ইতিহাসের বিখ্যাত চরিত্র রাসপুতিন। রাসপুতিনের পুরো নাম গ্রিগরি ইয়েফিমোভিচ রাসপুতিন। তিনি ছিলেন একজন কৃষক।
ইতিহাসে রাসপুতিনের প্রভাবশালী হয়ে ওঠার পিছনে ছিল তার অন্য পরিচয়। তিনি ছিলেন আধ্যাত্মিক নেতা। আধ্যাত্মিক ক্ষমতার মাধ্যমে তিনি অসুখ সারাতেন। তখনকার রাশিয়ার প্রভাবশালী নারীদের মধ্যে রাসপুতিনের প্রচণ্ড জনপ্রিয়তা ছিল। তাদের সাথে রাসপুতিনের গভীর সখ্য ছিল।
রাশিয়ার সর্বশেষ জার দ্বিতীয় নিকোলাই এর পরিবারের খুবই আস্থাভাজন বন্ধু ছিলেন রাসপুতিন।
১৯০৭ সালে জারের পুত্র আলেক্সেইর রোগমুক্তি ঘটাতে গিয়ে রাসপুতিন রয়্যাল ফ্যামিলির ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। জার দ্বিতীয় নিকোলাই ও সম্রাজ্ঞী আলেক্সান্দ্রিনার একমাত্র ছেলে আলেক্সেই দুরারোগ্য হেমোফিলিয়াতে আক্রান্ত হয়। চিকিৎসকেরা জার ও সম্রাজ্ঞীকে বলে দিয়েছিল খুব শীঘ্রই আলেক্সেই মারা যাবে। কিন্তু রাসপুতিন ধীরে ধীরে আলেক্সেইর অসুখের উপশম ঘটাতে সমর্থ হন। আলেক্সান্দ্রিনা বিশ্বাস করতেন একমাত্র রাসপুতিনই তার ছেলেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবে। এভাবেই রাসপুতিন খুব দ্রুত ক্ষমতাবানদের কাছে প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন।
রাসপুতিনকে অনেকবার হত্যা করার চেষ্টা করা হয়েছিল। তাকে হত্যা করার এই ষড়যন্ত্রগুলিতে তৎকালীন রাশিয়ার প্রভাবশালী ব্যক্তিরাই জড়িত ছিলেন। প্রতিবারই যেন রাসপুতিন দৈবক্রমে বেঁচে যাচ্ছিলেন।
তখনকার রাশিয়ার সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি ছিলেন প্রিন্স ফেলিক্স ফেলিক্সোভিচ ইয়ুসুপভ। তার স্ত্রী প্রিসেন্স ইরিনা আলেক্সান্দ্রোভনা ছিলেন রাশিয়ার গ্র্যান্ড ডিউক আলেক্সান্ডার মিখাইলোভিচের একমাত্র কন্যা ও দ্বিতীয় নিকোলাই এর একমাত্র ভাগ্নী।
১৯১৬ সাল। রাশিয়ার রাজনীতিতে রাসপুতিন তখন অনেক প্রভাবশালী হয়ে উঠেছেন। ইয়ুসুপভ কয়েক মাস ধরে রাসপুতিনের সাথে দেখা করছিলেন তার চিকিৎসার জন্য। ইয়ুসুপভ রাসপুতিনকে তার প্যালেসে দাওয়াত করলেন। ইরিনা তখন কোরেইজ নামক একটি জায়গায় বেড়াতে গেছেন। ইয়ুসুপভ রাসপুতিনকে জানালেন প্রিন্সেস ইরিনা এরই মধ্যে ফিরে আসবে এবং ওই হাউজপার্টিতে ইরিনার সাথে রাসপুতিনের দেখা হবে।
১৭ ডিসেম্বর, শনিবার মধ্যরাতে ইয়ুসুপভ ড. স্তানিস্লাস দে লাজোভার্তের সাথে রাসপুতিনের অ্যাপার্টমেন্টে যান। ইয়ুসুপভ এত রাতে সাধারণ সিঁড়ি ব্যবহার না করে উঠানের সিঁড়ি ব্যবহার করেন। রাত একটার দিকে রাসপুতিন সহ তারা ইয়ুসুপভের গাড়িতে করে তার প্যালেসে আসেন। ইয়ুসুপভের প্যালেসে মদ রাখার ঘরের সাথেই আরেকটি সাউন্ডপ্রুফ রুম ছিল। এই রুমটি তারা আগে থেকেই প্রস্তুত করে রেখেছিলেন। বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি মদের চারটি বোতল তারা জানালার তাকে রেখে দিয়েছিলেন। উপরের তলায় ড্রইং রুমে অন্য ষড়োযন্ত্রকারীরা—গ্র্যান্ড ডিউক দিমিত্রি পাভলোভিচ, পুরিসকেভিচ, ল্যাজোভার্ত, সুখোটিন, ইয়ুসুপভের মায়ের এক বন্ধু অপেক্ষা করছিলেন। আরো কয়েকজন অতিথিতেকেও পার্টিতে দাওয়াত করা হয়েছিল।
