লেখকের বন্ধু আর্থার ওবারমায়ারের নোট

১৯৫৯ সালে, আমি বোস্টনে অ্যালাইড রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট কোম্পানিতে একজন বিজ্ঞানী হিসেবে কাজ করেছি। এটি একটি এমআইটি স্পিনঅফ কোম্পানি, যাদের ফোকাস ছিল মূলত বিমানের কাঠামোতে পারমাণবিক অস্ত্রের প্রভাবের ওপর। একটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার জন্যে সম্ভাব্য সবচেয়ে সৃজনশীল পন্থা বের করার জন্য কোম্পানিটি অ্যাডভান্সড রিসার্চ প্রজেক্ট এজেন্সি GLIPAR (গাইড লাইন আইডেন্টিফিকেশন প্রোগ্রাম ফর অ্যান্টিমিসাইল রিসার্চ) এর কাছ থেকে একটি কন্ট্রাক্ট পেয়েছিল।

আর্থার ওবারমায়ার (১৯৩১-২০১৬)

সরকার স্বীকার করেছে যে, বর্তমান প্রযুক্তির উন্নতি ও সম্প্রসারণে যতই খরচ করা হোক না কেন, তা আসলে অপর্যাপ্তই থাকবে। তাদের চাহিদা ছিল আমরা ও অন্যান্য ঠিকাদাররা যেন “আউট অফ দ্যা বক্স” চিন্তা করি।

আমি যখন প্রথম এই প্রকল্পের সাথে জড়িত হয়েছিলাম, তখন আমি পরামর্শ দিয়েছিলাম যে, আইজাক আসিমভ, যিনি ছিলেন আমার একজন ভালো বন্ধু , এখানে অংশগ্রহণ করার জন্যে একজন উপযুক্ত ব্যক্তি। আসিমভও তার ইচ্ছা প্রকাশ করেন এবং কয়েকটি বৈঠকেও আসেন। তবে তিনি শেষ পর্যন্ত কন্টিনিউ না করার সিদ্ধান্ত নেন, কারণ তিনি কোনো গোপন ক্লাসিফায়েড তথ্যের অ্যাক্সেস পেতে চান না; তিনি মনে করতেন যে, এটা তার মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সীমিত করবে।

যাইহোক, চলে যাওয়ার আগে তিনি তার একক আনুষ্ঠানিক ইনপুট হিসাবে সৃজনশীলতার ওপর এই প্রবন্ধটি লিখেছিলেন। এই রচনাটি আমাদের ছোট গোষ্ঠীর বাইরে কখনো প্রকাশ বা ব্যবহার করা হয়নি। সম্প্রতি কিছু পুরানো ফাইল পরিষ্কার করার সময় এটিকে নতুন করে আবিষ্কার করার সাথে সাথেই মেনে নিয়েছিলাম যে, এর বিষয়বস্তু যখন এটি প্রথম লেখা হয়, আজকের দিনে ততটাই প্রাসঙ্গিক। এতে শুধুমাত্র ক্রিয়েটিভ প্রসেস এবং ক্রিয়েটিভ মানুষের প্রকৃতিই ব্যাখ্যা করা হয়নি, বরং সৃজনশীলতাকে উৎসাহিত করবে, এমন পরিবেশও বর্ণনা করা হয়েছে।


সৃজনশীলতার ওপর আইজাক আসিমভের ১৯৫৯ সালের প্রবন্ধ

অন ক্রিয়েটিভিটি

আইজাক আসিমভ

মানুষ কীভাবে নতুন আইডিয়া পেতে পারে?

