ট্রাই নট টু ব্রেথ উপন্যাসটির কাহিনী সাসপেন্স থ্রিলার ধরনের। আরো নির্দিষ্ট করে বললে, সাইকোলজিক্যাল সাসপেন্স থ্রিলার।
বইটির কাহিনী যতটা সম্ভব সংক্ষেপে বলার চেষ্টা করি।
১৯৯৫ সালের একটি সাড়া জাগানো ঘটনা ছিল অ্যামি স্টিভেনসন। ১৫ বছর বয়সী কিশোরী অ্যামি স্টিভেনসন একদিন স্কুল থেকে বাড়িতে আসার পথে নিখোঁজ হয়ে যায়। তিনদিন পরেই তাকে পাওয়া যায়, কিন্তু সে তখন কোমায়। অ্যামির আক্রমণকারী কে ছিল তা আর উদঘাটন হয় নি। তখন প্রতিটি সংবাদপত্রের প্রধান আলোচনার বিষয় ছিল অ্যামির এই ঘটনা।
এরপর অ্যামিকে নিয়ে আর কোনো আলোচনা হয় নি।
১৫ বছর পরে অ্যালেক্স ডেল নামের একজন নারী রিপোর্টার কোমায় থাকা পেশেন্টদের নিয়ে একটি রিপোর্ট তৈরির করার জন্য হাসাপাতালে গেলে সেখানে অ্যামিকে আবিষ্কার করে। সে দেখে অ্যামি হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছে।
অ্যালেক্স ডেল অ্যামিকে দেখে কিছুটা ধাক্কা খায়। তার মনে হয় অ্যামির ঘটনাটি যেন গতকালের ঘটনা। অ্যালেক্স এতটাই আলোড়িত হয় যে সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে অনেকদিন আগের এই কেসটি সে সমাধান করবে।
এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায় অ্যালেক্সের ব্যক্তিগত সমস্যা। সে প্রচণ্ড অ্যালকোহল আসক্ত। অ্যালকোহল আসক্তির কারণে তার বিয়ে ভেঙে গেছে, কাজের জায়গায় তার বদনাম রয়েছে। এই অ্যালকোহল আসক্তির কারণে অ্যালেক্স ডেল কোনো কিছুই নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে না।
অ্যালেক্স এটাকে চ্যালেন্জ হিসেবে নেয় যে, সে অ্যামি স্টিভেনসনের আক্রমণকারীকে খুঁজে বের করবে, এবং একই সাথে নিজের এই অ্যালকোহল আসক্তি থেকেও বের হয়ে আসবে। অ্যামির নিখোঁজ হওয়ার জন্য অ্যামিরই খুব কাছের একজনকে সন্দেহ করে সে।
বইটিতে কাহিনী বর্ণনার ধরনটি মজার।
অ্যামি আর অ্যালেক্স দুজনের বর্ণনার মাধ্যমেই কাহিনী আগাতে থাকে। বর্তমানের ঘটনা বর্ণনা করতে থাকে অ্যালেক্স, এবং কাহিনী যত বাড়তে থাকে, বোঝা যায় যে অ্যালকোহল আসক্তির কারণে তার সমস্যা হচ্ছে। অ্যালেক্স যে তার সমস্যার সাথে ফাইট করছে তা তার বর্ণনা থেকে বোঝা যায়। আর একই সাথে সেই সময়ের অর্থাৎ ১৯৯৫-এর ঘটনা বর্ণনা করতে থাকে অ্যামি স্টিভেনসন। ঘটনা চলে যায় ফ্ল্যাশব্যাকে। অ্যামির বর্ণনায় মনে হয় সে যেন অনেক আগের সেই ঘটনাগুলি কুয়াশার ভিতর দিয়ে দেখার চেষ্টা করছে। অথবা যেন ঘুমের মধ্যে দেখা ভুলে যাওয়া স্বপ্নের কথা আস্তে আস্তে মনে করার চেষ্টা করছে।
অধিকাংশ থ্রিলারে যেরকম হয়, শেষের ঘটনা চমকে দেয়, শ্বাসরুদ্ধকর কিছু একটা ঘটে, এখানেও তাই।
