তখন আমি ক্লাস ওয়ান কি টুতে পড়ি। আমার মা কিছুটা ভুলোমন টাইপের। কোথায় কী রাখে, না রাখে সেটা সবসময়ই ভুলে যায়। টাকা পয়সার ব্যাপারেও সবসময় এরকম হয়। একদিন মা ১০০ টাকার একটা নোট খুঁজে পাচ্ছিল না। আমার মা দশ-বিশ টাকা এরকম প্রায়ই হারায়ে ফেলে কিন্তু এত টাকা হারায় না কখনো।
১০০ টাকার নোট হারায়ে মা’র খুব মেজাজ খারাপ। নিশ্চয়ই কেউ চুরি করছে নাইলে এই টাকা যাবে কোথায়? কেউ বলতে আছি আমরা চার বোন। আমার বড়ো বোন খুব সরল টাইপ ভাল মানুষ। তার উপর মাকে অনেক বেশি ভয় পায়। তাই তার টাকা চুরি করার চান্স নাই। মেজ বোন আবার চরম মেজাজি। তার উপর সৎ, কর্তব্যপরায়ণ বিপ্লবী টাইপের। ওর কাছে ১০০ টাকার ব্যাপারে জিগ্যেশ করতে গিয়েই মা ঝাড়ি খাইছে। আর সেজো জন সবসময়ই চুপচাপ। সেও টাকা নেয় নাই। তো বাকি আছি সর্বশেষ আমি।
মা আমার কাছে আসছে। এসেই আমাকে ধমক, “আমার ১০০ টাকার নোট তুই নিছিস?”
আমি ঠোঁট বাঁকায়ে বলছি, আমি কেন নিব? টাকা নিয়ে আমার কী কাজ?
মা বলছে, চালাকি করবি না! তুই না নিলে আমার টাকা যাবে কোথায়?
আমি বিরক্ত হয়ে বলছি, চালাকি কী করলাম! আর ১০০ টাকা নিয়ে আমি কী করবো? ২ টাকা, ৫ টাকা হইলে একটা কথা ছিল।
এরপরই মা বুঝতে পারছে মাঝে মাঝে মা’র ব্যাগ থেকে যে ২, ৫ টাকা উধাও হয়ে যায় সেইটা আসলে কোথায় যায়! ঘটনা সেইটা না। ঘটনা হচ্ছে এই ২, ৫ টাকা নিয়ে আমি কী করি? বহু মাইর-টাইর খাওয়ার পরে আমার ২ টিক্কা নারিকেল আইসক্রিম আর চালতার আচার খাওয়ার কাহিনী বের হইল।
এরকম ধরা খাওয়ার পর থেকে আমি আর মা’র কাছ থেকে টাকা-পয়সা চুরি করার সাহস পাই নাই। আমার মেজ বোন পারমিতার ব্যাগ থেকে চুরি করতাম। আর ধরা যেন পড়ে না যাই তাই চুরি করার পরদিন নিজ থেকেই বলে দিতাম “তোমার ব্যাগ থেকে ২ টাকা নিছি।”
পারমিতা বড়লোক মানুষ। ২, ৫ টাকার জন্য আমাকে কিছু বলে না। কিন্তু ২ টিক্কা আইসক্রিম খাওয়ার ব্যাপারে তার মহা আপত্তি। তাই পরে পরে পারমিতা প্রতিদিন আমার জন্য ভাল চকলেট আইসক্রিম নিয়ে আসত যাতে আমার দুই টিক্কা আইসক্রিমের প্রতি ভালবাসা চলে যায়!
এরপর আমার চুরি-টুরি করার প্রয়োজন হয় নাই কখনো।
কিন্তু চুরির শিকার আমি বরাবরই হইছি।
বছরে দুই-তিনবার আমার ফোন চুরি হয়। মেমরি কার্ড চুরি হয়। জুতা-মোজা সব চুরি হয়। আর কলম-পেন্সিলের কথা বাদই দিলাম। যেদিন স্কুল/কোচিং থেকে কলম-পেন্সিল সব অক্ষত অবস্থায় নিয়ে আসতে পারি ওইদিন আমার মনটাই ভাল হয়ে যায় খুশিতে। বছরের পর বছর আমি এরকম জিনিসপত্র হারায়ে হারায়ে আসছি। প্রতিবার জিনিস-পত্র হারাবার পরে আমার একটু একটু মন খারাপ হয়, মনে মনে নিজেকে অপদার্থ বলে গালি দেই, এখন থেকে কেয়ারফুল হয়ে থাকব বলে প্রতিজ্ঞা করি এবং পরে পরে সব আবার ভুলে যাই আর আবার আমার জিনিস হারায়।
অবশ্য আমার কপাল অনেক বেশি ভাল। আমি সব ব্যাপারে ঠিক যতখানি কেয়ারলেস, আমার সব বন্ধু-বান্ধব ততটুকুই কেয়ারফুল। তাই বন্ধু-বান্ধবদের কারণে এই জীবনে আমার যতটুকু ধরা খাওয়ার কথা ছিল অতটুকু ধরা আমি খাই নাই। সবসময় আমার সব কিছু আমার বন্ধুবান্ধবরাই সামলায়ে রাখে।
