অমনোযোগ কি কখনো ভালো কিছু হতে পারে? আপনি কোনটাকে বেশি প্রাধান্য দেবেন, সবসময় মনোযোগ দিয়ে প্রতিটি কাজ করা, নাকি মাঝে মাঝে অমনোযোগী হওয়াও?

“Be Present” বা “বর্তমানে থাকুন”—মনোযোগপূর্ণ মেডিটেশনের একটা মন্ত্র হয়ে গেছে এই কথাটা। একইসাথে আত্মসচেতন হওয়া আর নিজের কাছে নিজের গ্রহণযোগ্যতা তৈরির জন্যেও এমন পরামর্শ দেয়া হয়। এ ধরনের মনোযোগ চর্চার মূল লক্ষ্য থাকে দৈনিক কাজগুলি সর্বোচ্চ সচেতনার সাথে শেষ করতে পারা। যেমন: আমেরিকার অলাভজনক সংস্থা ‘মায়ো ক্লিনিক’-এর একটা নিবন্ধে পরামর্শ দেয়া হয়েছিল, “আশেপাশের পরিবেশকে ছুঁয়ে, দেখে, শুনে, গন্ধ বা স্বাদ নিয়ে, মোটকথা সবগুলি ইন্দ্রিয় দিয়েই অনুভব করার চেষ্টা করুন। যেমন, যখন পছন্দের খাবার খাচ্ছেন, সময় নিয়ে ঘ্রাণ নিন, স্বাদ নিন, সত্যিকার অর্থেই উপভোগ করুন।”

গবেষণা
মনোযোগ চর্চার মানসিক উপকার হয়তো আসলেই থাকতে পারে। ২০২১ এর শুরুর দিকে একটি গবেষণা হয়েছিল। ‘র‍্যান্ডমাইজড্‌ কন্ট্রোলড ট্রায়াল’ পদ্ধতিতে করা সেই গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, মানসিক চাপ, উদ্বেগ আর বিষণ্ণতার মতো কিছু সমস্যা সমাধানে মনোযোগ চর্চা করা হলে তাতে হালকা থেকে মধ্যম পর্যায়ের উপকারিতা পাওয়া যায়। কিন্তু অন্যান্য চিকিৎসা পদ্ধতির তুলনায় যুক্তিশীলতা চর্চার উপকারিতা ও ধারাবাহিকতা বা কনসিস্টেন্সি ছিল কম। এমনকি মনোযোগ চর্চার প্রভাবও কয়েক মাসের মধ্যেই আস্তে আস্তে কমে যায়।


আলেকজান্ডার পি. বার্গোইন ও ডেভিড জেড. হ্যামব্রিক
সায়েন্টিফিক আমেরিকান, আগস্ট ৩১, ২০২১


সবকিছু মিলিয়ে, গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী একদম কোনো কিছু না করার চেয়ে মনোযোগ চর্চা হয়তো উপকারী হতে পারে। কিন্তু, অন্যান্য চিকিৎসা পদ্ধতির সাথে মনোযোগ চর্চা তুলনা করার জন্য আরো বেশি গবেষণা প্রয়োজন।

অমনোযোগ কি দরকারি?
মনোযোগ বা মননশীলতা তৈরির জন্য যেসব চর্চা রয়েছে, তার মধ্যে একটা সাধারণ মিল হলো প্রত্যেকটাতেই একাধিক ধ্যান বা মেডিটেশন সেশনের সাহায্যে বর্তমান মুহূর্তে মনোযোগ স্থির করার চেষ্টা চালানো হয়।

যদিও মনোযোগের উপকার আছে, কিন্তু মনস্তাত্ত্বিক গবেষণায় দেখা যায় কিছু পরিস্থিতিতে অমনোযোগ দেওয়া বা অমনোযোগী হওয়াই জরুরি। জটিল কাজগুলিতে দক্ষ হয়ে উঠতে থাকলে গভীর মনোযোগ ছাড়াই একসময় সেগুলি ঠিকঠাক করা যেতে পারে। দৈনন্দিন কাজের মধ্যে জটিল কাজের উদাহরণ হতে পারে সাইকেলে চড়া, শশা কাটা, দাঁত মাজা ইত্যাদি।

অমনোযোগ
অমনোযোগী ফ্রিল্যান্সার কাজের মাঝখানে ফ্রিজ খুলে দেখছেন কী কী আছে

কগনিটিভ সাইকোলজিস্টরা এধরনের দক্ষতাকে ‘স্বয়ংক্রিয়তা’ বলেন, যা মূলত কতগুলি মানসিক প্রক্রিয়ার ফলাফল। এর ফলে মনোযোগ দেয়া ছাড়াই অনেক কাজ স্বতঃস্ফূর্তভাবে করে ফেলা যায়। মানসিক এই প্রক্রিয়াগুলি সচেতনতা ছাড়াই চেইন রিয়্যাকশনের মত চলতে থাকে। সব কাজ আমরা এমন স্বয়ংক্রিয়ভাবে করি না, কিন্তু অনেক কাজই একবার ঠিকঠাক অভ্যাস হয়ে গেলে এভাবে করা সম্ভব।

আরো পড়ুন: অ্যাকশন প্রোগ্রাম: গুছিয়ে কাজ করার অসাধারণ উপায়

সোজা কথায়, নতুন কিছু শেখার সময় মনোযোগ দেয়া জরুরি। এক গবেষণায় দেখা গেছে, নবীন পিয়ানোবাদকরা কতখানি মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করতে পারে। সেই সক্ষমতা অনুসারে তাদের ‘হ্যাপি বার্থডে টু ইউ’ গানটার সুর তুলতে পারা ও বাজানোর সামর্থ্যের পূর্বাভাস দেয়া যায়।

