শর্টকাট কে না পছন্দ করে? কোনো কাজ অল্প পরিশ্রমে হয়ে গেলে বাড়তি পরিশ্রম কে করতে চায়? এমনকি যারা নিজেদের কর্মঠ মনে করেন, তাদের জীবনেও কিছু অলস মুহূর্ত থাকে। কখনও ব্যায়াম করতে ইচ্ছে করে না, কখনও বা ডেডলাইনের আগেই কোনো কাজ শেষ করার আলসেমি পেয়ে বসে। তাই এক অর্থে বলা যায়, কমবেশি আমরা সবাই কোনো না কোনোভাবে অলস।

কেন আমরা অলস হই?

জিনের প্রভাব: কাউচ পটেটো জিনের ভূমিকা

আমাদের মধ্যে কেউ কেউ শারীরিক শ্রমে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, আবার অনেকে তা এড়িয়ে যান। গবেষণার আলোকে এর কারণ বায়োলজিকাল। ২০১৮ সালের একটি গবেষণায় (প্রকাশিত: Nature Communications) দেখা গেছে, শারীরিক শ্রমের মোটিভেশন নিয়ন্ত্রণকারী জিনগুলির রূপান্তরের কারণে মানুষ অলস হয়ে থাকে। গবেষকরা এই জিনকে “কাউচ পটেটো জিন” হিসেবে অভিহিত করেছেন।

এই রূপান্তরের ফলে ডোপামাইন রিসেপ্টরগুলি সংকুচিত হয়ে যায়, যা আমাদের মোটিভেশন নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে কাউচ পটেটো জিনযুক্ত ব্যক্তিরা শারীরিক পরিশ্রমে আনন্দ পান না। এর বিপরীতে, যাদের ডোপামাইন রিসেপ্টর কার্যকর থাকে, তারা সহজেই ফিটনেস কার্যক্রমে মোটিভেটেড হন। এই জিন বংশপরম্পরায় সংক্রমিত হয়, অর্থাৎ আপনার অভ্যাস ভবিষ্যৎ প্রজন্মেও প্রভাব ফেলতে পারে।

মস্তিষ্কের শক্তি সংরক্ষণ করার প্রবণতা

অলসতার পেছনে আমাদের মস্তিষ্কের একটি স্বাভাবিক কার্যপ্রক্রিয়াও ভূমিকা রাখে। মানবদেহের ওজনের মাত্র ২% হলেও, মস্তিষ্ক আমাদের শক্তির ২০% ব্যবহার করে। ফলে এটি স্বাভাবিকভাবেই শক্তি সংরক্ষণে আগ্রহী। মস্তিষ্ক প্রায়শই “পাওয়ার সেভিং মোড”-এ চলে যায়, যার ফলে বুদ্ধিবৃত্তিক ও শারীরিক কাজ এড়িয়ে যেতে চাই।

এই প্রবণতা আমাদের অনেক সময় গভীর চিন্তা বা জটিল সমস্যার সমাধান থেকে বিরত রাখে। এটি আলসেমিকে স্বাভাবিক মনে হলেও দীর্ঘমেয়াদে এটি আমাদের দক্ষতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

আলসেমি: মানসিকতা ও আচরণের প্রভাব
অলসতা কখনও প্রোক্রেস্টিনেশন বা দীর্ঘসূত্রিতার রূপ নেয়। তা কেবল বায়োলজিকাল নয়, মানসিকতা এবং অভ্যাসের অভাবও এ জন্য দায়ী। যেমন:

ভয়ের প্রভাব: হেরে যাওয়ার ভয় অনেক সময় কাজ এড়িয়ে যাওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

জটিলতার শঙ্কা: কোনো কাজ খুব কঠিন বা জটিল মনে হলে আমরা সেটি এড়িয়ে যাই।

মনোযোগের অভাব: নির্দিষ্ট লক্ষ্য ঠিক না থাকলে কাজের প্রতি আগ্রহ কমে যায়।

আলসেমি কীভাবে আপনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে?
আলসেমি শুধুমাত্র সাময়িক স্বস্তি দেয়, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এটি দায়িত্ব এড়ানোর প্রবণতা তৈরি করে। এটি আত্মোন্নয়ন ও সাফল্যের পথে প্রধান বাধা। দিনশেষে আপনাকে বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় সব দায়িত্ব পালন করতেই হবে। তাই আজ থেকেই আলসেমি দূর করার অভ্যাস গড়ে তুলুন।

আলসেমি দূর করার কার্যকর উপায়

১. পরিকল্পনা তৈরি করুন

আপনার মস্তিষ্ক চিন্তা করতে আগ্রহী নয়, তাই আগে থেকেই কাজের পরিকল্পনা তৈরি করুন। টু-ডু লিস্টের বদলে প্রতিটি কাজের জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমা ঠিক করুন। উদাহরণস্বরূপ, প্রতিদিন বিকাল ৫টা থেকে ৬টা পর্যন্ত হাঁটার জন্য বরাদ্দ রাখুন।

২. লক্ষ্য নির্ধারণ করুন

এডুইন লকের ‘গোল সেটিং থিওরি’ অনুযায়ী, সুনির্দিষ্ট, স্পষ্ট, বাস্তবসম্মত এবং চ্যালেঞ্জিং লক্ষ্য আপনার কাজের প্রতি মোটিভেশন জাগিয়ে তোলে। যেমন, “একটি বই লিখব” এর পরিবর্তে “আগামী এক বছরে ১,০০,০০০ শব্দের একটি উপন্যাস শেষ করব” এই ধরনের লক্ষ্য নির্ধারণ করুন।

৩. কাজকে ছোট অংশে ভাগ করুন

কোনো কাজ বড় বা কঠিন মনে হলে সেটিকে ছোট ছোট ধাপে ভাগ করুন। উদাহরণস্বরূপ, একটি আর্টিকেল লেখার ক্ষেত্রে— রিসার্চ করা, আউটলাইন তৈরি, লেখা, এবং সম্পাদনার মত ধাপে কাজটি এগিয়ে নিন। এতে কাজ সহজ মনে হবে এবং ধাপে ধাপে আত্মবিশ্বাস বাড়বে।

৪. পারফেকশনিজম এড়িয়ে চলুন

কোনো কাজ নিখুঁত করতে চাইলে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সময় ব্যয় হতে পারে। প্রথমে কাজ শেষ করুন, পরে সময় নিয়ে ভুলত্রুটি সংশোধন করুন। এতে সময় সাশ্রয় হবে এবং কাজ দ্রুত সম্পন্ন হবে।

৫. শারীরিক পরিশ্রমে অভ্যস্ত হোন

প্রতিদিন শারীরিক পরিশ্রম করুন। এটি হতে পারে দৌড়ানো, যোগব্যায়াম, বা জিমে যাওয়া। নিয়মিত ব্যায়াম আপনার মস্তিষ্ককে কর্মক্ষম রাখে এবং অলসতা কমায়।

আলসেমি জীবনের স্বাভাবিক অংশ হলেও, এটি দূর করার জন্য সচেতন প্রচেষ্টা প্রয়োজন। সঠিক পরিকল্পনা, নির্দিষ্ট লক্ষ্য, এবং কার্যকর অভ্যাস আপনাকে আলসেমি থেকে মুক্ত করে দক্ষ ও সফল জীবন গঠনে সহায়তা করবে। আজ থেকেই ছোট ছোট পদক্ষেপ নিয়ে শুরু করুন, আর দেখুন কীভাবে আপনার জীবন বদলে যেতে থাকে।