দ্য লাস্ট অব আস উপন্যাসটির কাহিনী আসলে টিকে থাকা বা সারভাইভ করার কাহিনী। সারভাইভিং স্ট্রাগল এর কাহিনী নিয়ে এত বেশি উপন্যাস আর সিনেমা হয়েছে এবং হচ্ছে যে এটা এখন খুব কমন একটা ক্যাটেগরি। এমনকি ‘দ্য লাস্ট অব আস’ নামে ২০১৩ সালের একটি দারুণ ভিডিও গেমও আছে।
রব এউয়িং এর দ্য লাস্ট অব আস উপন্যাসটিকে বলা যাবে অন্যদের চেয়ে আলাদা। বা নতুন। তা বলা যাবে তিনটা কারণে—এক, এই উপন্যাসের কাহিনীতে যে বিপর্যয় বর্ণনা করা হয়েছে সেটা; দুই, যে পরিবেশের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে সেটা এবং তিন, এই উপন্যাসের চরিত্রের ধরন।
কয়েকটা বাচ্চার টিকে থাকার চেষ্টার কাহিনী এই উপন্যাস। কাহিনী সম্পর্কে বলার আগে ছোট একটা অংশ তুলে দেই, তা থেকে হয়ত তাদের পরিস্থিতির তীব্রতা বোঝা যাবে।
‘ আমরা কি পাহাড়ের ওপরে গিয়ে বোতল ছুঁড়ে ফেলতে পারি?’
—আমরা বোতল ছুঁড়ে ফেলি না, আমরা মেসেজ পাঠাই। সবকিছুর পেছনেই একটা উদ্দেশ্য থাকতে হবে।
‘কেন?’
—কারণ ভাইরাসের কারণে আমরা আমাদের বড়দের হারিয়েছি। কারণ আমরা একা।
এবার দ্য লাস্ট অব আস উপন্যাসের কাহিনী সম্পর্কে বলি।
অনেক দূরের একটা স্কটিশ দ্বীপে হঠাৎ এক ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ মারা যায়। কাছাকাছি বয়সের পাঁচজন শিশু শুধু বেঁচে থাকে। হঠাৎ করে বদলে যাওয়া এই অবস্থায় তারা দলবদ্ধ হয়। এই পরিবেশের ভয়াবহতা বুঝতে পারে তারা। তারা বুঝতে পারে নিজেদেরকে রক্ষা করতে হবে। তাদের কাজকর্ম থেকে মনে হয় তারা যেন অবচেতনে নিজেরা টিকে থাকার অর্থ খোঁজার চেষ্টা করছে।
তারা পরিত্যক্ত বাড়িগুলিতে প্রয়োজনীয় জিনিস খুঁজে বেড়ায়। অনেক বাড়ির ভিতরেই মানুষের লাশ। কোথাও কোথাও পোষা কুকুর বিড়াল মরে আছে। তাদের হাতে আর কোনো অপশন নেই। তারা গন্ধ থেকে টের পায় কোন বাড়িতে ঢুকতে হবে আর কোন বাড়ি এভয়েড করতে হবে। যেসব বাড়িতে তারা ঢুকতে পারে সেখান থেকে পড়ে থাকা খাবার, খাওয়ার পানি সংগ্রহ করে। বোঝার চেষ্টা করে কোন ধরনের ওষুধ তাদের কী কাজে লাগতে পারে।
দ্য লাস্ট অব আস এর কাহিনী আগায় রোনা নামের আট বছর বয়সী একটা মেয়ের বর্ণনায়। তার বর্ণনায় কাহিনী কখনো কখনো বিপর্যয়ের আগের অবস্থায় ফিরে যায়। আবার হঠাৎ করে বর্তমানে অর্থাৎ তাদের এই সারভাইভিং স্ট্রাগলের কাহিনীতে ফিরে আসে। দ্য লাস্ট অব আস পড়তে থাকলে, রোনার বর্ণনা যখন তাদের বিপর্যয়ের মুখোমুখি করিয়ে দেয় তখন এক ধরনের ধাক্কা বা শক কাজ করে।
দ্য লাস্ট অব আস উপন্যাসটিতে আট বছর বয়সী রোনা বলতে থাকে এভাবে:
‘ একজন অনুসন্ধানকারী হলে কোনোকিছু জানার ব্যাপারে আপনার দক্ষতা বাড়ে। আমি এখন জানি কয়েক মাস ধরে এক কাপ চা পড়ে থাকলে তা দেখতে কেমন হয়।… যখন আপনি দেখবেন কুকুরগুলি বাড়ির দরজায় পড়ে আছে আর বিড়ালগুলি পড়ে আছে জানালায় তখন কুকুর এবং বিড়ালের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত টিকে থাকার চেষ্টার পার্থক্য বুঝতে পারবেন।’
