দবির দেশে চলে এসেছেন। যদি দবির নামটা এমন বড় একটা মানুষের জন্য আপনার অপছন্দের হয়ে থাকে, আমরা অবশ্যই তাঁকে দবির বলব না। আমরা তাঁর নাম দিহান, দিনার, দেবপ্রিয় এমনকি ডেভিড পর্যন্ত দিতে পারি।
দেশে এসেই তিনি ধানমণ্ডি বা গুলশানের রেঁস্তোরাতে ‘বন্ধুবান্ধব’দের নিয়ে একটা পার্টিও দিলেন। সেই পার্টিটা দেবার মূল কারণ মোটামুটি দুইটা। একটা হলো বহুদিন যাঁদের সঙ্গে দবিরের তেমন কোনো নিয়মিত যোগাযোগ নেই তাঁদেরকে বুঝিয়ে দেয়া যে তাঁরা কতখানি আপন, দবিরের। আরেকটা হলো দবির আগামিতে যা করতে যাচ্ছেন তার একটা প্রাথমিক ঘোষণাপত্র।
এই ঘোষণাপত্র তিনি পত্রিকাতে দিতেই পারতেন, খরচও হয়তো তাতে কম পড়ত। কিংবা টেলিভিশনে যেসব বিজ্ঞাপন হতে থাকে, তাতে যদি দবির কিছু টাকাপয়সা খরচ করে সেখানেই বিজ্ঞাপন দিতেন যে তিনি দেশে চলে এসেছেন অমুক-তমুক উদ্দেশ্যে তাহলেও টেলিভিশন কোম্পানিগুলো না বলতে পারত না। আর তাতেই কাজ দবিরের চলত। বস্তুত, তাতেই বরং বেশি লোকে জানার সুযোগ পেতেন যে দবির এসেছেন, দবির কাদেরকে প্রকৃত আপন ভাবেন, আর কী দবিরের পরিকল্পনা।
কিন্তু পত্রিকা বা টেলিভিশনে এরকম একটা বিজ্ঞাপন দিয়ে দবিরের পক্ষে দুটো কাজ কিছুতেই করা সম্ভব হতো না। প্রথমত, তিনি তাঁর খরুচে-দয়ালু মনের পরিচয় দিতে পারতেন না যা এই রেস্তোঁরাতে ভুড়িভোজ দেবার মাধ্যমে পারছেন। দ্বিতীয়ত, তিনি যত লোকের সঙ্গে কোলাকুলি করলেন আজকের এই রাত্রিকালীন আয়োজনে, তা কিছুতেই পারতেন না।
যদিও আন্দাজ করা যায় যে দবিরের এই আয়োজনে আগত অতিথিদের সিংহভাগই পুরুষ, এটাও তাহলে মেনে নিতেই হচ্ছে যে তিনি কোলাকুলিও মোটের উপর পুরুষদের সঙ্গেই অধিক করেছেন। তবে তিনি যখন ঘোষণা দিলেন ‘এখন দেশের জন্য কিছু করতে চাই’ তখন কিন্তু নারীপুরুষ সকলে একত্রে হাততালি দিলেন। আর নারীপুরুষ সকলেই আপনারা কমবেশি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন। এতটা আবেগ আপনাদের দেখা দিয়ে থাকতে পারে যে বাসায় ফেরার পথে, যদি দুই বন্ধু বা স্বামীস্ত্রী একত্রে ফিরতে থাকেন, দবির-দবির-দবির করতে করতে যাচ্ছেন আপনারা। “ভাবা যায় কী একটা ছেলে দবির!” আপনারা পরস্পরকে বললেন। কিংবা “আয়াম জাস্ট প্রাউড অব হিম”, “উই আর জাস্ট টু লাকি টু বি হিজ ফ্রেন্ড।” আবার সাদাসিধা একটা সরল বাংলাতেও হয়তো আপনারা বলতে পারেন যে “আজকালকার দিনে এরকম ছেলে/লোক পাওয়া যায় না।” আসলে আপনাদের কাছে দবিরের দাম কমানো আমার একটুও লক্ষ্য নাই। কিন্তু সমস্যাটা আপনাদের মাথায় গুরুতর।
এইটা এত বড় সমস্যা যে আমার মতো লোকের পক্ষেও আপনাদের সঙ্গে কথা না বলে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। এখানে আমার মতো কথাটা কিন্তু খুবই গূঢ় মানেওয়ালা কথা। আমার মতোটা কী? আমার শৈশবে ‘ও আমার দেশের মাটি’র মতো যেকোনো গানেই চোখে পানি চলে আসত। ‘ধনধান্য পুষ্পে-ভরা’র মতো গান সেটা প্রায় ফোঁপানির পর্যায়ে যেত; এতটাই যে দলগত সঙ্গীতে গলা মেলাতেই আমার কষ্ট হতো। বড় হয়ে এসব গান কানে আসলেই এমন একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি হয়। একটা হয় শৈশবের সেই আবেগ মনে পড়ে যাওয়াতে বোকা-বোকা লাগতে থাকে। আরেকটা অনুভূতি হয় এই যে এসব সঙ্গীত পরিবেশন নেহায়েতই পার্ফর্মিং আর্ট মাত্র; এর সঙ্গে বৃহত্তর দেশের, দেশের মানুষজন বা দশের কোনোই সম্পর্ক নাই।