কিন্তু এসএসসি’র পরে স্কুল, স্কুলের বন্ধু-বান্ধব ছেড়ে আমি কলেজে উঠলাম। স্কুলের ছোটখাট কলম চোর আর ছোট ক্লাসরুম ছেড়ে আমি বড় ক্লাসরুম আর বড় চোরদের মাঝে এসে পড়লাম।
যেহেতু কলেজের প্রথম প্রথম, বন্ধু-বান্ধব তেমনটা হয় নাই। হইলেও তেমনটা খাতির হয় নাই। প্রথম দিন আমার সুন্দর ফ্লাক্স গেল। মানে আমি বাসায় এসে খেয়াল করলাম যে ব্যাগে ফ্লাক্স নাই। ফ্লাক্স না পেয়ে মা সেইরকম ঝাড়ি দিছে।
এরপর দিন বৃষ্টি দেখে ছাতা নিয়ে গেলাম কলেজে। ছাতাও গেল। ওই দিন অবশ্য মা’র পাশাপাশি আমার বন্ধু-বান্ধবও আমাকে বকা দিছে, “কেমন বেহুঁশ হয়ে থাকো যে ফ্লাক্স নিয়ে যায়, ছাতা নিয়ে যায় অথচ টের পাও না?” এরপর আমার বন্ধুরা আমার ব্যাপারে সচেতন হয়ে গেছে। আমার ব্যাগ-ট্যাগ সব ওরাই সামলায়ে রাখত।
অবশ্য সামলায়ে রেখে লাভ হয় নাই। প্রতিদিনই কারো না কারো কিছু না কিছু চুরি হচ্ছেই। কারো বই, কারো খাতা, আর কলম-পেন্সিল তো আছেই। এর মধ্যে একদিন আমার কলম-পেন্সিল রাখার বক্স চুরি হয়ে গেল। ওই বক্সে আবার ১০০ টাকার একটা নোট ছিল। টাকা হারায়ে আমার খুব মন খারাপ দেখে আশেপাশের সবাই বলা শুরু করছে, “আমার ঐদিন ৫০০ হারাইছে… আমার ঐদিন ৩০০ হারাইছে…।” কিন্তু চুরিটা করে কে? চোরটাকে তো ধরতে হবে তাই না? চোর কীভাবে ধরা যায় সেইটা নিয়ে পরিকল্পনা করতে করতে আমাদের ক্লাসে আরেকটা চুরি হয়ে গেল। এইবার জেনির মোবাইল। বেচারির স্যামস্যাং ফোন। মোবাইল হারানোর পর তো আমরা মহা খ্যাপা। এইবার সবার ব্যাগ চেক করলেই ফোন পাওয়া যাবে। সবার ব্যাগ চেক করতে যখন যাচ্ছিলাম তখন জেনি আমাকে ডেকে বলেতেছে, সবার ব্যাগ চেক করা লাগবে না, আমি জানি কে চুরি করছে?
আমি বলছি, কে?
ও মুখ বাঁকায়ে বলছে, “লিজা”।
পরে আমি লিজার কাছে গেলাম।
গিয়ে বলছি, “কীরে লিজা? তোর কী মনে হয় জেনির ফোন কে চুরি করতে পারে?”
লিজা হেসে বলছে , “আমি শিওর চোরটা নীলা।”
আশেপাশে থেকে লিজার বান্ধবীরাও হ্যা হ্যা বলে উঠছে। তাদের মতে, এই ক্লাসের চোরটা নীলাই।
আমি ওদেরকে বললাম. “নীলার ব্যাগ চেক করে তো কিছু পাইলাম না!”
লিজা বলছে, “তাতে কী? এত ভালোমানুষি করে লাভ নাই। আমি বলি নীলাই চোর। এত ব্যাগ-ট্যাগ না ঘেটে জেনিরে বল নীলার ফোনটা চুরি করে নিতে। চুরির বদলে চুরি। শেষ!”
মেয়ের কথা শুনে আমি পুরাই হা। ওকে বললাম “জেনি চুরি করবে মানে?”
লিজা: “না পারলে আমারে বল, আমি মোবাইলটা মাইরা দিতেছি।”
ওর কথাবার্তা শুনে সবাই মোটামুটি শিওর হয়ে গেল যে ক্লাসের চোরটা আসলে লিজাই। আর লিজা একা না। ওর বান্ধবীরাও চুরির সাথে জড়িত।
বিষয়টা আরও ক্লিয়ার হইল যখন দুইদিন পর লিজা তার নতুন স্যামস্যাং ফোনটা নিয়ে আসল। ওর নতুন ফোন একদম জেনির চুরি হওয়া ফোনটার মতই। জাস্ট জেনির ফোনটা সাদা ছিল আর লিজারটা পিংক।
এরপর কয়েক দিন চুপচাপ ছিল। একদিন ঘুম ঘুম চোখে আমরা ম্যাডামের লেকচার শুনতেছি। হঠাৎ দেখি হইচই। একটা মেয়ের দুইটা ফোন হারাইছে। বেচারি ঈদ উপলক্ষে নতুন দামি ফোন কিনছে ঐটাই দেখাইতে আনছিলো বান্ধবীদেরকে। আর সাথে পুরান ফোনটাও ছিল। চোর দুইটা ফোনই একসাথে পেয়ে নিয়ে গেছে। তারপর ক্লাসে প্রচুর কান্নাকাটি। তবুও আমাদের ক্লাস ম্যাডামদের কোন মাথাব্যথা নাই। তাদের একটাই উত্তর “ক্লাসে ফোন আনছো কেন? খুব ভাল হইছে!”
