আপনাদের লিঙ্গ-অনুধাবন ৩
দেবানন্দ সাহেবের কথা মনে আছে তো? ওই যে সিনেমার নায়ক কাম প্রযোজক কাম পরিচালক। সত্যি কথা বলতে যাঁরা খান সাহেবদের পঞ্চাশোর্ধ কালে যুবক সাজা নিয়ে চমৎকৃত (বা বিরক্ত) হন, তাঁরা আসলে এই অঞ্চলের সিনেমার ইতিহাসই ঠিকমতো লক্ষ্য করেন নাই। দেবানন্দ সাহেবের জন্য এগুলো, ৫০ বা ৬০ তদূর্ধ্ব বয়সে যুবক-সাজা, ডাল ভাত ব্যাপার ছিল। কিন্তু তিনি তাঁর জৌলুসের কারণে আজকে আমাদের আসরে আসেন নাই। এসেছেন একটা বিশেষ ছায়াছবি বানানোর কারণে। ওটার তিনি প্রযোজক-নায়ক তা মনে করতে পারি। বাকিগুলো এখনই গুগল করে নিলাম।
সিনেমাটোগ্রাফি বা মিউজিক ছাড়া প্রায় সব কাজই করেছেন এই ছবিতে। তবে সিনেমাটোগ্রাফি আর নায়কগিরি একসঙ্গে করা যায় না তাও সত্য। ছবিটা ১৯৭১ সালের হরে রাম হরে কৃষ্ণ। এরকম একটা ভক্তিমূলক নামের ছবির সঙ্গে রাম কিংবা কৃষ্ণ কিংবা হরির সামান্যই সম্পর্ক। বরং ছবিটার কাহিনী ও লক্ষ্যকে অভক্তিমূলক বলাই সবচেয়ে ঠিক হবে। এই ছবির লেখক-প্রযোজক-পরিচালক-নায়ক যাঁদেরকে ‘হিপ্পি’ বলে জানতেন বা মানতেন বা ভাবতেন বা অন্যদের ভাবা উচিত বলে মনে করতেন সেই ‘হিপ্পি’দের প্রতি তাঁর বিশুদ্ধ অভক্তি-অশ্রদ্ধার ছবি।
এখন কেউ কেউ বিরক্ত হতে পারেন আপনারা যে নারীবাদের নানান রকমফের আর নারীবাদীদের প্রতি অনারীবাদীদের নিখিল বিশ্বব্যাপী নানান রকম বিদ্বেষের বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে কেন আমি দেবানন্দ সাহেব আর তাঁর চলচ্চিত্রে ‘হিপ্পি’ বিষয়বস্তু হাজির করলাম।
আসলে কখনো কখনো একটু দূরে গিয়ে প্রাথমিক কাজটা করলে সেই কাজটা পাকা হয়। বাংলাদেশে একদা যাঁরা চিংড়ির ঘেড় করে করে বড়লোক হয়েছিলেন তাঁরা যত্রযত্র চিংড়ির পোনা ছিটিয়ে দিতেন না। আগে তাঁরা পোনাগুলোকে একদিকে পোনা হতে দিতেন ডিম থেকে। তারপর শিশুপোনাদেরকে আরেক জায়গায় নিয়ে যেতেন। তাতেই ফলন ভাল হতো। কিংবা ধরুন, বাংলাদেশে যাঁরা কিছুতেই পার্বত্য চট্টগ্রামে রাষ্ট্রীয় এবং/বা সামরিক বাহিনীর উৎপীড়ন বুঝতে পারেন না তাঁদেরকে তা বোঝাতেই বা যান কেন? তাঁদের সঙ্গে আলাপ শুরুই করবেন কাশ্মিরীদের কিংবা ফিলিস্তিনিদের অভিজ্ঞতা নিয়ে। তারপর আপনি যখন নিশ্চিত হবেন যে তাঁরা ভালমতো বুঝতে পেরেছেন তখন আস্তে করে, আরামসে, প্রসঙ্গটাকে পার্বত্য চট্টগ্রামের টিলা-পাহাড়ে কিংবা মান্দিদের শালবনে নিয়ে আসবেন। যাঁর সঙ্গে আলাপ করছিলেন তাঁর পক্ষে তখন রেগেমেগে চলে যাওয়া ছাড়া আর তেমন কোনো উপায় থাকবে না।