ইয়ুসুপভ ও রাসপুতিন আধ্যাত্মিকতা, অলৌকিক ক্ষমতা ও রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করছিলেন। ইয়ুসুপভ রাসপুতিনকে সায়ানাইড মিশ্রিত চা অফার করলে রাসপুতিন তা গ্রহণ করেন। আলোচনার এক পর্যায়ে ইয়ুসুপভ ও রাসপুতিন ক্রিমিয়ার সেরা ও ইয়ুসুপভের নিজের বাগানের তৈরি মদ পান করতে থাকেন। ঘণ্টা খানেক পরে রাসপুতিন বেশ মাতাল হয়েছেন, ইয়ুসুপভ উঠে দোতলায় চলে যান এবং রিভলভার হাতে ফিরে আসেন। ইয়ুসুপভ খুব কাছ থেকে রাসপুতিনকে গুলি করেন। রাসপুতিনের পাকস্থলী ও কলিজা ভেদ করে শরীরের ডান পাশ দিয়ে গুলি বেরিয়ে যায়। সাথে সাথে রাসপুতিন মেঝেতে একটি সাদা ভালুকের চামড়ার উপর পড়ে যান।
কিন্তু ইয়ুসুপভের গুলিতেও রাসপুতিন মরেন না। কিছুক্ষণ পর রাসপুতিন চোখ খোলেন এবং নিজের অবস্থা সম্পর্কে সচেতন হন। তিনি অনেক কষ্টে উঠে দৌড়ে গিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকেন। নিচে নেমে উঠানের দিকের একটা দরজা খুলে ফেলেন রাসপুতিন। আওয়াজ শুনে পুরিসকেভিচ দ্রুত নিচে নেমে আসেন এবং রাসপুতিনের দিকে চারটি গুলি করেন।
তিনটিই মিস হয়। একটা গুলি রাসপুতিনের পিছন দিকে, ডান কিডনি দিয়ে ঢুকে মেরুদণ্ডে আটকে যায়। গেট পর্যন্ত যেতে পারেন না তিনি, তার আগেই বরফের ওপর পড়ে যান। এরপর তারা তার দেহ ভিতরে নিয়ে আসেন। ইয়ুসুপভ তখন অনেক নার্ভাস হয়ে গেছেন। তিনি রাসপুতিনের ডান চোখে পা দিয়ে অনেক জোরে আঘাত করেন। যে দুটি গুলি রাসপুতিনের লেগেছিল, দুটিই মারাত্মকভাবে লেগেছিল, ১০-২০ মিনিটের মধ্যে তার মারা যাওয়ার কথা। কিন্তু এরপরও রাসপুতিনের দেহ হঠাৎ নড়ে ওঠে। এতে ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে একজন রাসপুতিনের কপালে রিভলভার ঠেকিয়ে ট্রিগারে চাপ দেন।
বাইরে থেকে দুইজন পুলিশ সদস্য গুলির আওয়াজ শুনতে পেয়েছিল। তার পাশাপাশি বিভিন্ন গাড়ির আসা যাওয়াও তাদের নজরে পড়েছে। পোচতামতস্কি ব্রীজে দাঁড়িয়ে পুলিশ দুইজন এই নিয়ে আলোচনা করছিল। তাদের একজন এসে ইউসুপভের বাড়ির একজন বেয়ারাকে এই নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। তাকে কোনোরকমে বুঝিয়ে ফেরত পাঠানো হয়। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে আবার সেই পুলিশ ব্যক্তিটিকে প্যালেসে ডেকে আনা হয়। পুরিসকেভিচ স্বীকার করে যে সে রাসপুতিনকে গুলি করেছে। সে পুলিশকে বলে যে এটা ভুলবশত হয়েছে এবং অনুরোধ করে যে জারের মঙ্গলের কথা চিন্তা করে সেই পুলিশ যেন চুপ থাকে। সেই পুলিশ যা শুনেছে এবং দেখেছে, সব তার সুপারভাইজরকে বলে দেয়।