পুনরাবৃত্তির ক্ষেত্রে অমনোযোগ
কিন্তু ‘এক্সপার্টিজ রিসার্চ’ শিরোনামের একধরনের গবেষণায় এটাও দেখা গেছে, আপনি যা করছেন, তার প্রতি খুব বেশি মনোযোগ দিলেও ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে পারে। বিশেষ করে ইতোমধ্যে ভালোভাবে অভ্যাস ও দক্ষতা রয়েছে, এমন কোনো কাজের ক্ষেত্রে। প্রকৃতপক্ষে, একারণেই বিভিন্ন কাজের ওপর বিশেষজ্ঞ মানুষেরা চাপের মধ্যে পড়লে ভালো করতে পারেন না। কারণ, তখন তারা হাতে থাকা কাজটার ভেতরের ক্রিয়াকৌশল সম্পর্কে খুব বেশি চিন্তা করতে থাকেন।

একটি সুপরিচিত গবেষণায়, কগনিটিভ বিজ্ঞানী সিয়ান বেইলক এবং তার সহকর্মীরা দক্ষ একদল গলফারকে বিভিন্ন পরীক্ষামূলক অবস্থার অধীনে গর্তে বল পাঠানোর কাজ দেন। পরীক্ষার সময় একবার গলফারদের কেবল তাদের ক্লাবের (গলফ বলে যা দিয়ে আঘাত করা হয়) সুইংয়ের দিকে মনোযোগ দিতে এবং সুইং শেষে ‘স্টপ’ বলার নির্দেশ দেয়া হয়। আরেকবার নির্দেশ দেয়া হয় তারা আশেপাশের অন্যান্য শব্দ উপেক্ষা করে একটা নির্দিষ্ট শব্দ শোনার চেষ্টায় থাকবেন এবং নির্দিষ্ট সেই শব্দ শুনলেই তারা ‘টোন’ কথাটা বলবেন।

আরো পড়ুন: চেষ্টা করা এবং করে ফেলার মধ্যে পার্থক্য

গবেষকদের অনুমানকে ভুল প্রমাণিত করে, আলাদাভাবে শব্দ শোনার চেষ্টার তুলনায় বরং সুইংয়ের দিকে আলাদা মনোযোগ দিয়ে খেলার সময়ই গলফারদের পারফর্মেন্স ছিল অতিমাত্রায় জঘন্য। সুইংয়ের দিকে মনোযোগ দেয়ার ফলাফল এতটাই খারাপ ছিল যে, গবেষণায় অংশ নেয়ার আগে গলফারদের ওয়ার্ম আপের পারফর্মেন্সও তার চেয়ে ভালো ছিল।

অতি সম্প্রতি মনোবিজ্ঞানী ইয়ানিক বাল্ক ও তার সহকর্মীরা গলফারদের খেলায় পারফর্মেন্স প্রেশারের (ভালো খেলতে হবে, এমন চাপ) প্রভাব কমানোর উদ্দেশ্যে, তাদের ওপর বিভিন্ন ধরনের পদ্ধতির পরীক্ষা চালান। গবেষকরা একবার অংশগ্রহণকারী গলফারদের ভিডিও রেকর্ড করে তাদের ওপর ভালো পারফর্মেন্সের জন্য চাপ সৃষ্টি করেন। গলফারদের বলা হয়, তাদের সবার স্কোরশিট ক্লাবহাউসে প্রকাশ্যে পোস্ট করা হবে এবং ভালো পারফর্মেন্স যারা করবে, তাদেরকে গলফ শপের কুপন দিয়ে উৎসাহিত করা হবে।

বিশেষ কোনো হস্তক্ষেপ ছাড়া চাপের মুখে গলফাররা উল্লেখযোগ্যভাবে খারাপ করতে থাকেন। এরপরও যেসব গলফার অন্যকিছু ভাবতে পেরেছিলেন—বিশেষত মনে গেঁথে থাকা প্রিয় কোনো গান—তারা অনেক চাপের মধ্যেও ভালো খেলেছিলেন।

মনোযোগ না অমনোযোগ?
মনে রাখা দরকার, এই ফলাফল থেকে সিদ্ধান্তে আসার জন্য আরো বড় আকারে ও বিভিন্ন পরিস্থিতিতে একই পরীক্ষা হওয়া দরকার।

এই গবেষণা থেকে পাওয়া গুরুত্বপূর্ণ বার্তাটা হলো, আগে থেকে ভালোভাবে অভ্যাস করা কাজগুলি করার সময় অতিরিক্ত মনোযোগ দিলেই বরং ভুলের আশঙ্কা বাড়ে। কিন্তু অবশ্যই সবকিছু ছেড়ে দিয়ে অটোপাইলটের মতো জীবন কাটানোর ভাবনাও অমূলক। নিজের সঙ্গে, অন্যদের সঙ্গে আর চারপাশের পরিবেশের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করার দরকার আছে। কিন্তু কিছু কিছু সময় জীবন যেভাবে যাচ্ছে, সেভাবেই যেতে দেয়া ভালো। পরেরবার মোটর সাইকেল চালাতে গেলে সেটা নিয়ে অতিরিক্ত কিছু না ভাবাই ভালো হবে।

অনুবাদ: সাব্বির পারভেজ সোহান