ইয়েলোর উপরে চা-ওয়ালা নামে একটা চা খাওয়ার জায়গা ছিল। চায়ের সাথে অন্যান্য খাবারও পাওয়া যেত।
ওইখানে সাধারণ দুধ চায়ের দাম ছিল ৩০ টাকা। সর্বনিম্ন দাম ওইটারই। এরপরে বিভিন্ন মশলাদার চায়ের দাম ৮০, ১২০, ১৫০, ১৮০ টাকা ও দাম আরো বাড়তেছে।
সেদিন ক্লাস শেষে আমি ক্যাম্পাস থেকে বের হয়ে আমার বয়ফ্রেন্ডকে ফোন দিলাম। ওর মন খারাপ ছিল। অনিচ্ছাসত্ত্বেও যে দিনগুলিতে আমার ফোন ধরত, ওইদিনটাও ছিল ওইরকম একটা দিন।
এর আগে কথা হইছিল আমাদের। মারুফ বলছে আজকে সে দেখা করবে না। আমি তবু বললাম দেখা করতে।
”আমি ইয়েলোর কাছে আছি, আসো আসো প্লিজ। বোর হইতেছি, বা আমিই তোমার বাসায় আসি? প্লিজ?”— এভাবে অনুরোধ করতেছি ওকে।
বলতে বলতে বুঝলাম আর কাজ হবে না। তখন ফোন রাইখা ভাবলাম কোথায় যাওয়া যায়। তখন দুপুর ১টা বাজে। আমার ৪টা পর্যন্ত কোথাও বসে থাকতে হবে। ৪টায় ক্রাভমাগার ক্লাসে যাব। ইয়েলোর সামনে দাঁড়িয়ে ঠিক করলাম যেই রেস্টুরেন্টগুলাতে গেছি ওগুলাতে আজকে যাব না। ওইখানের ক্রিমসন কাপ, নর্থ এন্ড, ইয়াম চা, আলা গ্রিক, নার্ডি বীনস, পিৎজা রমা, ইয়েলো ক্যাফে সবগুলিতে আমি গেছি।
তখন মনে হইল চাওয়ালাতে যাই। একবার আমি আর তানিম স্টার কাবাবে খেতে গেছিলাম। দুইতলায় সিট পাইছিলাম আমরা। ওইখান থেকে চাওয়ালা দেখা যাইতেছিল। ওকে জিজ্ঞাসা করলাম, “ওইটা কেমন? ওইখানে গেছ?”
তানিম বলল, “না, অনেক এক্সপেন্সিভ। কখনো অনেক টাকা হইলে যাব।”
আমি বললাম, “এত দাম? চা-ই তো বেচে?”
“হ্যাঁ, কিন্তু চায়েরও অনেক দাম। ১০০০ টাকা দিয়ে চা খাইলে পোষাবে বলো?”