তো ছবিতে দেবানন্দ সাহেবের বোন ছিলেন জিনাত আমান। কাহিনীর মধ্যকার নামটাম তো আমার মনে নেই। আপনাদেরও তাতে সমস্যা হবে না। লোকে বলে ওটাই ছিল জিনাত আমানের অভিনেতা জীবনের মেজর ব্রেক থ্রু, ক্যারিয়ারের শুরুতেই। বিশাল হিট। তারপর আর তাঁর পরম আকাঙ্ক্ষিত এক তারকা হয়ে থাকতে বহু বছর কোনো সমস্যা হয়নি। তো, যাকগে, সেই বোন হয়ে গেছিলেন ‘বখাটে’, কারণ তিনি ‘হিপ্পি’দের ‘খপ্পরে’ পড়ে গেছেন। তাহলে দেবানন্দ সাহেব ও তাঁর ভক্ত দর্শকদের জন্য ‘হিপ্পি’ মানেই হলো ‘বখাটে’ — গাঁজাখোর, গাঁজা খেয়ে গান বাজনা-করা, কিংবা গানবাজনা করতে করতে গাঁজা খাওয়া, ‘উচ্ছৃঙ্খল’ ইত্যাদি।
আমি একবার নিকট থেকে, দুই হাত মতো হবে, ‘হিপ্পি’দের অবশিষ্টাংশ এক-দুইজনকে দেখেছিলাম। তাঁরা ছিলেন ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নিরামিষ খাদ্য-বিক্রেতা। সেটা হবে ২০০৫ সালে। তাহলে দেখেন, মাত্র ৩৫ বছরের ব্যবধানে দেবানন্দ ও আমি, আমাদের স্বাস্থ্য কাছাকাছি হওয়া সত্ত্বেও, ‘হিপ্পি’দের দেখতে পাচ্ছি যথাক্রমে ‘উচ্ছৃঙ্খল গাঁজারু’ ও ‘তুলসিধারী ডালবড়া শব্জিভাত বিক্রেতা’ হিসাবে। দেবানন্দের আবিষ্কৃত ‘হিপ্পি’দের ‘মানুষ’ করে তুলতে দেবানন্দের ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়; নায়করা যেমন করে থাকেন। আমার আবিষ্কৃত ‘হিপ্পি’দের কাছে ‘বড়মানুষ’ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা খুশিমনে লাঞ্চ খেতে যান। শুধু তাই-ই নয়, তাঁরা স্পেশাল ট্রিট দিতে হবে এমন মেহমানকেও সাথে করে নিয়ে যান। উপরন্তু জানাতে ভোলেন না যে ব্রাজিলীয় হওয়া সত্ত্বেও এঁরা ভারতীয় রান্নাতে অতিশয় পাকা। বাস্তবে এখানে ব্রাজিলীয়তা ও ভারতীয়তাকে দেখতে হবে একটা স্মৃতিচিহ্ন হিসাবে। ওই বড়া কিংবা তার নির্মাতা উভয়েই তখন আমেরিকীয়। পরিচয়ের এই যে এতরকম প্যাঁচ সেটাই একটা বিরাট পাঠের জায়গা আপনাদের জন্য। কিন্তু আমাদের আরো বেশি লক্ষ্য করা দরকার ভিন্ন ভিন্ন লোকজনের কাছে ওই বর্গটা কী কী রকমের বিভিন্ন দ্যোতনা/অর্থময়তা বহন করে।
তাহলে বিদ্বেষের ব্যাপারটা সহজেই বুঝে গেলেন আপনারা। আপনি দেখতে পারেন না; সহ্য হয় না—তাই বিদ্বেষ। দেবানন্দের উদাহরণে বুঝলেন কিংবা ওই যে কাশ্মিরবাসী আর পার্বত্যবাসীদের উদাহরণে বুঝলেন। পরিষ্কার আপন-পরের ঝামেলা; পক্ষ-বিপক্ষের বিবাদ; স্বার্থের মামলা। কিন্তু এত রকম নারীবাদ কেন এই প্রশ্নটার মীমাংসা আরেকটু জটিল হতে পারে। আমাকে অনেকেই বলেন ‘আপনারে কিন্তু একদম হিন্দুদের মতো লাগে না।’ এটা শুনে আমি কিন্তু তব্দা মেরে যাই। প্রতিবার ভাবি যে পরেরবার আর তব্দা খাব না। কিন্তু আবারো সেই একই অবস্থা হয় পরের বার।