রাসপুতিনের পশমি কোট, জুতা ও হাতের গ্লাভস পড়ে ছদ্মবেশ নেয় সুখোটিন। রাসপুতিন জীবন্ত অবস্থায় প্যালেস থেকে বের হয়েছে এটা দেখানোর জন্য রাসপুতিনের পোশাকে সুখোটিন দিমিত্রি পাভলোভিচ ও ড. ল্যাজোভার্তের সাথে পুরিসকেভিচের গাড়িতে করে চলে যায়। ষড়যন্ত্রকারীরা রাসপুতিনের সব জিনিস পুড়িয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়। পুরিসকেভিচের স্ত্রী তাদের অ্যাম্বুলেন্স ট্রেনের ছোট্ট ফায়ারপ্লেসে রাসপুতিনের পশমি কোট ও রাবারের জুতা পোড়াতে অস্বীকৃতি জানান। এই কারণে, তারা এইসব জিনিস সাথে করে আবার প্যালেসে ফিরে আসেন।
ছদ্মবেশে পাভলোভিচ ও ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্য থেকে আরো দুয়েক জন রাসপুতিনের দেহ উলের কাপড়ে মুড়িয়ে গাড়িতে করে ক্রেস্তভস্কি দ্বীপের দিকে নিয়ে যান। মালায়া নেভকা নদীতে রেলিং এর এপার থেকে একটি বরফের গর্তে রাসপুতিনের দেহ ও তার সব জিনিস গাড়ি থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে তারা ফিরে আসেন। কিন্তু তাদের অলক্ষ্যে রাসপুতিনের একটি জুতা রেলিং এর খুঁটিতে আটকে যায়। বরফের নিচে পড়ার পরে রাসপুতিনের কোট বাতাসে ফুলে উঠে, এতে মৃতদেহে একটি বরফের চাইয়ের সাথে আটকে যায়। এর ফলে মৃতদেহটি আর সাগরের দিকে ভেসে যায় না।
পরদিন শনিবার, সকাল আটটায় রাসপুতিনের অ্যাপার্টমেন্টে পুলিশ আসল; তার মেয়েদেরকে জিজ্ঞাসা করলো, তাদের বাবা কোথায়।
সকাল এগারোটা পর্যন্ত রাসপুতিনের কোনো সন্ধান পাওয়া গেল না। এই খবর সম্রাজ্ঞীর কাছে পৌঁছে। সম্রাজ্ঞীর আদেশে পুলিশ তদন্ত শুরু করে। তদন্ত করতে গিয়ে ইয়ুসুপভের প্যালেসের পিছনের দরজার সিঁড়িতে রক্তের দাগ দেখতে পায় পুলিশ। ইয়ুসুপভকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে, সত্য ঢাকতে তিনি মিথ্যার আশ্রয় নেন। তিনি বলেন, গ্র্যান্ড ডিউক দিমিত্রি দুর্ঘটনাবশত তার একটি কুকুরকে গুলি করে ফেলেছে, এটা সেই রক্তের দাগ। ইয়ুসুপভ ও দিমিত্রি পরের দিন, অর্থাৎ রবিবারে সম্রাজ্ঞীর সাথে দেখা করার চেষ্টা করে। সম্রাজ্ঞী তাদেরকে না করে দেয়, বলে, দেখা করতে না পারলেও কী ঘটনা তা সম্রাজ্ঞীর কাছে চিঠি লিখে তারা ব্যাখ্যা করতে পারবে। পুরিশকেভিচ তাদের দুজনকে চিঠি লিখতে সহায়তা করে এবং রাত দশটায় মস্কো ছেড়ে চলে যায়।
