রাতে আগে আগে ঘুমাতে গেলে আর সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠতে পারলে সত্যিই কি স্বাস্থ্যবান, ধনী এবং জ্ঞানী হওয়া যায়?
যারা খুব ভোরে বসন্তমাখা পা নিয়ে বিছানা ছাড়তে পারেন তাদেরকে দেখে কি আপনার ঈর্ষা হয়? অথবা, হতে পারে আপনিও সেই ভাগ্যবানদেরই একজন!
কথিত আছে যে, যিনি সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতে পারেন, সাফল্য তার ভাগ্যেই জোটে। জনপ্রিয় সংস্কৃতিতেও এই ধারণার ব্যাপক প্রচলন রয়েছে যে, যারা ভোরে ঘুম থেকে উঠতে পারে তারা জীবনে বেশি সফল হয়, আরো বেশি কিছু করতে পারে এবং তাদের মুখে সবসময় একটা হাসি লেগেই থাকে।
অগণিত গবেষণা নিবন্ধে বলা হয়েছে যে, আমরা যদি সকালে কেবলমাত্র আরো এক ঘণ্টা আগে নিজেকে বিছানা থেকে টেনে তুলতে পারি তাহলেই আমরা বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় উদ্যোক্তাদের মতোই উচ্চমাত্রায় উৎপাদনশীল হয়ে উঠব।
আপনি যদি রাতের পেঁচা হয়ে থাকেন এবং সকালবেলায় ঘুমিয়ে থাকতেই পছন্দ করেন তবে আপনি সম্ভবত আশা করছেন এমনটা যেন সত্য না হয়। কিন্তু এমনকি, “ক্রোনোটাইপস” এর মনোবিজ্ঞানও বলে যে, সকাল সকাল বিছানা ছাড়তে পারে যারা তারাই বেশি সুখী হয়। যদিও, বাস্তবতা একটু ভিন্ন কথাও বলে।
বাস্তবে আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ তথা প্রায় ৬০% শতাংশ মানুষই ভোরের পাখিও নয় আবার রাতের পেঁচাও নয় বরং দুটোর মাঝামাঝি বা মিশ্রণ। আর ক্রোনোটাইপ খালি আমরা রাতে কখন ঘুমাতে যাই এবং সকালে কখন ঘুম থেকে উঠি সে সম্পর্কিত বিষয় নয়, বরং দিনের কোন সময়টাতে আমরা সবচেয়ে বেশি কর্মক্ষম থাকি তাও ক্রোনোটাইপের বিষয়।
ভোরের পাখিরা সাধারণত দিনের শুরুতে সবচেয়ে বেশি অ্যাকটিভ থাকেন আর রাতের পেঁচারা আরো পরে গিয়ে ভাল ভাবে কাজ করতে পারেন। রাতের পেঁচারা ইভনিং বা নাইট শিফটের ক্যারিয়ারে ভালো করতে পারেন।
সাধারণভাবে বলতে গেলে, নারীরা বেশির ভাগই ভোরের পাখি বা মর্নিং ক্রোনোটাইপের হয়, আর পুরুষদের বেশির ভাগ সাধারণত রাতের পেঁচা বা ইভনিং ক্রোনোটাইপের হয়ে থাকেন। এইক্ষেত্রে বয়সও একটি প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। কৈশোরে মানুষ একটু বেশিই রাত জাগে। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে মানুষ ভোরের পাখি হয়ে ওঠেন।
এখন প্রশ্ন হল, আসলে কে বেশি সুখী?
অনেক গবেষণাতেই দেখানো হয়েছে যে, ভোরের পাখিরা অর্থাৎ যারা সকাল সকাল বিছানা ছাড়েন তারাই বেশি সুখী মানুষ। সম্প্রতি তুরস্কের দোকুজ ইয়েলুল বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচালিত শতাধিক মেডিকেল শিক্ষার্থীর একটি গবেষণায়ও দেখা গেছে, যারা সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠেন তারাই বেশি সুখী
ওই গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ২৬.৬ শতাংশ ছিল রাতজাগা পাখি। আর ভোরের পাখি ছিল মাত্র ৬.৭ শতাংশ। বাকিরা দুটোর মিশ্রণ বা মাঝামাঝি বৈশিষ্ট্যের ছিল।
রাতের পেঁচারা সুখের ইনডেক্সে ভোরের পাখিদের চেয়ে অনেক কম স্কোর করেন। বয়স্ক ব্যক্তিদের ওপর চালানো গবেষণায়ও দেখা গেছে, ঘুম থেকে সকাল সকাল উঠতে পারার সঙ্গে সুখী হওয়ার একটা সম্পর্ক রয়েছে। আর বয়স্কদের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষই ভোরের পাখি।
লাইপজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ভোরের পাখিরা জীবন বেশি সুখী হওয়ায় আবেগগত ভাবেও বেশি স্বাভাবিক থাকতে পারেন এবং তাদের মানসিক স্বাস্থ্যগত সমস্যাও কম হয়।
অন্যান্য গবেষণায় দেখা গেছে, রাতের পেঁচা টাইপ মানুষরা মানসিক অবসাদ, মৌসুমী আবেগীয় ব্যাধি এবং মাদকাসক্তির মতো সমস্যায় আক্রান্ত হন বেশি।