আমার কোনোই সন্দেহ থাকে না যে বক্তব্য কিংবা রায়প্রদানকারী ব্যক্তিটি এই বাক্যের মাধ্যমে আমার জন্য সাধ্যমতো প্রশংসা জুড়ে দিয়েছেন। কিন্তু ওই প্রশংসা গ্রহণে আমি হিন্দু থাকি, নাকি অহিন্দু হয়ে পড়ি; নাকি অগ্রহণে বেশি হিন্দু হয়ে পড়ি নাকি কীর থেকে যে কী হয়ে যায় মাথা-আউলানো একটা দশা। আউলানোর কারণ হলো এই যে, হিন্দুদের অব্যর্থভাবে চেনার জন্য ওই প্রশংসাকারী যে কতগুলো লক্ষণ মাথায় বহন করেন সেটার ভেজাল নিয়ে আলোচনা শুরু করা যায় না। আরো যায় না এটা ‘প্রশংসা’ হিসাবে তিনি করেছেন বলে। আমি সধবা বাঙালি হিন্দু নারী না যে আমার শাঁখাসিঁদুর না-দেখে তিনি এই শংসন করলেন। জগতে এক চেহারার ও আচরণের হিন্দু যে থাকার কোনো সম্ভাবনা নাই এই আলাপ তোলা তখন কি সোজা কাজ মনে করেন আপনারা?
আচ্ছা এই উদাহরণটা আপনাদের অপছন্দের হতে পারে। হিন্দুত্ব প্রায় বাপ-মায়ের দান ধরনের একটা জিনিস। এটা ঠিক মতাদর্শ বা ভাবনাচিন্তার জগতে বদলে ফেলার জিনিস হলো না। ঠিক আছে! জাতীয়তাবাদের কথাই ধরুন না। এক রকমের জাতীয়তাবাদী নাকি দুনিয়ায়? নাকি বাংলাদেশে? কিছু জাতীয়তাবাদী আছেন যাঁদের রবীন্দ্র নজরুল দ্বিজেন যে কারো গান কানে আসলেই সাথে-সাথে চোখে পানি চলে আসে। কিছু জাতীয়তাবাদী আছেন যাঁরা নিজেদের পরিচয় ঠিকঠাক বানানোর জন্য সকল সরকারী স্থাপত্যে গোল-গোল গম্বুজাকৃতির জানালা বসাতে চান। আবার কিছু জাতীয়তাবাদী আছেন যাঁরা রবি-সোম-মঙ্গল যে কোনো কোম্পানির ডাকে কাঠ ফাটা রোদ্দুরে গিয়ে পতাকা বানাতে দৌড়ান।
আবার কিছু জাতীয়তাবাদী আছেন যাঁরা প্রতিপক্ষের নামে কোনো বিমান বন্দর থাকলে সেটা বদলানোর জন্য আরবি ভাষার ব্যবহার করে ফেলতেও প্রস্তুত থাকেন। আবার কিছু জাতীয়তাবাদী আছেন যাঁরা বাংলাদেশে আর কোনো জাতির নাম শুনলেই ‘কাইটা হালা’ ‘মাইরা হালা’ মুডে থাকেন। এঁদের মধ্যে আবার নরমপন্থীরা মারাকাটার রাস্তা না বলে বলেন ‘অরা কিন্তু বাইরে থেকে আসছে’। অন্য কিছু জাতীয়তাবাদী আছেন যাঁরা ৭০/৮০ বছর মাত্র আগে বানানো মানচিত্রের বাইরে বা আগে কিছু যে ছিল বা আছে তা বেবাক ভুলে গিয়ে থাকতে চান। অন্য আরেকদল আবার হাজার বছরের ‘আবহমান’ হিসাব করতে গিয়ে জোরাজুরি করে অংক মিলিয়ে দেন। আবার অন্য কিছু জাতীয়তাবাদী ছিলেন যাঁরা মাত্র ৫০ বছর আগেও সামরিক বাহিনীর কোনো মাতব্বরি সহ্য করতে পারতেন না। এমন জাতীয়তাবাদীও ৪০ বছর আগে কম ছিলেন না যাঁরা দেশজ শিল্পবিকাশের জন্য জানবাজি চেষ্টা করেছিলেন। বলে শেষ করা যাবে না কত রকম জাতীয়তাবাদী! তাহলে হঠাৎ করে, নারীবাদীদের এত রকমফের নিয়ে আপনাদের কারো কারো এত মাথাগরম হয়ে যাচ্ছে কেন?
