ত্রিমাত্রিক প্রিন্টিং বা এডিটিভ ম্যানুফ্যাকচারিং হচ্ছে এডিটিভ অর্থাৎ প্লাস্টিক জাতীয় জিনিস দিয়ে কোনো বস্তুর থ্রি-ডি মডেল তৈরি করা। মডেলিং সফটওয়ার ব্যবহার করে যে কোনো জিনিস থ্রি-ডি প্রিন্টার দিয়ে তৈরি করা যায়। খেলনা, যন্ত্রপাতি, গয়না এমন কি অস্ত্র পর্যন্ত বানানো যায় এভাবে! অনেকেই এই প্রযুক্তিকে যুগান্তকারী বলছেন, কারণ এখন এমন সব নতুন প্রোডাক্ট তৈরি করা যাচ্ছে যেগুলি তৈরিতে খরচ কম আর পারফরমেন্সও আগের প্রোডাক্টগুলির চেয়ে ভালো। তাই থ্রি-ডি প্রিন্টার দিয়ে তৈরি প্রোডাক্টের কাছে পুরনো প্রযুক্তির অনেক প্রোডাক্ট মার খেয়ে যাচ্ছে।

কীভাবে শুরু হলো থ্রিডি প্রিন্টার

যদিও থ্রি-ডি প্রিন্টার নিয়ে এখন অনেক কথা হচ্ছে তবে এই প্রযুক্তি কিন্ত নতুন না। ১৯৮৩ সালে চার্লস হাল স্টেরিওলিথোগ্রাফি (SLA) নামে একটা প্রযুক্তি বের করেন। তিনি CAD সফটওয়্যার ও থ্রি-ডি মডেল ব্যবহার করে অবিকল প্রোডাক্ট রেপ্লিকা তৈরি করতে পারতেন।

চার্লস হাল তার কাজের অনেকগুলি পেটেন্ট করে রাখেন যেগুলি এখনও অনেক থ্রি-ডি প্রিন্টিং-এর কাজে ব্যবহার করা হয়। প্রযুক্তিটি প্রথমে ব্যবহার করা হতো বিভিন্ন উৎপাদন প্রক্রিয়ায় প্রটোটাইপ ডিজাইন তৈরি করার জন্য। তবে সম্প্রতি থ্রি-ডি প্রিন্টিং-এর খরচ কমার পর এর উপর মানুষের আগ্রহ বেড়ে গেছে। ফলে এই প্রযুক্তিতে আরো বেশি উদ্ভাবন এসেছে। মিডিয়া কাভারেজও বেড়েছে।

থ্রি-ডি প্রিন্টার দিয়ে কীভাবে প্রিন্ট করে

থ্রি-ডি আইটেমের প্রিন্টিং-এর জন্য প্রথমে যে আইটেমের ডিজাইন করতে হবে সেটার ডিজিটাল ডিজাইন প্রস্তত করতে হয়। এজন্য থ্রি-ডি মডেলিং প্রোগ্রাম (CAD) ব্যবহার করা হয় অথবা থ্রি-ডি স্ক্যানার দিয়ে স্ক্যান করা হয়। স্ক্যানার প্রথমে জিনিসটার একটা কপি বানায় তারপর সেটাকে থ্রি-ডি মডেলিং প্রোগ্রামে পাঠিয়ে দেয়। এরপর ডিজাইন ডিজিটাল ফাইলে কনভার্ট করা হয়। তখন মডেলটা কয়েক’শ এমনকি হাজার লেয়ারে ভাগ হয়ে যায়। প্রিন্টার এই প্রত্যেকটি লেয়ারের ডিজাইন পড়তে পারে এবং প্রিন্ট দিতে পারে। তারপর প্রিন্টার নির্ভুল ভাবে প্রত্যেকটা লেয়ার প্রিন্ট দিয়ে একসাথে জোড়া লাগিয়ে দেয়। ফলে একেবারে মডেলের মত থ্রি-ডি আইটেম প্রিন্টার থেকে বের হয়।

থ্রি-ডি জিনিস বানানোর স্টেপ

স্টেপ ১ – প্রথমে একটা থ্রি-ডি মডেল বানাতে হবে CAD বা অন্য কোনো থ্রি-ডি ডিজাইন সফটওয়ার দিয়ে।

