বিজ্ঞানের জগতে যেন ঝড় তুলেছে জিন-পরিবর্তনের এই নতুন সিস্টেম।
CRISPR হচ্ছে জেনেটিক কোড পরিবর্তন করার একটা যুগান্তকারী পদ্ধতি। এর মাধ্যমে হয়ত কোনোদিন আমরা পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া কোনো প্রজাতিকে আবার পৃথিবীর বুকে ফিরিয়ে আনতে পারব, কিংবা কোনো দুরারোগ্য ব্যাধির প্রতিষেধক আমরা বের করতে সক্ষম হব।
CRISPR প্রযুক্তি তৈরি করা হয় ব্যাকটেরিয়া ও এককোষী জীবদের প্রাকৃতিক অভিযোজন ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে। CRISPR এর পূর্ণরূপ হচ্ছে Clustered Regularly Interspaced Short Palindromic Repeats।
এক কথায় বলা যায় CRISPR হচ্ছে জেনেটিক কোডের একটা নির্দিষ্ট ফরম্যাট, যা দিয়ে ওই কোডকে চিহ্নিত করা যায়। CRISPR এর সিকোয়েন্সগুলি জিনে বার বার দেখা যায়, যদিও অনেক সময় তারা বিপরীত সিকোয়েন্সে থাকে। তাই একে বলা হয় প্যালিন্ড্রোমিক।
মাইকেল ট্যাব, আন্দ্রিয়া গাওরিলেভস্কি, জেফরি ডেলভিসিও
সায়েন্টিফিক আমেরিকান, ২২ জুন ২০২১
প্যালিনড্রোম কথাটা হয়ত অনেকে শুনে থাকবেন। যে শব্দের বর্ণ সামনে ও পেছন থেকে একই রকম তাদের বলা হয় প্যালিনড্রোম। যেমন MADAM শব্দটি একটি প্যালিনড্রোম শব্দ। ডিএনএ’র মধ্যে প্রায়ই প্যালিনড্রোম সিকোয়েন্স দেখা যায়। এর মধ্যে কিছু ক্ষতিগ্রস্ত ডিএনএ কোডের ব্যাকআপ হিসেবে কাজ করে। আর অন্যগুইকে দেখা যায় ক্যানসারের মিউটেশনের সময়।
কিছু এনজাইম আছে যারা CRISPR এর সাহায্যে ডিএনএ’র পুনরাবৃত্তি বুঝতে পারে এবং ডিএনএ’কে জায়গা মতো ভেঙে তাতে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রবেশ করাতে পারে। একে বলা হয় “স্পেসার”। স্পেসারের মাধ্যমে এমন সব ভাইরাসের জেনেটিক কোড প্রবেশ করানো হয় যেগুলি আগে আক্রমণ চালিয়েছিল।
এই ধরনের আক্রমণ বিবর্তনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এর মাধ্যমেই আমাদের শরীর বাইরের শত্রু থেকে নিজের প্রতিরোধ ব্যবস্থা বা ইমিউনিটি তৈরি করে।
১৯৮০ সালে গবেষকরা ই কোলাই ব্যাকটেরিয়ার ওপর গবেষণা চালাতে গিয়ে CRISPR আবিষ্কার করেন। ই কোলাই যখন ভাইরাসের আক্রমণ থেকে নিজেকে প্রতিরোধে সক্ষম হয় তখন তারা নিজেদের জেনেটিক কোডে ভাইরাসের ডিএনএ’র কিছু অংশ যুক্ত করে ফেলে। কেবল ই কোলাই এই কৌশল ব্যবহার করে তা নয়। ১৯৮০ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে বিজ্ঞানীরা অনেক ব্যাকটেরিয়া ও এককোষী জীবের মধ্যে এই আচরণ আবিষ্কার করেন।
সম্পূরক আরএনএ স্ট্র্যান্ড থেকে কোড অনুলিপি করার সময় কোষগুলি এই সিকোয়েন্স টেমপ্লেটের মতো ব্যবহার করে। যখন ভাইরাসের জেনেটিক কোড টেমপ্লেটের সাথে মিলে যায় তখন সেটা কোষে প্রবেশ করে। তখন সম্পূরক আরএনএ একে বেঁধে ফেলে। CRISPR এর সাথে সম্পর্কিত একাধিক এনজাইম আছে যাদেরকে বলা হয় “Cas” এনজাইম। এই “Cas” এনজাইমকে তখন বলা হয় আক্রমণকারী ডিএনএকে কেটে ফেলতে। এভাবে ভাইরাসের আক্রমণ প্রতিরোধ করা হয়।
CRISPR একটি অত্যন্ত কার্যকর সিস্টেম। এর পরিবর্তন বা সংশোধন করাও বেশ সহজ। তাই CRISPR ব্যবহার করে আমরা ইচ্ছামতো একটা কোষের জেনেটিক কোড বদলাতে পারি।
২০১২ সালে ফরাসি অণুজীববিজ্ঞানী ইমানুয়েল শারপঁসিয়ে ও আমেরিকান জৈবরসায়নবিদ জেনিফার এ ডাউডনা আবিষ্কার করেন যে “Cas” এনজাইমকে প্রোগ্রাম করার মাধ্যমে আরএনএ সিকোয়েন্স ব্যবহার করে যে কোনো জিনোমের অংশ কাটা যায়।
এই আবিষ্কারের জন্য তারা ২০২০ সালে রসায়নে নোবেল পুরষ্কার পান। আর CRISPR-এর ব্যবহারের যুগান্তকারী সূচনা সেই থেকে শুরু হয়। যদিও বিজ্ঞানীরা এখনও এর সার্বিক সম্ভাবনা কাজে লাগানো থেকে অনেক দূরে।