আবার এমন এমন সব দেশপ্রেমিক লোকজন আমার দেশে, পাশের দেশে, দেশদ্রোহী বলে সাব্যস্ত হয়ে চলেছেন যে আমার পক্ষে দেশপ্রেমিক সাজতেও কম ভয় লাগে না। ওদিকে আবার জাতীয়তাবাদের নয়া নয়া ভূত আমাদের কাঁধে এমনভাবে সওয়ার হয়েছে যে একটা টেলিকম্যুনিকেশন কোম্পানি লাখ খানেক লোককে ডেকে সামরিক ময়দানে পতাকা বানানোর কাজে আহ্বান করে প্রশংসনীয় হয়ে পড়ছেন। সব মিলে এমন একটা ভুজুংভাজুং পরিস্থিতিতে আমরা আছি যে আজকে দেশে ফিরে আসা দবিরের দেশপ্রেম নিয়ে সন্দেহ করা খুবই বাজে একটা কাজ বলে বিবেচিত হতে পারে। তা সত্ত্বেও আমরা চাইছি তাঁর দেশে “ফিরে আসা”কে আপনারা একটু ভালভাবে বুঝুন।
এটা বুঝতে গিয়ে দবিরের জীবনেতিহাসের কিছু দিকে আমাদের আলোকপাত করতে হবে। ধরা যাক আজকের দবির হলেন পঞ্চাশোর্ধ বা ষাটের কাছাকাছি এক মানুষ। শৈশবে তিনি ছিলেন একজন পুরুষ চিত্রকর, কিংবা আইনজীবী কিংবা শিক্ষকের পুত্র। মানে এখনো থাকতে বাধা নেই যদি তাঁর পিতা বেঁচে থাকেন। তবে বেঁচে থাকলেও চিত্রাঙ্কন, কোর্টে গিয়ে আইন অনুশীলন কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে পাঠদানের কারণ তাঁর অতি সামান্য। জৈববয়স বিবেচনা করলে। তো সেই শিক্ষক বা চিত্রকর তাঁর যৌবনে ধরা যাক কিস্তিতে ধানমণ্ডিতে একটা প্লট পেয়েছিলেন। তখন সেটা শহরের প্রায় বাইরের দিক। আর প্লট মানেই হলো গিয়ে এক বিঘা। লোকে বলেন কিছু প্লট দশ কাঠার ছিল, আমি মিলিয়ে দেখতে যাইনি। তো, সেই প্লটে মাথা গোঁজার একটা বাড়ি বানিয়ে সেই চিত্রকর নিজের সন্তানদের প্রতিপালন করতে থাকলেন। স্ত্রী-ও চাকুরিজীবী হতে বাধা নেই। ৬০-৭০ দশকের চাকুরিজীবী মধ্যবিত্ত পুরুষদের ভিতরে একটা ‘স্ত্রী-জাগরণ’মূলক চেতনা প্রবাহিত থাকার কথা জানা যায়।
তো দবিরের আজকের বয়সের উপর নির্ভর করছে যে তাঁকে কত সালের দিকে বিদেশে রপ্তানি করা হয়েছিল। যদি দবির হয়ে থাকেন পঞ্চাশ প্লাস তাহলে হয়তো মধ্য ৮০তে তাঁকে আন্ডারগ্রাড করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়েছিল। নিম্ন ৮০ও হতে পারে। আবার যদি দবির তার থেকে বছর পনেরো বেশি হয়ে থাকেন, তাহলে হয়তো স্বাধীনতার পর পরই তাঁকে রপ্তানি করা হয়েছিল। তা হয়ে থাকলে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র না হয়ে পূর্ব জার্মানি কিংবা রাশিয়া (প্লিজ সোভিয়েত ইউনিয়ন পড়বেন) পাঠানো হয়ে থাকতে পারে। এটা নিশ্চিত থাকুন যে, ৮০র দশকে দবির মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে থাকুন কিংবা ৭০ এর দশকে রাশিয়া, প্রবাসী শ্রমিকদের পিতার মতো দবিরের পিতা জমি বিক্রি করে এই রপ্তানিকার্যটি সাধন করেননি। দবির গেছেন হয় সরকারী বৃত্তিতে, না হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ডিংয়ে; যদি দুটোর কোনোটাই না হয় তাহলে দাদাজি বা নানাজির লগ্নিতে। ফলে আমাদের কথিত ধানমণ্ডির প্লটটি কিন্তু পুত্রহীন বিরহেই থেকে যাচ্ছে। ওদিকে দবির বস্টন থাকুন বা বার্লিন, মস্কো বা মিনিয়াপোলিস তাঁর বাচ্চাকাচ্চা জন্মাবেই। এমনও হতে পারে মস্কোবাসী দবির বাচ্চা জন্মানোর পর পরই নিউ ইয়র্ক শিফট করলেন। এসব যা কিছু ঘটতে থাকুক তাঁর জীবনে, ধানমণ্ডির ওই প্লট দবির বিহনে দ্বিতল গৃহ হিসাবেই পড়ে থাকছে।