পাঁচজন শিশুর এই দলের নেতা এলিজাবেথ। সে অনেক প্র্যাকটিক্যাল, শান্ত, সবার ভার বহন করে। সে খুবই সেনসিবল। সে সবার যত্ন নেয়।
এলিজাবেথ সবাইকে রুটিন অনুসরণ করায়। এলিজাবেথের নির্দেশে তারা নিয়মিত দাঁত ব্রাশ করে, রেডিওতে সিগন্যাল খোঁজার চেষ্টা করে, তাদের টর্চের জন্য ব্যাটারি সংরক্ষণ করে, প্রয়োজনীয় জিনিসের লিস্ট করে ও পরিত্যক্ত বাড়িগুলিতে সেই জিনিসগুলি খুঁজতে বের হয়।
তাদের টিকে থাকার যুদ্ধ আরো স্বাভাবিক করতে এলিজাবেথের নির্দেশে তারা নিজেরা একটা স্কুল পরিচালনা করে এবং নিজেরাই সেই স্কুলে শিখে। স্কুলের জন্য তারা নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলে। সবকিছুর জন্যই তাদের নিয়ম আছে। তাদের কাছে আরো আছে প্রচুর লিস্ট—বিভিন্ন জিনিসের ও বিভিন্ন বিষয়ের লিস্ট। তারা ভুলে যাওয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকে। তারা আশা করতে থাকে বড়দের কেউ একজন হঠাৎ চলে আসবে এবং তাদের বাঁচাবে।
এলিজাবেথ সবসময়ই একটা শব্দের ওপর জোর দেয়। বাকি শিশুদেরকে স্মরণ করতে বলে শব্দটি—‘বিফোর’ অর্থাৎ ‘আগে’।
এলিজাবেথ বলে, আমাদের শুধু মনে রাখার ব্যাপারটিই আছে। আমাদের অতীত সবচেয়ে মূল্যবান। এটাকে সঠিক হতে হবে।
কিন্তু রোনা অন্যরকম ভাবে। তার চাওয়া—‘নতুন একটা শেষ। যেখানে আর কেউ অসুস্থ হবে না, ইলেক্ট্রিসিটি ফিরে আসবে।’
রোনার স্মরণশক্তি কমতে থাকে। তার মায়ের সাথের শেষ স্মৃতিগুলি তাকে যন্ত্রণা দেয়। সে তার মায়ের সাথে কথা বলে, তার সাহায্য চায়, তার স্মৃতি মনে করে। রোনা তার মাকে স্বপ্নে দেখে, তার হ্যালুসিনেশন হয়। এই ব্যাপারটি রবার্ট এউয়িং খুব কাব্যিক ও লিরিক্যালভাবে বর্ণনা করেছেন। একই স্মৃতি বারবার মনে করা ও অতীতকে জোর করে ধরার চেষ্টার মধ্য দিয়ে কয়েকটা বাচ্চার অসহায়ত্ব বোঝা গেছে। তাদের সারভাইভের চেষ্টার ব্যাপারটি আরো তীব্র হয়ে উঠেছে।
কাহিনী বাঁক নেয় যখন দলের দুই সদস্য, দুই ভাই ক্যালাম ইয়ান ও ডানকান এলিজাবেথের নেতৃত্বকে অগ্রাহ্য করে। এলিজাবেথ যেখানে চায় শৃংখলা ও নিয়ম মানার মধ্য দিয়ে পরিস্থিতির বিরুদ্ধে ফাইট করতে, ক্যালাম ইয়ান তার সম্পূর্ণ বিপরীত। সে চায় তার হঠাৎ পাওয়া এই স্বাধীনতাকে কাজে লাগাতে।
ক্যালাম ইয়ান ও ডানকানের ঝামেলার কারণে তাদের সব কাজকর্ম, সারভাইভিং পদ্ধতি, পরিকল্পনা সবকিছু বদলে যায়। ঘটনাগুলি একটার পর একটা পালটে যায়। এই পর্যায়ে কাহিনী খুব থ্রিলিং হয়ে ওঠে। দলটি ভেঙে যায়। দলটির সবচেয়ে ছোট সদস্য অ্যালেক্সের শরীরে ইনসুলিনের সমস্যা রয়েছে, তার প্রতিদিন ইনসুলিনের দরকার হয়। ইয়ান ও ডানকানের বিদ্রোহের কারণে অ্যালেক্সের জীবন বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়ে। কাহিনীর এই পর্যায়ে এসে একটা নার্ভাসনেস কাজ করে।