এই উপন্যাস প্রকাশিত হওয়ার পরে পলা হকিন্সের দ্য গার্ল অন দ্য ট্রেন বইটির সাথে এটির তুলনা করা হয়েছিল। কিন্তু তা তুলনা মাত্র। তুলনার কারণ ছিল দ্য গার্ল অন্য দ্য ট্রেইনের মূল চরিত্র ও এই উপন্যাসের অ্যালেক্স, দুজনেরই ঘটনা অনুসন্ধানের সময় নিজেদের ব্যক্তিগত সমস্যা সামনে চলে আসে। পলা হকিন্সের দ্য গার্ল অন দ্য ট্রেনের সাথে এই উপন্যাসের কাহিনীর কোনোই মিল নেই, দুইটি দুই গ্রহের। দুই উপন্যাসের কাহিনীর পার্থক্য আরো বোঝানোর জন্য হয়ত বলা উচিৎ—দুইটি দুই গ্যালাক্সির।
ট্রাই নট টু ব্রেথ উপন্যাসের চরিত্রগুলি জটিল ধরনের। ফলে উপন্যাসটি সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার হিসেবে ভালোভাবেই এগিয়ে গেছে।
যুক্তরাজ্যের লেখিকা হলি সেডনের প্রথম উপন্যাস ট্রাই নট টু ব্রেথ। এটি প্রকাশিত হয়েছে ২০১৬ এর ২৩ ফেব্রুয়ারি। এর আগে ২০১৪ এর নভেম্বরে কয়েকজন লেখকের গল্প নিয়ে একটি বই প্রকাশিত হয়েছিল, সেখানে হলি সেডনের গল্প ছিল। কয়েকটি ডাইস্টোপিয়ান গল্পের সংকলন ছিল সেই বইটি, নাম ব্রোকেন ওয়ার্ল্ড। এছাড়া হলি সেডানের প্রকাশিত আর কোনো বই নেই। সেই দিক থেকে এই ট্রাই নট টু ব্রেথই হলি সেডনের এককভাবে প্রকাশিত প্রথম বই। এটি প্রকাশ করেছে ব্যালানটাইন বুকস। লেখালেখি শুরু করার আগে হলি সেডন যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সংবাদপত্রে ১৫ বছর সাংবাদিকতা করেছেন।
হলি সেডনের লেখার ধরন বা বর্ণনার ধরন নিয়ে কিছু বলার নেই, তবে তার কাহিনী নির্মাণ বা ঘটনা নির্মাণ নিয়ে কিছু বলা যায়। যেহেতু এটি হলি সেডনের প্রথম উপন্যাস, সেই কারণে বা হয়ত অন্য কোনো কারণে অনেকদিন আগের একটি কোল্ড কেস অর্থাৎ অ্যামি স্টিভেনসনের ১৯৯৫ সালের সেই নিখোঁজের ঘটনা ঠিক ততটা উত্তেজনাকর ও থ্রিলিং হয়ে ওঠে নি। কাহিনী এগিয়েছে সাধারণ ডিটেকটিভ উপন্যাসের ভঙ্গিতে, কিন্তু শেষপর্যন্ত অপরাধ আর উপন্যাসটির কেন্দ্রে থাকে না। বরং অপরাধকে ভিত্তি করে পারিবারিক ড্রামা হয়ে ওঠে।
জিলিয়ান ফ্লিনের বিখ্যাত উপন্যাস গন গার্লে এই জিনিসটি ঘটেছিল। কাহিনী শেষ পর্যন্ত ডোমেস্টিক ড্রামা হয়ে ওঠে। গন গার্লে এই ব্যাপারটি কাজ করলেও ট্রাই নট টু ব্রেথ উপন্যাসের ক্ষেত্রে সেরকম কাজ করে নি। এর আগে ব্রোকেন ওয়ার্ল্ড বইয়ের সেডনের সায়েন্স ফিকশন গল্প ‘গ্র্যাজুয়েট স্কিম’-এও কাহিনীর প্ল্যাটফর্ম বদলে যাওয়ার এই ব্যাপারটি ছিল। আমার মনে হয়, আগেই কাহিনীর ফলাফল বা পরিণতি নিয়ে সেডন বেশি ব্যস্ত হয়ে ওঠেন, তিনি আগে থেকেই হয়ত একটা ফিনিশিং নির্ধারণ করে তারপর কাহিনী আগাতে থাকেন। উপন্যাসের জন্য এটা ক্ষতিকর।
প্রথম উপন্যাস প্রকাশের পর হলি সেডন তার লেখার ধরন, প্লট ডেভেলপ করা ইত্যাদি বিষয়ে একটি ব্লগ লিখেছেন। সেখানে সেডন জানিয়েছেন, উপন্যাসের ফার্স্ট ড্রাফট লেখার সময় তিনি কোনো ফিকশন পড়েন না। অন্য কারো লেখার ধরন বা স্টাইল যাতে তার লেখায় ঢুকে না যায়, এই কারণে তিনি এই ব্যাপারে খুব বেশি সতর্ক থাকেন।