স্টেপ ২ – এরপর ডিজাইনকে STL (Standard tessellation language) ফরম্যাটে নিয়ে আসতে হবে। কারণ থ্রি-ডি প্রিন্টার এই ফরম্যাট নিয়ে কাজ করে।

স্টেপ ৩ – এবার STL ফাইলকে কম্পিউটারে নিয়ে আসতে হবে যে কম্পিউটার দিয়ে থ্রি-ডি প্রিন্ট দেয়া হবে। তখন প্রয়োজন মত এর সাইজ বা ওরিয়েন্টেশন ঠিক করা যাবে।

স্টেপ ৪ – এবার থ্রি-ডি প্রিন্টারে প্রয়োজনীয় ম্যাটেরিয়াল দিতে হবে মানে যে ধরনের ম্যাটেরিয়াল দিয়ে প্রোডাক্ট বানাতে চান সে ম্যাটেরিয়াল রিফিল করতে হবে।

স্টেপ ৫ – এখন জিনিস তৈরি হওয়ার প্রসেস শুরু হবে। যেহেতু প্রতি লেয়ার .1 মিলিমিটার পুরু হয় তাই পুরো কাজ শেষ হতে কয়েক ঘণ্টা থেকে কয়েক দিনও লেগে যেতে পারে। এটা নির্ভর করে প্রোডাক্টের সাইজের উপর।

স্টেপ ৬ – এবার প্রিন্টার থেকে প্রোডাক্টটি সরিয়ে ফেলতে হবে। খেয়াল করতে হবে গরম বা টক্সিক কিছু যেন না লাগে।

স্টেপ ৭ – এবার যদি কোনো পোস্ট প্রসেসিং-এর প্রয়োজন পড়ে সেটা করতে হবে। মানে জিনিসটা ধোয়া বা ব্রাশ করে পরিষ্কার করা। তবে খেয়াল রাখতে হবে কোন ধরনের থ্রি-ডি প্রিন্টার দিয়ে কাজ করা হচ্ছে। এমনও হতে পারে যে প্রিন্ট হওয়ার পরে আর কিছুই করার দরকার নেই।

স্টেপ ৮ – এবার আপনার নতুন বানানো প্রোডাক্ট ব্যবহার করতে শুরু করুন।

থ্রি-ডি প্রিন্ট করার চ্যালেঞ্জ কী কী?

উপরের স্টেপগুলো দেখে মনে হতে পারে থ্রি-ডি প্রিন্টিং করা অনেক সোজা কাজ। কেবল কম্পিউটারে প্রিন্ট বাটন চেপে দিলেই কাজ হয়ে যায়। প্রচুর আর্টিকেল আছে যেখানে এভাবে বলা আছে। কিন্ত আসলে ব্যাপারটা এমন না। কাগজ প্রিন্টিং আর থ্রি-ডি প্রিন্টিং-এর মধ্যে বেশ তফাৎ আছে।

·  থ্রি-ডি কনটেন্ট বানানো বেশ কঠিন প্রসেস। প্রিন্টিং ডকুমেন্ট বানানো তো সোজা কাজ, যে কেউ করতে পারে। কিন্ত থ্রি-ডি ডিজাইন করতে ডিজাইন সফটওয়ার ব্যবহার করার দক্ষতা লাগে। সাথে স্ক্যানিং বা ডিজিটাইজিং হার্ডওয়ারের ব্যবহার জানতে হয়। এগুলির জন্য ট্রেইনিং আর ইনভেস্টমেন্টের দরকার আছে, যা সাধারণ যে কেউ চাইলেই করতে পারবে না।

·       সব ধরনের থ্রি-ডি একভাবে বানানো হয় না। একটা থ্রি-ডি ছবি তৈরি করতে পারলেই সেটা থ্রি-ডি প্রিন্ট করা যাবে বিষয়টা মোটেও তেমন না। থ্রি-ডি প্রিন্ট দেয়ার জন্য দরকার হয় থ্রি-ডি ডেটা। যেখানে নির্দিষ্ট ফরম্যাটে প্রোডাক্টের ডিটেইলড জ্যামিতিক মাপ দেওয়া থাকে। তার মানে একটা “মিডলওয়ার” সফটওয়ারের দরকার হয় যেটা থ্রি-ডি ডেটার ইনপুট নিয়ে সেটাকে থ্রি-ডি প্রিন্ট করার উপযোগী ডেটাতে কনভার্ট করে। এগুলির জন্যেও অনেক টাকা খরচ করতে হয় ও সময় দিতে হয়।

