যেন ইন্ডিয়ানা জোনস সিনেমার সেই কাহিনীর বাস্তব রুপ। শত শত বছর ধরে মিশরের মরুভূমির বালির নিচে লুকিয়ে আছে এক প্রাচীন নগরী। দশকের পর দশক ধরে প্রত্নতত্ত্ববিদ এবং অভিযাত্রী গবেষকরা হন্যে হয়ে যার সন্ধান করছেন। অবশেষে বাস্তবেই সে শহরটি খুঁজে পেলেন বিজ্ঞানীরা। শহরটি অমূল্য সব প্রত্নতাত্ত্বিক  নিদর্শন এবং প্রাচীন শিল্পবস্তুতে পূর্ণ। যা থেকে ফারাওদের অধীনে জীবন সম্পর্কে বিস্ময়কর সব অজানা তথ্য জানা যাচ্ছে।


ইয়ান টেইলর
সায়েন্স ফোকাস, ৯ এপ্রিল ২০২১


এটেন নামের এই শহর এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত মিশরের সবচেয়ে বড় প্রাচীন মানববসতি। লুক্সর এর খুব কাছেই অবস্থিত এই শহরটি ফারাও আমেনহোটেপ তৃতীয় এর সময়কালের। আমেনহোটেপ ছিলেন মিশরের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ফারাওদের একজন। তার রাজত্বকাল ছিল খ্রিস্টপূর্ব ১৩৯১ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১৩৫৩ পর্যন্ত।

নব আবিষ্কৃত এই প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানটি এতটাই বিশাল যে আগামী কয়েক মাসেও এর সব কিছু দেখে ফেলা সম্ভব হবে না। ফলে সামনের মাসগুলিতে এখান থেকে আরো নতুন নতুন জিনিস ও তথ্য আবিষ্কৃত হতে থাকবে।

তবে ইজিপ্টোলজিস্ট ড. জাহি হাওয়াস ইতিমধ্যেই একে “হারানো স্বর্ণনগরী” (লস্ট গোল্ডেন সিটি) বলে আখ্যায়িত করেছেন। গত বছর সেপ্টেম্বরে মরুভূমিতে খনন শুরু করার পর অল্প সময়ের মধ্যেই এই শহরের সন্ধান মেলে।

ড. জাহি হাওয়াস এক বিবৃতিতে বলেন, “পুরো টিমকে চমকে দিয়ে মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই চারিদিকে মাটির নিচ থেকে কাদামাটি দিয়ে বানানো ইটের তৈরি কাঠামো বেরিয়ে আসতে থাকে। প্রায় অক্ষত অবস্থায় এক বিশাল শহর বেরিয়ে আসে মরুর বুক থেকে। এর বাড়ির দেয়ালগুলি প্রায় অক্ষত এবং ঘরগুলি নিত্যব্যবহার্য হাতিয়ার ও জিনিসপত্রে ভরপুর।”

পুরো শহরটির বিস্তারিত জানতে আরো অনেক সময় লাগবে। তবে ইতিমধ্যেই এখান থেকে ৫টি উত্তেজনাপূর্ণ, অপ্রত্যাশিত এবং অদ্ভুত আবিষ্কার হয়ে গেছে।

 

১. একটি অস্বাভাবিক কঙ্কাল

মিশরে এর প্রাচীন শাসক এবং তাদের প্রজাদের দেহাবশেষ পাওয়া কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। কিন্তু এবার এই এটেন শহরে এমন একটি কঙ্কাল পাওয়া গেছে যা দেখে প্রত্নতাত্ত্বিকরা হতবুদ্ধি হয়ে গেছেন। কঙ্কালটির হাত দুটো দুদিকে লম্বা করে ছড়ানো এবং হাঁটু দুটো একসঙ্গে দড়ি দিয়ে বাধা।

এই কঙ্কালটি যার সেই ব্যক্তি কীভাবে মারা গেছেন তা বের করার জন্যে গবেষকরা এখনো অনুসন্ধান চালাচ্ছেন। শহরটির অন্য একটি জায়গায় পুরো একটি গোরস্থান পাওয়া গেছে, যেখানে ভ্যালি অফ দ্য কিংস এর মতই পাথরের সমাধি রয়েছে। তবে সমাধিগুলি এখনো খোলা হয়নি।

 

