আগের পর্ব ।  পর্ব ১

সিজন ১, এপিসোড ৭

ট্রম্প লে

ওয়েস্টওয়ার্ল্ড এর ৭ নাম্বার এপিসোড আসার পরে যেটা নিয়ে উত্তেজনা শুরু হয়েছে সেটা আসলে এই এপিসোডের শেষের ৭ মিনিট। এই পর্বের শেষের ৭ মিনিটে যেটা প্রকাশ পেয়েছে সেটা আনএক্সপেক্টেড, এবং হ্যাঁ, কিছুটা এক্সপেক্টেডও।

ওয়েস্টওয়ার্ল্ড এর কাহিনীতে যেহেতু এখন প্রচণ্ড গতি চলে আসছে, এই পর্বেও কাহিনী অনেক দ্রুত এগিয়েছে। তবে পুরা পর্বটা ওই ৭ মিনিটের অংশটুকুর দিকেই গেছে।


আশরাফুল আলম শাওন


আমি জানতাম ৭ নাম্বার পর্বে কিছু একটা আছে। দেখতে বইসা দেখি যে কাহিনীতে জটিলতা তৈরি হইতেছে, কিন্তু সেই সারপ্রাইজিং কিছু একটা আর হয় না। ১৫ মিনিট যায়, ৩০ মিনিট যায়। তখন মনে পড়ল আমি টিভি সিরিজের কনভেনশন কাউন্ট করতেছি না। স্টোরির খুব উত্তেজনাকর ঘটনা দেখাবে একবারে শেষে—এই কনভেনশন।

এই পর্ব শুরু হয় বার্নাডকে দিয়ে। প্রোগ্রামার বার্নাড তার মৃত ছেলেকে স্বপ্নে দেখে। খুব নরমালি চলতে থাকে সবকিছু—বার্নাড হোস্ট হেক্টরের অ্যানালাইসিস চালায়; উইলিয়াম, ডোলোরেস ও লরেন্জ ট্রেনে করে ফিরতেছে পারায়াহ থেকে; থেরেসা বোর্ড এক্সিকিউটিভ শার্লট হেলের সাথে মিটিং করে।

ট্রম্প লে
প্রোগ্রামার বার্নাড তার মৃত ছেলেকে স্বপ্নে দেখে

থেরেসার সাথে শার্লটের মিটিংটা নিয়ে একটু বলি। ঠিক সময়ে থেরেসা যখন মিটিং এর জন্য শার্লটের রুমে যায়  শার্লট তখন হোস্ট হেক্টরের সাথে সেক্স করতেছে। ওই অবস্থায়ই সে খুব নরমালি দরজা খুলে থেরেসাকে ভিতরে আসতে বলে।

শরীরে একটা রোব জড়ায়ে, সোফাতে আধশোয়া হয়ে, খুবই ক্যাজুয়াল মুডে থেরেসার সাথে কথা বলতে শুরু করে।

শার্লট এইখানে বোর্ড এক্সিকিউটিভ, মানে কর্পোরেট। শার্লটের এই আচরণ—অন্যকে সম্মান না দেওয়া, সিরিয়াসনেস শো না করে সিরিয়াস বিষয় ডিল করা, সবসময় কনজাম্পশনের মধ্যে থাকা—এইগুলি এখানে কর্পোরেট-এর আচরণ হিসেবে দেখানো হয়েছে।

এইচবিও যেহেতু একটা বড় কর্পোরেশন, এবং সবসময়ই নিজেদের ব্যবসা-স্বার্থ চিন্তা করতে থাকে এই কারণে সিরিজের ক্রিয়েটর ও ডিরেক্টরদের স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে তারা। কর্পোরেশন যেহেতু পাওয়ারফুল, ফলে ক্রিয়েটিভরা, মানে সিরিজের ক্রিয়েটররা এই নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাইতে পারে না।

ট্রম্প লে
শার্লটের এই আচরণ—অন্যকে সম্মান না দেওয়া, সিরিয়াসনেস শো না করে সিরিয়াস বিষয় ডিল করা, সবসময় কনজাম্পশনের মধ্যে থাকা—এইগুলি এখানে কর্পোরেট-এর আচরণ হিসেবে দেখানো হয়েছে।

শার্লটের মাধ্যমে কর্পোরেটকে এভাবে দেখিয়ে জোনাথন নোলান কি ইঙ্গিতে বোঝালেন যে কর্পোরেটের মেধা ক্রিয়েটিভদের বা যারা প্র্যাকটিক্যালি কাজ করে তাদের চেয়ে কম? এক ধরনের সূক্ষ্ম রিভেঞ্জ নিলেন?

