২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বরে সুমাত্রায়, সমুদ্র উপকূলবর্তী সাগরের নিচে সংঘটিত ভূমিকম্পটি এ যাবতকালের রেকর্ডকৃত তৃতীয় শক্তিশালী ভূকম্পন ছিল। এর ফলে একটা ভয়াবহ সুনামিও এসেছিল। ভারত মহাসাগর থেকে ধেয়ে আসা কয়েক মিটার উঁচু ঢেউ হাজারো মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয় সেবার।
আজকাল হাজার হাজার মেজারমেন্ট স্টেশন বিশিষ্ট আগাম পূর্বাভাস ব্যবস্থাপনা তৈরি করা হয়েছে এ ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকিতে থাকা মানুষকে সতর্ক করতে। ভারত মহাসাগরীয় সুনামি সতর্কতা ও নিরসন ব্যবস্থাপনা (The Indian Ocean Tsunami Warning and Mitigation System বা IOTWS), ভারত মহাসাগরের তলদেশে সংঘটিত ভূমিকম্প সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে। এই সিস্টেম আসন্ন কোনো সুনামি চিহ্নিত করতে পারলে তা ইন্দোনেশিয়া ও আরব উপদ্বীপের মধ্যবর্তী অঞ্চলে বসবাসকারী অধিবাসীদের দ্রুত জানিয়ে দেয়।
আরো পড়ুন: রাশিয়ায় ২৮ হাজার বছর আগের সিংহশাবক এর হিমায়িত মরদেহ আবিষ্কার
মহাসাগরে ভূমিকম্প পরিমাপক স্টেশনগুলির নেটওয়ার্ক এবং স্যাটেলাইটের সাথে সংযুক্ত ভাসমান বয়াগুলি পানির কম্পন ও ওঠানামার তথ্য সংগ্রহ করে। এই সতর্কতা সিস্টেমটি শুধুমাত্র প্রযুক্তির দিক দিয়েই জটিল নয়, একইসাথে খুব ব্যয়বহুলও। প্রতি বছর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা চালাতে ভারত মহাসাগর তীরবর্তী দেশগুলির ৫০ থেকে ১০০ মিলিয়ন ডলার খরচ হয়।
জার্মানির কন্সটান্স শহরের ম্যাক্সপ্লাংক ইনস্টিটিউটের অ্যানিমেল বিহেভিয়র বিশেষজ্ঞ মার্টিন ওয়েলস্কির নেতৃত্বে একদল আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানী বর্তমানে একটি ব্যতিক্রমধর্মী ও সরল আগাম সতর্কতা ব্যবস্থার ওপর কাজ করছেন। এর নাম দেয়া হয়েছে ইকারাস (ICARUS)। ইকারাস-এর পূর্ণরূপ হচ্ছে ইন্টারন্যাশনাল কর্পোরেশন ফর অ্যানিমেল রিসার্চ ইউজিং স্পেস (International Cooperation for Animal Research Using Space)।
প্রাণীদের প্রবাদতূল্য যে “সপ্ত-অনুভূতি”র কথা বলা হয়, বিভিন্ন প্রাণীর বিস্ময়কর সেই সংবেদন ক্ষমতাকে মানুষের কাছে বোধগম্য করে তোলার চেষ্টা করছে ইকারাস।
ঐতিহাসিক নথি থেকে জানা গেছে, এমনকি প্রাচীন সভ্যতাগুলিও প্রাণীদের কাছ থেকে পাওয়া জ্ঞান থেকে উপকৃত হয়েছিল। এবং তারা প্রাণীদের কার্যক্রম বিভিন্ন শ্রেণীতে ভাগও করেছিল। তাছাড়া প্রাণীদের প্রাকৃতিক দুর্যোগ সম্পর্কিত পূর্বাভাস-এর ওপর অনেক প্রতিবেদন ও গল্প পাওয়া যায়, যে তাদের আগাম সতর্কতা ব্যবস্থা আছে। যেমন, আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের আগে পাখিদের চঞ্চল আচরণ, ভূমিকম্পের আগে সাপদের শীতঘুম থেকে জেগে ওঠা এবং বড় ধরনের ভূমিকম্পের আগে ব্যঙদের প্রসব মৌসুমের মধ্যেই আবাসস্থল ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া।
আরো পড়ুন: বয়স্করা কেন সহজেই নিজেদের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন?
