জানুয়ারি ৩১, ২০১৩ থেকে নিখোঁজ ছিলেন কানাডার ভ্যাংকুভারের ছাত্রী এলিসা ল্যাম।  লস অ্যাঞ্জেলসে ডাউন টাউনের সেসিল হোটেল থেকে নিখোঁজ হন তিনি। অভ্যাগতরা হোটেলের খাবার পানির রঙ আর স্বাদ বদলে যাওয়ার অভিযোগ করায় ১৫ তলা হোটেলের পানির ট্যাংক পরিষ্কার করতে গিয়ে এক হোটেলকর্মী দেখতে পান এলিসা ল্যামের মৃতদেহ পড়ে আছে ওয়াটার সাপ্লাই ট্যাংকের ভিতরে। যেখান থেকে সঞ্চালিত পানি ঊনিশ দিন ধরে পান করে চলেছেন হোটেল অভ্যাগতরা।


ফারুক আব্দুল্লাহ


ময়নাতদন্তে এই মৃত্যুকে বলা হয়েছিল “পানিতে ডুবে দুর্ঘটনাজনিত”, অটোপসি রিপোর্টে জানা গেছে মৃতের দেহে কোনো নেশাজাতীয় দ্রব্য কিংবা অ্যালকোহলের আলামত পাওয়া যায় নি। পুলিশের এই বয়ানের বাইরেও এই মৃত্যুর আরো কিছু খুঁটিনাটি ঘটনা লক্ষ্য করা যায়। যে ব্যাপারটা প্রথমেই নজরে আনতে হয় তা হল, তার মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগেও হোটেলের এলিভেটরের ক্যামেরায় তার উদভ্রান্ত আচরণের ফুটেজ।

এলিসা ল্যাম (১৯৯১-২০১৩)

এলিভেটরের ভিতরের সার্ভিলেন্স ভিডিওতে দেখা যায় এলিসা অদ্ভুত আচরণ করছিলেন। এলিভেটরের অনেকগুলি বোতাম টিপেছেন তিনি। এলিভেটরে ঢুকে এক কোনায় লুকিয়ে থেকেছেন। অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাত নেড়েছেন। যখন দেখেছেন দরজা বন্ধ হচ্ছে না তখন তিনি উদ্ভট আচরণ শুরু করলেন। হতে পারে তিনি কারো উপস্থিতি আশা করছিলেন বা কারো কাছ থেকে কিছু লুকানোর চেষ্টা করছিলেন।

ভিডিওটির ১ মিনিট ৫৭ সেকেন্ডে তার হাতের নড়াচড়া অন্য রকম, মোটেই মানুষের মত ভঙ্গিতে নয়, তখন তাকে দেখা যাচ্ছিল তিনি কথা বলছেন কারো সাথে, কোন কিছুর সাথে, কিংবা কোন কিছুর সাথেই না। তারপর তাকে বের হয়ে যেতে দেখা যায়। এলিভেটরের দরজা বন্ধ হয়।

ধারণা করা হয় ভিডিওর এ ঘটনার কিছুক্ষণ পরে এলিসা হোটেলের ছাদে যান, পানির ট্যাংকিতে ওঠেন এবং কোনোভাবে সেখানে ডুবে মারা যান।

ধারণা করা হয় ভিডিওর এ ঘটনার কিছুক্ষণ পরে এলিসা হোটেলের ছাদে যান, পানির ট্যাংকিতে ওঠেন এবং কোনোভাবে সেখানে ডুবে মারা যান।

নিরাপত্তা ক্যামেরার ফুটেজ দেখে বেশিরভাগ মানুষের মনে হতে পারে তার আচরণ মাদক-প্রভাবিত। যদিও এলিসার মাদক গ্রহণের কোন রেকর্ড নাই এবং অটোপসিতেও তার শরীরে মাদকের অস্তিত্ব ছিল না বলে জানানো হয়েছে।

সেসিল হোটেলে আত্মহত্যা ও অন্যান্য

১৯২০ সালে সেসিল হোটেল (Cecil Hotel) তৈরি হয়েছিল মূলত ব্যবসায়ীদের জন্য যারা “শহরে এক দুই রাতের জন্যে থাকেন।” তবে দ্রুত সেসিলের জাঁকজমক বাড়তে থাকে। স্কিড রো এলাকার মত এক অখ্যাত জায়গায় সাশ্রয়ী দামে দীর্ঘসময়ের জন্য ভাড়ার প্রস্তাব যাযাবর স্বভাবের খদ্দেরদের যথেষ্ট আকৃষ্ট করে। অবশ্য ‘নিরিবিলি’ হোটেলটি ক্রমে ‘অনিরাপদ’ হতে থাকে যখন এখানে বেশ কয়েকটা আত্মহত্যা এবং হত্যার ঘটনা ঘটে। তাছাড়াও এই হোটেলে সিরিয়াল কিলারদের বসবাসের ঘটনাও রটতে থাকে। হোটেলটির ইতিহাসে দুজন সিরিয়াল কিলারের নাম জড়িয়ে আছে। রিচার্ড রামিরেজ এবং জ্যাক উন্টারওয়েগার।