তাই যদি নিয়ে থাকেন তাহলে এইগুলি ইনোসেন্ট ধরনের প্রতিশোধ। যার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়া হইল এতে তার কিছুই আসে যায় না। যে নিল তার এক ধরনের অর্থহীন আত্মসন্তুষ্টি হয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে ওই ক্ষমতার অধীনেই থাকতে হয়।

জোনাথন নোলানের এইরকম সাইকোলজি থাকতে পারে, এটা আমার কী কারণে মনে হল?—এই পর্বেই পরে আরেকটা ঘটনা আছে।

শার্লট হেল একটা স্বচ্ছ কাচে নিজের ঝাপসা প্রতিবিম্ব দেখতে থাকে, তখন রবার্ট ফোর্ড প্রবেশ করে। ফোর্ড সামনে আসতে আসতে শার্লটরে বলে, মিস হেল, আই ওয়াজ নট অ্যাওয়ার দোজ উইদ ইয়োর লেভেল অব ইনসাইট নিডেড অ্যানি মোর রিফ্লেকশন। (মিস হেল, আমি জানতাম না আপনার মত অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষের আরো রিফ্লেকশনের দরকার হয়।)

স্পষ্টভাবেই ফোর্ডের এই কথাটা একটা খোঁচা।

শার্লট থেরেসাকে বলে, ‘ডেলোস’ কর্পোরেশন এখানকার কর্মী এবং হোস্টদের ব্যাপারে কেয়ার করে না। তাদের সমস্ত আগ্রহ এই প্রজেক্টের কোড (কম্পিউটার কোড) নিয়ে। ৩৫ বছরের র ইনফরমেশন এই পার্কের ভিতরে আছে। ফোর্ড এগুলিকে বাইরে যাইতে দেয়নি। এই কোডগুলির নিয়ন্ত্রণ নেয়ার জন্য ফোর্ডকে রিটায়ার করার প্রস্তাব দিতে হবে।

ট্রেন জার্নিতে ডোলোরেস ও উইলিয়াম একজন আরেকজনের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে।

ওয়েস্টওয়ার্ল্ড টিভি সিরিজের একটা লক্ষ্য করার মত জিনিস হল ওয়েস্টওয়ার্ল্ড অ্যান্টি-এরোটিক। একটা পর্বে বড় একটা অর্জি চলতেছিল, অনেক সেক্স সিন আছে, প্রচুর ন্যুড ফিগার দেখাচ্ছে এই সিরিজে—কিন্তু এইসব সিনে কোনো সেনসেশন নাই। খুবই প্লেইন।

নোলানদের আগের সিনেমাগুলিতেও এই ব্যাপারটা আছে। নোলানদের ছবিতে যে দুয়েকটা সেক্স সিন আছে সেগুলির একটাও এরোটিক না। কোনো গ্লোরিফিকেশন, সেনসেশন নাই। এমনভাবে দেখানোর উদ্দেশ্য হইতেছে, ইট’স জাস্ট লাইক সাম আদার হিউম্যান হ্যাবিটস, নট এ বিট মোর দ্যান দ্যাট।

তবে এই পর্বে ডোলোরেস আর উইলিয়ামের সেক্স সিন কিছুটা এরোটিক। উইলিয়ামের প্রতি ডোলোরেসের প্যাশনের কারণে এটা হয়েছে। একটা সিনথেটিক মেয়ে বা রোবট এবং একজন মানুষের মধ্যে সত্যিকারের ইমোশন তৈরি হইছে, এখন এই দৃশ্যকে এরোটিক দেখানো হয়ত দরকার ছিল!

