগান্ডা চলবে। ২০১৪ সালের মধ্যে এটা সিরিয়াসভাবেই প্রভাব ফেলবে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমে আসবে, কিন্তু আমার সন্দেহ সেটা যথেষ্ট পরিমাণে না।
২০১৪ সালের মেলার সবচেয়ে সিরিয়াস প্রদর্শনীর একটা হবে ওয়ার্ল্ড পপুলেশন কন্ট্রোল সেন্টারে লেকচার, চলচ্চিত্র ও প্রামাণ্যচিত্রের উপকরণের সিরিজ। এখানে শুধু প্রাপ্তবয়স্করাই যেতে পারবে, টিনেজারদের জন্য স্পেশাল প্রদর্শনীর ব্যবস্থা থাকবে।
স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে অবস্থা আরো ভয়াবহ হয়ে যাবে। ২০১৪ সালে শুধু অল্প কিছু কাজই কোনো মানুষের চেয়ে মেশিন ভালো করতে পারবে না। মানুষের মধ্যে মেশিন ব্যবহার করার প্রচলন অনেক বাড়বে।
শিক্ষা কার্যক্রমও সেভাবে পরিচালিত হবে। আজকের ‘জেনারেল ইলেকট্রিক’ এর প্রদর্শনীর একটা অংশ ভবিষ্যতের এমন এক ধরনের স্কুলের ধারণা দেয় যেখানে ক্লোজড সার্কিট টিভি এবং রেকর্ড করা প্রোগ্রামের মাধ্যমে শিক্ষা দানের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। এতে শুধু শিক্ষাদানের পদ্ধতিই উন্নত হবে না, বরং শিক্ষার বিষয়ও পরিবর্তিত হবে। সকল হাই-স্কুল শিক্ষার্থীরা কম্পিউটার প্রযুক্তি শিখবে এবং তারা বাইনারি অ্যারিথম্যাটিকেও দক্ষ হবে। তাদেরকে কম্পিউটার ল্যাঙ্গুয়েজে দক্ষতার জন্যও প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে ফলে এখনকার ‘ফোরট্রান’ বা ফর্মুলা ট্রান্সলেশনের মত কাজে উন্নতি ঘটবে।
আরো পড়ুন: জানালার কাচে ধাক্কা খেয়ে বছরে মারা যায় ১০০ কোটি পাখি—কীভাবে এই মৃত্যু থামাতে পারি আমরা?
তারপরও মানুষ মারাত্মকভাবে একঘেয়েমির অসুখে ভুগবে। প্রতি বছরই এই অসুখ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে এবং এর প্রভাব বাড়বে। এর মানসিক, ইমোশনাল এবং সামাজিক ফলাফল হবে ভয়াবহ। এবং আমি সাহসের সাথে বলছি ২০১৪ সালে সাইকিয়াট্রি হবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা ক্ষেত্র। অল্প যে কয়জন ভাগ্যবান ক্রিয়েটিভ কাজে জড়িত থাকবে তারা হবে মানবগোষ্ঠীর সত্যিকার এলিট, কারণ তারা মেশিনের নির্দেশনা অনুসারে কাজ করার বাইরেও নিজেদের কাজ করবে।
প্রকৃতপক্ষে, ২০১৪ সাল নিয়ে আমি সবচেয়ে নেতিবাচক যে ধারণাটি করতে পারি, সেটা হলো প্রচুর অবসরের একটি সমাজে অভিধানের সবচেয়ে নিঃসঙ্গ শব্দটি হবে ‘কাজ’!
(আগস্ট ১৯৬৪)