আপনি না হোন, এই রাগটা যে দেখা যাচ্ছে তা তো সত্যি নাকি? আসলে নারীবাদের রকমফের নিয়ে বিদ্বেষকারীদের সমস্যা হয় না। এটা আজকে আমরা ভালভাবে বুঝে নেবার চেষ্টা করব। এটা আসলে একটা সামনে পাওয়া ‘দোষ’, একটা অজুহাত, একটা ভুজুংভাজুং যার মাধ্যমে নারীবাদের বিরোধিতা চালানো যাবে বলে তাঁরা সাব্যস্ত করেন। ‘নিজেগো মধ্যেই কোনো ঠিক নাই!’ — এইরকম একটা অবস্থান নিয়ে নিজের কাছে নিজের বিদ্বেষকে সিদ্ধ বানানোর একটা উপায় এটা। এত রকম নারীবাদ আছে বলেই তো আপনার পক্ষে বরং কোনো একটা রকমের প্রতি কিছুটা প্রশ্রয় থাকতে পারত। সেটাই তো সহজ বুদ্ধিতে মাথায় আসে। লক্ষ্য করে দেখবেন, বৈষম্যের লোপ চান এমন রাজনৈতিক দলগুলো তো বটেই, সরকারী দলে পর্যন্ত নারী শাখা খুলে রাখা হয় এবং নারী-অধিকার বিষয়ক সভা-সম্মেলনে তাঁরা যোগও দেন। দেশে দেন, বিদেশে দেন।
হতে পারে তাঁরা সবসময় ‘নারীবাদ’ শব্দটা নিয়ে অত শান্তি পান না; ‘অধিকার’ দিয়ে চালিয়ে দেন। তারপরও তাঁরা এরকম করেন কেন! করেন, কারণ তাঁরা নিজেদের পছন্দমতো মাপে ও বৈশিষ্ট্যে একটা কিছু দাঁড় করাতে চান যাতে তাঁরা বলতে পারেন ‘ও একখান তো আমাদেরও আছে’। এরকম কাস্টমাইজড করে হলেও কিন্তু তাঁরা স্রোতে থাকতে চান; কারণ একদম না-থাকাটা প্রায় চক্ষুলজ্জার পর্যায়ে চলে গেছে। তাহলে চক্ষুলজ্জামূলক হলেও একটা অংশ আপনি বাছাই করতে পারতেন! আপনিও আপনার মনমতো কিছু একটা কাস্টমাইজ করে নিতে পারতেন; ঢাকার কিছু গুরু ও দল যা করেছিলেন। এসব না করে যেহেতু আপনি বহুবিধতার অভিযোগ করেন, তার মানেই আপনি কোনমতেই নারীর বঞ্চনা বা দাবিটাবি নিয়ে ভাবতে রাজি না। কেউ ভাবুক তাও চান না।
আমাকে জাতীয়তাবাদ নিয়ে খোঁটা দিয়ে লাভ নেই। আপনারা যদি ভাবেন যে আমার কোনো রকমেরই জাতীয়তাবাদের প্রতি প্রশ্রয় ছিল না, তা আসলে একশ ভাগ ঠিক নয়। দেশজ শিল্পবিকাশের জাতীয়তাবাদীরা আজ থাকলে আপনাদের তা মনে হতো না। আমার এই মানব পতাকা-বানানো, টি-শার্ট বানানো জাতীয়তাবাদ বেশি অসহ্য তাও ঠিক।
আদাবর, ১২ জুলাই ২০২১
কভারে মানস চৌধুরী; ছবি. শরৎ চৌধুরী, ২০১৭