২০১৩ সালের জুন মাসে ডেথ রোর অপেক্ষায় থেকে মরে যাওয়া নাইট স্টকার রামিরেজ সেসিল হোটেলের সব চেয়ে উপরের ফ্লোরে থাকতেন, ১৯৮৫ সালে। তার কাছ থেকে প্রতি রাতে ভাড়া নেয়া হত ১৪ ডলার। ১৩ জন নারীর নিপীড়ক এবং খুনীকে ভবঘুরেদের ভিড়ে লক্ষ্য করা সম্ভব হয় নি। তিনি তার রক্তাক্ত কাপড় আবর্জনা ফেলার জায়গায় রেখে আসতেন সন্ধ্যার দিকে এবং ফিরতেন হোটেলের পিছনের দরজা দিয়ে।

জ্যাক উন্টারওয়েগার ১৯৯১ সালে অস্ট্রিয়ার এক ম্যাগাজিনের লস এঞ্জেলসের ক্রাইম রিপোর্টার ছিলেন, ধারণা করা হয় জ্যাক উন্টারওয়েগার সেসিলের অভ্যাগত হিসাবে থাকতে শুরু করছিলেন রামিরেজের প্রতি শ্রদ্ধাবশত। সেসিলে থাকাকালীন তিনজন পতিতাকে খুন করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

৫০ ও ৬০ এর দশকে সেসিলের কুখ্যাতি ছিল মূলত এখানের জানালা দিয়ে অতিথিদের নিচে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করার কারণে।

হেলেন গার্নি নামের একজন পঞ্চাশ বছর বয়সী নারী ১৯৫৪ সালের ২২ অক্টোবর সেসিলের সাততলা থেকে হোটেলের নামফলকে ঝাঁপায় পড়েন।

জুলিয়া মোর বলে আর একজন আটতলার রুমের জানালা থেকে লাফ দেন ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৬২ তে।

পাওলিন অটোন নামের ২৭ বছর বয়সী একজন, তার বিকারহীন স্বামীর সাথে ঝগড়া করে এই হোটেলের নয়তলার জানালা থেকে লাফ দেন। তিনি জর্জ গিয়ানি নামের ৬৫ বছর বয়সের এক পথচারীর উপর নব্বই ফুট উপর থেকে পড়েন, সেখানেই দুজনের মৃত্যু ঘটে। ঘটনাটা ঘটে অক্টোবর ১২, ১৯৬২ তে।

এই হোটেলের একজন অতিথির খুন হবার ঘটনাও আছে। “পিজিওন গোল্ডি” অসগোড নামের এক অবসরপ্রাপ্ত টেলিফোন অপারেটরকে ১৯৬৪ সালের ৪ জুন তার লণ্ডভণ্ড ঘরে মৃত পাওয়া যায়। তাকে ছুরি দিয়ে আঘাত, ধর্ষণ ও শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়েছিল। এই অপরাধের এখনো কোন সুরাহা হয় নাই।

এলিসা ল্যামের ঘটনাও সেসিলের ইতিহাসে আর একটা সংযোজন, যা থেকে মনে হতে পারে “আসলে এ জায়গার সমস্যাটা কী?”

‘ডার্ক ওয়াটার’ সিনেমা
এলিসা ল্যামের ঘটনা আশ্চর্যজনকভাবে ২০০৫ সালের হরর সিনেমা ডার্ক ওয়াটার -এর কাহিনীর মতই। এই সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্র ডাহলিয়া (ডালিয়া) তার তরুণী কন্যা সেসিলিয়াকে নিয়ে নতুন অ্যাপার্টমেন্টে আসে। এই সিনেমার দুটি নামই বেশ অদ্ভুতভাবে সেসিল হোটেলের সাথে সম্পৃক্ত। ব্ল্যাক ডাহলিয়া এলিজাবেথ সর্ট নামের একজনের ডাক নাম, যিনি ১৯৪৭ সালে আর একটা অমীমাংসিত ও নৃশংস খুনের শিকার হয়েছিলেন। লস এঞ্জেলস অবজার্ভড (LA Observed) জানায় এরকম শোনা যায় যে ব্ল্যাক ডালিয়া খুন হবার আগের রাতে সেসিল হোটেলে ছিলেন। যদিও সংস্কৃতিক ইতিহাসবিদ কিম কুপার, রিচার্ড স্কেইভ ও এসোটউরিক এই তথ্যকে শ্রেফ গুজব মনে করেন। মুভিতে ডালিয়ার মেয়ের নাম সেসিলিয়া যা সেসিল নামের সাথে মিলে।

