দুপুরে এক হোটেলে ভাত খাইলাম আমি আর ফারহান মাসউদ। ছোট হোটেল। ভিতরে চারটা টেবিল, হাতের ডানে একটা দরজা দিয়া আরেক রুম। রুমে ঢুকলে একটা সিঁড়ির নিচের অংশ পড়ে। সম্ভবত কোনো বিল্ডিংয়ের গাড়ি পার্কিংয়ের অংশ ছিল ওইটা, রুম কইরা হোটেল ভাড়া দিছে। ওই ছোট রুমে দুইটা টেবিল। চারজনের বসার আয়োজন। শেষে একটা স্ট্যান্ড ফ্যান। পিছনটা তো উন্মুক্তই, তারপরে সিঁড়ি।
হোটেলের চারপাশে গোবর বা ছাগলের গন্ধ। ফারহানকে বললাম, কোনো কিছু বিশ্রী গন্ধ আসতেছে। ফারহান বলল, হ্যাঁ, ছাগলের গন্ধের মত।
খাওয়ার আগে হোটেলের বাইরে বেসিনে হাত ধুইতে গিয়া দেখি উল্টাপাশে অসংখ্য ছাগল বাঁধা। কিন্তু কোনো সাউন্ড নাই। পাশে গরুও আছে।
সিংককে বেসিন হিসেবে বসানো হইছে হোটেলের বাইরে। বেসিন, পানির ফিল্টার ও ইনস্ট্যান্ট কফি মেশিন এই সিরিয়ালে। ছোট একটা লাক্স সাবান, সিংকের সমতল অংশগুলি সাদা হইয়া আছে। সম্ভবত ব্লিচিং পাউডার। তার উপরেই সাবানটা, সাবানের জায়গা সাবান পানি দিয়া অল্প কাদা হইয়া আছে। হোটেলের গলির অংশটা তখন দেখলাম। একদম গঞ্জের মত লাগল।
কি যে মজার মাছ ভর্তা আর বেগুন ভর্তা খাইলাম ওখানে। অন্যান্য সময় পয়সা খরচ কইরা রেস্টুরেন্টে খাই, কিন্তু কোথাও’ই খাবার মন মতো হয় না। আজকে যদিও মাংস তেমন ভালো ছিল না, ভর্তা অসম্ভব ভালো ছিল।
হোটেলে খাইতে আসা লোকজন ও ছেলেরা সবাই বারবার আমার দিকে তাকাইতেছিল। ফারহান বলল, এখানে বোধহয় মেয়েরা তেমন আসে না, এইজন্য এত তাকাইতেছে।
হাত ধুইয়া ভিতরে গিয়া বসলাম। হোটেলে তিন চারজন ছেলে সার্ভ করে। নীল গেঞ্জি পরা তরুণ একজন আমাদের টেবিলে আসলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আলু ভর্তা আছে না? ছেলেটা আগায়া আইসা একটু ঝুঁকল আমাদের দিকে। স্বর নামায়া বলল, আলু ভর্তা ভালো হবে না। অন্য ভর্তা দিতেছি।
আমি নিশ্চিত আলু ভর্তা অন্যেরা তখনো খাচ্ছে। লোকজন দেখলাম আসা মাত্র তাদের টেবিলে ভাত তরকারি দেওয়া হচ্ছে। কেউ’ই কাউকে কিছু জিগাইতেছে না।
আমি ফারহানকে বললাম, এই যে ধরেন মানুষ মেয়েদের বদনাম করে, তারা সব জায়গায় গিয়া নাকি বাড়তি সুবিধা নেয়। তা যদি সমস্যার হয়, সেইটা তো পুরুষদের সমস্যা। পুরুষরা বাড়তি সুযোগ দিবে আর মেয়েরা নিলে সমস্যা!