প্রচলিত ধারণা অনুসারে, ক্রিয়েটিভ প্রসেস, তা যে ধরনেরই হোক না কেন, সমস্ত শাখা এবং বৈচিত্র্যের মধ্যে মূলত একইভাবে কাজ করে। একটি নতুন আর্ট ফর্ম, একটি নতুন গ্যাজেট, একটি নতুন বৈজ্ঞানিক নীতির বিবর্তন, ইত্যাদি সব কিছুর সাথেই কমন কিছু ফ্যাক্টর জড়িত। আমরা নতুন বৈজ্ঞানিক নীতির “সৃষ্টি” বা পুরানোটির একটি নতুন প্রয়োগে বেশি আগ্রহী। তবে আমরা এই ব্যপারটা সর্বজনীনভাবে চিন্তা করতে পারি।

কোনো সমস্যার সঠিক সমাধান খোঁজার একটি উপায় হলো, অতীতের গ্রেট আইডিয়াগুলি বিবেচনা করা এবং সেগুলি কীভাবে তৈরি হয়েছিল, তা দেখা। দুর্ভাগ্যবশত, প্রতিটি প্রজন্ম উদ্ভাবনের জন্যে যে পদ্ধতি ব্যবহার করে থাকে, তা এমনকি “উদ্ভাবকদের” কাছেও স্পষ্ট থাকে না।

কিন্তু একই পৃথিবী-কাঁপানো আইডিয়া যদি একইসাথে এবং স্বতন্ত্রভাবে দুই ব্যক্তির মধ্যে ঘটে থাকে? তাহলে সম্ভবত, কমন যে ফ্যাক্টরগুলি জড়িত, সেগুলি সহজভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে। ‘ন্যাচারাল সিলেকশন’ বা প্রাকৃতিক নির্বাচন দ্বারা বিবর্তনের তত্ত্বটি বিবেচনা করুন, যা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রভাবে চার্লস ডারউইন এবং আলফ্রেড ওয়ালেস নিয়ে আসেন।

এখানে অনেকগুলি কমন বিষয় রয়েছে। তারা দুইজনেই দূরবর্তী স্থানে ভ্রমণ করেছিলেন, উভয়ই অদ্ভুত প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণী দেখেছিলেন এবং প্রজাতিগুলি কী পদ্ধতিতে স্থানভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়, তা দেখেছিলেন। উভয়ই এর একটি ব্যাখ্যা খুঁজতে গভীর আগ্রহী ছিলেন এবং উভয়েই ব্যর্থ হয়েছিলেন, যতক্ষণ না তারা ম্যালথাসের “এসে অন পপুলেশন” (Essay on population) পড়েছেন।

এটি পড়ার পর তারা দেখেছিলেন যে, কীভাবে অতিরিক্ত জনসংখ্যা এবং আগাছা দূর করার ধারণা (যা ম্যালথাস মানুষের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেছিলেন) প্রাকৃতিক নির্বাচনের (যদি সাধারণত প্রজাতির ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়) দ্বারা বিবর্তন মতবাদটির সাথে খাপ খায়।

স্পষ্টতই, তখনকার সময়ে, শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে ভালো ব্যাকগ্রাউন্ড নলেজ আছে, এমন লোকই নয়, বরং এমন ব্যক্তিরও প্রয়োজন ছিল, যারা আইটেম ১ এবং আইটেম ২-এর মধ্যে একটি সংযোগ তৈরি করতে সক্ষম, যা সাধারণত সংযুক্ত বলে মনে হয় না৷

নিঃসন্দেহে ১৯ শতকের প্রথমার্ধে, অনেক প্রকৃতিবিদ কীভাবে প্রজাতিগুলি নিজেদের মধ্যে আলাদা হয়েছিল, তা অধ্যয়ন করেছিলেন। অনেক অনেক মানুষ ম্যালথাস পড়েছিল। সম্ভবত কেউ কেউ একসাথে প্রজাতি অধ্যয়ন এবং ম্যালথাস পড়েছেন। কিন্তু আপনার দরকার ছিল এমন একজন লোক, যিনি প্রজাতি অধ্যয়ন করেছেন, ম্যালথাস পড়েছেন এবং ক্রস-কানেকশন করার ক্ষমতা রাখেন।

আইজাক আসিমভ (১৯২০-১৯৯২)

এটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট, এটাই সেই বিরল বৈশিষ্ট্য, যা অবশ্যই খুজে পেতে হবে। একবার ক্রস-কানেকশন তৈরি হয়ে গেলে এটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। থমাস এইচ. হাক্সলি ‘অন দ্য অরিজিন অফ স্পিসিজ’ পড়ার পর চিৎকার করে বলেছিলেন, “এসব আগে না ভাবার মতো বোকা আমি কীভাবে ছিলাম।”

