সাফল্য কখনো রাতারাতি আসে না। অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সাফল্যের সমষ্টিগত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই আমরা আমাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারি। বড় কিছু অর্জনের স্বপ্ন দেখা, উচ্চাকাঙ্ক্ষা পোষণ করা, এগুলি স্বাভাবিক। কিন্তু “কীভাবে এক লাফে সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছাবো”—এই প্রশ্নের চেয়ে বরং “কোন অভ্যাসগুলি আমাকে সে লক্ষ্যে পৌঁছে দেবে?”—এই প্রশ্নটি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
আপনার জীবনে সাফল্য আনতে সাহায্য করবে এমন উনিশটি ছোট ছোট অভ্যাস এখানে তুলে ধরা হল। অভ্যাসগুলি হয়তো খুবই সাধারণ মনে হবে, কিন্তু এদের প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী।
১. যা করতে চান, তাই করুন
আপনার পরিকল্পনা অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি হতে পারে যে কোনো ছোট্ট বিষয়, যেমন কম কথা বলা বা কাজের গতি এবং পরিমাণ বাড়ানো। প্রথম ধাপ থেকেই নির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত নিয়ে এগিয়ে গেলে, আপনার লক্ষ্য অর্জনের পথ সহজ হয়ে যাবে।
২. জার্নাল রাখুন: নিজের ভাবনা সংরক্ষণ করুন
প্রতিদিন একটি ব্যক্তিগত জার্নালে আপনার অভিজ্ঞতা ও অনুভূতিগুলি লিখে রাখুন। এটি হতে পারে একটি প্যারাগ্রাফ, কয়েকটি বাক্য বা এমনকি দু’লাইন কবিতা। প্রতিদিন কোথায় গিয়েছেন, কী করেছেন এবং কেমন ছিলেন, সেই বিবরণও অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন।
এই অভ্যাস দীর্ঘমেয়াদি হলে তা আপনার আত্মবিশ্লেষণে সহায়ক হবে। জার্নালে লিপিবদ্ধ ছোট ছোট বিষয়গুলিই ভবিষ্যতে আপনার অগ্রগতির মাপকাঠি হিসাবে কাজ করবে। এটি কেবল আপনার স্মৃতিকে সংরক্ষণ করবে না, বরং নিজের লক্ষ্য ও অর্জনের ওপর স্পষ্ট ধারণাও দেবে।
৩. মিথ্যা বলা বন্ধ করুন: সততার শক্তিতে এগিয়ে যান
মিথ্যা বলা থেকে বিরত থাকুন। একবার মিথ্যার আশ্রয় নিলে, তা রক্ষা করতে অসংখ্য মিথ্যার জাল তৈরি করতে হয়, যা আপনাকে আরও জটিলতায় ফেলে দিতে পারে। এই জটিলতা কেবল আপনার লক্ষ্য অর্জনকে বাধাগ্রস্ত করবে না, বরং আপনার বিশ্বাসযোগ্যতাও নষ্ট করবে।
সততার চর্চা আপনাকে দীর্ঘমেয়াদে সাফল্যের দিকে নিয়ে যাবে। নিজের জীবনে মিথ্যা এড়িয়ে চলুন এবং সর্বদা সত্যবাদী হওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন। এটি আপনার ব্যক্তিগত এবং পেশাগত জীবনকে আরও সমৃদ্ধ করবে।
৪. বন্ধুদের জন্য সময় দিন: সম্পর্কের মূল্য বুঝুন
কাছের বন্ধুদের জন্য সময় বের করা জরুরি। সাফল্যের পথে তারা আপনার শক্তি এবং অনুপ্রেরণার উৎস হতে পারে। বন্ধুত্ব কেবল সম্পর্কের নয়, বরং মানসিক সমর্থনেরও ভিত্তি।
তাদের সঙ্গে সময় কাটানো এবং তাদের অনুভূতিগুলির প্রতি যত্নশীল হওয়া বন্ধুত্বের গভীরতা বাড়ায়। তাই কাজের ব্যস্ততার মাঝেও বন্ধুত্বের প্রতি আপনার দায়বদ্ধতা বজায় রাখুন এবং সম্পর্কগুলিকে মর্যাদা দিন।
৫. ব্যক্তিগত শখের যত্ন নিন: অনুপ্রেরণার উৎস তৈরি করুন
আপনার শখকে গুরুত্ব দিন এবং নিয়মিত চর্চা করুন। আজকের ছোট্ট শখ একদিন আপনার জীবনের বিশেষ কিছুতে রূপান্তরিত হতে পারে। শখের প্রতি ভালোবাসা এবং ধারাবাহিক চর্চা কেবল মানসিক প্রশান্তি এনে দেয় না, বরং আপনাকে সৃজনশীলতাতেও সমৃদ্ধ করে।
