বর্তমান পৃথিবীর সবচাইতে বড় প্রাণী তিমি। তবে শুধু দৈহিক আকৃতির দিক থেকেই নয়, অন্যান্য বহু অনুষঙ্গেও তিমির বিশালতা তুলনাহীন। এমনকি তাদের মলত্যাগের পরিমাণও এর মাঝে পড়ে।

আমেরিকার দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার উপকূলের ওপর দিয়ে পর্যবেক্ষণের এক পর্যায়ে মেরিন বায়োলজিস্ট এডি কিসফালুডি নীল তিমির ফেলে যাওয়া বিপুল পরিমাণ বর্জ্য দেখতে পান এবং তার ছবি তুলে রাখেন।

এডি’র তোলা সেই ছবিতে একটি নীল তিমির পাশেই তার ফেলে যাওয়া হালকা কমলা রঙের বিষ্ঠা দেখা যায়।


ব্র্যানডন কেইম
অয়্যার্ড, ৮ সেপ্টেম্বর ২০১২


এই কমলা রঙের উৎস নীল তিমির প্রধান খাবার চিংড়ী জাতীয় মাছ ‘ক্রিল’। যদিও ছবিটি ঠিক কত দূর থেকে তোলা হয়েছিল তা নির্দিষ্ট নয়, তবে ধারণা করা হয়েছে—তিমির ফেলে যাওয়া সেই বিষ্ঠা, আকৃতির দিক থেকে একটি পূর্ণাঙ্গ নীল তিমির প্রায় সমান। ছবিটিকে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় আয়তনের বিষ্ঠার নমুনা ধরা যায়।

সাম্প্রতিক সময়ে মেরিন বায়োলজিস্টদের কিছু গবেষণার সত্যতা প্রমাণেও ভূমিকা রাখে ছবিটি। তারা বলেন, কেঁচো যদি প্রকৃতির লাঙল হতে পারে তাহলে নীল তিমিকেও সাগরতলের লাঙল ধরে নেওয়া যায়। সাগরতলের পরিবেশে পুষ্টি আর কার্বন চক্রে নানাবিধ ভূমিকা রাখায় নীল তিমিকে সমুদ্র জগতের অন্যতম মূল চালিকাশক্তি ধরা হচ্ছে এখন।

বায়োলজিস্টদের মতে, তিমি এবং অন্যান্য যেসব সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী রয়েছে, তারা সাগরের উপরিভাগের পানি উর্বর করতে সাহায্য করে।

ইউনিভার্সিটি অফ ভেরমন্টের বায়োলজিস্ট ‘জো রোমান’ এবং হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির জুওলজিস্ট জেমস ম্যাককার্থি ২০১০ সালে মেইন উপসাগরের হাম্পব্যাক তিমির বর্জ্য পরীক্ষা করেন। এই পরীক্ষার মাধ্যমে তারা ‘হোয়েল পাম্প’ নামের একটি ধারণার জন্ম দেন।

তিমির বিষ্ঠার আশ্চর্য ক্ষমতা
মেরিন বায়োলজিস্ট এডি কিসফালুডির তোলা ছবিতে নীল তিমি ও কমলা রঙের বর্জ্য

এই ধারণা অনুযায়ী, সাগরের গভীরে খাদ্যগ্রহণের পর উপরিভাগে চলে আসা তিমি মলত্যাগের মাধ্যমে সাগরের ইউফোটিক জোন নাইট্রোজেন পূর্ণ করে দেয়। এই ঊর্ধ্বমুখী হোয়েল পাম্পের কার্যকারিতার পেছনে তিমির পাশাপাশি সিল মাছেরও ভূমিকা আছে।

তিমির বিষ্ঠা পশমের মত নরম আর তুলতুলে। ঠিক এই কারণেই তা পানির উপর ভেসে থাকতে পারে। এর আগে সমুদ্রের নাইট্রোজেন আর কার্বন প্রবাহের উপর যত ধরনের গবেষণা চালানো হয়েছিল, তার সবই এদের নিম্নমুখী গমনের ব্যাপারে আগ্রহী ছিল বেশি। কিন্তু হোয়েল পাম্প ধারণার ফলে নাইট্রোজেন আর কার্বনের ঊর্ধ্বমুখী আগমনের বিষয়টি গবেষণায় উঠে আসে। ফলে আমরা জানতে পারি কীভাবে এই নাইট্রোজেন সমুদ্রের উপরের অংশের পানিকে উর্বর ও উজ্জীবিত করতে সাহায্য করে। এতে প্রচুর পরিমাণে প্ল্যাংকটন উৎপাদিত হয়—ফলে যেসব সামুদ্রিক প্রাণী প্ল্যাংকটন খেয়ে বেঁচে থাকে তাদের সংখ্যাও বেড়ে যায়।

ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে তিমি শিকারের আগে মেইন উপসাগরে প্রাকৃতিক উৎসের চাইতে তিন গুণ বেশি নাইট্রোজেন সরবরাহ করত তিমি। এমনকি বর্তমানে সেই সময়ের চাইতে তিমির সংখ্যা বিপুল পরিমাণে কমে যাওয়ার পরেও তিমি নাইট্রোজেন সরবরাহ করেই যাচ্ছে। মেইন উপসাগরে যেসব নদী এবং উপনদী মিলিত হয়—তাদের সরবরাহকৃত মোট নাইট্রোজেনের চাইতেও এর পরিমাণ বেশি। হয়ত এই কারণেই মেইন উপসাগর সামুদ্রিক জীব দিয়ে এতটা সমৃদ্ধ।

জলজ উদ্ভিদ এবং প্রাণীরা বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে প্রচুর পরিমাণে কার্বন শোষণ করে। এরপর সেই কার্বন সমুদ্রতলের মাটিতে প্রাকৃতিকভাবে পুঁতে ফেলে তারা। জলজ জীবদের দ্বারা সংঘটিত এই কার্বন চক্রকেই ‘আয়রন ফার্টিলাইজেশন’ প্রক্রিয়ার মূলনীতি ধরা হয়ে থাকে।

যা পরবর্তীতে সাগরের সারফেস লেভেলে আয়রনের পরিমাণ বাড়াতে সাহায্য করে; এই আয়রনের উপস্থিতি আবার ফাইটোপ্ল্যাংকটনের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করে। আর ফাইটোপ্ল্যাংকটন তাদের সালোকসংশ্লেষণের জন্য কার্বন শোষণ করে যা সবশেষে ‘গ্লোবাল ওয়ার্মিং’ প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে।

তিমির বিষ্ঠার আশ্চর্য ক্ষমতা
হোয়েল পাম্প ধারণার ফলে নাইট্রোজেন আর কার্বনের ঊর্ধ্বমুখী আগমনের বিষয়টি গবেষণায় উঠে আসে। ফলে আমরা জানতে পারি কীভাবে এই নাইট্রোজেন সমুদ্রের উপরের অংশের পানিকে উর্বর ও উজ্জীবিত করতে সাহায্য করে। এতে প্রচুর পরিমাণে প্ল্যাংকটন উৎপাদিত হয়—ফলে যেসব সামুদ্রিক প্রাণি প্ল্যাংকটন খেয়ে বেঁচে থাকে তাদের সংখ্যাও বেড়ে যায়। (The Whale Pump: Marine Mammals Enhance Primary Productivity in a Coastal Basin)

এইদিক থেকে দেখলে, তিমিকে এক রকম ‘জিও-ইন্জিনিয়ার’ বলা যায়। দক্ষিণ মহাসাগরের তিমিরা শুধু মলত্যাগের মাধ্যমেই প্রতি বছর প্রায় ৪ লাখ টন কার্বন ডাই অক্সাইড বায়ুমণ্ডল থেকে পৃথক করে থাকে। তিমি শিকারের আগের সময়টাতে একটি কয়লা চালিত পাওয়ার প্ল্যান্ট প্রতি বছর যে পরিমাণ কার্বন নির্গত করে তা খুব সহজেই বায়ুমণ্ডল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত তিমিদের মাধ্যমে।

একসময় শুধু অ্যান্টার্কটিক মহাসাগরেই ২ লাখের মত নীল তিমি ছিল। অথচ সারা বিশ্বে এখন এই সংখ্যা মাত্র ৮ হাজারের কাছাকাছি। কাজেই তিমিরা পরিবেশের উপকারে যে ধরনের অবদান রেখে এসেছে তা নিশ্চিতভাবেই আগের তুলনায় অনেক অনেক কমে গেছে।

আরো পড়ুন: ‘আর্জেন্টাইন অ্যান্ট’―শত কোটি পিঁপড়ার আগ্রাসী মেগা কলোনি

বিশাল আকৃতির অন্যান্য মেরুদণ্ডী যেসব প্রাণী রয়েছে, যেমন—সী বার্ড এবং সিল মাছ—এদের দ্বারাও পরিবেশ নানাবিধ পুষ্টি উপাদান পেয়ে থাকে। কিন্তু এদের কোনোটিই তিমির মত তা এতটা ব্যাপক ও বৃহৎ পরিমাণে সরবরাহ করতে পারে না।

মোট কথা, নীল তিমির বিষ্ঠা তাদের ইকোসিস্টেমে এবং সেই ধারাবাহিকতায় আমাদের সমগ্র পরিবেশে বরাবরই অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে আসছে।

অনুবাদ: আয়মান আসিব স্বাধীন