এটা শুনে আর যাওয়া হয় নাই আমার।
তখন মনে হইল চাওয়ালাতে যাই, ওইখানে আগে যাইও নাই। ভাবার সাথে সাথেই ইয়েলোর ভিতরে গেলাম। অনেকক্ষণ রোদের তাপে দাঁড়ায়েছিলাম বাইরে। ভিতরে ঢুকতেই একটা লোক বলল ইয়েলোর পাশে আরেকটা দরজা আছে, ওইখান দিয়ে যেতে। এখান থেকে চাওয়ালায় যাওয়া যাবে না।
লিফটে ওঠার সময় দেখি একটা ছেলে উঠবে উঠবে করেও উঠল না। আমার একা যাইতে ভয় করল। ভয়ে বলেই ফেললাম, “কেউ তো নাই লিফটে।”
দারোয়ান দু’জন হাসতে হাসতে বললেন, “কিছু হবে না, আপনি যান।”
“না, ঠিক আছে। কেউ যখন যাবে তখন যাব আমি, সমস্যা নাই।”
উনারা মায়া করলেন আমাকে। ওই লোকটা খুব হাসলেন আমার কথায়।
একটা ছেলে পাশেই দাঁড়ায়ে ছিল, ওদেরই কোনো কাজ করে হবে হয়তো। ওই ছেলেটাকে বললেন, আমাকে উপরে দিয়ে আসতে। উনি তখন আমার সঙ্গে গেলেন।
উপরে এসে থ্যাংকস দিলাম ছেলেটাকে। তারপর একজায়গায় বসলাম। ব্যাগে পাঁচশ টাকার নোট ছিল একটা আর কিছু একশ টাকার নোট। আমি কখনো ভাঙতি গুনতাম না। এইজন্য আসার আগে মনে হইছিল অল্প টাকা আছে। পরে গুনে দেখি, নয়শ টাকার বেশি আছে।
কমদামি আইটেম খুঁজে বের করে একটা গ্রিল চিকেন আর একটা গার্লিক নান অর্ডার করলাম। করে সিলভিয়া প্লাথের ‘দি বেল জার’ বইটা বের করলাম। এমন না যে আমি রেস্টুরেন্টে খাবার আসার জন্য অপেক্ষা করতে করতে সবসময় বই পড়ি। বরং পড়িই না। সবসময় বই সঙ্গে থাকে। তবুও পড়ি না। সেদিন জোর করে নিজেকে পড়াইলাম। পড়লাম ঠিকই কিন্তু কিছু বুঝলাম না। প্রথমত ছাদে যেহেতু, পরিবেশটা গরম ছিল, দ্বিতীয়ত অনুবাদটা ভালো না।
তবে পরে যখন আমি ‘বেল জার’ পড়ছি আমার মনে হইছে সিলভিয়া প্লাথের গদ্যই আসলে ওইরকম ছিল। খুব অগোছালো লেখা উনার।
খাবার আসলে খাবারের ছবি তুললাম কয়েকটা। তারপর খাইতে শুরু করলাম। চিকেন গ্রিলটা দেখতে খুব সুন্দর ছিল, কিন্তু শক্ত।
খাওয়া শেষ করে মারুফকে কল দিলাম আবার। এরপর কিছুক্ষণ বসে থাকলাম। বিল দিয়ে দিলাম। দিয়ে মনে হইল, বিল না দিলেই ভাল হইত। এখন তো চলে যেতে বলবে।
কিন্তু যাই হোক, যেতে বলে নাই। আমি ছাদে হাঁটাহাঁটি করলাম। উপরে আরেকটা ছাদ লক্ষ্য করলাম। ওইখানে উঠতে চাচ্ছিলাম, তখন রেস্টুরেন্টের একটা লোক বললেন, এখনও উপরের ফ্লোর ওপেন হয় নাই।
“ও, যাওয়া যাবে না?”
“উপরে কোনো অর্ডার হবে না ম্যাম। বিকালে অর্ডার হবে।”
আমি ভাবলাম শুধু বসার জন্য উপরে যাওয়া যায়। উনাকে বললাম, আমি শুধু বসব।
উনি রাজি হইলেন। বললেন, আচ্ছা ম্যাম।
তারপর উপরে গেলাম। গিয়ে বসলাম। বসেই ভাবলাম নিচ থেকে বইটা নিয়ে আসি। আবার নিচে গিয়ে আমার বই আর ব্যাগটা নিয়ে আসলাম।
উপরে বসে পড়তে শুরু করলাম। রোদের জন্য আর পড়তে পারলাম না। কিছুক্ষণ পরে টিনেজ (আন্দাজে) ছেলেমেয়েদের ছোট একটা গ্রুপ আসল।