এর কারণ সম্ভবত যারা বেশি রাত পর্যন্ত জেগে থাকেন তাদের ঘুম কম হয় এবং তারা ঘুমের সমস্যায়ও বেশি ভোগেন। অন্যদিকে, যারা সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠেন তাদের এমন কোনো সমস্যা হয় না। এছাড়া ভোরের পাখিদের আবেগ নিয়ন্ত্রণের দক্ষতা ও সক্ষমতা বেশি হয় এবং সময়ের ব্যাপারেও তারা বেশি সচেতন থাকেন।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, আমাদের মধ্যে এই রাতের পেঁচা বা ভোরের পাখির বৈশিষ্ট্য কোথা থেকে এসেছে। এবং আরো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হতে পারে, আমরা আমাদের এই বৈশিষ্ট্য বদলাতে পারি কিনা।
ওয়ারউইক বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক দেখিয়েছেন, ক্রোনোটাইপ সাধারণত ব্যক্তিত্বের সাথে সম্পর্কিত থাকে। যেমন, যাদের শুভবুদ্ধি বেশি এবং যারা বেশি বিবেকবান তারা সাধারণত ভোরের পাখি হয়ে থাকেন। আত্মসংযমী, সুশৃঙ্খল এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী মানুষদের যে ৫টি বড় বৈশিষ্ট্য থাকে তার মধ্যে একটি হল এই শুভবুদ্ধি সম্পন্ন বা বিবেকবান হওয়া।
বিপরীতভাবে, যারা একটু এক্সট্রোভার্ট এবং উদার ব্যক্তিত্বসম্পন্ন তাদের মধ্যে রাত জাগার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। ব্যক্তিত্ব এবং ক্রোনোটাইপ নির্ধারণে একই ধরনের জিনগত বৈশিষ্ট্যের প্রভাবও রয়েছে।
তবে সুসংবাদ হল ব্যক্তিত্ব বা ক্রোনোটাইপ পুরোপুরি পাথরের মতো সেট করা থাকে না। উভয়ই আমাদের জিনগত বৈশিষ্ট্যের বাইরের জিনিস দিয়েও প্রভাবিত হয়। বাইরের জিনিস বলতে, আমাদের পারিবারিক পরিবেশ এবং পেশাগত ভূমিকা এবং সেসব আমাদের উপর যে দৈনন্দিন রুটিন আরোপ করে সেসব। তার মানে আমাদের ক্রোনোটাইপ বদলানো সম্ভব। ওয়ারউইক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা যেমন লিখেছেন, “… সম্ভবত ইচ্ছামতো উপায়েই একজন মানুষের ক্রোনোটাইপ পরিবর্তন করা সম্ভব।”
আপনি যদি রাতের পেঁচা থেকে ভোরের পাখিতে রূপান্তরিত হতে চান তাহলে আপনাকে প্রথমেই যা করতে হবে তা হল, সন্ধ্যা বেলাতেই ডিজিটাল ডিভাইসের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।
এরপর ধীরে ধীরে রাতের প্রথম ভাগেই বিছানায় যাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। তারপর সকাল সকাল ঘুমে থেকে ওঠার জন্য নিজেকে কিছু একটা পুরস্কার দিতে হবে। তা হতে পারে এক কাপ গরম কফি, সকালের হিমেল হাওয়ায় একটু হাঁটাহাঁটি করে শরীরে বসন্ত মেখে আসা এবং ঘরে ফিরে আইপ্যাডে কিছুক্ষণ নিজের মতো করে সময় কাটানো।
আরো পড়ুন: ১ মিনিটে ঘুমিয়ে পড়বেন যেভাবে
কিন্তু খারাপ খবর হল, ওয়ারশ বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্ডারগ্র্যাড শিক্ষার্থীদের ওপর চালানো একটি গবেষণায় দেখা গেছে, তাদের মধ্যে মৌসুম ভিত্তিক ক্রোনোটাইপের পরিবর্তনে তারা খুব একটা সুখী হতে পারছে না।
যেমন, গ্রীষ্মকালে তারা সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠলেও তাদের মেজাজ-মর্জি খুব একটা ভালো যাচ্ছে না এবং জীবন নিয়েও কোনো তৃপ্তির অনুভূতি হচ্ছে না।
এ থেকে বোঝা যায় যে, ক্রোনোটাইপ পরিবর্তনের মাধ্যমে শিগগিরই সুখী হওয়া সম্ভব নাও হতে পারে। শুধুমাত্র সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস তৈরি করার পাশাপাশি আরও মৌলিক ভাবে বিষয়টা নিয়ে ভাবতে হবে।
এর কারণ অংশত সম্ভবত জীবনে সুখ-শান্তি থাকলে ক্রোনোটাইপেও ইতিবাচক পরিবর্তন আসে। যেমন, আপনি যদি জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট থাকেন এবং আপনার দিনগুলি ব্যস্ততা ও সাফল্যে পূর্ণ থাকে তাহলে আপনি খুব সম্ভবত রাতের বেলা সহজেই ঘুমাতে পারবেন এবং রোজ সকালে পাখির মতোই বিছানা ছেড়ে উঠতে পারবেন।
সায়েন্স ফোকাস অবলম্বনে মাহবুবুল আলম তারেক