ফারহান তার দিক থেকে এই বিষয়ে কিছু বলল বা বলল না। মাছের পেইনলেস ডেথ নিয়া বলল। যে, মাছদের নিয়া একটা ডকুমেন্টারি সে দেখছে বা কোথাও এই বিষয়ে পড়ছে। মাছেরা নাকি মানুষদের চেয়েও বেশি রঙ দেখতে পায় এবং প্রাণী হিসেবে ওরা অনেক স্মার্ট। আরো বলল, আমেরিকার কিছু ফার্মে পশু জবাইয়ের আগে অজ্ঞান করে নেওয়া হয়। ফারহানের সঙ্গে থাকলে এইটা সুবিধা, অনেক কিছু আর পড়তে হয় না আমার।
হোটেলের সেই তরুণ নীল গেঞ্জি পরা ছেলে দুই প্লেট ভাত আর বেগুন ও মাছ ভর্তা নিয়া আসল। কোনো তরকারি আনে নাই৷ তরকারি যে আছে সেই কথাও বলে নাই আমাদেরকে।
ভাত সাধারণ হোটেলে যত দেয় আমাদের প্লেটে দেখলাম তার চেয়ে অনেক কম। এমনকি ওনারাই আশেপাশের লোকজনকে যতগুলা কইরা দিচ্ছিল, আমাদেরকে দিছে তার চেয়ে অনেক কম। ছেলেটা আচরণও করতেছিল ওয়েটারদের মত।
সে একটা দেড় লিটারের পানির বোতল নিয়া আসলো। ছোট বোতল নাকি নাই। আর দুইটা মাংস দিতে বললাম, একটা নিয়া আসল।
ফারহান বলল, এইটা আগে খাই আমরা তারপর লাগলে আরেকটা নিবো। আমি বললাম, না, এখনই অর্ডার দেই, সমস্যা তো নাই।
মাংস দেওয়ার পর দেখলাম একটা ছোট বাটিতে তিন চার টুকরা খারাপ চেহারার মাংস। আমি আরেকটা দিতে বললাম। এ’ই কয়েকটা জিনিস আনতে সে চার থেকে পাঁচবার আসল গেলো।
সেকেন্ড টাইম মাংসটা আইনা ঠিক আমার প্লেটের পাশে রাখল। যেন, এইটা আপনার। আগেরটা ফারহানের প্লেটের কাছে রাখছিল।
সেকেন্ড টাইমের বাটিটা দেখলাম আকারে বড়। মাংসের টুকরাগুলি দেখতে ভালো এবং ঝোলের পরিমাণ বেশি।
তার কিছুক্ষণ পর নীল গেঞ্জি পরা ছেলে ওয়েটারদের মত আইসা ঝুঁইকা ফারহানকে জিজ্ঞেস করল, ভাই, আরো ভাত দিব?
ফারহান বলল, না, আর লাগবে না।
শুইনা গেল গা। আমারে আর ভাত লাগবে কিনা জিজ্ঞেস করল না।
যেন মেয়েদের আর ভাত লাগে না, এইটা সে জানে। হয়ত আসলেই লাগে না। কিন্তু তখন জিজ্ঞেস করলে আমি হয়ত না করতাম না। দুইটা ভর্তা দিয়াই প্লেটের তিন ভাগের দুইভাগ ভাত খাইছিলাম। মাংসের জন্য অল্প ভাত ছিল। মাংস ভালো না হওয়ায় না আর নিতে হয় নাই। কিন্তু ভর্তা দিয়া চাইলে আরো খাইতে পারতাম।
ফারহান তার বাটির মাংস খাইতে গিয়া বলল, মাংস শক্ত রয়ে গেছ ৷ আমি আমার বাটি থেকে নিতে বললাম ওনাকে। আমার বাটিরগুলি নরম ছিল।
লোকজন এত বেশি তাকাচ্ছিলো যে মনে হইতেছিল আমার একটা ফোটো তুইলাই ফ্রেম কইরা টাঙায়া রাখবে হোটেলে।
নীল গেঞ্জির ছেলে আমাদের খাওয়ার শেষ দিকে সিঁড়ির রুমে গেল গা তার চেয়ে কয়েক বছরের ছোট একজনকে ধরায়া দিয়া। তাকে বইলা পাঠাইলো জিজ্ঞেস করতে আমাদের আর কিছু লাগবে কিনা। এইটা আমরা শুনতে পাইলাম।
কমবয়সী ছেলেটা মুখে চাপা হাসি ও পায়ে জড়তা নিয়া কয়েক পা সময় নিয়া ফালায়া (ছোট হোটেল), ফারহানের মাথার উপর দিয়া আমাদের প্লেটের অবস্থা দেইখা কিছু না বইলা আবার গেল গা।
তাকে বিল দিতে বললাম। এইটুকু খাবারে তিনশো টাকার বেশি আসল। এর আগেও আমরা খাইছি অন্য হোটেলে। দুইজন কয়েক পদ দিয়া ভাত খাইয়া ১৩০ টাকার মত আসছিল।
বিল দিলাম। কমবয়সীর কাছে বিল জানতে চাওয়ার সময় থেকে সে আমাদের টেবিলের সামনে দাঁড়ায়া থাকল, টাকা না দেওয়া পর্যন্ত গেল না।
নীল গেঞ্জি ছেলেটা আমরা থাকার সময়টাতে আর সিঁড়ির রুম থেইকা আসল না। টাকা দিয়া আমরা আর বসলাম না। বের হইয়া আরেকটা গলিতে একটা কনফেকশনারিতে গেলাম। ফারহান মাউন্টেন ডিউ খাইলো, আর আমি একটা পেপসি। এই পেপসি খাওয়া নিয়া এখনো বিরক্তি আছে কেন খাইলাম। মাঝখানে না খাইতে না খাইতে অভ্যাস হয়ে গেছিল৷ এখন খাইলে এর টেস্ট নিয়াও সমস্যা হয়।
৮ নভেম্বর ২০২১