পরীক্ষায় যখন ধরা পড়ে যে সিঁড়িতে পাওয়া সেই রক্ত আসলে মানুষের, তখন দিমিত্রি ও ইয়ুসুপভকে গৃহবন্দি করা হয়। ইয়ুসুপভ পুলিশকে বলতে অস্বীকৃতি জানায় যে দেহ কোথায় রয়েছে। বিকালের দিকে পেত্রোভস্কি ব্রিজে রক্তের দাগ পাওয়া যায় এবং ব্রিজের নিচে রাসপুতিনের একটি জুতাও পাওয়া যায়।
মাঝরাতে রাসপুতিনের দুই মেয়ে নিশ্চিত করে যে এটা রাসপুতিনের জুতা। দেরি হয়ে গেলেও পুলিশ বুঝতে পেরেছিল কোন জায়গায় তদন্ত করতে হবে। ১৯ ডিসেম্বর, সোমবার সকালে, রাসপুতিনের সেই পশমের কোট এবং তার মৃতদেহ নদীতীরের খুব কাছেই পাওয়া যায়। ব্রিজ থেকে এই জায়গাটির দূরত্ব ছিল ১৪০ মিটার। ১৫ মিনিটের মধ্যে সরকারি কর্মকর্তা ও পুলিশ কর্মকর্তারা এসে পৌঁছায়।
রাসপুতিনের লাশ জমে বরফ হয়ে গিয়েছিল। লাশটি সেই জায়গা থেকে চেসমেনস্কি আলমহাউজে নিয়ে যাওয়া হয়। সন্ধ্যায় কসোরোতভ নামে একজন ফারেনসিক এক্সপার্ট লাশের ময়নাতদন্ত করেন। ময়নাতদন্তে দেখা যায়, রাসপুতিনের শরীরে তৃতীয় গুলিটি লাগলে তিনি মারা যান। তৃতীয় গুলি লেগেছিল ফ্রন্টাল লোবে। প্রথম এবং তৃতীয় গুলি খুব কাছে থেকে তার শরীরে লেগেছিল। তার শরীরে অ্যালকোহল পাওয়া গেছে, কিন্তু তার ফুসফুসে কোনো পানি বা পাকস্থলীতে কোনো সায়ানাইড পাওয়া যায় নি।
২১ ডিসেম্বর একটি জিঙ্কের কফিনে করে রাসপুতিনের মৃতদেহ চেসমে চার্চে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে লাশ নিয়ে যাওয়া হয় সম্রাজ্ঞীর ও রাসপুতিনের মধ্যকার বার্তাবাহিকা ভাইরুবোভার বাড়ির কোণায় রাসপুতিনকে কবর দেওয়ার জন্য।
ভাইরুবোভার বাড়ি জারের প্যালেসের সাথে লাগোয়া ছিল। সকাল আটটা পয়তাল্লিশ মিনিটে রাসপুতিনকে কবর দেওয়া হয়। কবর দেওয়ার সময় সেখানে জার, জারিনা, তাদের কন্যারা উপস্থিত ছিলেন। সেই দিনই, পরে, ইরিনার বাবা গ্র্যান্ড ডিউক আলেক্সান্দার মিখাইলোভিচ জারকে চিঠি লেখেন কেসটি বন্ধ করে দেওয়ার অনুরোধ করে।
এক সপ্তাহ পরে, কোনো জিজ্ঞাসাবাদ ও বিচার ছাড়াই জার গ্রান্ড ডিউক দিমিত্রি পাভলোভিচ ও ইয়ুসুপভকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেন। তিনি নিশ্চিত করেন, রাসপুতিনের হত্যার বিচারকার্জে কোর্ট আর কখনো হস্তক্ষেপ করবে না।
২৪ ডিসেম্বর, পরের শনিবার বেলা দুইটায় দিমিত্রি পারস্যের উদ্দেশ্যে এবং ইয়ুসুপভ বেলগ্রেডের উদ্দেশ্যে মস্কো ছেড়ে যান। পুলিশকে হুকুম দেওয়া হয়েছিল তারা যেন তদন্ত থামিয়ে দেয়।
রাশিয়ান বিপ্লবে রুমানভদের পতনের পরে রাসপুতিনের দেহ কবর থেকে তোলা হয় এবং জঙ্গলের ভিতরে নিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয়।
রাসপুতিনের মৃত্যুর পরে জার নিকোলাই তার পরিবারের দেখাশোনা করেছেন। কিন্তু ১৯১৭ সালের মার্চে জারের পতনের পরে তার পরিবারকে দেখাশোনা করার কেউ থাকে না, ফলে তারা আবার সাইবেরিয়াতে তাদের গ্রামেই ফিরে যায়।