শতাব্দীকাল ধরে ইন্দোনেশিয়ার বাচ্চাদের গাওয়া একটি গান থেকে জানা যায়: “যখন প্রাণীরা উদ্ভট আচরণ করে, তখন সাগর থেকে দূরে চলে যাও এবং উঁচু জায়গায় অবস্থান গ্রহণ করো।” ইন্দোনেশিয়ার লোকেরা বলে, সুনামি আঘাত হানার আগে হাতির পাল উপকূলবর্তী এলাকা ছেড়ে দেশের মধ্যবর্তী অঞ্চলের দিকে পালাতে থাকে। যাইহোক, প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক সমাজে প্রাণীদের এই দক্ষতাগুলি গুরুত্ব হারিয়েছে এবং তাদের পূর্বাভাস সংকেতগুলিও উপেক্ষিত হয়েছে।
কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে পাওয়া এই তথ্যগুলি কি সঠিকভাবে নিরাপত্তামূলক সতর্কতা সংকেত দিতে সক্ষম? প্রযুক্তিগত সহযোগিতা ছাড়া এই প্রশ্নের উত্তর দেয়া যাবে না। যেহেতু আসন্ন বিপদ সম্পর্কে প্রাণীদের এই অস্বাভাবিক আচরণ শুধুমাত্র বিভিন্ন প্রতিবেদনেই প্রকাশিত হয়েছে। আর কেবলমাত্র অনেক প্রচেষ্টার ফলেই এই বিষয়টা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণ করা যেতে পারে।
এই ব্যাপারে মার্টিন ওয়েলস্কির সাথে কর্মরত একদল বিজ্ঞানী প্রথমবারের মতো একটি বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা চালিয়েছে। তারা মাউন্ট এটনায় কিছু ছাগলের গায়ে ট্রান্সমিটার বসিয়ে কয়েক বছর ধরে তাদের গতিবিধির ওপর নজর রেখে তা নিবন্ধিত করেছে এবং পূর্বে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের সময় প্রাণীদের আচরণ কেমন ছিল, তার সাথে মিলিয়ে দেখেছে। ২০১২ সালের ৪ জানুয়ারি ৪:২০ মিনিটে সেই প্রত্যাশিত মুহূর্তটি এসেছিল। গবেষকরা ছাগলদের অস্বাভাবিক কার্যক্রম রেকর্ড করার ৬ ঘণ্টা পর মাউন্ট এটনা’র বাতাসে প্রচুর পরিমাণে লাভা ও ছাই উদগীরণ শুরু হয়। দুই বছর ধরে চলা এই গবেষণায় বিজ্ঞানীরা পূর্বে সংগৃহীত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে এমন ৭টি অগ্নুৎপাত সম্পর্কে আগাম ভবিষ্যৎবাণী করতে পেরেছিলেন।
গবেষকরা ছাগলদের অস্বাভাবিক কার্যক্রম রেকর্ড করার ৬ ঘণ্টা পর মাউন্ট এটনা’র বাতাসে প্রচুর পরিমাণে লাভা ও ছাই উদগীরণ শুরু হয়।… বিজ্ঞানীরা পূর্বে সংগৃহীত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে এমন ৭টি অগ্নুৎপাত সম্পর্কে আগাম ভবিষ্যৎবাণী করতে পেরেছিলেন।
২০০৯ সালের এপ্রিলে ইতালির লা’কুইলা শহরে সংঘটিত বড় ধরনের ভূমিকম্পের জায়গাটির আশেপাশে ব্যাঙের আচরণ বিশ্লেষণ করে দেখেছিলেন গবেষকরা। বিশ্লেষণে দেখা গিয়েছিল, এই উভচরেরা ভূমিকম্প শুরুর ৫ দিন আগে থেকেই অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করেছিল এবং নিজেদের যৌন কার্যক্রম থেকেও বিরত থেকেছিল।
আরো পড়ুন: মানুষের আয়ুর সীমা—১৫০ বছর?
প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, প্রাণীরা তাদের শরীরের পরিমাপক ব্যবস্থার মাধ্যমে আসন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যয় সম্পর্কে মানুষের তুলনায় অনেক আগেই টের পায়। তখন তারা এই তথ্যটি তাদের বিভিন্ন আচরণের মাধ্যমে প্রকাশ করে। এমনটাই হচ্ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ সম্পর্কে প্রাণীদের পূর্বাভাস ব্যবস্থাপনা। প্রাণীদের এই জ্ঞান হাজারো মানুষের প্রাণ বাঁচাতে পারে। এতে আগাম পূর্বাভাসের প্রতিটা মিনিটে আরো বেশি সংখ্যক লোককে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। এছাড়াও ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে, এমন ভবন থেকে লোকজন সরিয়ে নেয়ার সুযোগ থাকে এবং ঝুঁকিপূর্ণ জায়গাগুলি খালি করারও সময় পাওয়া যায়। এই তথ্যগুলি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির জন্যেও মূল্যবান হতে পারে এবং ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনতে পারে।
তবে এরকম একটি সতর্কতা ব্যবস্থাপনা আলাদাভাবে তৈরির জন্য যেসব তথ্য হাতে আছে, তা পর্যাপ্ত নয়। কোন প্রাণী কোন ঘটনায় সাড়া দেয় এবং সাড়া দেয়ার ক্ষেত্রে তারা কতটা বিশ্বাসযোগ্য, এসব বোঝার জন্যে আরো বেশি বিপর্যয়কর ঘটনা, আরো বেশি প্রাণীর আচরণ এবং আরো ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির প্রাণীদের বিশ্লেষণের আওতায় আনতে হবে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আগে প্রাণীদের আগাম পূর্বাভাস ব্যবস্থা কীভাবে কাজ করে, তার শর্ত তৈরি করাই হচ্ছে ইকারাস-এর কাজ। আধুনিক ক্ষুদ্রাকৃতির ট্রান্সমিটারের সাহায্যে আজকাল অধিক পরিমাণ তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। এই তথ্যগুলি আমাদের জানাচ্ছে, আগাম পূর্বাভাস পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রাণীদের ব্যবহৃত সেন্সরগুলি উপযুক্ত কিনা। আর যদি উপযুক্ত হয়ও, তাহলে কোনগুলি।
ভূমিকম্প, আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত, অথবা ঘূর্ণিঝড় সম্পর্কে বিশ্বাসযোগ্য পূর্বাভাস দেয়ার ক্ষেত্রে ইকারাস চূড়ান্তভাবে প্রাণীদের জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে মানুষের উপকার করতে পারবে।
ইকারাস থেকে অনুবাদ: মাহতাবুল আলম