ওইখানে মেয়ে একটাই ছিল। ছেলে ছিল চার জন।
কিছুক্ষণ ওদেরকে লক্ষ্য করার পর মনে হইল, এই অসভ্য ছেলেগুলির পাল্লায় পড়ে মেয়েটাও নষ্ট হয়ে যায় নাকি! কিন্তু মনে হইল না। প্রত্যেকেই যথেষ্ট আজাইরা। মেয়েটা দেখতে অত ভালো না। উপরের টপটা নাভির উপরে শেষ হইছে। ওর জিন্স আর টপ কোনোটাই বেশি ভালো লাগল না। আর মেয়েটা অনেক লাউড। প্রত্যেকটা ছেলেমেয়েই লাউড। আমার বই পড়ার বারোটা বাজল।
ওদের মধ্যে একটা ছেলে ছিল সবচেয়ে সিনিয়র, যাকে সবাই ভাইয়া ভাইয়া করতেছিল। ও কম কথা বললেও আমি বুঝতে পারলাম তলে তলে খেলাটা আসলে সে-ই খেলতেছিল। আমার মনে হইল ওই ছেলেটা মেয়েটাকে করতে চায়।
ওরা খালি কোল্ড ড্রিংকস অর্ডার করল। তাও মনে হয় দুই গ্লাস নিছিল। কিন্তু আমার এক্সাক্টলি মনে নাই। আরো বেশিও হতে পারে। আমি বই পড়তেছিলাম, আশেপাশে দেখতেছিলাম, তাই ওদের দিকে অনেকক্ষণ লক্ষ্য করি নাই।
ওইখানে একটা ছেলে, যে দেখতে কমপারেটিভলি ভাল। ওর ছিপছিপে শরীরের জন্য আমার ওকে ভাল লাগল। সে আমার টেবিলের কাছে এসে বলল, “হেই, হাউ আর ইউ? হোয়াটচা’ডুয়িন?”
আমার সামনে আচমকা কেউ ইংরেজি বলতে শুরু করলে আমি বাংলাতেই কথা বলি। এবং উত্তর দেই খুব সংক্ষেপে। “হ্যাঁ”, “না” এভাবে।
আমাকে হোয়াটচা’ডুয়িন বলার পর আমি বইটা বন্ধ করে কভার পেইজটা দেখাইলাম। কিন্তু ও ওইভাবে বইটাতে মনোযোগ দিতে পারল না। নার্ভাসনেসের জন্য।
আমি চুপ করে ছিলাম।
ও বলল, ”অ্যাম আই বদারিং ইউ?”
“না।”
তারপর “ওকে, নেভার মাইন্ড” বলে আবার ওদের টেবিলে চলে গেল।
কিছুক্ষণ পর ওরা বসা ছাদে হাঁটল আর নাচানাচির মতো করল। তখন ওদের টেবিলে লক্ষ্য করলাম আমি। দেখি বেশ অনেকগুলি প্লাস্টিকের গ্লাস। গ্লাস আর ওদের হঠাৎ অন্যরকম আচরণ দেখে বুঝলাম ওরা মদ খাচ্ছিল।
ওই ছেলেটা আবার আসল আমার কাছে। ওর মুখ থেকে তখন ভদকার গন্ধ আসতেছে। হেলেদুলে আসছিল ও, শরীরে কোনো ব্যালেন্স ছিল না তখন। এসে বলল, “হোয়াট আর ইউ রিডিং?” আমার মনে হইল ও আসলে অর্ধেক ঘুম আর অর্ধেক জাগরণের মধ্যে আছে।
ব্যালেন্স ঠিক রাখতে পারছিল না বলে বসে পড়ল। বলল, “অ্যাক্চুয়ালি আই লাইক ওল্ডার গার্লস।”
আমি বললাম, “আপনার মনে হয় আমি আপনার চেয়ে বড়?”
জানি না নিজেকে কী ভাবতেছিলাম আমি। এখন আমার মনে হয় নিজেকে খুব ম্যাচিউর ভাবছিলাম আমি ওই ছেলেটার সামনে। যা আমি ছিলাম না। আমি বড়দের মতো অ্যাক্ট করতে চাইছি। কিন্তু ছোটদের মতো অ্যাক্ট করলে হয়তো ওই জায়গায় আমার ওই থার্ড ক্লাস প্রেম থেকে আমি যা পাচ্ছিলাম, তার থেকে অনেক বেটার কিছু এক্সপেরিয়েন্স করতে পারতাম।
আমি আসলে ওই ছেলেটা যাকে আমি চিনি না, যে আমাকে চিনে না—তার সামনে আমি আমার ওজন রাখতে চাইছি। আমার ওই মনোভাবটা খারাপ ছিল শেষ পর্যন্ত।
ছেলেটা বলল, “হাউ ওল্ড আর ইউ?”