২. শক্তিশালী নিরাপত্তা দেয়াল

নব আবিষ্কৃত প্রাচীন এই শহরে এমন একটি অস্বাভাবিক কাঠামোর দেয়াল বেরিয়ে এসেছে যা মিশরে এর আগে আর কখনো দেখা যায় নি।

দেয়ালটির একটি মাত্র প্রবেশ পথ আছে। নেতৃস্থানীয় গবেষকদের ধারণা দেয়ালটি অত্যন্ত সুরক্ষিত ছিল এবং সেখানে অনেক পাহারাদার নিযুক্ত থাকত। শহরে প্রবেশ এবং প্রস্থান নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবহৃত হত দেয়ালটি। যার ভেতরে ছিল কিছু আবাসিক এবং প্রশাসনিক ভবন।

 

৩. কন্টেইনার ভর্তি মাংস

কেউ কী সাড়ে তিন হাজার বছরের পুরান মাংস খেতে চান? এই খননে সবচেয়ে কম ক্ষুধা-উদ্রেককারী যে আবিষ্কারটি হয়েছে সেটি হল এক বিশাল পাত্রভর্তি সেদ্ধ বা শুকনা মাংস। মাংসভর্তি ওই কন্টেইনারটিতে লেখা আছে: “বছর ৩৭, তৃতীয় হেব সেড উৎসবের জন্য প্রস্তুতকৃত মাংস, যা এসেছে কসাই লুভির তৈরি খা এর স্টকইয়ার্ডের কসাইখানা থেকে।”

ড. হাওয়াস বলেন, “এই মূল্যবান তথ্য থেকে আমরা শুধু এমন দুজন মানুষের নামই জানি না যারা ওই শহরে বসবাস ও কাজ করত, বরং এটাও নিশ্চিত হই যে রাজা তৃতীয় আমেনহোটেপ এবং তার ছেলে আখেনাটেন এর যৌথ শাসনকালেও শহরটি সক্রিয় ছিল।”

 

৪.  সমৃদ্ধিশালী বেকারি

আপনি কি মাংস খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন? চিন্তা করবেন না। এটেনে একটি সমৃদ্ধিশালী বেকারীও আছে। প্রত্নতত্ত্ববিদরা বেশ অক্ষত একটি কাঠামো পেয়েছেন যার ভেতরে একটি রান্নাঘর এবং খাদ্য প্রস্তুত করার জায়গা আছে।

যেখানে আছে অনেকগুলি চুলা এবং মাটির পাত্র। ড. হাওয়াস বলেন, “এর আকার দেখে অনুমান করা যায় যে, সেখানে শুধু রান্না এবং খাদ্য প্রস্তুত করার জন্যই বিশাল সংখ্যক শ্রমিক ও কর্মচারী কাজ করত।” সুতা কাটা এবং কাপড় বোনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু হাতিয়ার বা সরঞ্জামও পাওয়া গেছে সেখানে।

 

৫. ৭টি ভিন্ন ভিন্ন এলাকা

শহরটি সম্পর্কে সবচেয়ে অবিশ্বাস্য ব্যাপার হল এর আকর্ষণীয় সংরক্ষণ ব্যবস্থা। প্রত্নতত্ত্ববিদরা শহরটিতে ৭টি ভিন্ন ভিন্ন এলাকা আবিষ্কার করেছেন। যেগুলির মধ্যে আবাসিক, শিল্প এবং প্রশাসনিক কেন্দ্র এলাকাও রয়েছে। এই আবিষ্কার থেকে শহরটির সংস্কৃতি এবং অর্থনীতি সম্পর্কে অনেক কিছুই জানা যায়। যেখানে ধাতু এবং কাচ শিল্পের নিদর্শনও পাওয়া গেছে।

তবে, শহরটি কেন পরিত্যক্ত হয়েছিল তা এখনো জানা যায়নি। ধারণা করা হয় যে, রাজা আখেনাটন এবং রানী নেফারতিতি তাদের সাম্রাজ্যের রাজধানী আমার্না শহরে সরিয়ে নিয়েছিলেন। শহরটির কিছু অংশ মাত্র এর এক বছর আগেই নির্মিত হয়েছিল। সম্ভবত আরো খনন চালানোর পরই হয়ত জানা যাবে কেন শহরটি ছেড়ে গিয়েছিলেন তারা।

অনুবাদ: মাহবুবুল আলম তারেক