এরপর একদিন বেতন দেয়ার সময়। এক মেয়ের পুরা বেতন, চার হাজার পাঁচশ টাকা চুরি হইল। ঐদিন আবার বেতন দেয়ার লাস্ট ডেট। মেয়ে তো কান্নাকাটি করে একটা অবস্থা। এবার সব কথা ম্যাডামের কাছে গেল। কবে, কখন, কার, কীভাবে কী কী চুরি হইছে সব আমরা ম্যাডামকে খুলে বললাম। এবার ম্যাডাম সোজা অ্যাকশনে নামছে। সব মেয়ের ব্যাগ চেক করবে।
লাস্ট বেঞ্চ থেকে চেক করা শুরু হইছে। অবস্থা এতই গুরুতর যে ম্যাডাম সবার পা থেকে মাথা পর্যন্ত সারা শরীর + ব্যাগ চেক করতেছে। সবার ব্যাগ থেকে মোবাইল, এমপিথ্রি, আইপড আরও যা যা পাওয়া গেছে সব নিয়ে নিছে। এই সব দেখে আমার অবস্থা পুরাই খারাপ। কারণ আমার ব্যাগেও ফোন আছে। তবে সেই যাত্রায় আমি বেঁচে গেছি। আমি সবসময়ই সেকেন্ড বেঞ্চে বসি। সেকেন্ড বেঞ্চ পর্যন্ত আসতে আসতে ম্যাডাম টায়ার্ড হয়ে গেছে। আর এতগুলি ফোন পাওয়া গেছে যে সেইটা দিয়ে অনায়াসে একটা মোবাইলের দোকান দিয়ে দেয়া যায়।
যাই হোক, সেদিন ম্যাডাম লিজারও পা থেকে মাথা পর্যন্ত চেক করছিল। চেক করে কিছুই পায় নাই। ব্যাগ থেকে এক টুকরা কাগজ পাওয়া গেছিল। কাগজটা নিয়েই লিজা জানালা দিয়ে ফেলে দিছে। ম্যাডাম জিগ্যেশ করছে ,“ কাগজটা ফেলে দিয়েছ কেন?”
“ম্যাডাম ঐটা গোপন জিনিস?”
“কী গোপন?”
“আমার বয়ফ্রেন্ডের চিঠি।”
এই উত্তরে ম্যাডাম আর কী বলবে ভেবে পায় নাই। রেগে-মেগে চিল্লাচিল্লি শুরু করছে। আজকালকার মেয়েরা… ভয় তো নাই তোমাদের মধ্যে… মিনিমাম লজ্জা-শরম পর্যন্ত নাই। তারপর যাদের যাদের মোবাইল পাওয়া গেছে তাদের সবার ফোন সিজড করছে। আর যাদের যাদের ফোনে “জান” টাইপ কথাবার্তা পাওয়া গেছে তাদের ফোন রেখে দিছে আর বাবাকে নিয়ে আসতে বলছে।
তো চোরের ব্যাপারে ম্যাডাম কিছুই করতে পারে নাই।
চোরের কাজ কর্ম আগের মতই চলতেছে।
এখনও রেগুলার চুরি হচ্ছে। আর প্রতিবার চুরির পর আমরাও নতুন উদ্যমে পরিকল্পনা শুরু করি। মানে চোর কে সেইটা তো আমাদের জানাই শুধু চোরটাকে হাতে-নাতে ধরতে পারাটাই হচ্ছে ব্যাপার।
কিন্তু সেইটা আসলেই অনেক কঠিন। আমাদের সব পরিকল্পনাই বিফলে যায়।
এরপর একদিন আমার মানিব্যাগ গেছে। ঐদিন আমি রাগে-দুঃখে পুরা রাস্তা (মতিঝিল থেকে পরীবাগ) হেঁটে আসছি। আর মনে মনে নিজেকে অপদার্থ বলে গালি দিছি। আর এরপর থেকে আবারও কেয়ারফুল হয়ে থাকব বলে প্রতিজ্ঞা করছি। আর আবারও মন দিয়ে নতুন পরিকল্পনা করা শুরু করছি। কিন্তু কোন ভাল পরিকল্পনা আমাদের কারো মাথাতেই আসে নাই এখনো।
বি.দ্র.
লেখার সমস্ত নাম ছদ্মনাম (পারমিতা ছাড়া)। আর পাঠকদের কেউ যদি চোর ধরার ব্যাপারে বুদ্ধি দিতে পারেন তাহলে খুবই ভালো হয়।