কিন্তু কেন তিনি এসবের কথা ভাবেননি? মানুষের চিন্তার ইতিহাস দেখলে মনে হবে যে, একটি আইডিয়া ভেবে বের করা বেশ কঠিন, এমনকি সমস্ত তথ্য টেবিলে ছড়ানো থাকলেও। ক্রস-কানেকশন তৈরি করার জন্যে প্রয়োজন হয় এক প্রকার দুঃসাহসের। এটি আবশ্যক যে, যেকোনো ক্রস-কানেকশন, যার জন্যে সাহসের প্রয়োজন হয় না, তা একসাথে অনেকের দ্বারা সঞ্চালিত হয়। এবং এটি একটি “নতুন আইডিয়া” হিসেবে নয় বরং একটি নিছক “পুরনো আইডিয়ার ফলাফল” হিসেবে বিকাশ লাভ করে।

সবসময় একটি নতুন আইডিয়াকে তার পরের সময়ে গিয়ে যুক্তিসঙ্গত মনে হয়। শুরুর দিকে এটি সাধারণত অযৌক্তিক বলে মনে হয়। এটা শুনতে অযুক্তির চূড়ান্ত মনে হয়েছিল, যখন বলা হয়ছিল যে, পৃথিবী সমতল নয় বরং গোলাকার। বা সূর্য পৃথিবীকে কেন্দ্র করে নয়, বরং পৃথিবীই সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘোরে, বা গতিশীল বস্তুর গতি রক্ষা করার জন্যে ফোর্সের পরিবর্তে সে গতি থামানোর জন্যে ফোর্সের প্রয়োজন। ইত্যাদি ইত্যাদি।

যুক্তি, কর্তৃত্ব এবং কমনসেন্সকে সরাসরি মুখের ওপর চ্যালেঞ্জ করতে ইচ্ছুক একজন ব্যক্তিকে অবশ্যই যথেষ্ট আত্মপ্রত্যয়ী হতে হবে। এবং যেহেতু এমন ব্যক্তি খুব কমই থাকে, তাই আমাদের বাকিদের কাছে তাকে অবশ্যই একসেন্ট্রিক বা খামখেয়ালি (অন্তত এই ক্ষেত্রে) মনে হতে হবে। একজন ব্যক্তি এক বিষয়ে একসেন্ট্রিক মানে প্রায় অন্য সব ক্ষেত্রেও তিনি একসেন্ট্রিকই হন।

ফলস্বরূপ, যে ব্যক্তির কাজের জায়গাটাতে ব্যাকগ্রাউন্ড ভালো থাকে এবং যিনি তার অভ্যাসের ক্ষেত্রে প্রথাবিরোধী, সেই ব্যক্তির নতুন আইডিয়া পাওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। (কিন্তু একজন ক্র্যাকপট —খামখেয়ালী/উদ্ভট ব্যক্তি—হওয়াটাই অবশ্য যথেষ্ট নয়।)

একবার আপনি আপনার চাহিদা মতো লোকেদের পেয়ে গেলে পরবর্তী প্রশ্নটি হলো: আপনি কি তাদের একত্র করতে চান, যাতে তারা পারস্পরিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে পারে, নাকি আপনার প্রতিটি সমস্যাকে আলাদা করে তাদেরকে জানানো উচিৎ এবং তাদের বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করতে বলা উচিৎ?

আমার অনুভূতি হলো, যতদূর মনে হয় সৃজনশীলতার ক্ষেত্রে, বিচ্ছিন্নতাই প্রয়োজন। সৃজনশীল ব্যক্তি, যে কোনো ক্ষেত্রে, ক্রমাগত সৃজনশীলতা নিয়েই কাজ করে। তার মন সর্বদা তার তথ্য শাফল করতে থাকছে, এমনকি যখন সে এটি সম্পর্কে সচেতন নয়, তখনো। (জার্মান বিজ্ঞানী অগাস্ট কেকুলে যে ঘুমের মধ্যে বেনজিনের গঠন বুঝতে পেরেছিলেন, সেই বিখ্যাত উদাহরণটি এক্ষেত্রে সুপরিচিত।)