বিভিন্ন ধরনের থ্রি-ডি প্রিন্টার ও অ্যাপলিকেশন

·  ইন্ডাস্ট্রিয়াল থ্রি-ডি প্রিন্টিং: থ্রি-ডি প্রিন্টার ব্যবহার করা শুরু হয় শিল্প কারখানায় এবং এখনো সেটাই হয়ে আসছে। ফ্যাক্টরিতে থ্রি-ডি প্রিন্টার দিয়ে ডিজাইনের প্রটোটাইপ তৈরি করা হয়। এর নাম হচ্ছে র‍্যাপিড প্রটোটাইপ। আবার কোনো জিনিস একবার মাত্র বানানোর জন্য বা কম পরিমাণে প্রোডাকশনের জন্য থ্রি-ডি প্রিন্টিং করা হচ্ছে।

·  ইন্ডাস্ট্রিয়াল থ্রি-ডি প্রিন্টিং এপ্লিকেশন: ২০১০ সালে যখন ডাচ ডিজাইনার আইরিস ফন হার্পেন ক্রিস্টালাইজেশন কালেকশন আনেন তখন জামা-কাপড়ের ইন্ডাস্ট্রিতে প্রথম থ্রি-ডি প্রিন্টিং আসে। এরপর থেকে প্রতিবছর এটি আরো জনপ্রিয় হচ্ছে। নাইকি বা এডিডাসের মতো ব্র্যান্ড অবিশ্বাস্য দ্রুততায় থ্রি-ডি প্রিন্টার নিয়ে নতুন জুতার প্রটোটাইপ ডিজাইন করছে। আগে যে প্রোটোটাইপ বানাতে ৬ সপ্তাহ লাগতো এখন সেটা দুই দিনে বানানো যাচ্ছে।

গাড়ির রিপ্লেসের যন্ত্রাংশ তৈরিতে থ্রি-ডি প্রিন্টার ব্যবহার করা হচ্ছে বেশ কয়েক বছর থরে। অন্য সব ইন্ডাস্ট্রির মতো এখানেও বিভিন্ন যানবাহনের প্রটোটাইপ ডিজাইন করছে থ্রি-ডি প্রিন্টার। সবচেয়ে আধুনিক প্রযুক্তি এসেছে লোকাল মোটর থেকে যারা মাত্র ৬ দিনে একটা সম্পূর্ণ গাড়ি তৈরি করেছে থ্রি-ডি প্রিন্টার দিয়ে। তবে Strati নামের এই গাড়ি ২০১৫ সালে বের করা হলেও এখনো সেফটি ইস্যুর কারণে বাজারে ছাড়া হয়নি।

উইন্সুন নামের একটা চাইনিজ কোম্পানি এক দিনে ১০টা বাড়ি বানিয়েছিল থ্রি-ডি প্রিন্টার দিয়ে। এই প্রতিটি বাড়ি তৈরিতে খরচ পড়ে প্রায় ৫,০০০ মার্কিন ডলার। বিভিন্ন স্থপতিরা এখন থ্রি-ডি প্রিন্টিং-এর বাড়ির দিকে ঝুঁকছেন কারণ এগুলির খরচ কম আর ডিজাইন করা ফ্লেক্সিবল।

থ্রি-ডি প্রিন্টার দিয়ে যত জিনিস বানানো যায় তার মধ্যে সবচেয়ে ডেঞ্জারাস হলো অস্ত্র। গত দুই বছরে থ্রি-ডি প্রিন্টার দিয়ে পিস্তল বানানোর প্রযুক্তি অনেক দূর এগিয়ে গেছে। নিজের অস্ত্র প্রিন্ট করা আইনে অবৈধ না। কিন্ত প্লাস্টিকে তৈরি অস্ত্র মেটাল ডিটেকটরে ধরা পড়ে না। তাই প্লাস্টিক গান আনডিটেক্টিবল ফায়ারআর্মস অ্যাক্টের পরিপন্থী।