এদিকে ঢাকায় উন্নতির চোটে খালি বিল্ডিং হচ্ছে। এত এত বিল্ডিং যে বানিয়ে শেষ করা যাচ্ছে না। এবং বিল্ডারদের প্রমুখ সংস্থা একটা ঢাউস অত্যন্ত ক্ষমতাবান সংস্থায় পরিণত হয়েছে। এত ক্ষমতাবান যে লোকজন এঁদের পরিচালকদের নিয়ে কোনো বিরূপ কিছু বলতে চাইলে লুকিয়ে বলে থাকেন। প্রকাশ্যে বলেন না। এসব সংস্থার লোকজন এখানে ওখানে জমি ‘দখল’ করেন কীভাবে তা নিয়ে মানুষজন আলাপ করলেও আসলে গোপনেই করে থাকেন। ‘ভূমিদস্যু’ বলে একটা শব্দ চালু করলেন সরকারের লোকজন। কিন্তু কাকে বলা হবে তা নিয়ে কিছুতেই একমত হওয়া গেল না বলে বাহ্যত বিশেষণহীন সম্ভাব্য ভূমিদস্যুরাও হতাশ হয়ে নিজেদের কাজেই মন দিলেন আবার। কিন্তু ধানমণ্ডির ভূমি ঠিক ‘দখলযোগ্য’ বলা যাবে না। এটা হলো পরিষ্কার ক্রয়যোগ্য। ধানমণ্ডিতে প্রথমে ৬ তলা, পরে ৮ তলা, তারপর যা-খুশি তলার অনুমোদন পাওয়া যায়। আর নয়া নয়া শিল্পমনস্ক মধ্যবিত্ত এখানে ফ্ল্যাট কিনতে আগ্রহী হন। তো দবিরের বৃদ্ধ উচ্চশিক্ষিত শিল্পমনস্ক পিতার সঙ্গে মাঝেমধ্যেই ওই বিল্ডাররা যোগাযোগ করেন। আর তারপর রাত্রিবেলা দবিরের পিতা, সামনে দবিরের মাতাকে রেখে, দবিরের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। অধিকাংশ দিনেই দবির যা বলেন তার সারাংশ মোটামুটি এরকম: “আব্বা/বাবা প্রপার্টি-ট্রপার্টি নিয়ে আমার সঙ্গে ডিসকাস করে কোনো বেনেফিট আছে? আপনারাই যা ঠিক মনে করেন।”
এরকম যোগাযোগ চলতে-চলতে দবিরের পুত্রকন্যারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে গেছেন। দবির যে হোয়াইট কলার চাকরি করেন সেখানেও মেলাদিন চাকরি-টাকরি করা হয়ে গেছে। দবির নিজেও এখন চাইলে আমেরিকায় তাঁর মাস্টারি বা বিজ্ঞানীর বা ব্যবস্থাপকের চাকরি থেকে বেশ কিছু গ্রাচুইটি পেতে পারেন। তখন একদিন দবির অপেক্ষাকৃত আগ্রহী স্বরে আব্বা/বাবাকে বলে বসেন: “ডিল কী হবে, কিছু বলছে? আপনে আমার ফোন নম্বর দিয়া কনটাক্ট করতে বলেন।” এখন দেশে ওই ধানমণ্ডির (বা হয়তো গুলশান, কী আসে যায়) জমিতে ৮/১০/১৭ কত তলা হবে তা আসলে নির্ভর করছে দবির আর বিল্ডারের মধ্যকার চুক্তির উপরেই কেবল নয়; বরং বিল্ডার কত বড় বডিবিল্ডার তার উপরেও।
এখন দবির যে ৬টা ফ্লোর পাবেন সেখানের সবগুলোই যে দবির ভাড়া দিয়ে মাসে মৃদু ১২ লক্ষ টাকা তুলবেন তা নাও হতে পারে। হয়তো দবির জিমভক্ত। তাই একটাতে নিজ উদ্যোগে তিনি গোস্ত পাকানোর জিম দিতে পারেন। কিন্তু দবির তো সঙ্গীতানুরাগী কিংবা রবীন্দ্রভক্তও হতে পারেন। তিনি হয়তো ভাবলেন একটা ফ্লোরে তাহলে রবীন্দ্রচর্চা হোক! সেখানেই তখন কোনো এক সন্ধ্যায় কিশোরকিশোরীরা গাইবেন “ও আমার দেশের মাটি”। এই যে দবির একটা ফ্লোরের সম্ভাব্য দুই লক্ষ টাকা নেহায়েৎ রবীন্দ্রচর্চার জন্য উৎসর্গ করলেন, একে তাঁর দেশপ্রেম হিসাবে আপনি অবশ্যই দেখতে পারেন।
আদাবর, ২৮ এপ্রিল ২০২১; কভারে মানস চৌধুরী; ছবি. সুশান্ত পাল ২০১৬