আমি কিছু না বলাতে আবার বলল, “ক্যান উই টক? “ইউ আর ওল্ডার দ্যান মি, রাইট?”
“আপনার কী মনে হয়, আমার বয়স কত?”
আমাকে একটু দেখে ও বলল “টুয়েন্টি ফাইভ/টুয়েন্টি সিক্স?”
“আপনার বয়স কত?”
“টুয়েন্টি টু।”
“আই অ্যাম টুয়েন্টি” আমি বললাম।
ছেলেটাকে মনে হইল আমার কথা বিশ্বাস করে নাই। হয়তো ভাবছে মেয়ে বলে আমি বয়স কমায়ে বলছি।
“ক্যান আই হ্যাভ ইয়োর নাম্বার?”
“নো”
আমি খুব লাজুক ভাবে না করলাম। আমি যে অপ্রস্তুত বোধ করছি সেটা ওকে বুঝতে দিলাম।
“প্লিজ?”
“না।”
“হোয়াই?”
“এমনিই।”
“ওকে, ক্যান উই টক? অ্যাম আই বদারিং ইউ?”
“নো।”
মদ খাওয়ার পর অনেকবার বলল সে, “অ্যাম আই বদারিং ইউ?”
আমি বললাম যে সে বদার করতেছে না।
তখন যেন কিছু বুঝতে পারছে, বা ডিসিশন নিয়ে ফেলছে এমন ভাবে বলল, “নো, ইউ আর ফিলিং ডিস্টার্বড, আই শুড গো।”
“ওকে, বাট আমি ডিস্টার্বড হচ্ছি না।”
বলে ও চলে গেল।
গেল আর সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে হইল, কেন দিলাম না নাম্বারটা? খারাপ লাগতেছিল তখন। আর একবার না করছি মানে আর দেয়াও সম্ভব না। আমি মেয়ে না?
এই প্রথম বিদেশের মতো করে কোনো রেস্তোরায় একটা অপরিচিত সুন্দর দেখতে ছেলে আমাকে আস্ক আউট করল, আর আমি না বলে দিলাম!
কিছুক্ষণ পরে ওরা সবাই মিলে গ্রুপ ছবি তুলল। মেয়েটা মাঝে আর দুইপাশে দুইটা ছেলে—ওরা তিনজন রেলিংয়ে বসে ছবি তুলল।
ছবি তুলে জিনিসগুলি গুছায়ে ওরা চলে যাচ্ছিল। আমি আড় চোখে তাকায়েছিলাম। ছেলেটা আসে কিনা দেখতে। তখন আবার আসল ও।
এসে বলল, “ইউ আর নট গিভিং মি ইয়োর নাম্বার?”
“না,” হাসিমুখে বললাম। কিন্তু আমার দিতে ইচ্ছা করছিল তখন।
আরো পড়ুন, শৈলী নাসরিনের ব্লগ: অনামিকা ম্যামের একটা মেয়ে বাবু হইছে
তারপর সে বলল, “ওকে, বাই দেন।” বলে চলে গেল। খুব সুন্দর ছেলেটা, নরম। এই মেনে নেওয়া, একই সঙ্গে চোখে মুখে হালকা হার্টব্রেকের ছাপ নিয়ে আমাকে বাই বলল সে।
শেষ না’টা আমি খালি বলছি আগের ‘না’-এর সম্মান রাখতে। হুদাই।
ছেলেটা সিঁড়ি দিয়ে নেমে চলে গেল। আমার দিকে আর ফিরে তাকায় নাই। এখন চাইলেও আর নাম্বার দেওয়া সম্ভব না।
এত সুন্দর ছেলেটাকে কোনো কারণ ছাড়াই হাতছাড়া করলাম, যখন কিনা সে নিজে এসে ধরা দিল।