তবে উপন্যাস লেখার সময় তিনি ফিকশনের ভিতর থাকার জন্য প্রচুর টিভি দেখেন। উপন্যাস লেখার আগে, পরে এবং উপন্যাস লেখার সময়ও প্রচুর টিভি সিরিজ দেখেন সেডন। এ ক্ষেত্রে সেডন দুইটি নিয়ম মেনে চলেন। ১, খারাপ টিভি শো দেখবেন না। ২, গ্রেট টিভি শো বাদ দিবেন না।
সেডন বলেন, এখন ‘টেলিভিশন’ শব্দটি উচ্চারণ করলে আমরা আগে যে অর্থ বোঝাতাম সেটা আর নেই। আগে টেলিভিশন সেন্টার থেকে লোকাল এরিয়ালে, তারপরে আমাদের টিভি বাক্সে ছবি আসত। এখন আমাদের বাক্স যে কোনো কিছুই হতে পারে অ্যাপল টিভি, প্লে স্টেশন বা ল্যাপটপ। টিভি বলতে এখন আমরা পর্বভিত্তিক বা ধারাবাহিক কোনো জিনিস বোঝাই। ‘টিভি’কে আমরা এখন একটা ইভেন্টের মত দেখি ও সেভাবেই গ্রহণ করি।
পর্বভিত্তিক ধারাবাহিক কনটেন্ট হিসেবে আমরা হয়ত প্রথাগত টিভি, যেমন বিবিসি ফোরের ক্রাইম থ্রিলার দ্য ব্রিজ দেখতে পারি। আবার টিভি বলতে আমরা এখন স্যাটেলাইট বা কেবল, যেমন স্কাই টিভিতে ব্রডওয়াক অ্যাম্পায়ার দেখতে পারি। আবার একই সাথে টিভি বলতে আমরা ইন্টারনেটের শো যেমন নেটফ্লিক্সের নার্কোস বা আমাজন প্রাইমের ট্রান্সপারেন্ট দেখাকেও বোঝাই।
নিজের লেখার ক্ষেত্রে টিভি সিরিজ কীভাবে কাজ করে সে প্রসঙ্গে সেডন বলেন, গ্রেট টিভি সিরিজগুলি এমনভাবে আগায় যে এগুলির খুব শক্ত স্ট্রাকচার থাকে, আবার কাহিনীর একটা পর্যায়ে এসে সেই স্ট্রাকচার ভেঙেও যায়। এই জিনিসটি যে কাউকে অপ্রত্যাশিত একটা কিছুর মুখোমুখি দাঁড়া করিয়ে দিতে পারে। যেমন দ্য সোপরানোস টিভি সিরিজের শেষের ঘটনাটির কথা এখানে বলা যায়। আবার চরিত্র নির্মাণের জন্য আওয়ার ফ্রেন্ডস ইন দ্য নর্থ টিভি সিরিজটির কথা বলা যায়।
টিভি সিরিজের প্রসঙ্গে সেডন আরেক লেখিকার রেফারেন্স দিয়েছেন—ক্যাট্রিয়না চাইল্ড। ট্র্যাকম্যান ও সুইম আনটিল ইউ কান্ট সি দ্য ল্যান্ড এর লেখিকা ক্যাট্রিয়না চাইল্ড টিভি সিরিজ নিয়ে বলেছেন, কিশোর বয়স থেকে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার জার্নিটা ঠিকভাবে ধরার জন্য বাফি দ্য ভ্যাম্পায়ার হচ্ছে একটি অসাধারণ কাজ।
সেডন বিখ্যাত আওয়ার ফ্রেন্ডস ইন দ্য নর্থ, দ্য অয়ার সহ অনেক বিখ্যাত টিভি সিরিজের উদাহরণ দিয়েছেন।
সেডন বলেন, আমি জানি সবাই দ্য অয়ারের কথা এত বেশি শুনেছে এবং দেখেছে যে আবার শুনলে হয়ত বিরক্ত হয়ে যাবে… কিন্তু হাজার হাজার কারণ আছে যে লোকজন এটার কথা বলে বেড়ায়। কাহিনীর প্রতি লেখকদের ডেডিকেশন, চরিত্রদের ভাগ্য, তাদের অ্যারোগেন্স, তাদের নিজেদের ভুল ঠিক করা, বাস্তবের মত ডায়লগ, ‘সব সময়, ভুল জায়গা’—এই সত্যের নির্মমতা, সব কিছু নিয়ে দ্য অয়ার।
সেডন বলেন, ভালো ফিকশন হলো ভালো ফিকশন, আপনার যদি মনে হয় আপনি ফিকশন লিখতে পারবেন, তাহলে কলম বা কিবোর্ড তুলে নিন, মিডিয়াম কোনো ব্যাপার না।