একটা সমস্যা যে হঠাৎ করে ভাইরাসের কারণে একটি দ্বীপের পুরো একটা গোষ্ঠীর উজাড় হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটি অবিশ্বাস্য মনে হয়। কিন্তু যে কোনো পোস্ট-অ্যাপোক্যালিপ্টিক গল্প বা কাহিনীর ক্ষেত্রে আসল ব্যাপারটি হলো—যারা পড়বে তাদের বিশ্বাস তৈরি করে নেওয়া, কাহিনীকে সত্য করে তোলা। রবার্ট এউয়িং সাঙ্ঘাতিকভাবে সত্য একটি কাহিনী বলেছেন। আমি বেশ কিছু ডাইস্টোপিয়ান ও পোস্ট অ্যাপোক্যালিপটিক কাহিনী পড়েছি এবং এই ধরনের অনেক সিনেমা দেখেছি, আমার কাছে দ্য লাস্ট অব আস এর কাহিনী খুবই কনভিন্সিং মনে হয়েছে।
রবার্ট এউয়িং এর আরেকটি কৌশল সুন্দরভাবে কাজ করেছে। উপন্যাসের কাহিনীতে ভাইরাস আক্রমণে দ্বীপের সবগুলি মানুষ মারা যাওয়ার ঘটনার খুব বেশি ডিটেইলিং নেই। পাঁচজন বাচ্চার স্মৃতিতে এই বিপর্যয় নিয়ে নির্দিষ্ট কোনো কমন বক্তব্য নেই। যা আছে তা খণ্ড খণ্ড চিত্র। সবারই সেই বিপর্যয়ের স্মৃতি আছে, তবে তা সামগ্রিক নয়, সবার জন্যই আলাদা আলাদা।
রবার্ট এউয়িং মধ্য স্কটল্যান্ডের ফলকির্ক গ্রামে বেড়ে উঠেছেন। চিকিৎসক হওয়ার জন্য তিনি অ্যাবারডিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। স্কটল্যান্ডের একটা ছোট দ্বীপে অল্প কয়েকজন মানুষের সাথে তিনি বেশ কয়েক বছর বসবাস করেছেন। এর আগে বিভিন্ন পত্রিকায় তার কবিতা ও ছোটগল্প প্রকাশিত হয়েছে। দ্য লাস্ট অব আস রবার্ট এউয়িং এর প্রথম উপন্যাস।
দ্য লাস্ট অব আস উপন্যাসটি ২০১৬ এর ২১ এপ্রিল দ্য বোরাহ প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়েছে।
দ্য লাস্ট অব আস নামে ভিডিও গেমটিও পোস্ট-অ্যাপোক্যালিপ্টিক কাহিনীর। তবে দুইটারই কাহিনী আলাদা, কোথাও কোনো মিলের ছায়া পর্যন্ত নেই। দুইটাই নিজের নিজের জায়গায় অসাধারণ। বরং গেমটার কাহিনীতে হলিউডি প্রভাব আছে, এই গেম থেকে হিউ জ্যাকম্যান অভিনীত একটি সিনেমাও তৈরি হয়েছে, ২০১৬ সালে মুক্তি পাবে। সেই দিক থেকে উপন্যাসটির কাহিনী আলাদা এবং নতুন।
দ্য লাস্ট অব আস উপন্যাসটি বাচ্চাদের কাহিনী হওয়ায়, সারভাইভিং স্ট্রাগলের তীব্রতা অনেক কাছে থেকে টের পাওয়া যায়। পড়তে পড়তে একটা সময় মনে হয়, এই পাঁচজন শিশু যদি এই দ্বীপ ছেড়ে না যায় তাহলে নিশ্চিত তারা মারা যাবে। উপন্যাসটিতে পরিবেশ অনুযায়ী শিশুদের সাইকোলজি এতটাই বাস্তবের মত, যে পড়বে তাকে অনেক জায়গায়ই টাচ করবে। উপন্যাসটিতে আশেপাশের নিরানন্দ ল্যান্ডস্কেপের বর্ণনা কাহিনীটাকে আরো পারফেক্ট করেছে।
পড়তে শুরু করলে ৩০০ পৃষ্ঠার বইটি অনেক ছোট মনে হয়।