শখ আপনাকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও অনুপ্রেরণা দেয়। তাই এটি শুধু সময় কাটানোর মাধ্যম নয়, বরং জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক হয়ে উঠতে পারে। শখকে উপেক্ষা না করে প্রতিদিন এর জন্য সময় বরাদ্দ করুন।
৬. শারীরিক পরিশ্রম: সুস্থ জীবনের ভিত্তি
নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম করুন। এটি হতে পারে জিমে যাওয়া, যোগব্যায়াম শেখা, অথবা সামনের রাস্তায় দৌড়ানো। যেকোনো পছন্দের ব্যায়াম বেছে নিন, তবে নিশ্চিত করুন যে আপনার দৈনন্দিন রুটিনে শারীরিক পরিশ্রম অন্তর্ভুক্ত আছে।
সিঁড়ি বেয়ে ওঠার মত ছোট পরিবর্তনও আপনার স্বাস্থ্যকে উন্নত করতে পারে। তিন, চার বা পাঁচতলা সিঁড়ি উঠে যাওয়াটা বিশেষ কিছু নয়; বরং এটি দৈনন্দিন কাজকর্মকে সহজ করার শক্তি জোগাবে। শরীর সচল রাখুন, কারণ সুস্থ শরীরই সফল জীবনের প্রধান চাবিকাঠি।
৭. মানুষের সংস্পর্শে আসুন
এমন সব মানুষের সংস্পর্শে আসুন যারা আপনি শেষমেশ যা হয়ে উঠতে চান তার প্রতিনিধিত্ব করে। এটা একই সাথে অভ্যাস এবং পছন্দ।
আপনি যেখানে আছেন, বা যেখানে যাচ্ছেন তা যদি আপনার ভাল না লাগে তাহলে আশেপাশের লোকেদের দিকে একবার ভাল করে নজর দিন।
সম্ভাবনা আছে যে তাদের অবস্থাও আপনারই মত। তাই যতক্ষণ আপনি এই অবস্থা বা পরিস্থিতির মধ্যে আটকে থাকবেন, ততক্ষণ আপনাদের কারো অবস্থারই পরিবর্তন ঘটবে না।
৮. পড়ুন: জ্ঞানের দিগন্ত প্রসারিত করুন
নিজের জ্ঞান ও দৃষ্টিভঙ্গি সমৃদ্ধ করতে নিয়মিত পড়ুন। বই কেনা এবং পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন, কারণ এটি মনের বিকাশ ঘটায় এবং নতুন ধারণা গ্রহণে সহায়ক হয়।
যদি সম্ভব হয়, একটি ই-বুক রিডার সংগ্রহ করুন এবং দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বই ডাউনলোড করে পড়ুন। এটি আপনাকে বিভিন্ন বিষয়ের সাথে পরিচিত হতে সাহায্য করবে এবং আপনার চিন্তার গভীরতা বাড়াবে। পড়ার অভ্যাস কেবল জ্ঞান অর্জনের নয়, বরং নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কারের অন্যতম পথ।
৯. পরিকল্পনা তৈরি করুন
কীভাবে নিজের জীবন সাজাবেন তার একটা ছক তৈরি করুন। তার পর সেই ছকের পরিকল্পনা অনুযায়ী এগিয়ে যান।
যেমন, আগামি ৩ মাস আপনি কী কী করতে চান এবং কীভাবে করতে চান তার একটা পরিকল্পনা তৈরি করুন।
এর ফলে প্রতিটি কাজ করার ক্ষেত্রেই আপনি সচেতন থাকবেন যে কতটুকু পরিমাণে এবং কত সময়ের মধ্যে আপনাকে কাজটা শেষ করতে হবে।
জরুরি ভাবে এই অভ্যাস গড়ে তুলুন। অভ্যাস করতে গেলেই দেখবেন কত অতিরিক্ত কাজ আপনি করতে চান যা অনায়াসে বাদ দেওয়া যায়। ফলে অনেক অপ্রয়োজনীয় অভ্যাস ঝেড়ে ফেলতে আপনার সুবিধা হবে।
১০. একলা খাওয়া যাবে না
কখনোই একা খাবেন না। এমন সব মানুষের সাথে লাঞ্চ ও ডিনারে যান যাদের সাথে আপনি নিজের মিল খুঁজে পান, যাদের সাথে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন এবং যাদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখতে পারেন।
১১. পোশাকের দিকে নজর দিন
পোশাকের ক্ষেত্রে সচেতন থাকুন। কথাটা ক্লিশে শোনালেও এটা সত্যি যে আপনি যখন অন্যদের সামনে নিজেকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেন, তখন আপনার আত্মবিশ্বাস অনেক বেড়ে যায়।