থেরেসা আর শার্লট, ফোর্ড আর বার্নাডকে প্রমাণ করে দেখায়, যে-হোস্টদের রিসেট করা হয় না তাদের প্রোগ্রাম আবার চালু করলে তাদের মধ্যে আগের মেমোরির কিছু অংশ থেকে যায়, এটা খুব ঝুঁকিপূর্ণ। তাদের ইঙ্গিত, বার্নাড আর ফোর্ডই এর জন্য দায়ী।

অন্যদিকে, ওয়েস্টওয়ার্ল্ড এর রেগুলার প্রস্টিটিউট হোস্ট মেইভ ল্যাবরেটরিতে আসার জন্য ইচ্ছা করেই বার বার কারো হাতে খুন হয়। ল্যাবরেটরিতে দুই টেকনিশিয়ানকে ব্ল্যাকমেইল করে মেইভ নিজেকে আপডেট করে, নিজের প্রোগ্রাম চেইন্জ করে সে প্রায় মানুষের কাছাকাছি চলে যায়।

এই ব্যাপারটা গল্পের জন্য দুর্বল—টেকনিশিয়ানদের হাতে মেইভের ইন্টারফেস, তারা মেইভের কথামত কাজ করছে, অথচ তাকে রিসেট বা ডিঅ্যাক্টিভ করতে পারতেছে না! আর ওয়েস্টওয়ার্ল্ড টিমের অন্য কেউ সেটা বুঝতে পারছে না!—এইটা লজিক্যালি দুর্বল আসলে।

এই পর্বে এড হ্যারিস—দ্য ম্যান ইন ব্ল্যাককে দেখায় নাই।

থেরেসা আর বার্নাড পার্কের ভিতরে গোপন একটা ল্যাবরেটরি খুঁজে পায়। ৬ নাম্বার পর্বে ফোর্ড যে বাড়িতে আনরেজিস্টার্ড হোস্টদের রেখেছিল সেটার বেজমেন্টে। সেই ল্যাবরেটরিতে থেরেসা কিছু স্কিমেটিক খুঁজে পায়। স্কিমেটিক একটা ইন্জিনিয়ারিং টার্ম। কোনো প্রজেক্ট বা মডেলের ড্রইং বা নকশা হচ্ছে স্কিমেটিক। থেরেসা সেই স্কিমেটিকগুলির মধ্যে দেখে বার্নাডের স্কিমেটিকও আছে। তার মানে বার্নাড হোস্ট! থেরেসা শকড! আর বার্নাড যেহেতু হোস্ট, সে এমনভাবে প্রোগ্রাম করা যে নিজের স্কিমেটিক তার চোখে ধরা পড়ে না।

ফোর্ড আসে। সেই সাইলেন্স অব দ্য ল্যাম্বস এর অ্যান্থনি হপকিন্স। ডায়লগ সুন্দর এখানে।

ফোর্ড বলে, হোস্টদের ইমোশোনালি হিট করতে পারে এমন কিছু তারা দেখতে পায় না বা শুনতে পায় না। হোস্টদের অস্তিত্ব আমাদের চেয়ে খাঁটি। কারণ হোস্টদের আত্মঘৃণা, গিলটি ফিলিং, উদ্বেগ এসব নাই। থেরেসা ফোর্ডকে বলে, ইউ আর এ মনস্টার।

ফোর্ড উত্তর দেয়, অ্যাম আই? তোমরাই তো খুব শান্তভাবে হোস্টদের ধ্বংস করতে চেয়েছ। ফোর্ড বলে, আমার কাছে মনে হয়েছে, মানুষের এত বেশি কনসাশনেস মানুষের জন্য বারডেন। আমি হোস্টদের এই ভার থেকে মুক্তি দিয়েছি। হোস্টস আর ফ্রি হিয়ার আন্ডার মাই কন্ট্রোল।

ফোর্ড থেরেসাকে বলে, আমি বলছি, এই কারণেই বার্নাড তোমাকে এখানে নিয়ে আসছে।

থেরেসা আবার শকড! উইদ এ বিট কনফিউশন। থেরেসা সাহস নিয়ে ফোর্ডকে বলে, আপনার এইসব কিছুর দিন শেষ হয়ে আসছে, আপনার গডের রোল প্লে করার দিন শেষ।

ফোর্ড বলে, আই সিম্পলি ওয়ান্টেড টু টেল মাই স্টোরিজ। ইট ওয়াজ ইউ পিপল হু ওয়ান্টেড টু প্লে গড উইদ ইয়োর লিটল আন্ডারটেকিং।

ট্রম্প লে
ফোর্ড বার্নাডকে হুকুম দেয় থেরেসাকে মেরে ফেলার জন্য

ফোর্ড খুব অ্যাগ্রেসিভলি বলে, এই জায়গা সে কাউকে তার হাত থেকে নিতে দিবে না। দ্য সিচুয়েশন ডিমান্ডস এ ব্লাড স্যাক্রিফাইস। ফোর্ড বার্নাডকে হুকুম দেয় থেরেসাকে মেরে ফেলার জন্য।