মেডিক্যাল ইমপ্ল্যান্ট ও শরীরের অংশের প্রিন্ট করা যায় বলে থ্রি-ডি প্রিন্টার মেডিক্যাল সাইন্সে যুগান্তকারী পরিবর্তন এনে দিবে। বলা হচ্ছে নকল দাঁত, কোমরের জয়েন্ট এবং প্রতিস্থাপনযোগ্য হাঁটুর চাহিদার কারণে থ্রি-ডি প্রিন্টারের ব্যবহার অনেক বেড়ে যাবে আগামি দশকে। তবে থ্রি-ডি প্রিন্টার দিয়ে কৃত্রিম অঙ্গ তৈরি করতে আরও ১০ বছর লেগে যাবে। যদিও ৫ বছরের মধ্যে টিস্যু প্রিন্ট করা হবে ল্যাবেরটরি টেস্টিং-এর জন্য।

থ্রি-ডি প্রিন্টিং দিয়ে তৈরি মিউজিক ইন্সট্রুমেন্ট অবশ্য বাজারে চলছে বেশ কিছু বছর ধরে। বাজারে ছাড়ার জন্য গিটার, ইন্সট্রুমেন্ট প্রোটোটাইপ, ড্রাম সেট এমন কি স্যাক্সোফোনও বানাচ্ছে থ্রি-ডি প্রিন্টিং কোম্পানিগুলি। ODD Guitars এর মতে থ্রি-ডি গিটার প্রিন্ট করতে ১১ ঘণ্টা লাগে। আর এটা রঙ করতেও এ পরিমাণ সময় যায়।

থ্রি-ডি প্রিন্টারের দাম কমার কারণে অনেকে এখন শখ করে বাসায় এর ব্যবহার শুরু করেছে। মাইক্রো নামের থ্রি-ডি প্রিন্টার যেটা মূলত বাসায় ব্যবহার করার জন্য, এই বছরের শুরুতে Kickstarter এ বাজারে আসে। আসার কয়েক মাসের মধ্যে প্রিন্টারটি প্রয়োজনীয় ফান্ডিং পেয়ে যায়।

বেকারি, আর্টিস্ট  বা নিজে নিজে কাজ যারা করে এমন মানুষের বাসায় থ্রি-ডি প্রিন্টার থাকলে অনেক সুবিধা। কুকি কাটার থেকে শুরু করে রিপ্লেসমেন্ট টুলস সবই তো বানানো যায় এটা দিয়ে। সামনে আমরা আরও দেখবো থ্রিডি প্রিন্টার দিয়ে খাবার, মেকআপ, জামাকাপড়, বাচ্চাদের খেলনার মত জিনিসও তৈরি হচ্ছে।

 

ভবিষ্যতে আর কী কী হতে পারে থ্রি-ডি প্রিন্টিং দিয়ে

ব্যক্তিগত কাজে ও শিল্পকারখানায় সবখানে থ্রি-ডি প্রিন্টিং-এর ভবিষ্যৎ ভালো। প্রযুক্তির উন্নতির ফলে কম সময়ে কাজ করতে পারে এমন থ্রি-ডি প্রিন্টারের দাম কমে যাচ্ছে। তার উপর গবেষকরা থ্রি-ডি প্রিন্টার দিয়ে আরও কী কী নতুন জিনিস প্রিন্ট করা সে উপায় বের করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে আছে গাড়ি, বিমানের অংশ, প্রসথেটিক। তবে থ্রি-ডি প্রিন্টারের সবচেয়ে এক্সাইটিং ব্যাপার হচ্ছে এটা দিয়ে এমন সব নতুন জিনিস তৈরি করা যাবে যেগুলি আগে কখনও দেখা যায় নি।

যাই হোক, নতুন যে কোনো প্রযুক্তির মত এখানেও অনেক ধরনের চ্যালেঞ্জ আছে। যদিও এত মানুষ থ্রি-ডি প্রিন্টার ব্যবহার শুরু করাটা একটা ভালো দিক, কিন্ত এতে পরিবেশের জন্য মারাত্মক ঝুঁকির সম্ভাবনা থেকে যায়। কারণ ব্যবহার বেড়ে গেলে বিদ্যুৎ খরচ আর প্লাস্টিক বর্জ্য অনেক পরিমাণে বেড়ে যাবে। যে প্লাস্টিক দিয়ে প্রিন্ট করা হচ্ছে সেগুলি ঠিকমতো রিসাইকেল করা হচ্ছে কিনা সেদিকে নজর দেয়ার সময় এসেছে। এছাড়া আরো কিছু বিষয় আছে যেমন ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি নিশ্চিত করা। যাতে যে কেউ একটা স্ক্যানার আর প্রিন্টার দিয়ে অন্যদের কপিরাইট করা প্রোডাক্ট প্রিন্ট না করে ফেলে।