তাই পোশাক নির্বাচনের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকার অভ্যাস গড়ে তুলুন।
১২. ধীরেসুস্থে কাজ করুন
“ধীরে চলো” নীতি গ্রহণ করুন। সেইসাথে নিজেকে যাচাই করে দেখাটাও শিখতে হবে। জার্নাল লেখার পাশাপাশি এই অভ্যাসগুলিও তৈরি করুন।
সব সময়ই সাফল্যের পিছনে ছোটার চিন্তা করলে হবে না। মাঝে মাঝে থেমে দম নিতে হবে এবং যাচাই করে দেখতে হবে কোথা থেকে শুরু করেছিলেন আর কতটুকু এসে পৌঁছেছেন।
১৩. অন্যদেরকে শিখান
অন্যদেরকে শিখান। নিজেকে যদি যথেষ্ট অভিজ্ঞ বলে মনে নাও হয়, তবুও এতদিনে যা যা শিখেছেন তা অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করুন।
যখন আপনি এই কাজটি করবেন, অর্থাৎ অন্যদের কাছে নিজে যা শিখেছেন তা ব্যাখ্যা করবেন, তখন আপনি নিজেই বিষয়গুলি আগের চাইতে গভীরভাবে বুঝতে পারবেন।
১৪. খেলাধুলা
খেলাধুলা করতে হবে। শেষ কবে পাড়ার মাঠে ক্রিকেট খেলেছিলেন মনে আছে? অথবা বন্ধুদের সাথে ক্যারাম কিংবা ভাইবোনদের সাথে লুডু?
আপনার ভিতরে লুকিয়ে থাকা শিশুটির যত্ন নিন। খেলাধুনা করুন। এতে মন এবং স্বাস্থ্য দুই-ই ভাল থাকবে।
১৫. স্বাস্থ্যকর খাবারের অভ্যাস
স্বাস্থ্যকর খাবার খান। আপনার খাওয়াটা আসলে এক ধরনের অভ্যাস। প্রতিদিন কী খাবেন তা ঠিক করে নিন। তারপর সেই অনুযায়ী খাওয়ার অভ্যাস করে নিন। অভ্যাসটাকে দীর্ঘমেয়াদি করে তুলুন।
১৬. অসম বয়েসীদের সাথেও পরিচিত হোন
বন্ধুত্ব সাধারণত সম বয়েসীদের সাথেই হয়। তবুও চেষ্টা করুন আপনার চাইতে বয়সে বড় এবং ছোটদের সাথে মিশতে। বিভিন্ন বয়সে মানুষের চিন্তাধারা হয় বিভিন্ন রকম। ভিন্ন বয়সের মানুষের সাথে মিশলে তাই ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে জীবনকে দেখতে পারবেন।
১৭. শিল্পচর্চা
শিল্পের সাথে পরিচিত হোন। সারাদিন টেবিলের সামনে বসে থাকতে কারোরই ভাল লাগে না। বিরক্তি কাটাতে এবং নতুন করে অনুপ্রেরণা পাওয়ার জন্য বিভিন্ন রকমের শিল্পের সাথে পরিচিত হোন।
যেমন, মিউজিয়ামে যেতে পারেন, অথবা মুভি দেখতে পারেন, কিংবা গান শুনতে পারেন।
শুধু এগুলিই নয়। মাঝেমধ্যে রাস্তায় নেমে হাঁটুন। দেখবেন আপনার আশেপাশের বিচিত্র সব মানুষেরা বিচিত্র সব কাজকারবার করে যাচ্ছে। সেগুলি দেখুন, অনুপ্রাণিত হোন আর নতুন উদ্যমে নিজের কাজ শুরু করুন।
১৮. নিয়মিত ঘুম
ঠিক সময়ে ঘুম থেকে উঠুন। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে যখন অ্যালার্ম সেট করবেন, তখন নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করবেন যে নির্ধারিত সময়েই ঘুম থেকে উঠবেন। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ অভ্যাস। নিজের প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে শিখুন।
১৯. কী করতে চান তা নিজেকে শোনান
নিজের মূল লক্ষ্যের কথা উচ্চকণ্ঠে পড়ুন। নেপোলিয়ন হিল এর থিংক অ্যান্ড গ্রো রিচ এর পরামর্শ অনুযায়ী, আপনি যা হয়ে উঠতে চান বা করতে চান তা লিখে রাখুন।
প্রতিদিন সকালে ও রাতে সেটি নিজেকে শুনিয়ে শুনিয়ে পড়ুন। নিজের কানে শুনুন আপনি কী করতে চান আর কী হয়ে উঠতে চান। আপনার জীবনের উদ্দেশ্যকে এভাবে পৃথিবীর কাছে প্রকাশিত হতে দিন।