এই শেষ দৃশ্যের কারণেই সাত নাম্বার পর্ব উত্তেজনা তৈরি করেছে। বার্নাড হোস্ট—এই ব্যাপারটাই অনেকগুলি সম্ভাবনা এবং স্পেকুলেশন সামনে নিয়ে আসছে।

ওয়েস্টওয়ার্ল্ড এর সায়েন্টিফিক গ্রাউন্ডের সাথে রিলেটেড এ রকম কিছু বলি, প্রতি পর্বেই যেহেতু বলা হয়। গত পর্বে বলছিলাম হিউম্যান ব্রেইনের কথা। নেচারাল ইনটেলিজেন্স বা হিউম্যান ব্রেইন যেভাবে কোনো কিছু শিখে এবং সে অনুযায়ী পরে ডেভেলপ করে সেইটা জাস্ট অসাধারণ! বাচ্চারা যেভাবে কোনো কিছু শিখে সেইটা অবজার্ভ করলেই এইটা বুঝতে পারার কথা।

হিউম্যান ব্রেইন নিয়ে একটা এক্সপেরিমেন্টে তিন খণ্ড কুকিজের মধ্যে এক খণ্ড কুকিজ দেওয়া হচ্ছিল দেড়-দুই বছরের একটা বাচ্চাকে আর রিসার্চার নিজে নিচ্ছিলেন দুই খণ্ড। বাচ্চাটা এক্সপ্রেশনে-আচরণে প্রকাশ করছিল সে এইভাবে ভাগাভাগিটা পছন্দ করেনি। কিন্তু যখন, সেই বাচ্চার ওই এক খণ্ড কুকিজই ভেঙে দুই টুকরা করে তাকে দেওয়া হল, সে তখন খুশি।

আরেকটা ঘটনা। এইবার তিন-সাড়ে তিন বছরের একটা বাচ্চা মেয়ে। তার সামনে দুইটা গ্লাসে জুস রাখা হয়েছে। তাকে জিজ্ঞাসা করা হল কোন গ্লাসে জুস বেশি আছে। সে বলল দুটাতেই সমান সমান। এরপর একটা গ্লাসের জুস নিয়ে অন্য ধরনের একটা লম্বা চিকন গ্লাসে ঢালা হয়েছে। লম্বা চিকন গ্লাসে ঢালার কারণে এই গ্লাসে জুস অনেক উপর পর্যন্ত আসছে। আর আরেকটা গ্লাসে আগের মতই জুস আছে।

এবার তাকে জিজ্ঞাসা করা হইছে, এই গ্লাসে বেশি জুস আছে, নাকি এই গ্লাসে বেশি জুস আছে, নাকি দুটাতেই সমান সমান। সে খুব সুন্দরভাবে লম্বা গ্লাসটা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল এই গ্লাসে বেশি জুস আছে। তাকে জিজ্ঞাসা করা হইল কেন এই গ্লাসে বেশি জুস আছে? সে উত্তর দিল, কারণ এই গ্লাসটা লম্বা।

জুস কিন্তু পরিমাণের দিক দিয়ে সমানই ছিল দুই গ্লাসে। বড় কাউকে জিজ্ঞাসা করলে তাই বলত। কিন্তু বাইরে থেকে আপাতভাবে যা দেখা যাচ্ছে, এই তিন-সাড়ে তিন বছরের ব্রেইন সেটাই কাউন্ট করেছে। আবার তাকে যখন কারণ জিজ্ঞাসা করা হল, ঠিক যে কারণে জুস ওই গ্লাসে বেশি দেখা যাচ্ছে, সেটা সে ধরতে পেরেছে।

ওয়েস্টওয়ার্ল্ড এর এই পর্বে কিন্তু একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার মিসিং। এলসি। মিসিং ঠিক না এক অর্থে। একটা দৃশ্যে বার্নাড যখন একজনকে এলসির কথা জিজ্ঞাসা করে, সে জানায় সিস্টেম দেখাচ্ছে এলসি ভ্যাকেশনে আছে।

৬ নাম্বার পর্বে থেরেসা ছাড়া আর কার কথা এলসি জানতে পেরেছিল সেটা এখনও অজানা। এলসিকে কে আক্রমণ করল, সেটাও এখনও আসেনি।

(পর্ব ৮)