অন্যের উপস্থিতি কেবল এই প্রক্রিয়াকে বাধা দিতে পারে, যেহেতু সৃষ্টি লজ্জাকরও বটে। আপনার কাছে থাকা প্রতিটি নতুন ভালো আইডিয়ার জন্যে শত শত হাজার হাজার বোকা আইডিয়া থাকে, যেগুলি আপনি স্বাভাবিকভাবেই প্রদর্শন করতে চান না। সব কিছুর পরও, সৃষ্টির কাজ ছাড়া অন্য কোনো কারণে এই ধরনের লোকদের সাথে মিলিত হওয়া কাম্য হতে পারে।

কোনো দুই ব্যক্তিই একে অপরের মেন্টাল স্টোরের আইটেমের নকল করে না। একজন ব্যক্তি হয়তো A জানে কিন্তু B জানে না, আরেকজন B জানে কিন্তু A জানে না এবং A ও B জেনে তারা উভয়েই আইডিয়া পেতে পারে—যদিও তা একই সময়ে বা কাছাকাছি সময়ই হবে, এমন নয়।

তাছাড়া, তথ্যগুলি শুধুমাত্র যে পৃথক আইটেম A এবং B, এমন নয়। এমনকি A-B এর সংমিশ্রণও হতে পারে, যা বস্তুত ওইভাবে সিগনিফিকেন্ট বা বিশেষ কিছু নয়। যাইহোক, যদি একজন ব্যক্তি A-B এর অস্বাভাবিক সংমিশ্রণ এবং অন্যজন A-C এর অস্বাভাবিক সংমিশ্রণটি উল্লেখ করেন, এক্ষেত্রে A-B-C এর সমন্বয়, যা কেউই আলাদাভাবে চিন্তা করেনি, তা খুব ভালো কিছু হতে পারে। এটি একটি দুর্দান্ত সমাধান দিতে পারে।

সেক্ষেত্রে আমার মনে হয় যে, সেরিব্রেশন (Cerebration; মাথা খাটানো) সেশনের উদ্দেশ্য নতুন আইডিয়া নিয়ে চিন্তা করা নয়। বরং অংশগ্রহণকারীদেরকে ফ্যাক্ট ও ফ্যাক্ট-কম্বিনেশন, তত্ত্ব এবং এলোমেলো চিন্তায় শিক্ষিত করা।

কিন্তু সৃজনশীল মানুষকে তা করতে রাজি করাবেন কীভাবে? প্রথমত এবং সর্বাগ্রে, সেখানে স্বাচ্ছন্দ্য, আরাম এবং কোনো কিছু নিজের ক্ষমতায় করার একটি জেনারেল সেন্স থাকতে হবে। বিশ্ব এমনিতেই সৃজনশীলতাকে অগ্রাহ্য করে এবং জনসমক্ষে সৃজনশীল হওয়া বিশেষভাবে খারাপ। এমনকি জনসমক্ষে চিন্তাভাবনা করাই বরং উদ্বেগজনক। তাই ব্যক্তিদের অবশ্যই এই ফিলিংস থাকতে হবে যে, অন্যদের এতে কোনো আপত্তি নেই।

উপস্থিত একজন ব্যক্তির মূর্খতার প্রতি কেউ একজন যদি সহানুভূতিশীল না হয়—যা এই জাতীয় অধিবেশনে ঘটতে বাধ্য—তবে অন্যরা নিথর হয়ে যাবে। সহানুভূতিহীন ব্যক্তিটি তথ্যের সোনার খনি হতে পারে, কিন্তু সে যে ক্ষতিটা করবে, তা তার ক্ষতিপূরণের চেয়ে বেশি হবে। সেক্ষেত্রে আমার কাছে এটা প্রয়োজনীয় বলে মনে হয় যে, একটি অধিবেশনে সমস্ত লোকেরা বোকা কথা শুনতে এবং অন্যদের শোনাতে যেন ইচ্ছুক থাকে।