নতুন অ্যাপার্টমেন্টে আসার পর ডালিয়া লক্ষ্য করে তার বাথরুমের সিলিং চুইয়ে কালো রঙের পানি পড়ছে। তার সূত্র ধরে সে পানির ট্যাংকিতে নাতাশা রিমস্কি নামের এক অল্প বয়সী মেয়ের মৃতদেহ খুঁজে পায়, যার কারণে পানির রঙ কালোতে বদলে গিয়েছিল। অ্যাপার্টমেন্ট মালিক এই ঘটনা জানলেও তিনি কোন পদক্ষেপ নিতে রাজি ছিল না। এলিসা ল্যামের ক্ষেত্রেও তার লাশ দুই সপ্তাহ পানির ট্যাংকিতে ছিল, যার কারণে হোটেলের অতিথিরা বিস্বাদ “কালো পানির” ব্যাপারে অভিযোগ করছিলেন।

মুভির শেষ দৃশ্যও অদ্ভুতভাবে এলিসা ল্যামের ঘটনার সাথে মিলে যায়। অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং-এর এলিভেটর কাজ করছিল না, এবং সেসিলিয়ার মায়ের ভূত তার চুল এলেমেলো করছিল। এলিসা ল্যামের মৃত্যুও কি তেমন খুন যা হলিউডের সিনেমার সাথে মেলে?

আর একটা আশ্চর্য ব্যাপার
এলিসা ল্যামের মৃতদেহ আবিষ্কারের পরপরই হোটেল সেসিলের পার্শ্ববর্তী স্কিড রো অঞ্চলে ভয়াবহ কলেরা মহামারি দেখা যায়। আর এরকম পরিস্থিতিতে কলেরা টেস্টের যে কিট ব্যবহার করা হয়, তার নাম শুনলে আপনারা বিশ্বাস যাবেন না: “ল্যাম-এলিসা”। এটা মর্মান্তিক কাকতাল!

কোন লুকাছাপা নাই তো?
লস এঞ্জেলস কর্তৃপক্ষ ২০১৩ এর জুনে ঘোষণা দেয় এলিসার মৃত্যু ‘দুর্ঘটনা’ এবং সে ‘সম্ভবত বাই পোলার’। তারপরেও কিছু প্রশ্নের উত্তর মিলছে না। কীভাবে এলিসা, তার মানসিক দুর্বলতা সত্ত্বেও হোটেলের পানির ট্যাংকি পর্যন্ত পৌঁছাতে পারল, যেখানে আসলেই যাওয়াটা দুরূহ। সংবাদকর্মীরা পানির ট্যাংকি এলাকার বর্ননা দিয়েছেন ভিডিও ক্লিপসে, জানা যায় হোটেলের ছাদে সক্রিয় অ্যালার্ম সিস্টেম আছে, এবং পানির ট্যাংকি পর্যন্ত পৌঁছানোটা বেশ কঠিন। তাহলে এলিসা অত উঁচুতে কীভাবে গেলেন? আর কীভাবে তিনি পানির ট্যাংকির ঢাকনা বন্ধ করলেন?

এলিভেটরে এলিসা ওই রকম অদ্ভুত আচরণ করছিলেন?

যে কোন রহস্যজনক/অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় কর্তৃপক্ষ তদন্তে খুব গোপনীয়তা ও অস্বচ্ছতা রাখে। আসলেই এখানে কী হয়েছিল? এ জায়গায় এত আশ্চর্য কাকতালীয় মিল কেন? কী কারণে এলিভেটরে এলিসা ওই রকম অদ্ভুত আচরণ করছিলেন? সেখানে কি খুনের কোন আচার পালন হচ্ছিল? সেসিল হোটেলেই কেন এরকম ঘটে? এই রহস্যের সমাধানে কর্তৃপক্ষের আর কোন পদক্ষেপ জানা যায় নাই। সম্ভবত ডার্ক ওয়াটার মুভির পোস্টারের শ্লোগানটাই এ জায়গায় প্রযোজ্য: “কিছু কিছু রহস্যের সমাধান নাই!”

উল্লেখ্য, সনি পিকচার্স সিসেল হোটেলের এ ঘটনা নিয়ে একটি ছবি বানাচ্ছে। নাম The Bringing। এতে এলিসা ল্যামের মৃত্যুর তদন্তে আসা এক ব্যক্তির দুঃস্বপ্ন নিয়ে ছবির কাহিনী তৈরি হয়েছে।