Cas9 এনজাইম অনাকাঙ্ক্ষিত জিনকে বের করে দেয়া বা দমিয়ে দেয়ার জন্য বেশ কার্যকর। তবে চিকিৎসার জন্য কেবল অনাকাঙ্ক্ষিত ডিএনএ কেটে ফেলা যথেষ্ট নয়। বিজ্ঞানীদের আরও জানতে হবে কীভাবে ডিএনএ নিজেকে মেরামত করে।
কোষগুলি যখন নিজে নিজেই ডিএনএ মেরামত করে তখন তারা এমন দৈবচয়ন পদ্ধতি ব্যবহার করে যেখানে অনেক ভুল থাকে। গবেষকরা মেরামত প্রক্রিয়াকে নির্দেশ করার জন্য টেমপ্লেট সহ কোষগুলি সরবরাহ করতে পারেন, তবে তারা এখনও এটিকে আরো নির্ভরযোগ্য করার জন্য কাজ করছেন।
গবেষকেরা প্রাণিজগতে CRISPR-এর বিভিন্ন ব্যবহারিক প্রয়োগ দেখাতে সক্ষম হয়েছেন। যেমন রোগমুক্ত মুরগী ও শূকরের জিন উদ্ভাবন, কিংবা ডিম পাড়ে না এমন মশার জীন উদ্ভাবন। কিন্ত এখনও তাদের অনেক প্রকল্পের কাজ চলমান আছে। যেমন আছে রোগ প্রতিরোধক শস্য উদ্ভাবন এমনকি ওয়াইনে ব্যবহৃত আঙুরের জাতও। এছাড়া কিছু উচ্চাবিলাসী প্রকল্প আছে। এর একটি হচ্ছে এমন শূকরের জাত উদ্ভাবন যাদের দেহ থেকে অঙ্গ নিয়ে মানব শরীরে প্রতিস্থাপন করা যাবে। আরো আছে বিলুপ্ত প্যাসেঞ্জার কবুতরের জাতকে পৃথিবীতে আবারো নিয়ে আসা। এর জন্য তাদের কাছাকাছি জাতের অন্য পাখিদের জিন এডিট করতে হচ্ছে।
মানুষের জিন নিয়ে কাজ করার ব্যাপারে এখনও গবেষকেরা দ্বিধার মধ্যে আছেন। কারণ আমাদের জিন পরিবর্তন করতে গিয়ে উপকারের চেয়ে বেশি সমস্যা তৈরি হয়ে যেতে পারে।
যদিও Cas9 এনজাইম দিয়ে নির্দিষ্টভাবে ডিএনএ কাটা যায়, সম্প্রতি গবেষণায় দেখা গেছে এর কারণে দূরে থাকা অন্য জিনগুলি প্রভাবিত হতে পারে। আবার আমরা যদি মানুষের জিন নিয়ে গবেষণার সব কিছু নিরাপদে সম্পন্ন করতেও পারি, অনেক বিশেষজ্ঞ মানুষের জিন পরিবর্তনের গবেষণার নৈতিক ভিত্তি নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন। যেমন ইউজেনিকস এবং ডিজাইনার বেবি নিয়ে তাদের শঙ্কা আছে। যদি পিতামাতারা গবেষকদের দিয়ে পয়সার বিনিময়ে তাদের সন্তানের ডিএনএ পরিবর্তন করে আরো স্মার্ট ও সবল বাচ্চা তৈরি করেন তবে পৃথিবীর ভারসাম্য নষ্ট হবে এবং একটা অসম সমাজ তৈরি হবে।
২০১৮ সালে চীনের গবেষক হে ঝি দাবি করেন তিনি CRISPR ব্যবহার করে এইচআইভি প্রতিরোধে সক্ষম মানবশিশু তৈরি করতে পেরেছেন। চীনের ন্যাশনাল হেলথের নিয়ম অমান্য করার জন্য তার দাবি যাচাই না করেই তাকে তিন বছরের জেলের শাস্তি দেয়া হয়েছিল।
তবে CRISPR মানবশিশুর উপরে ব্যবহার করা অবৈধ হলেও কিছু ক্ষেত্রে এর ব্যবহার হয়তো এক সময় প্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়াবে।
আরো পড়ুন: CRISPR বা জিন এডিটিং-এর অন্ধকার দিক
২০২০ সালে অ্যামেরিকান গবেষকেরা প্রথম বারের মতো CRISPR সরাসরি প্রবেশ করার মাধ্যমে মানবশরীরে এর ক্লিনিক্যাল ট্র্যায়াল শুরু করেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল জেনেটিক মিউটেশন বা পরিব্যক্তি প্রভাবিত করে অন্ধত্ব কীভাবে নিরাময় করা যায় তা বের করা। অনেক গবেষক মনে করেন CRISPR ব্যবহার করে থেরাপি দেয়া হলে অনেক বংশগত রোগের নিরাময় করা সম্ভব। তারা একাধিক প্রাণীর উপরে গবেষণা চালিয়ে এমন ফলাফল পেয়েছেন। তবে মানব শরীরে CRISPR ব্যবহারের ঝুঁকি মাথায় রেখে বলতে হয় চিকিৎসাক্ষেত্রে CRISPR-এর পূর্ণ সুফল পাওয়া থেকে এখনো আমরা অনেক দূরে আছি।
CRISPR বিজ্ঞানকে জীবনের কোড নিয়ে নাড়াচাড়া করার সুযোগ করে দিয়েছে। কিন্ত আসল প্রশ্নটা রয়েই যায়। আমরা কি নিরাপদে এবং নৈতিক মানদণ্ড বজায় রেখে এর ব্যবহার করতে পারব যাতে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি না হয়?
অনুবাদ: আমিন আল রাজী