যদি উপস্থিত একজন একক ব্যক্তির অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি খ্যাতি থাকে, বা সে আরো স্পষ্টবাদী হয়, বা তার যদি স্পষ্টভাবে আরও কমান্ডিং ব্যক্তিত্ব থাকে, তবে তিনি ভালোভাবে সম্মেলনটি অধিকার করতে পারেন এবং বাকিদেরকে প্যাসিভ আনুগত্যের চেয়ে কিছুটা নিচু করে দিতে পারেন। হয়তো ব্যক্তিটি নিজে অত্যন্ত উপযোগী হতে পারে, সেক্ষেত্রে তাহলে তাকে একা কাজ করতে দেয়া যেতে পারে। কেননা সে বাকিদেরকে নিউট্রালাইজ করছে।

একটি দল গঠনের জন্যে সর্বোত্তম অনুকূল সংখ্যা সম্ভবত খুব বেশি হবে না। আমার অনুমান যে, একটি দলের সদস্য সংখ্যা পাঁচটির বেশি হবে না। একটি বৃহত্তর দলের কাছে তথ্যের বৃহত্তর সরবরাহ থাকতে পারে। তবে এতে নিজের কথা বলার জন্যে অপেক্ষা করার দুশ্চিন্তা থাকবে, যা খুব হতাশাজনক হতে পারে। অধিবেশনে সবাইকে যুক্ত করে একটি সেশনে করার পরিবর্তে, বরং অনেকগুলি সেশন থাকা সম্ভবত ভালো হবে, যেখানে অংশগ্রহণকারী লোকেদের সংখ্যা একেকসময় একেক রকম থাকবে৷ (এতে পুনরাবৃত্তি ঘটে, তবে পুনরাবৃত্তি অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু নয়। অধিবেশনে লোকেরা যা বলে, সেটি ব্যাপার নয়। বরং পরে তারা একে অপরকে কীভাবে অনুপ্রাণিত করছে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ।)

সেরা উদ্দেশ্যের জন্যে সেখানে এক প্রকার ঘরোয়া অনুভূতি থাকা উচিৎ। উচ্ছ্বাস থাকা, ডাকনামের ব্যবহার, জোক করা, শান্তিপূর্ণ মজা করা, ইত্যাদিকে আমি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গুণাবলি হিসেবে মনে করি। এগুলির নিজস্ব গুণের কারণে নয়, বরং এগুলি সৃজনশীলতার বাতুলতার সাথে জড়িত হওয়ার ইচ্ছাকে উৎসাহিত করে, সেই কারণে। তো এসব কারণেই আমি মনে করি কারো বাড়িতে বা কোনো রেস্তোরাঁয় ডিনার টেবিলে একটি বৈঠক সম্ভবত একটি কনফারেন্স রুমের চেয়ে বেশি কার্যকর।

সম্ভবত অন্য যেকোনো কিছুর চেয়ে বেশি বাধা দেয় দায়িত্ববোধ। যুগের মহান আইডিয়াগুলি এমন লোকদের কাছ থেকে এসেছে, যাদের কখনো কোনো গ্রেট আইডিয়ার জন্যে অর্থ প্রদান করা হয়নি। তবে শিক্ষক বা পেটেন্ট ক্লার্ক বা তুচ্ছ কর্মকর্তা হওয়ার জন্যে অর্থ প্রদান করা হয়েছিল, বা একেবারেই অর্থ প্রদান করা হয়নি। গ্রেট আইডিয়াগুলি সব সাইড ইস্যু হিসাবে এসেছে।

আরো পড়ুন: উদ্ভাবনী আইডিয়া তৈরি হয় কীভাবে 

আগামী সময়ে কোনো দুর্দান্ত আইডিয়া আসবে না, এমনটা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আমার কাছে সবচেয়ে ভালো উপায় মনে হয় এমন একটা পরিস্থিতি, যেখানে একজনের কাছে কোনো গ্রেট আইডিয়া না থাকায় তার নিজের স্যালারিটা অর্জিত হয়নি ভেবে সে অপরাধবোধে ভুগছে।

এছাড়াও আপনার কোম্পানি সরকারি টাকায় এই সেরিব্রেশন অনুষ্ঠান পরিচালনা করছে। বিজ্ঞানীদের বোকা বোকা কাজের গল্প, অযথা সময় ও টাকা নষ্টের ফিরিস্তি, নোংরা রসিকতা বলা, সম্ভবত, সরকারী টাকায়, এ সম্পর্কে কংগ্রেসম্যান বা সাধারণ পাবলিক হিয়ারিং-এর কথা ভাবলে দুশ্চিন্তায় শরীর ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। প্রকৃতপক্ষে, গড়পড়তা কোনো বিজ্ঞানীর যথেষ্ট বিবেক আছে যে, তিনি কিছুতেই অনুভব করতে চান না তিনি এ ধরনের কিছু করছেন, এমনকি কেউ খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা না থাকলেও।

আমি পরামর্শ দেব যে, একটি সেরিব্রেশন সেশনে সদস্যদের করার জন্যে কিছু সাধারণ কাজ দেয়া হবে। যেমন সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদন লিখতে দেয়া বা তাদের উপসংহারের একটি সারসংক্ষেপ তৈরি করা। বা প্রস্তাবিত সমস্যার সংক্ষিপ্ত উত্তর দিতে বলা হবে এবং এর জন্যে তাদের অর্থ প্রদান করা হবে। এর ফি হবে সাধারণত সেরিব্রেশন সেশনের জন্যে যতটা প্রদান করা হয়, সেরকমই। সেরিব্রেশন সেশনটি তখন আনুষ্ঠানিকভাবে আর অর্থ প্রদান ভিত্তিক থাকবে না এবং এর ফলে যথেষ্ট রিল্যাক্সেশনও পাওয়া যাবে।

সেরিব্রেশন সেশনগুলিতে কোন গাইড করা না হোক, এমনটাও আমি মনে করি না। দায়িত্বে এমন কাউকে থাকতে হবে, যিনি একজন মনোবিশ্লেষকের সমতুল্য ভূমিকা পালন করবেন। একজন মনোবিশ্লেষক, যেমনটা আমি বুঝতে পারি, সঠিক প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে (এবং যতটা সম্ভব ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপ ব্যতীত), যার উত্তরে রোগী নিজেই তার অতীত জীবন সম্পর্কে এমনভাবে আলোচনা করতে পারে, যাতে তার নিজের চোখে এ সম্বন্ধে নতুন উপলব্ধি ধরা পড়ে।

একইভাবে, একজন সেশন নিয়ন্ত্রককেও সেখানে থাকতে হবে, প্রাণীদের জাগ্রত করতে হবে, বুদ্ধিদীপ্ত প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে হবে, প্রয়োজনীয় মন্তব্য করতে হবে, তাদের আলতো করে পয়েন্টে ফিরিয়ে আনতে হবে। যেহেতু সেশন-নিয়ন্তা নিজেই আগে থেকে জানেন না যে, কোন প্রশ্নটি বুদ্ধিদীপ্ত, কোন মন্তব্যটি প্রয়োজনীয় এবং বিষয়টা আসলে কী, তাই তার কাজটি সহজ হবে না।

আরো পড়ুন: নতুন আইডিয়া কীভাবে তৈরি করবেন: পদ্ধতি ও কৌশল

সৃজনশীলতা প্রকাশ করার জন্যে যেসব “গ্যাজেটস” বা কাঠামো ডিজাইন করা হচ্ছে, সেগুলি সমন্ধে আমি মনে করি, এগুলি বুল সেশন (অনানুষ্ঠানিক ঘরোয়া আলাপ আলোচনা) থেকে আসা উচিৎ। যদি সম্পূর্ণভাবে আরামদায়ক পরিবেশে, দায়িত্বের ঝামেলা মুক্ত, আগ্রহের বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয় এবং যদি এর প্রকৃতি হয় ভিন্নধর্মী, তবে অংশগ্রহণকারীরা নিজেরাই আলোচনাকে উদ্দীপিত করার ডিভাইস বা উপায় তৈরি করবে।

(এমআইটি টেকনোলজি রিভিউর অক্টোবর ২০, ২০১৪ তারিখে প্রকাশিত রচনা)
অনুবাদ: জুবায়েদ দ্বীপ